মানুষে মানুষে দ্বেষঃ কিছু করার আছে কি

by Vinnokatha

সন্দীপ ব্যানার্জি

যে জিনিসটাকে কেন্দ্র করে জনগণের মধ্যে বিভেদ তৈরি হচ্ছে সেটা তাদের ধর্মীয় পরিচয়। যেটা এই বিভেদকে পিছনে সরিয়ে দেয় তা হলো তাদের মানুষ হিসেবে পরিচয়, তাদের শ্রেণি হিসেবে পরিচয়। কোনো হিন্দু বা মুসলনমান বা শিখ বা খ্রিষ্টান শ্রমিক বা কৃষক কিংবা এমনকি অত ধর্মটর্ম মানে না এমনও যেকোনো শ্রমিক বা কৃষক সমাজের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ও দরকারি কাজ করেন। তারা সমাজের জন্য উৎপাদন করেন বা সেটা লোকজনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থ্য করেন। উৎপাদন ও বিতরণের কাজে ও সেই সংক্রান্ত আরো নানা কাজেই দেশের বেশিরভাগ লোক নিযুক্ত।

শ্রমিক-কৃষকদের মেহনত ছাড়া কোনো সমাজ চলতেই পারে না। ফলে শ্রমিক বা কৃষক হিসেবে তাদের গর্ববোধ করাই উচিত। শুধু বড়লোকশ্রেণির বাবু লোকেরা বা “ভদ্রলোকেরা” মেহনতি জনগণকে “চাষা” বা “লেবার-ক্লাস”, “কুলি/মজুর” এসব বলে ব্যঙ্গ করে। অথচ তারা কোনো খাদ্য- বস্ত্র-বাসস্থান কিছুই উৎপাদন করতে পারে না।

শ্রমিকেরা যখন কিছু উৎপাদন করে তাতে লেখা থাকে না কোন ধর্মের লোক তা উৎপাদন করেছে, বা কোন জাতের, কোন জাতির। সেটা শুধু মানুষের শ্রম হিসেবেই গণ্য হয়। এই যে কাগজটা পড়ছেন সেই কাগজটা, বা রাত্রে যে ইলেক্ট্রিক লাইটে পড়বেন সেই ইলেক্ট্রিক, বা জামা-কাপড়, বা চাল-গম… সেসবই তাই।

ট্রেন বা বাসে গেলে ড্রাইভার কোন ধর্মের লোক, কোন জাতের লোক, তাতে কিছুই যায় আসে না। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো পরবের সময়, প্রার্থনার সময়, বিয়ে- সাদির সময়, মরার সময়, এরকম কিছু সময়ে হুট করে একজন আরেকজনের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। যাক গে, কিন্তু বাকি সময়, যখন সে সমাজের জন্য দরকারি কাজ করছে সেসময়ে তার কী জাত কী ধর্ম তা কেউ দেখে না। (একটু ভুল হলো সমাজের সব চেয়ে দরকারি কাজের একটা হলো পরিষ্কার করা ও রাখা ভারতে সেই সব চেয়ে দরকারি কাজটা বেশিরভাগ জায়গাতেই মেথর জাতের লোকেরা করে যাদেরকে অন্যায়ভাবে সমাজ ‘নিচু’ জাতের বলে- ঘেন্না করে!! এরকম সমাজটার প্রতি ঘেন্না হওয়া উচিত।)

শ্রেণি পরিচয় সমানে ভালোভাবে থাকে যখন পরস্পরবিরোধী শ্রেণিরা একে অপরের সাথে লড়ে। শ্রেণি-সংগ্রামের সময় শ্রমিকেরা একজোট হয়ে মালিক-প্রশাসন তাদের সব দালাল পার্টি ইউনিয়ন… এদের সাথে লড়ে। যত লড়াই-এর পরিবেশ থাকে ততই শ্রেণিবোধ গেড়ে বসে। আবার দীর্ঘদিন লড়াই-এর পরিবেশ না থাকলে সেই চিহ্ন চাপা পড়ে যেতে থাকে। তাড়াতাড়ি চাপা পড়ে যায় যদি ধুলো-ময়লা বেশি ওড়ে।

