বিশ্ব বই দিবসঃ কিছু কথা

“There is no friend as loyal as a book “– Ernest Hemingway

একটি বই, একটি পেন, একটি শিশু এবং একজন শিক্ষক –গোটা পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। আজ ২৩ শে এপ্রিল। বিশ্ব বইদিবস। প্রতিবছর এই দিনটি উদযাপিত হয়। ইউনেস্কোর মতে — এই দিনটি পড়ার আনন্দ এবং বইয়ের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনের সুযোগের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার জন্য। বই দিবসের ধারণাটি প্রথম ১৯২২ সালে লেখক মিগুয়েল ডি সার্ভান্তেসকে সম্মান জানাতে ও বইয়ের বিক্রি বাড়াতে বার্সেলোনার সার্ভান্তেস প্রকাশনা সংস্থার পরিচালক ডিসেন্টে ক্লাভেন এই ধারণাটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন।এটি প্রথম উদযাপিত হয় ৭ই অক্টোবর ১৯২৬ সালে সার্ভান্তেসের জন্মদিনে। তারপর ১৯৩০সাল থেকে ২৩শে এপ্রিল তাঁর মৃত্যুদিনটিকে বেছে নেওয়া হয় ।১৯৯৫ সাল থেকে ইউনেস্কো ২৩শে এপ্রিল এই দিনটিকে বিশ্বব্যাপী বই দিবস হিসাবে উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। মূলত বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা ও জ্ঞান অর্জনকে উৎসাহিত করতে।

বই শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। জ্ঞান ও বোধগম্যতার প্রবেশদ্বার।বই আমাদের জড়তা, কুসংস্কার ও অজ্ঞতা সর্বোপরী সব ধরণের সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করে মনের প্রসারনশীলতা বৃদ্ধি করে। বই আমাদের যুক্তি তর্কের মাধ্যমে কোন কিছুকে গ্রহণ করতে শেখায়। সমালোচনামূলক চিন্তা ভাবনার দক্ষতা বৃদ্ধি করে। সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রকৃত সত্যকে উপলব্ধি করতে শেখায়। আমরা যখন বই পড়ি তখন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারনার মুখোমুখি হই যা আমাদের নিজস্ব মতামত তৈরি করতে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। জ্ঞান প্রদান, দক্ষতা বৃদ্ধি, আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে ও সহানুভূতি বৃদ্ধি করতে বই এর জুড়ি মেলা ভার। আজীবন শেখার উৎসাহ দেয়। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সাথে আমাদের পরিচিত হতে সাহায্য করে।

ভালো বন্ধু, ভালো বই, শান্ত বিবেক –একটি আদর্শ জীবন। আলো যেমন অন্ধকার দূর করে তেমনি বই মনের অন্ধকার দূর করে চেতনার আলোকে সব কিছুকে উদ্ভাসিত করে। বই অতীত থেকে ভবিষ্যতে, নিকট থেকে দূরে, প্রান্ত থেকে অন্তে, যুগ থেকে যুগান্তরে জ্ঞানের আলোকে পৌঁছে। বিনোদন, শিক্ষা,অবসর যাপন, আত্মশিখন , একাকিত্ব দুর এমন কি উৎকৃষ্ট বন্ধু হিসাবেও বই শ্রেষ্ঠ অবলম্বন হতে পারে। বই জ্ঞানের ভান্ডার, এক বিশাল সমুদ্র ‌। তাই বইয়ের কাছে আমরা ঋণী।

বই পড়ার যদিও নির্দিষ্ট দিন হয় না তবুও আজ বিশ্ব বই দিবসে বই পড়ার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে ভাবনা চিন্তা থেকেই কিছু লেখার চেষ্টা। বতর্মান পরিস্থিতিতে সমাজ ব্যবস্থা গভীর সংকটের মুখে। মানবিকতা, নৈতিকতা, সততা, ধৈর্য্য , নিষ্ঠা, ভরসা , নির্ভরতা এগুলো দিন দিন মানুষের মধ্যে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত যান্ত্রিকতা নষ্ট করছে আমাদের সুন্দর মনটাকে। অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, দাঙ্গা, হানাহানি -এসবে নির্লজ্জের মত মেতে উঠেছি। সোস্যাল মিডিয়াতে উত্তেজনা ছড়ানোর মত পোস্ট দিচ্ছি। সত্যতা যাচাই না করে এমন অনেক কিছু শেয়ার করছি।তিল থেকে তাল হচ্ছে। তাতে কি!

