আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধের এক দুর্যোগময় সময়ে বাংলার ভাগ্যাকাশে আবির্ভূত হন মির্জা শেখ এহতেশামউদ্দীন (১৭৩০-১৮০১) । বাংলায় নবাবি শাসনের অবসান ও ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি শাসনের সূচনা তাঁর চোখের সামনে ঘটে। সেকালের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার তিনি সাক্ষী। কর্ম উপলক্ষে দেশি-বিদেশি, স্বজাতি-বিজাতি শাসকশ্রেণির সাথেই মেলামেশা করেছেন। পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক আবহাওয়ায় জড়িত থেকে তিনি প্রথম বিলেত তথা ইউরোপ ভ্রমণের দুর্লভ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতীয় রাজনীতিতে যেভাবে ইংরেজরা দ্রুততার সঙ্গে প্রভাব-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হচ্ছে, তার মূলে কেবল তাঁদের কূটবুদ্ধিই নেই, তার সঙ্গে আছে বিজ্ঞান কারিগরি ও শিক্ষায় তাদের শ্রেষ্ঠতা। তিনি আরও উপলব্ধি করেছিলেন, পাশ্চাত্য শিক্ষায় কর্তৃত্ব অর্জন করতে না পারলে ভারতীয়দের পরে একালে টিকে থাকা সম্ভব নয়।

শেখ এহতেশামউদ্দীন বাংলার নবজাগরণের অগ্রনায়ক রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) ৬৫ বছর আগে (রামমোহন ইংল্যাণ্ডে গিয়েছিলেন ১৮৩১ থেকে ১৮৩৩ সালের মধ্যে) বিলেত যান। প্রায় তিন বছর ধরে তিনি ইংল্যাণ্ড, ইউরোপের অনেক দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। প্রাণভরে বিদেশি সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, ধর্ম, বিজ্ঞান সবকিছুই বুঝতে ও জানতে চেষ্টা করেছেন। সর্বোপরি সেদেশের মানুষদের সঙ্গে হার্দিক সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলেন এহতেশামউদ্দীন। শুধু বৌদ্ধিক পরিদর্শনেই শেষ হয়ে যায়নি তাঁর ভ্রমণ। ফিরে এসে একটি চমৎকার ভ্রমণ বৃত্তান্তমূলক বই লিখেছিলেন ফারসি ভাষায়। ১৭৮৪-এ রচিত ‘শিগুর্ফনামা-এ-বেলায়েত’ (‘বিলেতের বিস্ময়কর দৃশ্যাবলী’) শীর্ষক এই ভ্রমণকাহিনিতে তাঁর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণমুখী চিন্তার ছাপ আছে। ইউরোপের বিভিন্ন জাতির চরিত্র বিশ্লেষণ, তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির অগ্রগতির ব্যাখ্যায় তিনি গভীর জ্ঞান ও মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি একই সাথে স্বদেশ ও স্বজাতির নানাবিধ গলদ ও অযোগ্যতার কথা তুল্যমূল্যভাবে তুলে ধরেন। এজন্যে তাঁর চিত্তের ব্যাকুলতা ও কণ্ঠের আর্তনাদ কম ফোটেনি। নিজ দেশের প্রতি তাঁর ভালবাসা ও মমত্ববোধের অভাব ছিল। না। এসত্ত্বেও এহতেশামউদ্দীন বাংলার সমাজকে নতুন পথের সন্ধান দিয়ে যেতে পারেননি। তখন প্রাচ্য শিক্ষা নীতি এমন ছিল না। যাতে করে দেশের মানুষকে স্বদেশ চিন্তায় উজ্জীবিত করা যায়। ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর (১৭১২-১৭৬৬) ওই সময় জীবিত ছিলেন। পলাশির যুদ্ধের ৩ বছর পর তিনি মারা যান। ভারতচন্দ্রের খ্যাতি মূলত ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। “ভারত ভারত খ্যাত” আপনার গুণেই। ‘অন্নদামঙ্গল’ সম্পূর্ণ পৌরাণিক ছাঁচের মঙ্গল কাব্য হলেও এতে অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার সমাজচিত্র ও মানব জীবনের ছবি চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। তৎকালীন যুগের ঐতিহাসিক পটভূমিকাটি এই কাব্যে সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ভারতচন্দ্র একটা শিল্পচেতনা নিয়ে অন্নদামঙ্গল রচনা করেছিলেন, যা পূর্ববর্তী কবিদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। কাব্যের প্রয়োজনে বাংলা মঙ্গলকাব্যের পয়ার ও ত্রিপদী-র মধ্যে বৈচিত্র্য এনেছেন তিনি। তাঁর কাব্যে এসেছে অলংকার প্রয়োগের বৈচিত্র্য এমনকি যাবনী মিশাল’, ভাষাতেও বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায়। তিনি প্রথম সজ্ঞান সাহিত্যরসিকের মতন বলতে পেরেছেন “যে হোক সে হৌক ভাষা কাব্যরস লয়ে। অতএব যে সজ্ঞান আর্ট সাধনা আধুনিকতার বিশেষ লক্ষণে প্রাচীন মঙ্গলকাব্যের পরিকাঠামোর মধ্যে ভারতচন্দ্র তার প্রবর্তন করেন, এখানেই তাঁর ঐতিহাসিকতা। ভারতচন্দ্র নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের সভাকবি ছিলেন। নবাব সিরাজদ্দৌলার্ বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করেছিলেন কৃষ্ণ চন্দ্র তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ভারতচন্দ্রও পলাশির যুদ্ধ ও বাংলার ভাগ্য পরিবর্তন সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব ছিলেন। সম্ভবত সামাজিক দায়িত্ববোধ ও রাজনৈতিক চেতনার অভাবের কারণেই এমন হয়েছিল।

সিরাজউদ্দৌলার বিঝদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের অপর একজন ছিলেন মহারাজা নন্দকুমার (১৭০৭-১৭৭৫)। সিরাজউদ্দৌল্লার আমলেই নন্দকুমারের ভাগ্যোদয়। প্রথমে দেওয়ান তারপর ফৌজদার। নন্দকুমারের ওপর হুকুম ছিল চন্দননগর ইংরেজরা আত্র(মণ করলে সীদের সাহায্য করার। কিন্তু উমিচাদের মন্ত্রণায় (এবং উৎকোচে) করলেন উল্টোটা। নিজে তো সরে রইলেন, সাহায্যের জন্য এত দুর্লভরামকে ফিরিয়ে দিলেন। তখন ষড়যন্ত্র বেশ পেকে উঠেছে। ইংরেজ ঐতিহাসিক অর্মে বলেন, ইংরেজপ( উমিচাদের হাত নন্দকুমারকে ১২,০০০ টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন। এই জালিয়াতির সংবাদ নবাবের নিকট পৌঁছবার সাথে সাথে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কুমারকে চাকরীচ্যুত করেন। নন্দকুমার পালিয়ে গিয়ে কোম্পানির আশ্রয় লাভের সাথে সাথে যুদ্ধের উপদেশ মন্ত্রদাতারূপে কাজ শুরু করেন। নন্দকুমারের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনাও ছিল, কিন্তু কিছু করার আগেই পাল্টা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ফাঁসিকাষ্ঠে প্রাণ হারান। মোহাম্মদ রেজা খান, সিতাব রায় উভয়েই কোম্পানির সুবিধাভোগী ব্যক্তি( ছিলেন( তাঁদের দেশপ্রীতি ও স্বাজাত্যবোধ মাত্র ছিল না। মীরজাফর ও তাঁর বংশধর প্রথমে পুতুল সরকার, পরে ক্রমে ক্রমে কোম্পানির অনুগ্রাহী বৃত্তিভোগী সরকারে পরিণত হন। মীরকাসিম রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে সিংহাসন উদ্ধারের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। বীরভূমের মহারাজা আসাদুজ্জামান, মজনু শাহ, মুসা শাহ, ভবানী পাঠক ও আরো কতিপয় ব্যক্তি পৃথক পৃথক বিচ্ছিন্নভাবে বিদ্রোহ করে সফল হতে পারেননি। মজার ব্যাপার, আসাদুজ্জামানের বিদ্রোহ দমনে শেখ এহতেশামউদ্দীন ইংরেজের পক্ষ নিয়েছিলেন। এমনকি, মীরকাসিমের বিরুদ্ধেও একাধিক যুদ্ধে তিনি ইংরেজকে সহযোগিতা করেন। সুতরাং ইংরেজের বিজয় ও স্বজাতির পরাজয় সে সময় তার মতো অন্যদেরও বিচলিত করেনি। অর্থাৎ যুগটাই ছিল চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির দিক দিয়ে দেশিয় এলিট শ্রেণির নিষ্ক্রিয়তা ও আবেগশূন্যতার যুগ। সেকালে রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে যেভাবে নৈরাজ্য দেখা দিয়েছিল, তাকে মোকাবিলা করে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মাথা এহতেশামউদ্দীনের ছিল না।

এক্ষেত্রে রামমোহনের সাফল্য ছিল উল্লেখ করার মতো। কিন্তু মনে রাখতে হবে ব্যবধানটা ছিল ৬৫ বছর। আসলে এহতেশামউদ্দীন যখন বিলেতি জ্ঞান-বিজ্ঞা্নের গুরুত্ব সম্বন্ধে দেশবাসীকে সচেতন করার চেষ্টা করছিলেন, তখন এদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়নি। ফলে তাঁর চেষ্টা উপযুক্ত গ্রাহকের অভাবে ব্যর্থ হয়। তারপর আবির্ভূত হলেন রামমোহন উপযুক্ত সময়ে সংগ্রাম শুরু করে তিনি ভারতবর্ষের আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়া শুরু করলেন। প্রসঙ্গত বিলেত শব্দের অর্থটি সম্বন্ধে একটু স্পষ্ট ধারণা দেওয়া উচিত। বিলেত শব্দের সাধারণ অর্থ হল বিদেশ। যখন ইংরেজ এল ভারতে, তখন এ ধারণাটির কিছুটা পরিবর্তন হয়। তখন ইংল্যাণ্ড বা ইউরোপ গেলেই তাকে বিলেত যাত্রী বলা হত। কিন্তু এই মত ইতিহাসের প্রেক্ষিতে তে আজ আর সঠিক বলে মেনে নেওয়া হয় না।

(২)

নানা সময়ে প্রশ্ন ওঠে প্রথম বিলেত যাত্রী বাঙালি তথা ভারতীয় কে ছিলেন? এতদিনের যে আলোচনা তাতে রাজা রামমোহনের নামই উঠে এসেছে। তার আগে যারা গেছেন তারা ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করতে যাননি। তারা গিয়েছেন লস্কর হয়ে, বিদেশি জাহাজের সঙ্গে, পর্তুগিজ ফরাসিদের কর্মচারী হয়ে। স্বাধীন ভ্রমণকারীর পরিচয় তাদের ছিল না। কিন্তু ইতিহাস বলছে, শির্দি ত ভারতীয়দের মধ্যে রামমোহনের আগে ভ্রমণকারী হিসেবে বিলেত পাড়ি দিয়েছিলেন এহতেশামউদ্দীন, হয়ে উঠেছিলেন ইতিহাসের নায়ক। পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধের পরবর্তীকালে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দৌরাত্মা বৃদ্ধি পেলে মুঘল সম্রাট শাহ আলমের (১৭৫৯-১৮০৬) সঙ্গে কোম্পানির কর্মকর্তাদের আদান-প্রদান সংক্রান্ত বিরোধ দেখা দেয়। এরই ফলস্বরূপ তিনি ইংল্যাণ্ড রাজ তৃতীয় জর্জের কাছে দুই সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পাঠান যার অন্যতম সদস্য ছিলেন মুঘল রাজদূত স্কটিশ ডাক্তার ক্যাপ্টেন সুইন্টন ও তাঁর সহযোগী মির্জা শেখ এহতেশামউদ্দীন।

উল্লেখ করা যায় যে, বাংলায় ব্রিটিশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলা ও বাঙালির মাঝে নব উদ্যমের সূচনা ঘটে, যা বাঙালি সমাজের এলিট অংশের রেনেসাঁ বা নবজাগরণের ইতিহাস। এই পর্বে আমরা দেখতে পাই, রামমোহন উনিশ শতকের প্রথমার্ধে দিল্লির মুঘল বাদশাহর দূত হয়ে ইংল্যান্ডে যান এবং সাধারণের মাঝে একটি ধারণা বদ্ধমুল হয়ে যায় যে, আধুনিককালে রামমোহনই প্রথম ইউরোপ গমন করেন বাঙালি হিসেবে। যদি পলাশি যুদ্ধের বিয়োগান্ত পরিণতি ও ব্রিটিশ শাসনের সূচনাকালকে আধুনিক যুগের শুরু বলে বিবেচনা করা হয় তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, রামমোহনের জন্মের সাত বছর আগে ক্যাপ্টেন সুইস্টনের সাথে নুনশীরাপে প্রথম বাঙালি হিসেবে বিলেত গমন করেন এহতেশামউদ্দীন। কিন্তু এহতেশামউদ্দীন যে সেই দুঃসাহসিক কর্মটি করেছিলেন। তা জানা আছে খুব কম লোকেরই।

শেখ এহতেশামউদ্দীনের শিগুর্ফনামা এ-বিলায়েত নামে ভ্রমণকাহিনি পড়লে সে-কথা জানতে পারবেন পাঠকরা। শুধু তাই নয়, দেকার্তের কথা যেমন সত্য, ঠিক একথাও তেমনি সত্য যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর এই ফারসি বইটির মধ্য দিয়ে সেই বঙ্গসন্তান যেন আজকের এই ভিন্ন শতকের পাঠকদের সঙ্গে কথা বলছেন। এহতেশামউদ্দীনের ফারসি গ্রন্থ শিগুর্ফনামা এ-বিলায়েত বা বিলেতের বিস্ম্যাকনা দৃশ্যাবলী মুদ্রিত আকারে কখনও প্রকাশিত হয়নি। ১৮২৭ সালে ক্যাপ্টেন জেমস এডওয়ার্ড আলেকজান্ডার প্রথম এর সংক্ষিপ্ত ইংরেজি অনুবাদ করে লন্ডন থেকে প্রকাশ করেন। উনিশ শতক পর্যন্ত এর আর কোনো আলোচনা হয়নি। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ১৯১৭- এ “দ্যা ঢাকা রিভিউ” পত্রিকার দুটি সংখ্যায় বেলায়েতনামা শিরোনামে ঢাকার হাকিম হাবিবুর রহমানের ব্যক্তিগত সংগ্রহে শিগুর্ফনামার যে পাণ্ডুলিপিটি ছিল তার প্রথম তিন অধ্যায়ের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেন মৌলবি আবদুল আজিজ তালুকদার, মুখবন্ধটি লিখেন সৈয়দ আওলাদ হোসেন। যদিও ১৯৮১-তে উক্ত গ্রন্থটি ফারসি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে অনুবাদক এ বি এম হাবিবুল্লাহ ক্যাপ্টেন আলেকজাণ্ডার-এর অনুবাদকে ‘সংক্ষিপ্ত ও এবং ত্রুটিপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেছেন। এহতেশানউদ্দীনের প্রশ্নের ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদের এই মধ্যবর্তী সময়কালে তাকে নিয়ে কিছু আলোচনা প্রকাশিত হয়। মূল কারসি থেকে এহতেশানউদ্দীনের প্রশ্নের বাংলা অনুবাদক হাবিবুল্লাহ তাঁর অনুবাদ গ্রন্থের (“বেলায়েতনামা”) ভূমিকায় লিখেছেন, “যতদূর জানা যায়, এই শতকে এহতেশানউদ্দীনের ভ্রমণ কাহিনির প্রতি সর্বপ্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ঢাকার তারিন হাবিবুর রহমান তাঁর সম্পাদিত উর্দু মাসিক পত্রিকা ‘যাদু’-তে ১৯২৬-২৭ সালে। তার ফলে কলকাতায় ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ও বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় এ সম্পর্কে কিছু কৌতূহল প্রকাশ করে মূল পাণ্ডুলিপির সন্ধান করা উচিত বলে মন্তব্য করা হয়। পরে আলোকাচারের উপরোন্ত ইংরেজি তর্জমাকে ভিত্তি করে আলতাক হোসেন ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় এহতেশামউদ্দিনের উপর একটি সম্পূর্ণ প্রবন্ধ লেখেন। পরে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, ১৯৩৪ সালের ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে কয়েকটি মূল পাণ্ডুলিপির অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেন।”