আবার অন্যদিকে ধর্ম। বেশিরভাগ শ্রমিকই কট্টর হিন্দু বা মুসলমান নয়। কিন্তু তাদের কেউ পুজোয় বোনাস পায়, ছেলেমেয়ের জন্য জামাকাপড় কেনে। আবার কেউ কুরবানী বা ঈদে ছেলেমেয়ের জন্য নতুন জামা কেনে। চাষির বাড়িতে ভাদ্র- আশ্বিন-কার্তিক বেশ কষ্টের মাস। তাকে ধার দেনা করতে হতে পারে। কারোর ছেলেমেয়ের বিয়েতে পুরুত এসে সংস্কৃতে মন্ত্রটন্ত্র পড়ে। কারোর ছেলেমেয়ের বিয়ের ক্ষেত্রে কাজিসাহেব আসেন। কেউ দেখা হলে নমস্কার জানায়, কেউ বা সালাম জানায়। এই রকম কিছু হলো আলাদা।

এবার আসবে কিছু ধর্মীয়- সাম্প্রদায়িক সংগঠন। তারাই এসবের ভিত্তিতে আপনাদের দুটো শিবিরে ভাগ করবে। তারপরে নানাকিছু প্রচার করে এক শিবিরের মন বিষিয়ে দেবে আরেক শিবিরের বিরুদ্ধে। একদলকে লেলিয়ে দেবে অপর দলের বিরুদ্ধে। ভুলিয়ে দেবে যে মেহনতি জনগণ হিসেবে সবাইই এক।

এই নিয়ে প্রচারমাধ্যমও খুব কাজ করছে। কত সিরিয়ালে দেখা যায় ভয়ানক ধর্মীয় উপাদান ঢোকানো হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যাপক চাঁদা দিচ্ছে সেইসব ছড়িয়ে দিতে। মালিকেরা ধুমধাম করে মন্দির বানচ্ছে, পুজো দিচ্ছে।

মন্দির আর পুজো বাড়ানোর জন্য বিদেশ থেকে ডলার আসছে হিন্দু এন.আর.আই.-দের থেকে। ধনী মুসলমানদের দানে ঝাঁ চকচকে মসজিদও বানানো হচ্ছে নানা জায়গায়। আরবের দিনার আসছে মসজিদ নির্মাণে। ধর্ম নিয়ে সিনেমা হচ্ছে। বিখ্যাত সিনেমাস্টার ছেলের বিয়ে দিচ্ছে ঠিকুজি-কুষ্ঠি মিলিয়ে, জাঁকজমক করে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করে সেসব কাগজে, টিভিতে দেখানো হচ্ছে। ভারত-পাকিস্তানের খেলা মানেই যেন হিন্দু-মুসলমান যুদ্ধ।

এক ভয়ঙ্কর জোয়ার ধর্মীয় উন্মাদনা বাড়ানোর। আর শ্রেণিসংগ্রামে এখনো ভাটার টান। এই স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটতেই হবে যদি এই বিভেদ- বিদ্বেষ দূর করতে হয়। মনে করিয়ে দিতে হবে শ্রেণি পরিচয়। পুরোনো বাস্তব সংগ্রামগুলো এখন হয়তো গল্পকথা। শ্রমিক কৃষকের লড়াই-এর অতীত আজ গল্পকথা লাগলেও সেটা কিন্তু বাস্তব। সেটা সত্য। সেসব ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে মেহনতিদের কাছে। পাশাপাশি নানা দাবিতে, কিংবা নানা অসহ্য অবস্থার প্রতিবাদে মেহনতিদের ঐক্যবদ্ধ লড়াই শুরু করার চেষ্টাও করতে হবে। স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার খুবই কঠিন। কিন্তু কোনো সোজা উপায় আর নেই।

(লেখাটি, ‘অপ্রচলিত’ বিশেষ বইমেলা সংখ্যা, ২০২৪-এ প্রকাশিত)

You may also like