চেতনা টিম
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি – বা – “এক দেশ এক আইন” — বিষয়টা কি হচ্ছে আসলে?
অনেকেরই শুনে ভালো লাগবে যে, এক দেশে একই আইন তো সকল দেশেই থাকা উচিত ।এটাই আমাদের দেশের সকল নাগরিকের কাম্য হওয়া উচিত। কিন্তু ব্যাপারটা কি এতটাই সহজ? না সহজ নয় । তার প্রথম ও প্রধান কারণ হল –এটি আসলে একটি রাজনৈতিক তাস । আপনি যদি কাউকে জিজ্ঞেস করেন এতে লাভ কি ? তিনি যদি সাধারণ ভাবে আজকের দিনের একজন “হিন্দু” হন তাহলে উত্তর দেবেন – ‘মুসলমানরা কেন চারটে করে বিয়ে করতে পারবে? এটা বন্ধ করা দরকার।” অথচ সরকারী সমীক্ষা বলছে অন্য কথা । মুসলিমদের মধ্যে বহুবিবাহের পরিমাণ ১.৯ শতাংশ, হিন্দুদের মধ্যে যা ১.৩ শতাংশ । এমনকি বিজেপি-নেত্রী হেমা মালিনীর পরিবারেও বহুবিবাহ বর্তমান । আসলে এই আইনটি করলে “মুসলমানরা টাইট হবে” এই জন্যই করা দরকার – এই বলে বোঝানো হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে। অথচ তারা কখনো কাউকে বলেনি যে “হিন্দু যৌথ পরিবার আইন”, “হিন্দু বিবাহ আইন” ইত্যাদি নামে নানা বিশেষ আইন আছে হিন্দুদের জন্যও। আবার তারা কখনো বলেনি এক দেশ এক আইন হলে হিন্দু ধর্মের ভিন্ন জাতের মধ্যে বিয়ে হবে এবং সে ক্ষেত্রে বাড়ির কোন লোক তার উপর অত্যাচার করতে পারবে না ।বলেনি মন্দিরে ‘নিচু জাত’ ( এস.সি,এস.টি.) দের ঢুকতে বাধা দেওয়া হবে না কিংবা কোনো কোনো মন্দিরে হিন্দু মহিলাদের ঢুকতে বাধা দেওয়া হবে না । এমনকি বলেনি এসব হলে কোর্ট যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্ৰহনে গড়িমসি করবে না।
দ্বিতীয় কারণ হল : – এই আইন করার জন্য বিল আনা হল রাজ্যসভায় একজন সদস্যের ব্যক্তিগত বিল হিসেবে –কোনো পার্টির এমনকি বি.জে.পি-র নিজের বিল হিসেবে নয়। অর্থাৎ তাড়াতাড়ি আইন করার কোনো চেষ্টা এক্ষেত্রে নেই।কেননা তারা জানে চেষ্টা করলেও পারবে না – দেশে মোট এম.পি,এম.এল.এ দের মধ্যে বিজেপি ও তার বন্ধু দলগুলি মিলে ৪৫% ও সিট নেই। এবং বেশীরভাগ বড় রাজ্যে বিজেপি সরকার নেই।
এখন প্রশ্ন হল তারা এসব করতে চাইছে কেন ? কারণ তারা এই “ইস্যু” জিইয়ে রাখতে চায় আগামী লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে।
তারা এটা জিইয়ে রাখতে চায়-কারন তারা দেখেছে – “এরা মুসলমানদের টাইট দিয়েছে” ভোটারদেরকে এরকম ভাবমূর্তি দেখালে ভোটে সাফল্য পাওয়া যাবে । মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, কাজের জায়গায় ও জীবনে নানা অনিশ্চয়তা, অশিক্ষা ইত্যাদি সমস্যা যতই বাড়ুক অনেক লোককে স্রেফ মুসলমান-বিরোধিতা দেখিয়েই যখন খুশি করা যাচ্ছে তখন সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না । এই প্রথম গুজরাটে বিজেপি ৫০% ভোট পেল – উত্তরপ্রদেশেও ৪০% এর ওপর পেল। এটাই ওদের হিন্দুত্ব রাজনীতির সার কথা ।আর তার সাথে ঘটা করে মন্দির নির্মাণ করার হুজুগ তোলা হচ্ছে। তার সঙ্গে আছে নিজেদের মস্ত “দেশপ্রেমিক” হিসেবে দেখানোর প্রচেষ্টা। এসব করেই অবশ্য লোকজনকে খাওয়া-পরার সমস্যা থেকে ওরা ভুলিয়ে রাখতে পেরেছে এখনো পর্যন্ত।