আলতাফ হোসেনের প্রবন্ধের কিছু অংশ আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি of considerable interest to students of history in the news of the rescue from oblivion of a book published in London, in 1827, John Taylor, by James Duncan, Paternoster Row. The book is an English translation of an original Persian Ms, entitled ‘Shigorf Namah-i-Velayet, or ‘Excellent Intelligence concerning Europe’ being the account of the travels in Great Britain and France of a Bengali Moslem named Mirza Itesa Modeen, who left on a voyage to Europe in the year 1765, long before any other Bengali or Indian for that matter, is known to have made a similar voyage. The translator is James Edward Alexander, described on the title page as ‘Lieut late HM’s 13th Light Dragoons; and adjutant of the Bodyguard of the Honourable Governor of Fort St. George, and Author of Travels in Ava. Persia and Turkey.

The Original Persian MSS contained many more details of the Mirza’s experiences in Europe and of the men he had met, which though they appeared in the opinion of the translator, “Gross and therefore unsuitable for the general reader more than a century ago, would undoubtedly have been of considerable interest in these more research in this direc tion therefore, and scholars interested in such subjects might well direct their attention to possibilities of recovering one or both of these valuable manuscripts. There is no doubt however, that in the absence of the original, the value of the translation by James Edward Alexander is very considerable.

In another Persian book, written by the same Mirza Itesa Modeen and which in the MS. is still in the possession of the Mirza’s present descendants, and which is named Nasabnama (family history of births and marriages). Panchnour is thus described. প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে ১২ জুলাই ১৯৩৪- স্টেটসম্যান’ পত্রিকা আবুল কালাম আজাদের একটি চিঠি ছাপে। তাতে তিনি জানিয়েছেন, শিগুর্ফনামার একটি পাণ্ডুলিপি তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে আছে। ‘বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্টস্ট’ পত্রিকার ১৯৩৫ সালের এপ্রিল-জুন সংখ্যায় এ এস এম তৈফুর এহতেশামউদ্দিনের গ্রন্থ সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখেন। এ বি এম হাবিবুল্লাহ ইউরোপে প্রথম ভারতীর’ শিরোনামে ১৩৪৩-এ একটি বাংলা প্রবন্ধ লিখেন ‘মোয়াজ্জিন পত্রিকায়। ১৯৩৯ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ইণ্ডিয়ান হিস্টরিক্যাল রেকর্ডস কমিশন’-এর অধিবেশনে এ বি এম হাবিবুল্লাহ এই ভ্রমণকাহিনিতে উল্লিখিত রাজা তৃতীয় জর্জের নিকট লিখিত সম্রাট শাহ আলমের মূল ফারসি চিঠির একটি ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন।

এরপর ‘বাংলা একাডেমি পত্রিকা’য় ১৩৭১-এ মুহম্মদ দরবেশ আলী খানের ‘মুনশী শেখ ইহতিশামউদ্দীন মীর্জা’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে এহতেশামউদ্দীনের কারসি গ্রহটির পাণ্ডুলিপি প্রাপ্তির সম্পর্কে বলা হয়েছে “ফারসি ভাষায় লিখিত এই মূল্যবান গ্রন্থখানির কোনো মুদ্রিত সংস্করণ বের হয়েছে বলে জানা নেই। ইংরেজী অনুবাদক জেমস এডওয়ার্ড আলেকজান্ডার তাঁর অনুবাদের ভূমিকায় বলেন, তাঁর সময়ে অর্থাৎ ১৮২৭-র দিকে গ্রন্থখানির ফারসী পাণ্ডুলিপি সম্ভবত মাত্র দু’কপিরাই অস্তিত্ব ছিল। এর মধ্যে তাঁর হাতে যে কপি পড়ে তা তাঁর মুনশী ক্যাপ্টেন সুইনটনের পুত্রের প্রধান ভৃত্যের কাছ থেকে খরিদ করে আনেন। বর্তমানে লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামও বড়লিয়ান লাইব্রেরী, ভারতে হায়দ্রাবাদের অসকিয়া লাইব্রেরী আর এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল (কলকাতা) লাইব্রেরীতে শিগুর্রফনামার পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। পূর্ব পাকিস্তান এলাকায় মরহুম হাকীম হাবীবুর রহমান সাহেবের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে একখানি পাণ্ডুলিপি ছিল বলে জানা যায়। হাকীম সাহেবের উক্ত লাইব্রেরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হস্তান্তরিত হয়েছে। তবে ঐ পাণ্ডুলিপি সম্পূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য কিনা সন্দেহ আছে। হাকীম সাহেবের স্বল্পায়ু উর্দু মাসিক পত্রিকা ‘যাদু’ তে ১৯২৬-১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে শিগুর্ফনামার কিছু উর্দু অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।

‘মির্জা শেখ ইতিসা্মুদ্দীন- বিলাত ভ্রমণকথা’ শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ রচনা ‘ইতিহাস’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ৮ কিস্তিতে। এটি “শিগুর্ফনামা-এ-বেলায়েত” গ্রন্থের আরেক বাংলা অনুবাদ, অনুবাদক এ বি এম হাবিবুল্লাহ। ১৩৭৪-১৩৭৭ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এটি প্রকাশিত হয়। এই বাংলা অনুবাদটি ‘বেলায়েতনামা’ নামে ১৯৮১-২ মুক্তধারা, ঢাকা হতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ।এ বি এম হাবিবুল্লাহ নিজেও ১৯৪৪ সালে এহতেশামউদ্দীনকে নিয়ে লেখা তার পরিবারের পরবর্তী বংশধর কাজী সদলে ওলার গ্রন্থটি সম্পর্কে অঞ্জাত ছিল। অথচ এই গ্রন্থটি এহতেশামউদ্দীন সম্পর্কে জানার একটি অপরিহার্য আকরগ্রন্থ।শিগুর্ফনামা সম্পর্কে এহতেশামউদ্দীনের বংশধর সদলে ওলা বলেছেন, I had actually found a copy of the ‘Shigurinama’ at my own house after the death of my father. I treasured up the manuscript copy because the writing appeared to be beautiful. It looked like a neatly printed book, with flowery decorations of red and gold colours, at the border of all pages, and at the beginning of very new chapter, which has distinguished from the rest, by words written in red and gold. In spite of the great age of the book, the black and red, and the golden colours were as fresh and bright as new…I had two other Persian manuscripts also. I was then reading B.A. at the Presidency College, and was living in the Elliot Hostel Calcutta and I have shown all these books to some friends. In a few days, I was summoned by Dr. Sir E.D. Ross, the then Principal of the Calcutta Madrassa and the Elliot Hostel, He examined the Persian manuscripts I had then with me, and took over two of them. The Shigurfnama was one, and the other was a copy of some Treaties, concluded between the Governor General of India on the one side and some Feudatory and Independent Chiefs of some Native States in India. It was in 1910….In 1923 I found a mention of the subjhect in the Islamic Sahitya Patrika who quoted the article from the “Prabası. I tried to communicate with Dr. Roos and obtained his address from the most reliable official sources, but never succeeded in getting from him a reply to my letters…I was able to come in contact with Dr. Ross and obtained from him. (1) the sad news that he had lost the manuscript copy and (2) the kind present of a copy of the English Translation of some portions of the Book by one James Edward Alexander Esq. an Indian Army Officer published in 1827 A.D.

এছাড়া এহতেশামউদ্দীনের অপর এক বংশধর নাম শামস এন জামান-এর লেখা গ্রন্থে এহতেশানউদ্দীন ও তার বিলেত ভ্রমণ অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সমসাময়িক রাজনৈতিক কিছু কিছু ঘটনার উল্লেখ আছে। সম্প্রতি গোলান মুরশিদ তাঁর গ্রন্থেও সংক্ষিপ্ত হলেও এহতেশামউদ্দীনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। কুমুদনাথ মল্লিক তাঁর ‘নদিয়া কাহিনি’- তে এহতেশামউদ্দীনের বিলেত যাওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। মুনশী সলিমুল্লাহ-র ‘তারিখ ই বাঙ্গালা’ গ্রন্থের ফারসি টেক্সটসহ সম্পাদনার ভূমিকা অংশে সম্পাদক এস এম ইমামুদ্দিন বাংলার নবাব নীরজাফর ও তাঁর মুনশীদের সঙ্গে এহতেশামউদ্দীনের সম্পর্কের বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।

উল্লেখ্য যে, ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধে দিল্লির কেন্দ্রীয় শক্তির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে। নিরাপত্তার জন্য গোরা সৈন্যের প্রথম প্রয়োজন অনুভূত হয় সম্রাট শাহ আলমের। লর্ড ক্লাইভ বলেন যে, ইংল্যান্ডের রাজা এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তৃপয়ে র নির্দেশ ছাড়া গোরা সৈন্য সরবরাহ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলার পরাজয়ের পর এলাহাবাদে লর্ড ক্লাইভ ও দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের মধ্যে এক শান্তি চুক্তি হয়। সন্ধিসূত্র অনুসারে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি বাৎসরিক ২৬ ল টাকার খাজনার বিনিময়ে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে। ওই সময় নিজ নিরাপত্তার জন্যে পুনরায় দিল্লীর বাদশাহ ৫০০ ইংরেজ সৈন্য রাখার প্রস্তাব করেন। সন্ধির চুক্তি পত্র ও বাদশাহী ফরমানের মুসাবিদা ও নকল করার জন্যে মুনশী মুঈজ, শেখ এহতেশামউদ্দীন ও দোভাষী জর্জ ভ্যান্সিটার্ট উপস্থিত ছিলেন। এহতেশামউদ্দীন এ প্রসঙ্গে যে বিবরণ নিয়েছেন তাতে মুঘল শক্তির চরম অসহায়তা প্রকাশ পেয়েছে। ” কোম্পানির নামে এবং উড়িষ্যা সুবার দেওয়ানি আদায় করে ও মীরজাফর আলির পুত্র নজমউদদৌলার নামে সম্রাটের দরবার থেকে একটি নিজামত সনদ লিখিয়ে নিয়ে হার্ড ক্লাইভ দরবার থেকে প্রস্থান করতে চাইলে সজল নেত্রে বাদশাহ তাঁকে বললেন, “আপনি কোম্পানীর স্বার্থের সকল ব্যবস্থা নিজের খুশী মতই করেছেন, কিন্তু আমার বিষয়াদি সংরক্ষণের জন্য কিছুই চেষ্টা করলেন না। আমি যাবৎ দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকি, তাবৎ একটি ইংরেজবাহিনী আমার কাছে রাখবার ইচ্ছাও আপনার নেই। এখন আপনি আমাকে শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় একা ফেলে চলে যযাচ্ছেন। মোট কথা, ভাগ্যবিড়ম্বিত বাদশাহের তখন এমনই শোচনীয় অবস্থা যে, একটি ইংরেজ বাহিনীর উপস্থিতি ছাড়া তাঁর নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে যাবে বলে তিনি ভয় পেয়ে যান। তাই ক্লাইভের কাছে একটি অবস্থানকারী ইংরেজ বাহিনীর জন্য তাঁর এই সম্পূর্ণ প্রার্থনা।”

এই অবস্থায় স্থির হয়, মুঘল বাদশাহ শাহ আলমের অনুরোধ পত্র ও একলাখ টাকার উপঢৌকন নিয়ে দূত যাবে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জের কাছে। ক্যাপ্টেন সুইনটন দূত মনোনীত হন। এ সম্পর্কে এহতেশান বলেছেন, “তাই পরামর্শ করে স্থির হয়। বাদশাহের থেকে লাখ টাকার উপঢৌকনসহ একখানা পত্র দূত মারফত রাজা তাতীয় জর্জের নিকট পাঠানো হবে। ইংরেজ প্রধান সেনাপতি জেনারেল কর্ণকের মিলিটারী সেক্রেটারি সুইনটন বাদশাহের তরফ থেকে রাজদূত নিযুক্ত হন। নবাব মুনিরউদ্দৌলা মুলা ও রাজা সীতাব রায় তখন শাহ আলমের দু’জন মন্ত্রী। এঁদের মত নিয়ে বাদশাহ ক্লাইভকেই তাঁর পক্ষে রাজার কাছে পত্রখানা লিখে দিতে অনুরোধ করেন। ক্লাইভ সে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

সুইনটনকে সহযোগিতা করার জন্য অর্থাৎ ফারসি ভাষায় লিখিত অনুরোধ-পত্রটি পড়ে দেওয়ার জন্য ফারসসি মুনশী শেখ এহতেশামউদ্দীন নির্বাচিত হন। অর্থাৎ মুঘল বাদশাহ এহতেশামউদ্দীনকে পত্রবাহক করে ইংল্যাণ্ডের রাজার কাছে প্রেরণ করেন, সেটা ১৭৬৫ সাল। আর এই ১৭৬৫তে তিনি যে বিলেত বা ইংল্যাণ্ডে গেলেন এই যাওয়াই প্রথন কোনো ভারতীয়র বিলেতযাত্রা।