শিক্ষা ব্যবস্থায় অচলায়তন, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা তলানিতে। চাকরি সে তো অলিক কল্পনা।বেকার ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ প্রশ্ন চিহ্নের মুখে। শিক্ষকরা আজ পথে চাকরি হারিয়ে। হতাশা গ্রাস করছে তাদের। সুন্দর ভবিষ্যৎ কেড়ে নিয়ে ধর্মীয় মাদকতা ইনজেক্ট করার এক গভীর চক্রান্ত চলছে। ধর্মকে হাতিয়ার করে মানুষে মানুষে বিভেদ দাঙ্গা লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের যে সর্বনাশা খেলায় মেতেছে রাজনৈতিক দলগুলো তার ফল ভুগতে হবে সবাইকে।যে বিষবৃক্ষ মাটিতে পোঁতা হয়েছে তা একদিন মহিরুহে পরিনত হবে।

স্যোশাল মিডিয়ায় ছোট ছোট রিলস্, ভিডিও, ব্লগারদের দাপাদাপি। এসবের প্রতি নবীন প্রজন্ম অ্যাডিক্টেড হয়ে পড়ছে। কমছে কাজের প্রতি মনোনিবেশ করার ক্ষমতা। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার সর্বোৎকৃষ্ট পথ হচ্ছে বই পড়া। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।বই মনের দ্বার খুলে দেয়। মনোযোগ বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে, কল্পনা করতে শেখায়। প্রশ্ন করতে ও নতুন করে ভাবতে শেখায়। নিজেদের চারপাশের বাইরেও যে জীববৈচিত্র্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আছে বই পড়ে তা অনুভব করা যায়।

বই মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে শেখায়। মানুষ মানুষের জন্য এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে‌। নিয়মিত বই পড়লে আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে, অবসাদ কমে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে, হার্ট ভালো থাকে, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে।বই জোনাকি পোকার মতো চারিদিকে অন্ধকারের মাঝে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে রাখে। সর্বোপরি যা সত্য, যা চিরন্তন, তাই সুন্দর। বই পড়ার মাধ্যমে প্রকৃত সত্যের স্বরুপকে উপলব্ধি করতে হবে।বই পারে হতাশার অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতিকে আলোর পথে ফেরাতে।

অন্যায় করা এবং অন্যায় দেখে চুপ থাকা-দুটোই সভ্যতার সঙ্কটকে গভীর থেকে গভীরতর করে। এটা সমাজ ব্যবস্থার সুস্থতার লক্ষণ নয়। মুক্তি তখনই সম্ভব যখন আমাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। মনকে তাই পরিশুদ্ধ ও পরিশীলিত করতে হবে। ঠিক আর ভুলের পার্থক্য বুঝতে হবে। চোরাবালির ফাঁদে পড়ে ছটফট করলে মুক্তি মিলবে না।গুজবে কান না দিয়ে সব কিছু যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হবে। প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বই সকলের পড়া দরকার । তবে কোন বই? সব বই কোনমতেই পড়া সম্ভব নয়। উত্তর লেখক, রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন অনেক আগেই দিয়েছেন, ‘কিছু বই কেবল স্বাদ গ্রহণের জন্য, কিছু বই গিলে খেতে হয়, আর কিছু চিবিয়ে হজম করতে হয়’।

বই দিবস বছরে একদিন। কিন্তু নিত্য পাঠ আমাদেরকে অনেক কিছু দিতে পারে যা অন্য ভিসুয়াল মাধ্যমে পেলেও অতটা মনে ধরে না। আমরা উপহার হিসাবে বইয়ের প্রচলনকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে পারি। বাচ্চাদের মধ্যে বই বিতরণ করতে পারি। এভাবে তাদের জানার পরিধিকে বাড়াতে পারি। তাদের জানার খিদের খোরাক দিতে পারি। আজকের বিষাক্ত পরিবেশে (যার জন্য সামাজিক মাধ্যমের অপপ্রয়োগ অনেকাংশে দায়ি, দায়ি শিশুদের অভিভাবকরাই) বইয়ের বিকল্প আর কিছুই হতে পারে না। বই বিমুখের অর্থ হল আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া।

দুঃখের বিষয় এই যে, বিশ্বায়নের যুগে বই যেমন সহজলভ্য (ই বুক), অস্ত্রও।হিংসা, বৈরিতা, যুদ্ধ শিশুদের কাছে আর অজানা নয়। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে বইই হোক হিংসার বিকল্প।

আর বিবেকবান মানুষ (যে মানুষের বড় অভাব এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়) বই না পড়েও হওয়া অসম্ভব নয়। সুতরাং বই সভ্য সমাজের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না।সভ্য/ অসভ্য পড়ার উপর নির্ভর করে না, করে আমাদের বোধের উপরে।

You may also like

Vinnokatha
Prothom Khondo
Price: Rs.260/-
www.vinnokatha.in
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে। সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে।সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
Vinnokatha
Prothom Khondo