তাদের লক্ষ্য “মুসলমান টাইট করা” বিষয়টা জনগণের মনের মধ্যে সবসময় একটা বড় বিষয় করে রেখে দিতে পারলে আগামী লোকসভা নির্বাচনে আরো ভলো ফল করতে পারবে। এবং ভারত কে “হিন্দু রাষ্ট্র” হিসেবে তৈরী করতে পারবে। তারপর ধর্মের জিগির তুলে শাস্ত্র দেখিয়ে, শুধু অহিন্দু নয় , এমনকি যারা শুদ্র হিন্দু ( এস.সি,এস.টি,ওবিসি)তাদের সকলকে ঠিকমত “সাইজ” করে রাখতে পারবে উচ্চ বর্ণের ও ধনীদের পায়ের তলায়। বড় বড় পুঁজিপতিদের লুঠের রাজত্ব আরো জোরকদমে চলবে। দেশের জনগণকে ধর্ম ও ওদের মনের মত দেশপ্রেম দিয়ে ভুলিয়ে রেখে ওদের ব্যবসা ভালোই চলবে।
আমাদের দেশে অদ্ভুত এক প্রবণতা ইদানিং খুব বেশি চোখে পড়ছে সেটা হল ওদেরই অনেক বড় বিরোধী পার্টিরাও এটা বুঝতে পেরে তারাও একই লাইনে খেলতে শুরু করেছে। সবাই ধর্ম ভাঙিয়ে ভোট ধরতে ব্যস্ত।
আম আদমি পার্টি (আপ) অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সমর্থন করছে । এমনকি টাকার নোটে লক্ষ্মী ও গণেশের ছবি ছাপাতে বলছে। বাঙালীদের বস্তি উচ্ছেদ হচ্ছে দিল্লিতে, বলছে ওরা বংলাদেশী, রোহিংগা ।কিন্তু একটাও প্রমাণ করতে পারল না । হাইকোর্ট উচ্ছেদ বন্ধের রায় দিল।
ওরা যে তৃণমূল নেত্রী মমতাকে ‘মমতাজ বেগম’ বলে কুৎসা করে, সেই তৃণমূল সরকার কোটি কোটি সরকারি টাকা পূজোর সময় ক্লাবগুলোকে অনুদান দিচ্ছে । সরকারী টাকায় পুরীর থেকেও বড় জগন্নাথ মন্দির তৈরী করছে বাংলায়। এমনকি কলকাতায় তারা নাকি বৈষ্ণবদেবীর মন্দির করবে। যেন জীবনের সব যন্ত্রণা, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারী, শোষণ, গরিবী, অশিক্ষা ইত্যাদি সব কিছুর থেকে এখন মন্দির, পুজো, এসব করাই বেশী দরকার।
কর্ণাটকে বর্ধমান জেলার পলাশ অধিকারি বৌ-বাচ্চা সহ ব্যাঙ্গালোর জেলে । তারা নাকি বাংলাদেশী! আসামের নওগাঁওতে বাঙালী বস্তি উচ্ছেদ । তারাও নাকি বাংলাদেশী। বিজেপি সরকার থাকার এই “সুফল”! অথচ প্রমাণের দায় নেই সরকারের! প্রমাণ নেইও।
সিপিএম কেরলে আদানীদের বন্দর গড়ার জন্য হাজার হাজার জেলেদেরকে উচ্ছেদ করল ও জেলেদের সংগ্রমাকে রুখতে বিজেপি-সিপিএম জোট করে লড়ছে! ওদের ভেতরে ভেতরে সেটিং – শুধু জনগণ ধরতে পারছে না এ চিটিং !
তাহলে বুঝতে পারা গেল বোধ হয় “অভিন্ন দেওয়ানি বিধি” আপনার কাছে কি দরকারি বিষয়? সত্যিই বুঝতে পারলে আপনার যা দরকার জোরগলায় বলতে শুরু করবেন এখন থেকেই ।তা নইলে এ ব্যবসার উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটতেই থাকবে।
( লেখাটি ‘এই মুহূর্তে ‘ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশ হয়। এটি তারই পরিমার্জিত সংস্করণ । ছবি ঋণ , দ্যা ওয়ার )