স্মর্তব্য যে, কিছুকাল মুর্শিদাবাদে চাকরি করার পর এহতেশা্মউদ্দীন ইংরেজদের অধীনে কাজ করেন। তখন কোম্পানির সেনা কর্মকর্তা এবং ক্যাপ্টেন সুইনটনের সঙ্গে এহতেশামউদ্দীনের ঘনিষ্ঠতা জন্মে। ওদিকে সুইনটন ততোদিনে কোম্পানির চাকরি থেকে পদত্যাগ করে মুঘল সম্রাটের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। তাই সুইটনের সঙ্গী হিসেবে মুঘল সম্রাট এহতেশামউদ্দীনকে তাঁর দূত নিয়োগ করে লণ্ডনে পাঠিয়েছিলেন। ইংল্যান্ড যাত্রার এই উপলক্ষের বিবরণ দিয়ে এহতেশামউদ্দীন লিখেছেন, “সম্রাটের তরফ থেকে ফারসি ভাষায় দক্ষ একজন লোকের প্রয়োজন হওয়াতে এই অধমকে (এহতেশামউদ্দীনকে) নির্বাচিত করা হল। নবাব মুনিরউদ্দৌলার পক্ষ থেকে যাতায়াতের খরচ স্বরূপ তাঁকে চার হাজার টাকা দেওয়া হল এবং প্রত্যাবর্তনের পর রাজার পুরস্কার ও অনুগ্রহ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল। তারুণ্যের উৎসাহে এবং ভাগ্যের টানে এই অধীনের মনেও ইংল্যান্ড যাত্রার ইচ্ছা প্রবল হয়ে উঠন্যের”। চার হাজার টাকা প্রদানের মাধ্যমে এহতেশাম উদ্দীনের বিলেত যাত্রার বন্দোবস্ত চূড়ান্ত রূাপ পরিগ্রহ করলে রচিত হয় এক ইতিহাস। “ভারতের বাদশাহের পক্ষ থেকে ইংরেজ দূত বাঙালি সহকারী সমভিব্যাহারে চললেন ইংল্যান্ডে নেরের দিদার উপলক্ষ্যে ।” এহতেশামউদ্দীন ১৭৬৫-র জানুয়ারি (১১৭০ সনের ১৩ মাঘ) কলকাতার হিজলি ঘাটে মঁসিয়ে সোরভিল জাহাজে চড়ে যাত্রা করেন। কাজী আলিমুল্লাহ তাঁকে বিদায় দিতে এসেছিলেন। এ সম্পর্কে বলা হয়েছে The Mirza Saheb came home to Pachnoor took leave of his wife and relatives and started for the port of Hooghly after due perparation for this long strange and arduous journey The Foujdar of Hooghly and important personages, including among others his friend Qazi Shaikh Alimoolla gave him a happy send off The ship weighed anchor and started with the Caption and the Mirza on board, on 9th of Shaban in the year 1180 AH. মোহাম্মাদ মুকিম পরিচারক হিসেবে এহতেশামউদ্দীনের সঙ্গে ছিল। বিজাতির রান্না তিনি খাবে না, এজন্যই তিনি এ ব্যবস্থা করেছিলেন। রাজা রামমোহন রায় যখন বিলাতে যান, তখন তিনিও সঙ্গে ব্রাহ্মণ পাচক ও দুতি দুগ্ধবতী গাভী নিয়েছিলেন।

চারদিন পরে জাহাজ পৌঁছল সাগরে। মোহনার তীরের কাছের জল নোনা মিষ্টি মেশানো, যত দূরে যাওয়া যায়, জল তত নোনা, আর নীল। রাতে ঢেউয়ের মাথায় ফেনা ঠিক যেন প্রদীপের মতো জ্বলে। এহতেশামউদ্দীন লিখছেন, ‘জ্ঞানীরা বলেন পৃথিবীকে ঘিরে আছে ককেশাস নামে উজ্জ্বল নীল রঙের সুউচ্চ পর্বতমালা, আকাশের নীল রংটি তাদের শিখরের কাছেই ধার নেওয়া, নইলে আকাশ মূলত কাচের মতো স্বচ্ছ। আর সমুদ্রের নীল তো আকাশেরই প্রতিবিম্ব মাত্র।’—তার প্রমাণ ? অঞ্জলিতে যদি সমুদ্রের জল কোষ করে করা যায় তখন দেখব জলের কোনো রং নেই। আর সমুদ্রের যে লবণ স্বাদ? সেটা সমুদ্রগর্ভ থেকেই আসে। এহতেশানউদ্দীন লিখছেন, সমুদ্রের বাতাস সুস্থ লোকের পক্ষে ভালো, অসুস্থের পক্ষেও। তারপর বলছেন নিজের কথা। জাহাজে ওঁর কোনোই অসুখ-বিসুখ করেনি, একবারই শুধু পেটের গোলযোগ দেখা দিয়েছিল। সেটা কেবল ইসবগুলের শরবৎ খেয়েই ঠিক হয়ে গেছিল। তারপর পাঠকের মঙ্গল কামনায় ইসবগুলের শরবৎ প্রস্তুত প্রণালীটাও জানিয়েছেন ।

সমুদ্রের বিপুল বিস্তার, তার তলহীন গভীরতা, এহতেশানউদ্দীনের কাছে মনে হয়েছিল এসব রহস্যের আধার। আমার অসীম সৃজনীশক্তিরই পরিচয় সমুদ্রের অনির্বাণ প্রাণশক্তি তে। এই সমুদ্রের কোলে পৃথিবী ভাসছে, যেন ছোট্ট একটি ডিমের মতো। মহা উৎসাহে তিনি জানিয়েছেন কম্পাস কী বস্তু, কীভাবে প্রস্তুত করা হয়, নাবিকদের তাতে কত সুবিধা, আলেকজান্ডারের সময়ে কম্পাস ছিল না বলে তাঁদের কত বেশি ঝুঁকি নিতে হয়েছিল। জাহাজ কত রকমের হয়? তাদের কী কী নাম? বিভিন্ন বাতাসগুলি কোনটি কেমনভাবে বয়, নাবিকরা কীভাবে সেই বাতাসদের ওপরে নির্ভর করে জাহাজ চালনা করেন, তাঁদের কী কী ধরনের সমস্যা হয়, জাহাজ ঝড়-বাদলে পড়লে অবস্থা কত ভয়াবহ হতে পারে—সব কিছুরই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন এহতেশামউদ্দীন।

এইরকম টুকরো টুকরো মণিমুক্ত মাঝে মাঝেই পাওয়া যায় এহতেশামউদ্দীনের ভ্রমণলিপি ‘শিগুর্ফনামা- এ-বিলায়েত’-এ। হুগলি সদর থেকে যাত্রা আরম্ভ করে প্রায় সাতদিন চলবার পর তিনি মরিশাস দ্বীপে পৌঁছন, সেইসময় প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির কবলে তাঁকে পড়তে হয় এবং জাহাজও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। জাহাজ মেরামতের জন্য তাঁকে এই দ্বীপে অধিকসময় অতিবাহিত করতে হয়। মরিশাস দ্বীপের বর্ণনা তিনি বলেছেন যে, পঁচাত্তর শ্রোশ বিস্তৃত এই দ্বীপ, দ্বীপের মধ্যভাগে পাহাড়-পর্বত ও জঙ্গলাকীর্ণ জনহীন অঞ্চল। পূর্বদিকের জমিতে যেমন কলা উৎপন্ন হয় তেমনই এদিকে একটি শহরও আছে। এই দ্বীপের মানুষদের প্রত্যেকের চাষাবাদ প্রভৃতি কর্মসম্পাদনের জন্য পঞ্চাশ থেকে একশ দাস-দাসী আছে। এই দ্বীপে দাস-দাসীদের আগমনের নেপথ্য ইতিহাস যেমন এহতেশামউদ্দীনের লেখনীতে ধরা পড়েছে, তেমনই এখানকার মানুষের খাদ্যাভ্যাসেরও পরিচয় দিয়েছেন তিনি। তখনকার প্রচলিত ক্রীতদাস প্রথার রূপটিও এহতেশামউদ্দীনের গ্রন্থে ধরা পড়েছে।

এহতেশামউদ্দীনের লেখা থেকে জানতে পারা যায় যে, সে সময়ে মরিশাস দ্বীপে হুগলি, বুলবার ও আম্বারের মুসলমানরা শিশু পুত্রাদিসহ বসবাস করত। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ফরাসি ক্রীতদাসী বিবাহ করত। তিনি মরিশাস দ্বীপে আম, কুটি, তরমুজ, শসা সংগ্রহ করেছিলেন। আমগুলোর আবার বিশেষত্ব ছিল। সেগুলো বাইরে সবুজ, ভেতরে নীলাভ। উত্তমাশা অন্তরীপে আঙ্গুর, আপেল, নাসপাতি, সেওফল, চিফল, আম ও কলা দেখেছিলেন। রাজশেখর বসুর মতে, ‘সেও’ ফল হল আপেল এবং অমুল্যচরণ বিদ্যাভূষণ এর মতে, ‘(চি’ হল লবঙ্গ। এই উত্তমাশা অন্তরীপে তাঁর সঙ্গে কিছু বাঙালি ক্রীতদাসের পরিচিতি ঘটে। তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কথা, আচার ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। কিন্তু পরিষ্কার করে বলেননি তিনি সেসব জায়গায় গিয়েছেন কিনা কিংবা সেসব লোকমুখে শুনেছেন কিনা।

এহতেশামউদ্দীন পশ্চিমী মানুষের নৌবিদ্যার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাদের অভিযানপ্রিয়তা ও দুঃসাহস তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। মাঝে মাঝে বাতাস বন্ধ হয়ে স্রোত স্তব্ধ হয়ে যায়। তখন দু-তিন সপ্তাহ জাহাজ নড়ে না | একবার এরকম হতে, এহতেশামউদ্দীন খুব ভয় পেয়েছিলেন। আর খুব অবাক হয়েছিলেন জাহাজের যাত্রীদের নির্ভাবনায় হৈ চৈ করা এবং মেয়েদের নিয়ে নাচ গান হুল্লোড় দেখে।

অনেক ধরনের সামুদ্রিক জলন্ত, মাছের কথা লিখেছেন এহতেশামউদ্দীন । উড়ুক্কু মাছের ঝাঁক এদিক থেকে লাফিয়ে জাহাজের ওদিকে পড়ছে, শীল মাছের দল নেচেকুঁদে জাহাজকে তাড়া করছে। দুটো হাতির মতো বিশালবপু তিমিমাছ, তাদের নাক থেকে ফোয়ারা দিয়ে জলের ধারা আকাশে ঠিকরে উঠছে, একেকটা খেজুর গাছের মতো উঁচু হয়ে কখনও জাহাজের আশপাশে কখনও জাহাজের তলা দিয়ে তিমি মাছেরা সাঁতরে যাচ্ছে ইত্যাদি।

আর এহতেশামউদ্দীন কী লিখলেন সেই আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে? তাঁর মতে, নাছগুলি নিশ্চয় ওড়ে না, কোনোভাবে জলের কাঁপনে ভয় পেয়ে জাহাজের গতিপথ থেকে সরে যাবার জন্য শূন্যে লাফিয়ে ওঠে, ঝাঁক বেঁধে আত্মরক্ষার চেষ্টার কানকো দিয়ে বাতাস কাটে। আর যে শীল মাছেদের কথা এহতেশামউদ্দীন লিখেছেন, যারা জাহাজকে তাড়া করে যেত আশি মাইল, একশো মাইল। তারা অবশ্য শীল মাছ না, ডলফিন। জাহাজের দুই পাশে এবং পিছন পিছন তারা ঝাঁক বেঁধে সাঁতরে চলে—ঠিক রাস্তায় মোটর গাড়িকে যেমন ধাওয়া করে কুকুরের পাল, তেমনই।

এহতেশামউদ্দীনের বর্ণনায় তিমি মাছেরা এখনও তেমনই আছে। যদিও শোনা যায় জাপান, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে তিমি শিকার করে তিমির স্টেক খাওয়ার প্রচলন তাদের পক্ষে খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। তিমি শিকার যদিও আইনত নিষিদ্ধ, তবু চোরাশিকারিরা আছেই। নতুন নতুন দ্বীপের দিকে যাচ্ছিলেন এহতেশামউদ্দীন, আবিপেরংদের মুখে শুনছিলেন নতুন নতুন গল্প। এও যেন সেই ইউলিসিসের জলযাত্রা। রাত কি ভয়াবহ বিঘ্ন ছিল ওঁদের জলপানে নতুন নতুন গল্প। এও যেন সেই ইউলিসিসের জলযাত্রা। কত কি ভয়াবহ বিঘ্ন ছিল ওঁদের জলপথে!

এদেশে জাতিতত্ত্ব আলোচনার পথিকৃৎরাপে এহতেশামউদ্দীনকে গণ্য করা যায়। তাঁর গ্রন্থে বিভিন্ন জনজাতির আচার-ব্যবহার ইত্যাদির পরিচয় ও তাদের তুলনামূলক আলোচনাও স্থান লাভ করেছে। বস্তুতপর ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ই টি ডালটনের ‘ডেসক্রিপটিভ ইথনোলজি অব বেঙ্গল’ গ্রহের প্রকাশনা ও ইংরেজদের জাতিতত্ত্ব বিষয়ক নানা কর্মোদ্যমের মাধ্যমে এদেশে জাতিতত্ত্ব আলোচনার যে বাতাবরণ প্রস্তুত হয়, তার বহুপূর্বেই মির্জা এহতেশামউদ্দীন তাঁর গ্রন্থে জনজাতির জীবনযাত্রা প্রণালীর নিখুঁত বর্ণনার মাধ্যমে এ বিষয়ে অনুসন্ধানের পথ উন্মুক্ত করেন। উত্তমাশা অন্তরীপের আদিম জনজাতি সম্পর্কে তাঁর অভিমত প্রণিধানযোগ্য “ওলন্দাজদের বসতি স্থাপনের পূর্বে অঞ্চল জঙ্গলাকীর্ণ ছিল, আর এখানে বাস করত হটেনটট ও অন্যান্য জঙ্গলী জাতি। ভারতীয় বেদেদের ন্যায় এদের ঘরবাড়ী সঙ্গে সঙ্গেই। সাত আট সহস্র নরনারী ও শিশু ঘোড়া-ভেড়া-গবাদি পশুর পাল সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসত অন্তরীপ অঞ্চলে। এখানে তিন-চার বছর অবস্থান করে তারা আবার অন্যত্র চলে যেত। হাটেনটটদের পরিচ্ছদ কাঁচা চামড়া আর খাদ্য কাঁচা বা অর্ধপক্ষ গোশত, দুই মেষ মাংস, আর বনজ ফল। এরা গঠনে বলিষ্ঠ ও মাংসল আর স্বভাবে কর্মঠ।

মরিশাস, পেগু, মালাস্কা—এসব দ্বীপের কথা লিখতে গিয়ে এহতেশানউদ্দীন লিখেছেন নরখাদক জংলীদের কথা এরা ছিল মালাস্কার। তাদের পরনেও পশুচর্ম, তারা নানারকম জড়িবুটির চিকিৎসা জানত, রক্ত পাত বন্ধ করার ও ক্ষতস্থান সুস্থ করে তোলার উপায়ও জানত তারা। কিন্তু জ্বর হলেই মুশকিল। অমনি তার পড়শিরা নাচ-গান সহকারে তাকে খতম করত। তার মাংসের অতি উপাদেয় কাবাব বানিয়ে গ্রামসুদ্ধ সবাই নিলে ‘ফিস্টি’ করত। তার বাড়ির লোকেরাও নাকি তাতে যোগ দেয়। কী ভয়ানক!

