অনুরাধা গান্ধী

by Vinnokatha

কোবাড গান্ধী

অনুরাধা গান্ধী (১৯৫৪-২০০৮) কেবলমাত্র গরিব ও নির্যাতিতদের প্রতি দায়বদ্ধ ছিলেন না। বরং আমরা তাকে জানি তার অসামান্য ব্যক্তিত্বের জন্য। শুধুমাত্র সে একজন জননেতাই ছিলেন না গরিবদের কাছে, বিশেষ করে দলিত, মহিলা এবং আদিবাসীদের কাছে। এর সাথে সাথে ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে সে এই জনজাতির সমস্যাগুলোকে বুঝতে এবং তুলে ধরতে পেরেছিলেন তাঁর অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর স্ক্রিপটিং দি চেঞ্জ এবং আরো অন্যান্য লেখা ভারতীয় সমাজের জাতপাত এবং পুরুষতান্ত্রিক নির্যাতন সম্পর্কে এক মনোজ্ঞ অনুসন্ধান। তাঁর লেখা ও কাজ আজকের দিনে আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। ভারতে আজকে যারা মার্কসবাদী বা উদারবাদি বা গণতান্ত্রিক বলে পরিচিত তারা সকলেই গভীরভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী রোগে জর্জরিত। অনুরাধাই প্রথম যিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে দু দিক থেকেই লড়াই করেছিলেন- আদর্শগত ও তাত্ত্বিক দিক থেকে এবং একেবারে কাজের মাটিতে নেমে।

অনুরাধা গান্ধী যিনি অনু নামে তাঁর বৃত্তের মানুষদের কাছে পরিচিত, তাঁর স্মৃতিচারণা করা খুব জরুরী কারণ তাকে তাঁর সমসাময়িক অনেকেই উপেক্ষা করেছেন। সবথেকে যেটি আকর্ষণীয় সেটি হল যে তাঁর সরলতা এবং ভদ্রতা যা তিনি কখনোই হারান নি। অনুরাধা অনেকের কাছেই আদর্শ ছিল। সে কখনো নিজেকে নিপীড়িত জনগণের থেকে আলাদা করে দেখতেন না যেটা সবাই আমরা প্রায়ই করে থাকি আমাদের জাতপাতের কারণে অথবা বস্তুগত অবস্থানের স্থান থেকে।

আজ আমরা চতুর্দিকে দেখতে পাচ্ছি অহংকারী কমরেডদের দাপট। এরা সামান্যতম সফলতার আঁচ পেলে গর্বে বুক ফুলে ওঠে এবং নিজেদেরকে সাথীদের থেকে আলাদা করে দেখে। কিন্তু অনু ছিল সকালের তারার মতোই জাজ্বল্যমান গভীর অন্ধকারের মধ্যে। আজ যখন বামপন্থীদের মধ্যে নীতিহীনতা বা ম্যানিপুলেশন কে একটি স্বাভাবিক গুণ হিসাবে দেখা হয় বিশেষ করে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মধ্যে, সেখানে অনুরাধা ছিল একেবারেই সোজা সাপটা এবং আদর্শের প্রতি চরমভাবে দায়বদ্ধ।



বামপন্থীদের অধঃপতনের পরিবেশে অনুরাধা ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র একটি প্রদীপ। তার কোন ছলনা ছিল না, ছিল না কোন কৃত্রিমতা। কোন লোক দেখানো ব্যাপার ছিল না, ছিল না কোন অহংকার, ছিল না কাজ করে নিজেকে অপরের চোখে বড় প্রমাণ করার তাগিদ। এগুলো হামেশাই আমরা অনেক বামপন্থী মহলে অনেক কমরেডদের মধ্যে লক্ষ্য করতে পারি। নিজেকে কখনোই খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরতেন না। সে সবসময় কাজ করেছিল একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে একেবারে শিশুসুলভ সরলতার সাথে।

আগেই বলেছি তাঁর ছিল কঠোর দায়িত্ববোধ। ছিল প্রখর নিয়মানুবর্তিতা, ছিল অসম্ভব দক্ষতা যে কোন কাজে যেটি সে গ্রহণ করতেন। সেগুলো শিক্ষা সম্পর্কে কাজকর্ম হোক অথবা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা অথবা তার প্রাত্যহিক কাজকর্মই হোক না কেন। অনুরাধা ছিল প্রচন্ড পরিশ্রমী। এবং কখনো সে নিজের দিকে তাকাত না। কোন অভিযোগ করত না তাঁর মারাত্মক শারীরিক সমস্যার জন্য। তার মন সবসময়ই ব্যথিত ছিল অপরের জন্য, অসহায় নিপীড়িত মানুষের জন্য।

এবং সে কখনো কাউকে বিচারকের চোখ দিয়ে দেখত না। সে সকলকে সমানভাবে গ্রহণ করতে পারত। এবং সে প্রচন্ড খোলামেলা ছিল তার জীবনের সব ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমনকি তার মতের বিরোধী মানুষজনের সঙ্গেও। কিন্তু তিনি কখনও নিজের ভিতরের বিশ্বাসের থেকে সামান্যতম টলতেন না। সে জীবনকে একরকম পরিপূর্ণতা দিয়েছিল, আর সে জীবন ছিল সব ধরনের সংকীর্ণতা, নিচুতা, কপটতা ও ভণ্ডামি থেকে অনেক অনেক দূরে। এবং শুধু এ কারণেই অনুরাধার সংস্পর্শে যারা এসেছিলেন তারা কখনোই তাকে ভুলবে না, ভুলতে পারবে না তার অপার ভালোবাসার কারণে।

তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে আসুন আমরা তাঁর প্রতি কেবল শ্রদ্ধা জানাব না। বরং আমরা তাঁর গুণাবলী এবং তার প্রাত্যহিক কাজকর্মের মূল্যায়ন ও প্রশংসা করি। অনুরাধা আমাদের হৃদয়ে চিন্তা ও মননের জগতে এবং জীবনে সর্বত্রই দিনের প্রথম আলো নিয়ে বিরাজমান।

You may also like