‘নরখাদকের দ্বীপ’ বলে তিনি যে দ্বীপটির গল্প বলেছেন, এখন ম্যাপ দেখে মনে হয় সেটি মাদাগাস্কার। সেখানে সোনার খনি ছিল। আর সেই দ্বীপবাসীরা নাকি বিদেশি জাহাজের নাবিকদের ভুলিয়ে এনে, জাহাজটি ধংস করে, নাবিকদের ভোজন করে মহফুর্তি করত। কিন্তু সোনা আছে বলে, স্বর্ণলোভী কিছু সাহেব ব্যবসায়ী ইউরোপ থেকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নিয়ে ঐ দ্বীপে যেত এবং দণ্ডিত মানুষদের বিনিময়ে সোনার তাল নিয়ে ইউরোপে ফিরত।

এহতেশামউদ্দীন উত্তমাশা অন্তরীপ দিয়ে ঘুরে ফালের বন্দরে পৌঁছেছিলেন। ফেরার পথে কেপটাউনে থেমেছিলেন, দু’সপ্তাহের জন্য ‘হাবসীদের দেশে’ (আবিসিনিয়া তথা ইথিওপিয়া) বাসও করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ওহান্দাজদের আসার আগে সেই দেশে শুধু বন্য কালো মানুষরা স্বাধীনভাবে বসবাস করত। ক্রীতদাস ব্যবস্থার নি্ন্দে করেছেন এহতেশামউদ্দীন এই হাবসীদের প্রসঙ্গে।

এহতেশামউদ্দীন লিখেছেন, ভয়ঙ্কর জলকন্যাদের কথা, যারা আশ্চর্য সুর শুনিয়ে নাবিকদের মাতিয়ে তোলে। তারপর নিশি ডাকের মতো তাদের নাম ধরে ডেকে নেয়। একবার ডাকে, দুবার ডাকে, তিনবার। বাস, তৃতীয় ডাকের পর জলে ঝাঁপ দেবেই সেই চিহ্নিত নাবিক। যদিও কেউ ফিরে আসে তো সে বোবা হয়ে আসে। মৎস্যকন্যাদের স্বভাবই যুবক, সমর্থ নাবিকদের নিয়ে নির্জন দ্বীপে সংসার করা। তারপর তাদের মূক করে দেওয়া হয়। যদিও বা তারা কোনো দিন ফিরেও যায়, কোনো গল্প করতে পারবে না। মৎস্যকন্যাদের বিষয়ে। তারা অর্ধ নারী, অর্ধ মাছ। এহতেশামউদ্দীন তাদের দেখা পাননি ভাগ্যিস! পেলে আর তাঁকে ফিরে এসে বিলায়েতনামা’ লিখতে হত না।

পালের জাহাজে ৬ মাস চলার পর এহতেশামউদ্দীন ইংল্যান্ডে পৌঁছেন। এত দীর্ঘ সময় লাগার কারণ, তখনো সুয়েজ হয়ে যাওয়ার উপায় ছিল না। তিনি গিয়েছিলেন মরিশাস, কেপ, আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল এবং ফ্রান্সের উপকূল হয়ে। বিলেতে এবং স্কটল্যান্ডে তিনি সব মিলে বছর খানেক ছিলেন। যেহেতু বিলেতের অনেকেই তখন ভারতবর্ষে গিয়ে ব্যবসা এবং চাকরি করে রাতারাতি ‘নবাব’ হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন, সে জন্যে তাঁর কাছ থেকে ফারসি এবং হিন্দুস্তানি ভাষা শেখার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন বহুজন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে আরও তিন-চার বছর বিলেতে রাখতে খুবই উৎসাহী ছিলেন ক্যাপ্টেন সুইন্টন। সুইন্টন বলেছিলেন যে, এ জন্যে দরকার হলে এহতেশামউদ্দীন বিলেতেই এক বা একাধিক বিয়ে করতে পারেন। কিন্তূ এহতেশামউদ্দীন তাতে রাজি হন নি।

এহতেশাম যে উদ্দেশ্য নিয়ে লন্ডনে যান, তা সফল হয়নি। সে জন্য তাঁর ক্ষোভের অন্ত ছিল না। গভীর সমুদ্রে পৌঁছলে তিনি জানতে পারেন এমন কিছু তথ্য যার ফলে তাঁর মনে হয়, এই সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ডে গমন ক্লাইভের একটি ছলনা ছিল মাত্র, যা আসলে শাহ আলমের সঙ্গে প্রতারণার নামান্তর। সুইনটন সাহেব মির্জা এহতেশামকে বলেন “রাজা তৃতীয় জর্জের উদ্দেশ্যে লিখিত শাহ আলমের পত্র ক্লাইভ রেখে দিয়েছেন। পত্রের সঙ্গে যে লক্ষ টাকা মূল্যের খেলাত যাবার কথা ছিল, তাঁরা রওনা হবার আগে তা বেনারস থেকে এসে পৌঁছেনি, তাই এই ব্যবস্থা। কারণ খেলাত ছাড়া পত্র পাঠানো খুবই দৃষ্টিকটু। খেলাত এসে পৌঁছনো পরবর্তী বছর ক্লাইভ নিজেই পত্র ও খেলাত নিয়ে বিলাত যাবেন। তখন যথা কর্তব্য পালনের জন্য পত্র ও খেলাত তাদের হাতেই ন্যস্ত করা হবে। সে পর্যন্ত তারা যেন বিলাতেই অপেক্ষা করেন। এই তাদের জন্য ক্লাইভের উপদেশ । তখন এহতেশাম নিরুপায়। স্বদেশে ফিরবার বাসনা থাকলেও তাঁর পক্ষে ফেরা আর সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে তার মানসিক অবস্থার যে লিপিচিত্রটি পাওয়া যায় তা বড়ই বেদনার। তিনি লিখছেন আমি স্থির নিশ্চিত হলাম যে, এর পিছনে নিশ্চয়ই কোনো দুরভিসন্ধি রয়েছে। এসব বাজে ছল ছাড়া আর কিছুই নয়। এই দুঃখময় সমুদ্র যাত্রার অবসানে আমার কোনো বাসনাই চরিতার্থ হবে না। যদি আগে এটা জানতে পারতাম, তবে কখনও এমন কাজে এগোতাম না। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। যদিও এই না পারার দায়িত্ব ছিল সম্পূর্ণই রবার্ট ক্লাইভের। বিষয়টি একটু খুলে বললে বোধহয় ভাল হবে।

ভারতের মুঘল বাদশাহ শাহ আলম লর্ড ক্লাইভের কাছে সৈন্য সাহায্য চেয়েছিলেন তাঁর রাজ্য শাসনে নানা বিঘ্ন ঘটছিল বলে (এ সম্বন্ধে পূর্বেই আলোচিত হয়েছে)। ক্লাইভ বললেন, সৈন্য সাহায্য করবার ক্ষমতা তো তাঁর নেই। সেটা শুধু ইংল্যান্ডের রাজার আছে। তিনি ভাবেননি বাদশাহর পর রাজার কাছে আবেদন পাঠানোর কথা ভাবা অসম্ভব নয়। বাদশাহ স্থির করলেন, আবেদনপত্র পাঠাবেন রাজা তৃতীয় জর্জের দরবারে। ক্যাপ্টেন সুইনটন ও এহতেশামউদ্দীন দুজনে মিলে রওনা হলেন রাজা তৃতীয় জর্জের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বিলেতে পৌঁছেও উদ্দিষ্ট কাজ করা গেল না। লর্ড ক্লাইভ তাঁদের শেষ মুহূর্তে জানালেন, আবেদনপত্রটি পেলেও টাকাটা হাতে আসেনি। তাই টাকাটা পাওয়া গেলে তিনি স্বয়ং আবেদনপত্র সমেত ইংল্যান্ডে যাবেন এবং ওঁদের সেগুলি অর্পণ করবেন।

এই ঘটনায় এহতেশামউদ্দীন যারপরনাই বিচলিত বোধ করেছিলেন এবং মনোদুঃখে ইচ্ছে করে এক বর্ণও ইংরেজি ভাষা শেখেননি। ইংরেজি অক্ষরজ্ঞানও অর্জন করেননি। স্বদেশে ফেরার পরে এই নিয়ে তাঁকে কম গঞ্জনা শুনতে হয়নি। এত বড় সুযোগ কেউ ছেড়ে দেয়? অতদিন ওদেশে থাকলে, এত ভালো ভাষাটা শিখে এলে না? কত সুবিধা হত। তাঁর মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ জমেছিল। সে ক্ষোভের কথা এভাবে প্রকাশ করেছেন, “তাঁর (এহতেশানউদ্দীনের) অবস্থা এমন হল যে সে খোলাখুলিভাবে কিছু বলতেও পারত না, অথচ সে যা করতে চাইছিল, তা করবার জন্য সামর্থ্য বা সাহস ছিল না। কোনোমতে সে দিনের পরদিন কেবল নিজের অস্তিত্ব বহন করে চলত। কিন্তু বিনোদনের জন্য সে কেবল ইতিহাসের বই পাঠ করতে চেষ্টা করত। ইংরেজি ভাষা বা ইংরেজি হস্তলিপি শেখার তার কিছুমাত্র আগ্রহ ছিল না। ইংল্যান্ডের নানা বৈচিত্রপূর্ণ বস্তু বা স্থান দেখবারও তার আর বিশেষ কোনো উৎসাহ থাকল না। বাংলাদেশে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানকার অধিবাসীরা বলতে লাগল যে, সে ইংরেজের দেশে গিয়েও তাদের ভাষা শিক্ষা করেনি। কিন্তু এ কথার উত্তর দিতে গেলে আমাকে সমস্ত রহস্য প্রকাশ করে দিতে হয়। একথা কাকেই বা আমি বুঝাতে পারি, আর কি উত্তরই বা দিতে পারি? সুতরাং মুখ বন্ধ করে থাকা এবং অজ্ঞতা স্বীকার করা ছাড়া আর কি উপায় আছে আমার ?”

ক্লাইভের কূটচালে এহতেশামউদ্দীন মনোবেদনা পেয়েছিলেন। ক্লাইভের ইচ্ছে ছিল না কোনোমতেই ইংল্যান্ডের রাজার সঙ্গে ভারতের মুঘল বাদশাহর কোনো যোগাযোগ স্থাপিত হোক। তাই তিনি আবেদনপত্রটি স্রেফ চেপে গিয়েছিলেন। আর টাকাটিও পরে ক্লাইভ তাঁর ব্যক্তিগত উপঢৌকন হিসেবে ইংল্যান্ড- রাজকে দেন। এখানে বলে রাখি, ক্লাইভের চরিত্রের এই দিকটি পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের আর কারও জানতে বাকি ছিল না। সম্ভবত সেজন্য এক ব্রিটিশ ছড়াকার ক্লাইভ সম্বন্ধে লিখেছিলেন, “What I like about Clive/ Is that he is no longer alive. / There is a great deal to be said/For behind dead.” আসলে ক্লাইভ ব্যক্তিগতভাবে চাননি যে, ইংল্যাণ্ডের রাজার কাছে চিঠি পৌঁছাক। তার কারণ, এই চিঠিতে সম্রাট কিছু অভিযোগ করেছিলেন কোম্পানির নানা রকমের আচরণ সম্পর্কে। ভারত-সম্রাটের অভিযোগ যাতে রাজার কাছে পৌঁছাতে না পারে, সে জন্যে এহতেশামউদ্দীন এবং সুইনটনের যাওয়ার ব্যাপারে ক্লাইভ নানা রকমের বাধা দিচ্ছিলেন। এহতেশামউদ্দীন সমুদ্রপথে ক্যাপ্টেন সুইনটনের মুখে এই ষড়যন্ত্র ও বঞ্চনার কথা শুনেছিলেন। কিন্তু তখন তাঁর কিছুই করার ছিল না। দেশে প্রত্যাবর্তন করেও তিনি কিছু করেননি, সবটাই হজম করেছিলেন। সে যুগের অনেকের মতো ইংরেজের বিরাগভাজন হতে চাননি তিনি।

এহতেশামউদ্দীন তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে বলেছেন যে, বাংলা দখল ও শাসন নিয়ে ইংল্যান্ডের রাজপুরুষ ও কোম্পানির কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এজন্যে কোম্পানির শুভাকাঙ্খী লর্ড ক্লাইভ মূলপত্র গোপন করেন এবং একটা নতুন চিঠি সতা করে বাদশাহর সিলমোহর দিয়ে সুইনটনের হাতে দেন। এটা করেছিলেন দমদমের বাড়িতে লর্ড ক্লাইভ, নবাব নজমউদ্দৌলা, সিতাব রায় ও জর্জ ভ্যান্সিটার্ট একত্রে নিলে। এসব ঘটনা তিনি দেশে ফিরে জানতে পারেন।

ইংল্যান্ডে অবস্থানকালে এহতেশামউদ্দীন লন্ডন ও এডিনবরা শহরে থেকে শহরের বিচিত্র মানুষ, মানুষের বিচিত্র জীবনযাত্রা, যানবাহন, ঘরবাড়ি, রাজপ্রাসাদ, ঐতিহাসিক স্থান ইত্যাদি দেখে সময় অতিবাহিত করেন। এডিনবরার ক্যাপ্টেন সুইনটনের বসতবাড়ি ছিল। তাঁর সঙ্গে এহতেশামউদ্দীন সেখানে যান। তিনি লন্ডনের যাদুঘর, চিড়িয়াখানা, মানমন্দির প্রভৃতি পরিদর্শন করেন এবং জ্ঞান বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিদ্যার উন্নতি দেখে বিস্মিত হন। ভারতবাসীর তুলনায় ইংরেজগণ যে উন্নত ও সভ্য জাতি, তা তিনি প্রায় প্রতিটি ব্যাপারে অনুভব করেন। তিনি উভয়ের তুলনায় ইংরেজ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাগ্রসরতার কথা মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেন। লণ্ডনের রাস্তার পরিকল্পনা দেখে তিনি তার প্রশংসা করেছিলেন, নগরীর বিশালত্ব এবং সৌন্দর্যেরও। তিনি সে দেশের লোকেদের সাহসের প্রশংসা করে ওখানকার ধর্মী ও এলিটনের সন্তানরা কেন চার পাঁচ বছর বয়সে ঘোড়ায় চড়া ও পোলো খেলা অভ্যাস করে তার কারণ উল্লেখ করে বলেছেন, “শারীরিক পরিশ্রম ও কষ্ট করাকে তারা দক্ষতা জ্ঞান করে, আলস্য, বিলাস ও শৈথিল্যকে দূষণীয় মনে করে। সে জাতি দেশে রাজা বিস্তার ও প্রভুত্ব স্থাপন করবে না তো কি আমাদের হিন্দুস্তানের বর্তমান অভিজাত ও আমীর ওমরারা করবে, যারা কেবল পোলাও খাওয়া, বরফ ও সোডার ঠাণ্ডা করা পানি পান করা, নরম মখমলের গদিতে তাকিয়া হেলান দিয়ে আরাম করে মেয়েদের মতো বসে থাকা আর শান-শৌকত আর ভোগবিলাসকেই জীবনের দস্তুর বানিয়ে রেখেছে? যে দেশের নেতৃবর্গরা এইরকম, তাদের দেশ ও ঘরবাড়ি বিদেশিদের কবজায় ভোগদখলে চলে যাবে না তো কি হবে? এহতেশামউদ্দীনের এই বক্তব্য কিন্তু ইংরেজপ্রীতি নয়। তাঁর এই খেদোক্তি স্বদেশ ও জাতির জাগরণের স্বার্থেই।

শীতে্র শুরুতেই ক্যাপ্টেন সুইনটন আর তিনি গিয়েছিলেন স্কটল্যান্ডে। যাওয়ার পথে বরফে ঢাকা রাস্তার মানুষজনের চলাফেরা, স্কেটিং করা দেখে অবাক হয়েছেন। স্কটল্যান্ডের বাসিন্দাদের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির প্রশংসা করেছেন। ইংল্যান্ডের সঙ্গে সংযুক্তি যে সেখানকার অর্থনীতি এবং সামাজিক অবস্থানকে ক্রমোন্নতির দিকে নিয়ে গিয়েছিল, সে বিষয়ে এহতেশামউদ্দীনের কোনো সন্দেহ নেই। এ-বিষয়ে তাঁর উক্তি আজকের দিনেও অনেক দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তিনি লিখেছেন, ‘Friendship between two peoples increase the wealth of both while enmity begets poverty’ একেবারে আজকের ব্যবস্থাপনাশাস্ত্রের (ম্যানেজমেন্ট) বর্ণনা বলা যার অর্থনীতির চাহিদা আর সরবরাহের টানাপোড়েনের কথা লিখেছেন এক জায়গায়, ‘Here is yet another example of the truth that excellences that abound in a country are depreciated while ordinary articles that are rate but of no value in their country of origin are very dear. Thus tamarinds sell for a pice a seer in India, and in Vilayet for one ashrafi or more.’ একেবারে খাঁটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূলকথা।

আরেক জায়গার ব্রিটিশ রাজনীতিতে রাজা এবং জনপ্রতিনিধি প্রমুখ বিশিষ্টজনদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, যখন দখেত্রে’ত্রু আক্রমণের শাংকা দেখা দেয়, যুদ্ধাবস্থা উপস্থিত হয় তখন রাজা দেশের বিশিষ্ট লোককে ডাকেন এক মজলিসে। সেখানে তিনি বিনয়ের সঙ্গে খুলে বলেন দেশের সংকটের কথা। সকলের সাহায্য চান সংকট নিরসনে “We are faced with a crisis if you rise to meet it you will help preserve our sovereignty and add to the nation’s glory. The assembly rises as one man… and replies, ‘We owe you full obedience and we are ready for any sacrifice to defeat the enemy.’ But were the King to order arrogantly. ‘Go and fight the assembly would curtly reply, we are not your slaves Go and fight for yourself.’ একেবারে উঁচুদরের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায় এই বর্ণনাতে। আজকের যে কোনো ব্যবস্থাপনা বিষয়ক পাঠ্যবইতে উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যায় এই বর্ণনা।

বিলেতে থাকাকালে সবচেয়ে যে বিষয়টি নিয়ে মির্জা এহতেশামউদ্দীনকে কথাবার্তা বলতে হয়েছে, প্রশ্নোত্তরের মুখোমুখি হয়েছে, তা হচ্ছে ধর্ম। তাঁর গ্রন্থের দীর্ঘ দুটি অধ্যায় জুড়ে বর্ণনা আছে তার। পরিচিত লোকজন তো বটেই, তার সহযাত্রী ক্যাপ্টেন সুইনটন, মি. পিককও নানারকমের প্রশ্ন করেছেন তাঁকে ভারতবর্ষের লোকজনের ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম সম্পর্কে। অন্যদিকে এহতেশামউদ্দীনও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানার চেষ্টা করেছেন খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে, ব্রিটিশ জাতির ধর্মচর্চা সম্পর্কে। সমগ্র ইউরোপে যখন ইহুদিদের উপর অত্যাচার নিগ্রহ চলছিল তখন ব্রিটেনে ইহুদিদের প্রতি সহনশীলতায় আনন্দিত হয়েছেন তিনি ‘….the English pursue a policy of tolerance and do not prevent adherences of any faith from practicising their religion। নামাজ রোজা করা ধর্মপ্রাণ এই মানুষটির কাছে উপাসনা-প্রার্থনার প্রতি ব্রিটিশদের অনীহা ভালো লাগেনি। এ-বিষয়ে ব্রিটিশদের যুক্তি … God has sent man to this world to enrich and beautify it…we try to build better houses, improve agriculture, invent new machines, add to knowledge… find better food and shelter for the myriad creatures in our care…we are truly fulfilling our divinely ordained role. If man spends all his time in player and grows weak from fasting and chanting on empty stomach the activities of the world will be neglected…. মির্জা এহতেশামউদ্দীন গ্রহণ করেননি এই যুক্তি । প্রার্থনা করেছেন, “Allah save us from such misguided ideas.’ স্বভাবতই তাঁর লেখা পড়তে পড়তে মনে হয় ধর্মীয় গোঁড়ামি যেটা বলছি তা বোধহয় ঠিক নয়। ধর্মের প্রতি আন্তরিক নিষ্ঠা বলাই ভাল। বিদেশে বিপাকে পড়েও তিনি তাঁর নিষ্ঠা থেকে সরে আসেননি, এমনকি আপৎকালেও নয়। যেহেতু ধর্মে নিষেধ আছে সেজন্যে নিজে জীবনে মদ স্পর্শ করেননি হাজার প্রলোভন ও অসুবিধা সত্ত্বেও।

তাছাড়া অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে কোরআন এবং কোরআনের বাহক হজরত মোহাম্মদের (সঃ) বাণী তথা হাদিস নিয়ে। ইসলামে। মদ্যপান নিষিদ্ধকরণ নিয়ে খোঁচা মেরে কথা বলছে ইংরেজ বন্ধুরা। তারা ইসলামকে যুদ্ধবাজ ধর্ম বলেছেন। মির্জা এহতেশামউদ্দীন বুঝিয়েছেন কী এবং কোন পরিস্থিতিতে হজরত মোহাম্মদকে (সঃ) যুদ্ধ করাতে হয়েছে। আবার অনেক সময় ওরাই বলেছে, তোমাদের রসুল হজরত মোহাম্মদ (সঃ) জ্ঞান-বুদ্ধিতে তাঁর সময়ে অদ্বিতীয় ছিলেন — আবার ওদের যুক্তির সঙ্গে একমতও হয়েছেন কখনো কখনো। যেমন ওদের পারিবারিক আইন, বিশেষ করে এদের উত্তরাধিকার আইন না বংশপরম্পরায় জমিজমাকে টুকরো টুকরো করে চাষবাস মুশকিল করে দেয় না, সেটি ওঁর পছন্দ হয়েছে।

বিলাতের বিচারব্যবস্থা, রাজস্ব আদায়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গঠন ও প্রকৃতি, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ইত্যাদি সব প্রতিষ্ঠান বেশ ভালো করে খুঁটিয়ে দেখেছেন মির্জা এহতেশাম। অনেক ক্ষেত্রে মতামতও দিয়েছেন নিজের। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিনয়, নম্রতা ও বীরত্ব নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার কথা চিন্তা করে দেখেছেন তিনি। লিখেছেন, “The English (soldiers) avoid self praise and even consider it disgraceful to talk of their Exploits. তুলনামূলকভাবে দিল্লির সিপাহিদের কথা বলেছেন ব্যঙ্গ করে, the sepoys and officers in India, particularly in Delhi, think that egotism and flattery add to their consequences. Thus if a person with great difficulty succeeds in killing a fox, he will go about loudly proclaiming that he has killed a lion বিলেতের বিচারকদের নিষ্ঠা ও সততায় মুগ্ধ হয়ে লিখেছেন, ‘ A strict code of conduct in enjoyed. Neither bribes not gifts are permitted, if one party attempts to bribery, even if its cause is just, the judges will assume otherwise.’ আড়াই শত বছর আগের ভ্রমণকারী মির্জা শেখ এহতেশামউদ্দীন এভাবেই যেন কথা বলেছেন।

এহতেশামউদ্দীন অক্সফোর্ডে গিয়ে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় দেখে খুব মুগ্ধ হয়েছিলেন। এই সময় অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিবিদ্যালয়ে তিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দেন। এই দুই বিবিদ্যালয়ের পা থেকে এহতেশামউদ্দীনকে বিশেষ সম্মানও জানানো হয়। এহতেশামউদ্দীনের বাস্তব অভিজ্ঞতার এসব বিবরণ ও বিশ্লেষণ এদেশের মানুষের চৈতন্যোপর হওয়ার পর সহায়ক হতে পারত, কিন্তু তখনকার ক্ষয়িষ্ণু, চিন্তাশূন্য, সম্বিৎহারা জাতির চিত্তে তা কোনো রেখাপাত করেনি।

এহতেশামউদ্দীন অক্সফোর্ড বিবিদ্যালয়ের প্রস্থাগারে পণ্ডিত প্রবর উইলিয়াম জোনস ও ড. হান্টের সঙ্গে পরিচিত হন। অধ্যাপক হাণ্ট এবং জোনস উভয়ই তাঁর পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করেছিলেন। কিন্তু এহতেশ্উমদ্দীন জোনসের ফারসি এবং আরবির জ্ঞানে বিশেষ মুগ্ধ হতে পারেননি। বিলেত যাত্রাপথে এহতেশামউদ্দীন জাহাজে সুইনটনকে বিখ্যাত আরবি গ্রন্থ ‘কালিলা ওয়া দামনা’ পড়িয়েছিলেন এবং একই সঙ্গে ‘ফরহাঙ -ই-জাহাঙ্গীরী’ নামক গ্রন্থের ফারসি ব্যাকরণ অংশ ইংরেজিতে অনুবাদে সাহায্য করেছিলেন। অক্সফোর্ড পরিদর্শনকালে এই অনুবাদ জোন্সকে প্রদান করা হয় এবং এই অনুবাদের সাহায্যেই জোন্স তাঁর সুবিখ্যাত ফারসি ব্যাকরণ। সন করেন। উইলিয়াম জোনস্ পরবর্তীকালে কলকাতা হাইকোর্টের জজ হন। তিনিই কলাকাতার ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’- র (১৭৮৪) প্রতিষ্ঠাতা।

ক্যাপ্টেন সুইনটন এহতেশামউদ্দীনকে ফারসি অনুবাদক হিসেবে ইংল্যান্ডে থেকে যেতে অনুরোধ করেছিলেন বারবার। প্রাচ্য ভাষা গবেষণার সহায়করুপে তাকে আন্তরিকভাবে পেতে চেয়েছিলেন, বারবার উপেক্ষিত হয়ে তিনি ইংল্যাণ্ডের জ্ঞানীগুণীদের দিয়েও অনুরোধ করেছিলেন। এমনকি সুব্যবস্থার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মির্জা এহতেশামউদ্দীনের গৃহমুখীতা আর বিলম্ব করতে চায়নি। তিনি স্বদেশেই ফিরতে চেয়েছেন মনে-প্রাণে ।

ইংল্যান্ডের অধিবাসীর কাছ থেকে তিনি বরাবর ভাল ব্যবহার পেয়েছেন। তারা তাঁকে সদ্য পরাজিত একটি দেশের নাগরিক হিসেবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখেননি, তিনিও নিজেকে পরাধীন মনে করেননি। তিনি স্বদেশ স্বজনের কথা কখনও ভুলেননি। বরং মাতৃভূমির হাতছানি তাঁকে বারবার আকৃষ্ট করেছে। তিনি বলেছেন কিন্তু দেশ ও আত্মীয়-স্বজনের বিচ্ছেদ-বেদনা তাকে এত অধীর করে তুলেছিল যে, এই সকল সুব্যবস্থা তাকে মোটেই আকৃষ্ট করতে পারেনি। সুলেমানের সিংহাসনের চেয়ে মাতৃভূমির মমতা মহত্তর। জন্মভূমির কাঁটাও পরদেশের সুগন্ধি ফুল অপেক্ষা মধুরতর। হজরত ইউসুফের কাছে মিশরে রাজত্ব করার চেয়ে কেনানে ভিখারী হওয়া অধিকতর প্রিয় মনে হত। জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে এহাতেশামউদ্দীন আরও বলেছিলেন, “আমার স্বদেশের দৈন্য, ইংল্যাণ্ডের ধন ঐশ্বর্যের বহুগুণে মহত্তর। হিন্দুস্তানের কৃষ্ণকায়া রমণী আমার নিকট ইংল্যান্ডের পরী বিনিন্দিতা স্বেতাহিনীর চেয়ে অধিকতর কামনার ধন।”

বিলেতের সমাজ এবং মানুষের জীবনযাত্রা দেখে তিনি খুব বিস্মিত হয়েছিলেন। নিজের দেশের সঙ্গে তিনি তাই বারবার এসবের তুলনা করেছেন। তিনি বিলেতের যা কিছু ভালো দেখেছিলেন, তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে কুণ্ঠিত হননি। প্রথমেই তাঁর চোখে পড়েছিল বিলেতের নারী। তাঁদের সৌন্দর্যের প্রশংসা করে তিনি লিখেছেন যে, তাঁরা হলেন হর বা স্বর্গীয় অপারীদের মতো—তাঁদের দেখলে পরীরাও লজ্জায় মুখ ঢাকবে। বিলেতে পছন্দ করে বিয়ে করার যে পদ্ধতি চালু ছিল, তিনি তারও প্রশংসা করেছেন, তবে এর ফলে অসুন্দরী এবং গরিব মেয়েদের অনেকের বিয়েই হয় না- -এটা তাঁর ভালো লাগেনি। সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি রীতিমতো উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। মেয়েরাও যে লেখাপড়া এবং নাচ-গান শেখেন তাও উল্লেখ করতে ভুলে যাননি। পার্কে গিয়ে নারী পুরো মেলামেশা করেন, এমনকি প্রেম করেন এবং পুলিশ তাতে বাধা দেয় না—এটা না করে তিনি খুব অবাক হয়েছিলেন। বিলেতি মানুষ কী ধরণের খাদ্য উৎপাদন করে এবং কী খান তারও মোটামুটি পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর বিবরণ থেকে। উচ্ছ্বসিতভাবে তিনি বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছিলেন যার, তা হল সেখানে প্রযুক্তির উন্নতির ফলে উৎপাদন ক্ষেত্রে যেসব সুবিধা হয়েছে সে বিষয়ে। এর অনেকগুলো দৃষ্টান্ত তিনি দিয়েছিলেন।

তাছাড়া কালো আদমী হিসেবে তিনি যে সাধারণ মানুষের কাছে নিজেই একটা দ্রষ্টব্য বস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন, এহতেশামউদ্দীন তা লিখতে ভুলে যাননি। তবে তাঁর মনে হয়েছে যে, সাধারণ মানুষ তাঁকে সম্মান এবং সহানুভূতির সঙ্গেই দেখেছেন। এমনকি একবার সংকোচ ওঠার পর মেয়েরাও তাঁকে বাজারে দেখলে কেউ কেউ তাঁদের সৌজন্যমূলক চুম্বন দেওয়ার আহ্বান জানাতেন। তাঁর চলাফেরা, জীবনযাত্রা এবং জাঁকজমক দিয়ে তিনি ইংরেজদের চোখে ভারতীয়দের সম্পর্কে একটা উজ্জ্বল ভাবমূর্তি রচনা করতে পেরেছিলেন। ভ্রমণকাহিনিতে তিনি লিখেছেন যে, বিলেতের লোকেরা হিন্দুস্তানী অর্থাৎ ভারতীয় বললে বুঝতেন চট্টগ্রাম অথবা ঢাকা থেকে যাওয়া জাহাজের খালাসিদের। কিন্তু তাঁকে দেখে বুঝতে পারলেন যে, অন্য ধরণের ভারতীয়ও আছেন।

এহতেশামউদ্দীনের সুদীর্ঘ যাত্রাপথকে এইভাবে বিন্যস্ত করা যায়—১. সমুদ্রযাত্রার ৫৭ দিন পরে এহতেশামউদ্দীন মরিশাস দ্বীপে পৌঁছন এবং সেখানে ১৬ দিন কাটান। ২. এহতেশামউদ্দীন মরিশাস দ্বীপ থেকে জাহাজে দক্ষিণ-পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে উত্তমাশা অন্তরীপে পৌঁছন। ৩. কেপটাউনে ২ সপ্তাহ অবস্থান করে এহতেশামউদ্দীনের জাহাজ। ৪. কেপটাউন থেকে এহতেশামউদ্দীনের জাহাজ উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত অ্যাসেনশন দ্বীপে উপস্থিত হয়। ৫. এরপর এহতেশামউদ্দীন ফ্রান্সের নান্টুজ বন্দরে উপনীত হন এবং সেখানে তিনি ১৬ দিন কাটান। ৬. নান্টুজের পর এহতেশামউদ্দীনের জাহাজ ক্যালে বন্দরে পৌঁছয় এবং ক্যালেতে তিনি ১৫ দিন অবস্থান করেন। ৭. এহতেশামউদ্দীন ১ দিনের মধ্যে ইংল্যাণ্ডের সামুদ্রিক বন্দর ডোভার-এ পৌঁছন। ৮. মির্জা এহতেশামউদ্দীন তিন মাস লণ্ডনে অবস্থান করেন। ৯. ক্যাপ্টেন সুইনটনকে সঙ্গে নিয়ে অক্সফোর্ড গমন করেন এহতেশামউদ্দীন। ১০. এরপর নির্জা এহতেশামউদ্দীন সুইনটানের সঙ্গে স্কটল্যাণ্ডের এডিনবরায় পৌঁছন। ১১. স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত তিনি এডিনবরায় ক্যাপ্টেন সুইনটনের পৈতৃক গৃহেই অবস্থান করেন। ১২ মামলার জন্য সুইনটনের সহযোগিতায় এহতেশামউদ্দীনের পুনরায় লণ্ডন গমন। ১৩. লন্ডনে ১ সপ্তাহ কাটিয়ে এহতেশামউদ্দীন আবার এডিনবরার প্রত্যাবর্তন করেন।

অবশেষে এহতেশামউদ্দীন কলকাতা কাউন্সিলের ভূতপূর্ব সেক্রেটারি মি. মিচন্ডের জাহাজে পাড়ি দিয়ে ১৯৭৩ সনের কার্তিক নাসে স্বদেশে ফিরে আসেন। জাহাজে যাতায়াতে ১ বছর, ইংল্যাড়াও স্কটল্যান্ডে ১ বছর এবং মাদ্রাজে ৭ মাস মোট ২ বছর ৭ মাস কেটেছিল। এসব তথ্য তাঁর রচিত শিগুর্ফনামা থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি এহতেশামউদ্দীনের একাধারে আত্মচরিত ও ভ্রমনবৃত্তান্ত দুইই। এটিই তাঁরা ব্যক্তিগত জীবনের ইতিহাস জানার উৎস।

এহতেশামউদ্দীনের পিতা শেখ তাজউদ্দীন এবং পিতামহ শিহাবউদ্দীন আহমদ তালিশ। শিহাবউদ্দীন তালিশ ছিলেন ‘তারিখ-ই আসাম’ গ্রন্থের লেখক। এটি মীর জুমলা কর্তৃক আসাম অভিযানের (১৬৬০-৬৪) ইতিহাস গ্রন্থ। এহতেশামউদ্দীনের জন্ম ১৭৩০ থেকে ৩২-এর মধ্যে নদিয়া জেলার পাঁচনুর গ্রামে। এহতেশাম নিজে লিখেছেন ‘নদীয়া জেলার অধীনে পাঁচনুর পরগণার কসবা গ্রাম আমার জন্মস্থান। এই গ্রামটি বর্তমানে নদীয়া জেলার চাকদহ থানার অন্তর্গত। শিয়ালদহ রানাঘাট সেকশনের চাকদহ স্টেশনের দক্ষিণে এক মাইল দূরে এই গ্রাম অবস্থিত। যখন গভর্ণর জেনারেল ছিলেন লর্ড ডালহৌসি, সেই সময় (১৮৫৫) রেলের রেভিনিউ সার্ভের ম্যাপে এই গ্রামটির নাম পরিবর্তিত হয়ে যায়। পাঁচনুর থেকে এর নাম হয় কাজীপাড়া। পাঁচনুর অঞ্চলে বসবাসকারী কাজীগণের নামানুসারেই কাজীপাড়া নামটি গৃহীত হয়।

এখন এই কাজীপাড়া নামেই মানুষ এই গ্রামটিকে বেশি চেনেন। এর থেকেও বড় ব্যাপার হল, লণ্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত এহতেশামউদ্দীনের লেখা ফারসি গ্রন্থটি ইতিহাস গবেষকদের কাছে একটি মহামূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে আজও পরিচিত। এহতেশামউদ্দীনের লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থটি হল ‘নসবনামা ‘। এর অর্থ হল পারিবারিক ইতিহাস। এই বইটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, পাঁচনুরে প্রাচীন সময়ে একটি বন্দর ছিল। বেশ বড় শহর ছিল এই গ্রাম। এর তলদেশ থেকে বয়ে যেত গঙ্গা। উপর দিয়ে যেসব জাহাজ এবং নৌকা যাতায়াত করত গ্রাম থেকে তা দেখা যেত। ক্রমে নদী সরে আসতে থাকে পাঁচনুর গ্রাম থেকে আরো পশ্চিমের দিকে। নদী বন্দর চলে আসে সপ্তগ্রামে। এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, পাঁচনুর গ্রামের পতনের পরে একজন সম্ভ্রান্ত খাজা সেখানকার জমিদার রাজারাম রায় ও রুদ্র রায়ের নাতিদের কাছ থেকে পাঁচনুর গ্রামকে কিনে নেন, মানে ইজারা নেন। খাজা সাহেবের বংশের মানুষেরাই ওই গ্রামের নাম পরিবর্তন করে কাজীপাড়া রাখেন। সুদূর আরব দেশ থেকে মির্জা মহম্মদ জামাল প্রথম পাঁচনুরে বসবাস শুরু করেন। তখন বাংলা শাসন করছে নবাব নীরজাফর আলি খান।

এহতেশামউদ্দীন বাঙালি ছিলেন? তাঁর ভাষিক পরিচয় সম্বন্ধে আমাদের কৌতূহল জাগা স্বাভাবিক। তাঁর একটি উক্তি থেকে সে বিষয়েও ধারণা করা যায়। তিনি লিখেছেন ” (মুর্শিদাবাদের নবাব) মরহুম জাফর আলি খানের নিজামতকালে এই অধম মুনশী সলিমুল্লাহ এবং নবাবের নীর মুনশি মির্জা কাসিমের সাহচর্যে দীর্ঘকাল কাটিয়েছিল এবং তাদের প্রভাবে লেখাপড়ায় কিছু দা তা লাভ করেছিল। ১৪৩ এই বক্তব্যের ভিত্তিতে গোলাম মুরশিদ এহতেশামুদ্দীন বাঙালিত্বের সমর্থনে লিখেছেন, “মুর্শিদাবাদের নবাব মীর জাফরের অধীনে চাকরি করার সময়ে সৌভাগ্যত্রক্রমে তিনি মুন্সি সলিমউল্লাহের কাছে ফারসি পড়তে এবং লিখতে শেখেন। এ কথার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, তার আগে পর্যন্ত তিনি ফারসি জানতেন না। অবশ্য তার পরেও একটা সন্দেহ থেকে যায়। মনে করা যেতে পারে যে, সেকালের অন্য অভিজাত মুসলমানদের মতো তিনিও উর্দুভাষী ছিলেন। এই মুসলমানরা বঙ্গদেশে বাস করলেও বাংলায় কথা বলতেন না। বাংলায় কথা বলতেন গ্রামের সাধারণ মুসলমানরা। আমাদের বিবেচনায়, তিনি উর্দুভাষী মুসলমান ছিলেন বলে মনে হয় না। কারণ, তাঁর বাঙালিত্ব সম্পর্কে আরও পরো প্রমাণ আছে। তিনি যখন স্কটল্যান্ডে ছিলেন তখন ক্যাপ্টেন সুইনটনের সঙ্গে একদিন তর্কের সময়ে সুইনটন তাঁকে বাঙালি বলে গাল দিয়েছিলেন। তা ছাড়া, তারিখ লেখার সময়েও তিনি হিজরি মাসের সঙ্গে বাংলা মাসের নাম লিখেছেন। তিনি যেসব ফুলের নাম উল্লেখ করেছেন, তা থেকেও মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, তিনি বাঙালি ছিলেন।”

১৩২৪ সনে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘প্রতিভা’য় এহতেশামউদ্দীনের ইউরোপ ভ্রমণ সম্পর্কে এক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে পত্রিকার হিন্দু পরিচালকমণ্ডলী তাঁকে বাঙালি বলেই সম্বোধন করেছেন। এহতেশামউদ্দীনের বাঙালিত্বের আরও একটি বড় প্রমাণ তার নিজের লেখাতে আমরা দেখতে পাই, যে বিষয়টি তাঁকে বাঙালি বলে দাবিকারীরা এড়িয়ে গেছেন। তিনি লিখেছেন, বিলেত থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় তাদের জাহাজ ‘কেপ’-এ দুই সপ্তাহ নোঙর করেছিল। সেই সময় ওখানকার কিছু কিছু সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, ওলন্দাজরা বাংলা থেকে বালক-বালিকাদের কিনে নিয়ে গিয়ে ‘কেপ’-এ রেখেছে তাদের কাজকর্ম করার জন্য। সেইরকম কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি দেখেন তারা অবশ্য বাংলা বা হিন্দুস্তানি ভাষা প্রায় সবই ভুলে গেছে।” তিনি ইশারায় তাদের সাথে কথা বলেন এবং ওদের বক্তব্যের বিষয়বস্তু বুঝতে পারেন। এ কথার অর্থ দাঁড়ায় তিনি তাদের সাথে বাংলা-সহ তাঁর জানা অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় কথোপকথনের চেষ্টা করেছিলেন। আর যেহেতু ওলন্দাজরা বাংলা থেকে এই সমস্ত ছেলেমেয়েদের কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন, ফলে তাঁরা ভারতের অন্য প্রাদেশিক ভাষাভাষী ছিলেন এ জাতীয় প্রওে এই ত্রে প্রযোজ্য নয়। তাছাড়া তিনি তাদের আতিথ্যে মাছ, আম, পেয়ারা ইত্যাদি বাঙালি খাদ্য সামগ্রী লাভ করেছিলেন সে কথাও উল্লেখ করেছেন।অর্থাৎ এহতেশামউদ্দীনের বাঙালিত্ব নিয়ে ওঠা এটি যে যথাযথ নয় তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।এহতেশামউদ্দীন মির্জা মোহাম্মদ কাসিমের সহায়তায় আরবি ভাষাও আয়ত্ত করেছিলেন। হিন্দি ভাষাও কিঞ্চিৎ তাঁর আয়ত্ত ছিল।

এহতেশামউদ্দীনের কর্মজীবনের সূত্রপাত মূলত মেজর পার্কের অধীনে ইংরেজ শিবিরে। তারপর কিছুদিন কুতুবপুরের তহশিলদারের চাকরি করেন। এখানেও তিনি স্থায়ী ছিলেন। জীবনের নানা পর্বে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। নিজের বিলেত ভ্রমণের বর্ণনার শুরুতে এহতেশামউদ্দীন নিজের পরিচয় সম্পর্কে লিখেছেন, “নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত পাঁচমুর গ্রামের অধিবাসী মরমন শেখ তাজউদ্দিনের পুত্র শেখ ইতিসামুদ্দিন নামক এই পাপী ব্যক্তি এখন তার অদ্ভুত কাহিনি লিপিবদ্ধ করতে এবং তার কাহিনিকে অলঙ্কৃত করতে কলম তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে।” নিজের রচনা সম্পর্কে তিনি আগে লিখেছেন, “কয়েকটি অদ্ভুত ঘটনার এই বিবৃতির সে নামকরণ করেছে ‘শিগুর্ফনামা -এ-বেলায়েত’ এবং কালের খাতায় তার স্মৃতিচিহ্ন রূপে এই পুস্তকটি রেখে যাচ্ছে।”

এহতেশামউদ্দীনের কর্মময় জীবন তাঁর বিবরণ মতে ছিল “নবাব মীর কাসিম খানের আমলে সে (এহতেশামউদ্দীন) মেজর পার্কের অধীনে চাকুরি নেয় এবং বীরভূমের রাজা আসাদুজ্জামান খানের বিরুদ্ধে সে মেজর পার্কের সাথে সেখানে উপস্থিত ছিল। এর পর তার মনিবের সাথে আজিমাবাদ গিয়ে শাহ আলম বাদশাহর সাথে সে সাক্ষাত লাভের সম্মান অর্জন করে। তারপর সে মেজর সাহেবের সাথে কলিকাতায় পৌঁছায়। সেই সময়ে কোম্পানির মুনশীখানায় সাহেবদের অধীনে সাতজন লোক মুনশীপদে নিযুক্ত ছিলেন—তাঁরা হলেন মুনশী আবদুল্লাহ, মুনশী ফকরউদ্দীন (মুনশী তাজউদ্দীনের পুত্র), মুনশী মোহাম্মদ আসলাম, মুনশী আবদুল বারী, মুনশী মুঈজ (মেজর কার্নাকের অধীনে), মীর সদরউদ্দীন (কর্নেল কুট বাহাদুরের অধীনে), এবং মূনশী সলিমুল্লাহ (হেনরি ভ্যান্সিটার্টের অধীনে)। পার্ক সাহেব যখন ইংল্যান্ডে যান তখন তিনি এই অধীনকে একটি প্রশংসাপত্র এবং বীরভূম ও আজিমবাদের মধ্যবর্তী অঞ্চলের একটি মানচিত্রসহ মেজর এ্যাডামের কাছে পাঠিয়ে দেন।কিন্তু যিনি এখন রাজা উপাধি ধারণ করে খ্যাতি সম্পন্ন হয়েছেন সেই মুন্সী বেনী কুষণের বিশ্বাসঘাতকতা ও শঠতার ফলে এই অধম কোন চাকুরী পেল না। অবশেষে সে মি.স্ট্রাচির সহায়তায় ক্যাপ্টেন ম্যাকিননের তত্ত্বাবধানে জালেনের চাকলার অনাথ আশ্রমের বকশী নিযুক্ত হন। এইখানে সে দুই বৎসর ছিল। এরপর ঘিরিয়া ও উর্দুয়ানালাতে কাসিম আলি খানের সঙ্গে যুদ্ধে সে উপস্থিত ছিল। তারপর… রাজমহল থেকে ফিরে সে মেদিনীপুরে পৌঁছাল। মি. বার্ডেটের অধীনে সে এক বৎসর কুতুবপুর পরগণার তহসিলদারের পদে বহাল ছিল। স্ট্রাচি সাহেব অতি মহানুভব ও হৃদয়বান ব্যক্তি ছিলেন। এইরূপ দয়াশীল ও স্নেহপরায়ণ সাহেব আর জন্মগ্রহণ করেননি। তাঁর মৃত্যুর পর এক মাস যাবৎ আমার চোখ অশ্রুসজল ছিল এবং এক বৎসর যাবৎ আমি শোকে মুহ্যমান ছিলাম। তাঁর কথা স্মরণ হলে আমার হৃদয় বিচলিত হয়ে উঠে। স্ট্র্যাচি সাহেবের মৃত্যুর পর যখন বক্সারের যুদ্ধে মেজর মনরোর হাতে পরাজিত হয়ে নবাব সুজাউদদৌলা লক্ষ্মৌ থেকে রোহিলাখণ্ডের দিকে পলায়ন করেন, তখন ১১৭৯ হিজরীতে (১৭৬৫) এই লেখক মেজর কার্নাকের অধীনে চাকুরিতে বহাল হয় এবং জাহাজগড়ে সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাতের সৌভাগ্য অর্জন করে। তারপর সে এলাহাবাদ যায় এবং সেখান থেকে লমৌ পৌঁছায়।”

এর কিছুদিন পরে এলাহাবাদে বাদশাহ শাহ আলমের সাথে লর্ড ক্লাইভের সন্ধি হয়, যার সূত্র ধরে এহতেশামউদ্দীনের এই বিলেত গমন। বিলেত থেকে ফেরার পরবর্তী জীবন সম্পর্কে এহতেশামউদ্দীন লিখেছেন, “১১৮৯ হিজরীতে (১৭৭৫) এই লেখককে…কর্নেল জন হ্যামিল্টনের সাথে পুনা-সাতরায় যেতে হয়েছিল। কর্নেল হ্যামিল্টন মারাঠা সর্দারদের সাথে চুক্তি সম্পন্ন করবার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন। উক্ত কর্নেল সাহেবের জন্য সওয়াল-জবাব বহন করা ও পেশওয়া দরবারের প্রধান পণ্ডিত সখারাম বাবু এবং বালাজী ওরফে নানা ফড়নবিশের নিকট যাওয়া-আসা ও চুক্তি লেখাপড়া করার সমস্ত কাজই দোভাষী ও অনুবাদক ক্যাপ্টেন ভ্যান্সিটার্টের সহযোগিতায় এই অধমকেই করতে হয়েছিল। অল্প কথায় বলতে গেলে, সে তার সমস্ত যৌবন ইংরেজ সাহেবদের অধীনে কোম্পানির কাজেই কাটিয়েছে। এখন যখন সবদিক দিয়েই তার কষ্টে দিন কাটছে, তখন সেসব সুযোগ তার কাছে পরম সৌভাগ্যের কাল বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।”

গ্রন্থ রচনার প্রেরণা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হল, “হিজরী ১১৯৯ সনে (১৭৮৪) যখন এই দীন লেখক অতি মাত্রায় উদ্বিগ্ন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিল, চারদিকের বিশৃঙ্খলায় যখন সে দুর্দশাগ্রস্ত এবং তার মন অশান্ত ও তার চিন্তাশক্তি লুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল, তখন বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে (এই বৃত্তান্ত) লিখতে বাধ্য হয়। ..তার উদ্দেশ্য পাঠকের উপকারের জন্য তার বিদেশ যাত্রার সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করা। সে অত্যন্ত সংযত ভাষা ব্যবহার করেছে, কারণ ভাষা নিয়ে চতুরতা বা ভেল্কিবাজী ভাষা ও চিত্তাশক্তির বিলাসিতা ও অপব্যয় মাত্র।”

১০

এহতেশামউদ্দীন যখন ইংল্যান্ড যান তখন তাঁর মনে তারুণ্যের উৎসাহ ছিল। তিনি যখন বিভিন্ন অফিসারের অধীনে কর্মরত তখন তাঁর যৌবনকাল আর যখন গ্রন্থ রচনা করেন (১৭৮৪) তখন তাঁর ভগ্নদশা অবস্থা। তাঁর বিবাহিত জীবন, সন্তান সন্ততি, মৃত্যুকাল ইত্যাদি বিষয় অজ্ঞাত। এহতেশামউদ্দীনের জীবনালেখ্য থেকে একটা বিষয় প্রতীয়মান হয় যে, রাজ্য হারানোর বেদনায় বাংলার মুসলমানগণ ইংরেজের সংসর্গ ত্যাগ করেছিল এবং শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছিল এ কথা সত্য নয়। কলকাতায় কোম্পানির মুনশীখানায় সাতজন মুসলমান কর্মচারী ছিলেন। এহতেশামউদ্দীন নিজেও মুনশীগিরির চাকরি করেন। এরূপ মুনশীগিরি দেওয়ানগিরি-গোমস্তাগিরি-মুৎসুদ্দিগিরি দ্বারা অর্থোপার্জন করে কলকাতার হিন্দু বাঙালি ধনী হন এবং মধ্যবিত্তের গোড়াপত্তন করেন। এহতেশামউদ্দীন ইংরেজের সহযোগী থেকেও শেষ পর্যন্ত নিঃস্ব অবস্থার কালাতিপাত করেছেন। বিচার বিভাগেও অনেক পদস্থ মুসলমান আইনজীবী ও কর্মচারী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে থেকে কেউ নব্য ধনিক শ্রেণিভুক্ত হয়েছেন, এমন নজির নেই। বরং তাঁরা বেশির ভাগ নিঃশেষ হয়ে গেছেন—এটাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা। হিন্দু-মুসলমানের ভাগ্য কেন দুই দিকে গেল, ঐতিহাসিকভাবে তার কারণ অনুসন্ধান এবং ব্যাখ্যা আজও হয়নি, কেবল জনপ্রিয় মতগুলো নিয়ে আলোচনা-গবেষণা হয়ে আসছে
এ বি এম হাবিবুল্লাহ এহতেশামউদ্দীনের গ্রহের বিষয় ও গ্রন্থকারের মনোভাব সম্পর্কে তার ‘বিলাতে প্রথম ভারতবাসী’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “ভারতের বাহিরে যাহা কিছু উল্লেখযোগ্য বস্তু তাঁহার চোখে পড়িয়াছে তাহারই তিনি সবিস্তারে বর্ণনা করিয়াছেন। উড়ন্ত মৎস্য হইতে আরম্ভ করিয়া ব্রিটিশ রাজতন্ত্র পর্যন্ত কিছুই তাঁহার চক্ষু এড়ায় নাই। বৃটিশের স্বজাতিপ্রীতি স্বীয় স্বাধীনতা, তীক্ষ্ণ ব্যবসায়ী বুদ্ধি , তাহাদের এন্টারপ্রাইজিং মন ইত্যাদি সমস্তই তিনি পর্যবেক্ষণ করিয়াছেন। বাংলার পরাধীনতা ও মোঘল সাম্রাজ্যের পতন, ইংরেজের সমগ্র ভারতে রাজ্য স্থাপন অদূর ভবিষ্যতে যে অবশ্যম্ভাবী তাহাও বুঝিয়াছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি তাঁহার ছিল না—লুপ্তপ্রায় স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের কোন আলোচনাই তাহার গ্রন্থে পাওয়া যায় না। জাতির অধঃপতনের তখন সবেমাত্র প্রারম্ভ—তাহার কারণসমূহের ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের সময় তখনও আসে এহেতাসামউদ্দীনের মন সেকালের ‘টিপিক্যাল’ গৃহবাসী নিরীহ ফ্যাটালিস্ট বাঙালি ‘ইনটেলেকচুয়ালে’র মন, যাহাদের চর্ম মোগল সাম্রাজ্যের পতনোন্মুখ শক্তি ও ঐর্যের মোহ তখনও ঘুচিয়া যায় নাই। তবু মাঝে মাঝে ভারতের রাজনীতির আলোচনাও তিনি করিয়াছেন ব্রিটিশ জাতির ইতিহাস আলোচনা প্রসঙ্গে তাহাদের একতায় মুগ্ধ হইয়া তিনি ভারতের গৃহবিবাদে আরোপ করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার দুঃখ ভারতের জন্য নহে——মুঘল সম্রাটের জন্য। অথচ ভারতের বিশেষত বাঙালি মুসলমানের সামাজিক দোষ তাঁহার চোখে অত্যন্ত পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে এবং তাহার উন্নতিকল্পে আলোচনাও করিয়াছেন অত্যন্ত তীব্রভাবে।

ইংরেজ ও বাঙালির জাতি চরিত্র-সমাজনীতির তুলনামূলক আলোচনায় তাঁর সূক্ষ্ম নিরীক্ষণ শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। ইংরেজ ও বাঙালিদের বিবাহ-সংসারধর্ম পালন সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “বিলাতে লোক ৪০ বৎসর বয়স পর্যন্ত বিবাহ না করিয়া দেশ পর্যটন, বিদ্যাশিক্ষা ও অর্থোন্নতির চেষ্টা করে কিন্তু আমার দেশে বাল্যকালেই সমর্থ পিতামাতা ছেলের বিবাহ দেওয়া ফরজ’ মনে করেন এই ভয়ে যে, ভবিষ্যতে তাহাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা না-ও থাকতে পারে। যাহার পিতামাতার সামর্থ্য নাই সে যেন-তেন প্রকারে, এমনকি ঋণ করিয়া, ভিক্ষে করিয়াও স্ত্রী ঘরে আনা জীবনের সর্বপ্রথম কর্তব্য মনে করে। পরে সন্তান লালন-পালনের সামর্থ্য থাকে না—আভাবে, অনাহারে নিজে তো মরেই, তাহার নির্দোষ বংশধর গুলিকেও জীবন্মৃত করিয়া্ রাখে।

এহতেশাম সামনে থেকে মুঘল শক্তি কে অবলোকন করেছেন। মুঘল রাজপুরুষর বদের অপদার্থতা যে এর পতনের অন্যতম কারণ ছিল সে সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, “সাম্প্রতিক কালের বাদশাহদের, বিশেষ করে মোহাম্মাদ শাহের আমলস, যিনি আনন্দ উৎসবে সর্বদা মেতে থাকতেন আর রাজ্য শাসনের কোন চিন্তাই করতেন না, ভোগ-বিলাসে সময় কাটানোই রাজপুরুষদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়, রণ দামামার স্থলে খঞ্জনি ও তানপুরার আওয়াজে দেশ ভরে উঠল। নাচওয়ালীদের কারবার বেড়ে গিয়ে রোজাদার মুসল্দেলীর দিলদারীতে বাধা হয়ে দাঁড়াল। নিঃস্বরা হল আমীর আর আমীররা আয়েশের কোলে আত্মগোপন করল। ফলে প্রত্যেক সুবায় নাজিম আর্থিক ও প্রশাসনিক কাজ নিজ ইচ্ছামত চালাতে লাগল এবং সৈন্য সংগ্রহ বা সৈন্য চালনায় অমনোযোগী হয়ে পড়ল, যার ফলে দেশে বিদ্রোহী, দুর্বৃত্তদের হাঙ্গামা ও অরাজকতা সৃষ্টি করার সাহস বেড়ে গেল। এই অবস্থায় পর্তুগীজ ও অন্যান্য ফিরিঙ্গীরা প্রত্যেক সুবা, শহর ও জেলায় নাজিম ও ফৌজদারদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে লিপ্ত হয়।”

১১

এহতেশামউদ্দীনের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি ছিল না সত্য, কিন্তু একজন ঐতিহাসিকের অন্তর্দৃষ্টি ছিল। দেশের ও বিদেশের সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মনুষ্যচরিত্র সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণে তার প্রমাণ আছে। এহতেশামউদ্দীনের ভাষার স্পষ্টতা, চিত্রধর্মিতা ও সংবাদবাহিতা থেকে মনে হয়, একজন ঐতিহাসিকের মনের সাথে একজন শিল্পীর মনের মিশ্রণ ঘটেছিল। ভ্রমণবৃত্তান্তের কৌতূহল, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা ও রসবোধ তাঁর রচনায় বিদ্যমান ছিল। শুধু এহতেশাম নয়, রামমোহনের আগে ফিলিপ গাঙ্গুলি, ঘনশ্যাম দাস বিলেত গিয়েছিলেন। ১৭৬৫ সালে ঘনশ্যাম দাস বিলেত গিয়েছিলেন। ১৭৭৪ সালে কলকাতায় সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হলে ঘনশ্যাম দাস সেখানে প্রধান বিচারপতি ইলাইজা ইম্পের ফারসি অনুবাদকের কাজে নিযুক্ত হন। তারপর ১৭৭৫ সালের জুন মাসে তিনি খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন।

১৭৭২ সালে আরবি-ফারসি ভাষার শিক্ষক মোহাম্মাদ ইসমাইলকে ইংল্যাণ্ডে নিয়ে যান ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির এক স্কটিশ কর্মচারী ক্লড রাসেল। রাসেল তাঁকে নিয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত ফারসি ভাষার মুনশী হিসেবে। দুজন ভারতীয় ভূত্যকেও রাসেল নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৭৭৬ সালে মোহাম্মদ হোসেন গিয়েছিলেন ইংল্যাণ্ডে বিজ্ঞানের উন্নতি দেখতে এবং সম্ভব হলে সেখানে বিজ্ঞান শিখতে। তিনি সেখানে জ্যোর্তিবিজ্ঞান ও অ্যানাটমির উন্নতি দেখে অবাক হয়েছিলেন। উনিশ শতকের গোলাম হায়দার, মীর আবদুল আলি, মির্জা খলিল এবং মীর হাসান আলিও গিয়েছিলেন আরবি-ফারসি ভাষার শিক্ষক হিসেবে। এরা লন্ডনের কাছে হেইলিরেরি কলেজে আরবি-ফারসি শেখানোর কাজে নিযুক্ত ছিলেন।

এহতেশামউদ্দীনের মতো মির্জা আবু তালিব খানও বিলেতে গিয়েছিলেন। তাঁরও রচিত ভ্রমণবৃত্তান্ত আছে। এসব রচনায় অনেক তথ্য আছে যা নিয়ে সমাজ বিবর্তনের লুপ্ত সূত্র বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে। আঠারো শতকের শেষে ১৭৯৯ সালে উচ্চশক্ষিত মির্জা আবু তালিব খান বিলেত গিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন (ডেভিস রিচার্ডসন নামে এক স্কটিশ কর্তার সহায়তায় তিনি কলকাতা থেকে বিলেত ভ্রমণে যান (১৭৯৫-১৮০১)। তারপর ফ্রান্স, ইতালি, তুরস্ক ও ইরান হয়ে ১৮০৩ এর ৪ আগস্ট কলকাতায় ফিরে আসেন। তাঁর ‘মাসির ই-তালিবী’ (১৮০৪) নামক ভ্রমণকাহিনিতে ইংল্যাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ আছে দেশ, সমাজ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি নিয়ে। তিনি ছিলেন সমাজ ও বিজ্ঞান সচেতন মানুষ। সেজনই ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব থেকে শু্রু করে বিজ্ঞানের উন্নতি পর্যন্ত অনেক বিষয়ই তিনি তাঁর ভ্রমণকাহিনিতে আলোচনা করেছেন। অক্সফোর্ড এ গিয়ে অ্যানাটমির উন্নতি দেখে তিনি তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন। আবার গ্রীনিচে গিয়ে সেখানকার মান মন্দির ও জ্যোর্তিবিজ্ঞানের উন্নতি দেখেও মুগ্ধ হন। গ্রন্থাগার সম্পর্কেও তাঁর বিশেষ কৌতূহল ছিল। রাজা তৃতীয় জর্জ ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের কথা তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।

পরিণত বয়সে (৫২ বছর) আবু তালিব তাঁর ভ্রমণ কাহিনি লিখেন। বিষয়গুণ ও রচনাগুণের জন্য পাণ্ডুলিপি আকারেই গ্রন্থটি জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৮১০ সালে চার্লস স্টুয়ার্ট দুই খণ্ডে এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। ১৮১১ সালে ইংরেজি থেকে ফরাসিতে অনুদিত হয়ে প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয়। ১৮১৩ সালে জার্মান ভাষায় এর অনুবাদ প্রকাশিত হয় ভিয়েনা থেকে। এসব থেকেই বোঝা যায়, আবু তালিবের ভ্রমণ কাহিনির অসাধারণ জনপ্রিয়তার কথা। একজন চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবী হিসেবে আবু তালিব ইউরোপকে কি চোখে দেখেছেন, এমন কৌতূহল ইউরোপীয়দের ছিল। ভারতবর্ষের প্রতি যন্ত্রবিপ্লবোত্তর ইউরোপের স্বার্থ ভীষণভাবে বেড়ে যায়। আবু তালিবের ইতিহাস চেতনা, অন্তদৃষ্টি ও বিশ্লেষণী জ্ঞান ইউরোপীয়দের সে কৌতুহল মেটাতে পেরেছিল।

একজন ভাষাবিদ হিসেবেও আবু তালিবের খ্যাতি ছিল। তিনি আরবি-ফারসি ভালভাবে আয়ত্ত করেন। ইউরোপগামী জাহাজে বসেই তিনি ইংরেজি ভাষা রপ্ত করতে পেরেছিলেন। তিনি ইংল্যাণ্ডের পণ্ডিতগণের সঙ্গে ইংরেজিতে যে কোনো বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ কথোপকথন করতে পারতেন। তাঁর ইংরেজি ভাষাজ্ঞান সম্পর্কে লন্ডনের ‘এশিয়াটিক অ্যানুয়াল রেজিস্টার ১৮০১’-এ লেখা হয়, ‘He was early distinguished for his abilities and his love of knowledge…Before he come to England he paid some attention to our language, and he now acquire sufficient knowledge of it to read to his own satisfaction, and make himself understood in conversion।’

নির্জা আবু তালিবের কোনো রচনা গতানুগতিক ছিল না। হুমায়ুন কবির তাঁর ‘মির্জা আবু তালিব খান’ শীর্ষক গ্রন্থে (১৯৬১ সালে পাটনা ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত) তাই বলেছেন, কার্ল মার্কসের প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে মির্জা আবু তালিব খান মানব সমাজের বিপ্লবের ও বিবর্তনে অর্থনীতির ভূমিকা গুরুত্ব উপলব্ধি করেন যদিও নির্দিষ্ট তত্ত্ব দ্বারা সে ধারণাকে সূত্রবদ্ধ করেননি।”

যন্ত্রের আবিষ্কার ও তার ব্যবহার ব্রিটেনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে পরিবর্তনের সূচনা করেছে, এটা তার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে।তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যার উপযোগিতা স্বীকার করেন। ইংরেজরা যন্ত্রশক্তির বলেই অন্যান্য জাতিকে অভিজ্ঞ ম করেছে বালে আৰু তালির মনে করেন। শিল্প নির্ভর অর্থনীতি সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য ‘In England labour is much facilitated by the aid of mechanism, and by its assistance the price of commodities is much reduced. It is their great manufactures they made use of horses bullocks or men as in other countries, the prices of their goods would be enormous.’

রামমোহনের আগে বিলাত গিয়েছিলেন শেখ দীন মহম্মদ, বিলাতে বিজ্ঞানের উন্নতি নিজের চোখে দেখার জন্য। জন্মেছিলেন পাটনায়। ১৭৮৩ সালে তিনি আয়ারল্যাণ্ডের কর্কে আসেন ক্যাপ্টেন বেইকারের সঙ্গে। অল্পদিনের মধ্যে তিনি বিলেতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। ১৭৯৪ সালে তিনি কর্ক থেকে ইংরেজিতে তাঁর একটি ভ্রমণ কাহিনি প্রকাশ করেন। এক দশক পরে ভাগ্যের অন্বেষণে তিনি তাঁর সন্তানদের নিয়ে লণ্ডনে আসেন ১৮০৫ সালে। মাইকেল ফিসার তাঁর জীবন সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত কিন্তু চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন। ১৭৮০ সালের দিকে মারাঠারাজ রঘুনাথ রাও বিলেত পাঠিয়েছিলেন হনুমন্ত রাওকে। হনুমত্ত রাও ছিলেন অনেকটা এহতেশামউদ্দীনের মতো। তিনি সমুদ্র পেরিয়ে অখাদ্য খেয়ে জাত খোয়াতে রাজি ছিলেন না। এহতেশামউদ্দীনের মতো তিনি দরকার হলে না খেয়ে থাকতেন, তবু অব্রাহ্মণের রান্না করা খাদ্য খেতেন না।

১২

বস্তুত এহতেশামউদ্দীন, মির্জা আবু তালিব খান প্রমুখ যে বিলেত যেতে পেরেছিলেন, তার একটা কারণ ছিল, মুসলিমদের মধ্যে কালাপানি অর্থাৎ সমুদ্র পার হওয়ার কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। তাছাড়া বিলেতে ভাষা শেখানোর কাজে চাহিদাও ছিল লেখাপড়া জানা মুসলিমদের। তারা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারি ও ভাবী কর্মচারিদের ভারতীয় ভাষা শেখাতেন, বিশেষ করে ফারসি ও হিন্দুস্থানি। আর কালাপানি পার হওয়ার ব্যাপারে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে একটা তীব্র বিরোধিতা (জাতিচ্যুতির আশঙ্কায়) থাকলেও, পশ্চিম ভারত থেকে একাধিক হিন্দু প্রতিনিধি দল রাজা মহারাজাদের ভাতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে অথবা অন্যান্য অভিযোগের প্রতিকারের জন্যে আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই বিলেত যেতে শু্রু করেন। আসলে গৃহভৃত্য হিসেবে বাঙালিরা বিলেতে আসতে শুরু করেন সতেরো শতক থেকে। আর দেশ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসেন অঠেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে। এই পথিকৃৎদের মধ্যে ছিলেন এহতেশামউদ্দীন, ঘনশ্যাম দাস, আবু তালিব খান, রামমোহনসহ অনেকেই।

শেষে বলি, প্রথম বিলেত যাত্রী বাঙালি তথা ভারতীয় হিসেবে মির্জা শেখ এহতেশামউদ্দীন (এশীয়দের মধ্যেও তিনি প্রথম) আজও বেশিরভাগ ইতিহাসের ছাত্র, সাধারণ পাঠক, গবেষকদের স্বীকৃতি তো দূরের কথা তাদের জানারও বাইরে রয়ে গেছেন। আঠারো শতকের দ্বিতীয় ভাগের অর্থাৎ এহতেশামউদ্দীন সমসাময়িক নদীয়া তথা বাংলা তথা ভারতের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তিনি ও তার কর্মতৎপরতার প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। দুঃখের বিষয় সমকালীন ইতিহাস নিয়ে যারা চর্চা করেছেন তাদের মধ্যে মুনশী সালিমুল্লাহ, গোলাম হোসেন খান তাবতাবায়ী,, উইলিয়াম হান্টার, এল এস এস ও ‘ম্যালি, গ্যারেট, জেমস্ টেলর, দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্ররায়, যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার, কালীকিঙ্কর দত্ত প্রমুখ হতে শুরু করে পরবর্তীকালে নগেন্দ্রনাথ দাস, অলোককুমার চক্রবর্তী, অতুল সুর, কৃষ্ণ গঙ্গোপাধ্যায় , এম এ রহিম, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন, অলোক রায়, চিত্তব্রত পালিত, স্বপন বসু প্রমুখের রচনায় এহতেশামউদ্দীনের প্রসঙ্গটি অনুল্লেখিত। অথচ তাঁর ” শিগুর্ফনামা – এ-বিলায়েত’ নামক ভ্রমণকাহিনিটি অনুসন্ধিৎসু মনন নিয়ে পাঠ তথা অনুধাবন করলে নদীয়া জেলা তথা বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে এহতেশামউদ্দীনের ভূমিকাকে স্বীকার না করে পারা যায় না।

তথ্যসূত্র

১। মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন, শিগুর্ফনামা এ বিলায়েত, বাংলা অনুবাদ-এ বি এম হাবিবুল্লাহ, বিলায়েতনামা, দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০৮( মুক্তধারা, প্রথম প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৮১। আরও দেখুন-মির্জা শেখ এহতেসামউদ্দীন—দ্য ওয়ান্ডার্স অক বিলায়েত বিইং দ্য মেমোয়ার, অরিজিন্যালি ইন পার্সিয়ান, অফ এ ভিজিট টু ফ্রান্স অ্যান্ড ব্রিটেন ইন ১৭৬৫, ট্রান্সলেটেড বাই-প্রফেসার কায়সার হক, লীডস পিপল ট্রি প্রেস, ২০০১।

২। “Shigurf Namah-i-Velayet or Excellent Intelligence concerning Europe, being the Travels of Mirza I’tesamodeen in Great Britain and France. Translated from the Original Persian Manuscript by James Edward Alexander. London, 1827.

৩। দ্য ঢাকা রিভিউ ফেব্রু-মার্চ ১৯১৭, পৃ. ৩২৭-৩৩২৩ এপ্রিল ১৯১৭, পৃ. ২৭-২৯।

৪।মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন, বিলায়েতনামা দিব্যপ্রকাশ, ভূমিকা অংশ দ্রষ্টব্য, পৃ. ৭-৮।

৫।Altaf Hosen, The first Indian in England A Bengali Muslim’s Chronicle of 1765, The Statesman : 1st July 1934 Sunday দেখুন-পবিত্র চক্রবর্তী , মির্জা শেখ ইতিশামুদ্দিন জীবন ও সাহিত্য, সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, বৈশাখ-আধিন ১৪১৪, কলকাতা।

৭। Syed A S M Taifoor. Sheikh I’ tesamuddin of Nadia the first Indian to visit London, Bengal-Past and Present April-June 1935 P 117-129.

৮।এ বি এম হাবিবুল্লাহ, ইউরোপে প্রথম ভারতীয়, মোয়াজ্জিন, কার্তিক ১৩৪৩, ঢাকা, পৃ ২৩৮-৪৯।

৯।মুহম্মদ দরবেশ আলী খান, প্রথম বাঙালী ইউরোপ পর্যটক মুনশী শেখ ইহতিশামউদ্দীন মীর্জা, বাংলা একাডেমি পত্রিকা, কার্তিক-পৌষ ১৩৭১, ঢাকা।

১০। কাজী সাদরুল ওলা, হিস্ট্রি অফ দ্য ফ্যামিলি অফ মির্জা ইতিসামুদ্দিন অফ কসবা, পাঁচনু্‌ দ্য ফার্স্ট এডুকেটেড ইন্ডিয়ান অ্যান্ড বেঙ্গলি মুসলিম টু ডিজিট ইংল্যান্ড ইন ১৭৬৫ উইথ সাম ইন্টারেস্টিং ক্রনিকলস অফ হিজ টাইমস, পাঁচনুর, কাজীপাড়া, ১৯৪৪।

১১। শামস্ এন জামান, মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দীন অ্যান্ড হিজ ট্রাভেলগ শিগুর্ফনামা এ-বেলায়েত, লন্ডন, ২০০৩।

১২।. গোলাম মুরশিদ, কালাপানির হাতছানি বিলেতে বাঙালির ইতিহাস, অবসর, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ১৮-১৯।

১৩। কুমুদনাথ মল্লিক, নদিয়া কাহিনি, দ্বিতীয় সংস্করণ, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ১৯৮৬, পৃ. ২৬৬।

১৪।. এস এম ইমামুদ্দিন, দ্য তারিখ-ই-বাঙ্গালা অফ মুনশী সলিমুল্লাহ, দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৭১, ভূমিকা অংশ দ্রষ্টব্য(আরও দেখুন-সুব্রত রায়, মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দিন ও অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নদিয়ার সমাজ ও সংস্কৃতি, ইতিহাস অনুসন্ধান-২৮, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, কলকাতা, ২০১৪, পৃ. ২৯৪।

১৫। এ বি এম হাবিবুল্লাহ অনুদিত, ‘মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দীন—বিলাত ভ্রমণকথা’, ইতিহাস, বৈশাখ-শ্রাবণ, ১৩৭৪, ঢাকা, পৃ. ৭৮-৭৯।

১৬।.মির্জা শেষ ইতিসামুদ্দিন, বিলায়েতনামা দিব্যপ্রকাশ, পৃ. ২৪-২৫, ২৭-৩০।

১৭। অশ্বিনীকুমার সেন, ইউরোপযাত্রী প্রথম শিক্ষিত বাঙালি, প্রতিভা, চৈত্র, ১৩২৪, ঢাকা।

১৮।”মির্জা শেখ ইতিসামুদ্দীন—বিলাত ভ্রমণকথা’, ইতিহাস ভাদ্র-অগ্রহায়ণ ১৩৭৪, ঢাকা, পৃ. ১৮৫-৮৬।

১৯।এশিয়াটিক অ্যানুয়াল রেজিস্টার ১৮০১, খণ্ড-৩, লন্ডন, ১৮০২, পৃ. ১০১।