ডানদিক থেকে কাহিনীকার আবুবাক্কার, দোহার সৌরভ, মুর্শিদাবাদ জেলার গবেষক তাজউদ্দিন বিশ্বাস ও বর্তমান গবেষিকা টুকটুকি হালদার।
মুর্শিদাবাদ জেলার লুপ্তপ্রায় লোকগীতি ‘কাহিনীগান’। ইতিহাসের কাহিনীকে গল্পচ্ছলে বলা ও গাওয়া হল কাহিনীগানের মূলকথা। গায়ক গল্প বলে, গান গায় আর তার দোহাররা কয়েকবার সেই গান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গায়তে থাকে। ইতিহাসের মুখ্য চরিত্রের নামে নামকরণ, যেমন – আকবর বাদশা, জানে আলম বাদশা, সেকেন্দার বাদশা, আলমগীর বাদশা প্রভৃতি। তবে বর্তমানে কাহিনীগান লুপ্তপ্রায়, কিন্তু গ্রামে গ্রামে বৃদ্ধদের মুখে কাহিনীর ছড়া আজও কথায় উপমায় প্রচলিত।
একটা সময়ে কাহিনীগান ছিল মুর্শিদাবাদ বাগড়ীর সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনের অঙ্গ। বাগড়ীতে বেশি চাষ হয় আউশ ধানের। ভাদ্র মাসে ঘরে ওঠে ধান। তাই তাকে ভাদুই ধানও বলে। নতুন ধানের নতুন চাল রান্নার দিনই বাড়িতে বসে কাহিনীগানের আসর। বাড়িতে বাড়িতে খাঁচা ভরা মোরগ-মুরগি। মোরগের মাংস আর ভাত হয়। সন্ধ্যার পরে পরেই মাংস ভাত খেয়ে শুরু হয় কাহিনীগান। মাঝরাত্রি পর্যন্ত কখনো সারারাত চলে সেই আসর। বলা হয় একটা কাহিনী, গীত হয় অনেক গান। কাহিনীকার একজন এবং দোহার দুই থেকে চারজন। এক-দেড় মিনিট কাহিনীকারের কথা। তারপর দুই থেকে চারলাইন কাহিনীর গান। কাহিনীকার প্রথমে গান করে। দোহাররা সেইটুকুই আবার কোরাস সুরে গায়। কাহিনীগান কোনো বাড়িতে হওয়া মানে সেই পাড়ায় সপ্তাহ খানেক আগে থেকে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। জানানো হয় আত্মীয়-স্বজনকে। আত্মীয়-স্বজনের আগমন কাহিনীগানের অছিলায়। গ্রামের মোড়ল মাতব্বরকে নিমন্ত্রণের রীতিও ছিল। কাহিনীগানের অনুষ্ঠান বসার কারণ থাকত দুইটি। হয় আত্মীয়বর্গের মিলন, না হয় মানত শোধ। কলেরা বসন্তর মতো মারণ রোগে পরিবারের কেউ আক্রান্ত হলে রোগ আরোগ্যের কামনায় মানত করা হত মোরগ ও কাহিনীগান। ভাদুই ধানের ভালো উৎপাদনের আশাতেও মানত করা হত কাহিনীগান। ভাদুই ধান ওঠা থেকে বাগড়ীর নিম্নভূমিতে জন্মানো আমনের আগাম প্রজাতির ধান ওঠা পর্যন্ত অর্থাৎ ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক মূলত এই তিনমাস আত্মীয়বর্গের মিলন উপলক্ষে কাহিনীগান আর সারা বছরের অনুষ্ঠান মূলত মানতের। ১৯৫০-এর দশকে কাহিনীগানের মূল্য ছিল ৩০ টাকা। তার মধ্যে প্রাপ্তব্য ছিল কাহিনীকার ১৫ টাকা এবং দোহারদের একযোগে ১৫ টাকা। ১৯৬০-এর দশকে মূল্য বেড়ে যায়। ধার্য হয় ৪০ টাকা। কাহিনীকার ২০ টাকা এবং দোহারদের একযোগে ২০ টাকা। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে কাহিনীগান ভাঁটার মুখে পড়ে। কাহিনীগান শেখার তাগিদহীনতা ও ১৯৭৫-৯০ মধ্যে পুরানো বয়স্ক কাহিনীকারগণের পরপর মৃত্যুতে কাহিনীগান পড়ে যায় গভীর সংকটে। আজ একুশ শতকে এসে কাহিনীগান বিলুপ্তপ্রায়। পূর্বে মুর্শিদাবাদ বাগড়ীর এমন কোন এলাকা ছিল না যেখানে একজন কাহিনীগানের ওস্তাদ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে অনেক কাহিনীকার ও তার দোহাররা মারা গিয়েছে। কোথাও হয়তো এক-একজন ওস্তাদ বা দোহার চরম বার্ধক্য নিয়ে বেঁচে আছে।
‘কাহিনী’ শব্দের আক্ষরিক আভিধানিক বাংলা অর্থ বিবরণ, গল্প, উপন্যাস, বৃত্তান্ত, প্রস্তাব। কোন বিশেষ ব্যক্তি বা কোন ঘটনাকে গল্পের আকারে বিবরণ দেওয়া, অথবা বৃত্তান্তকে উপাখ্যানের ঢঙে উপস্থাপনা করাই ‘কাহিনী’। কাহিনীর সাথে গান যুক্ত থাকায় বিবরণ, বৃত্তান্ত, গল্প এখানে গৌণ, মূল বিষয় হল সেই গল্পকে, বিষয়-বৃত্তান্তকে, উপাখ্যানের বিবরণকে গানের মাধ্যমে তুলে ধরা। কাহিনীকার বিষয়ের উপর গল্প বলতে বলতে গানের সুরে কথা বলে। দোহারদের সুরে বলা কথাগুলিই গান। গীত কথাগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছন্দবদ্ধ হয় কিংবা সুরের অভিঘাতে ছন্দবদ্ধ শোনায়। কাহিনীগানের কোন পালা বা বিষয়ে আগে থেকে গান তৈরি করা থাকে না। মঞ্চে তাৎক্ষণিকভাবেই কাহিনীকার তৈরি করে ফেলে গানের কলি। এখানেই কাহিনীকারের ওস্তাদি বা বিশেষত্ব। কবিত্ব শক্তি না থাকলে কাহিনীগানের কাহিনী বলা যায় না। একটা পালা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে শুনলে এই পার্থক্য ধরা পড়ে। মনে করা যায় আকবর বাদশাহর পালা। লিখিত কোন পালা নেই। ইতিহাসের সাথেও কোন মিল নেই। কাহিনীকার কাহিনী ও গান গাওয়ার সময় যখন যা মনে পড়ে তখন তাই-ই উপস্থাপনা করে। উপস্থাপিত বিষয় গানের সুরে ও ছন্দে গীত হলে ঘটনার অমিল বিষয়ে কোনো ধারণা জন্মায় না। তাই, কাহিনীগান মুর্শিদাবাদ বাগড়ীর নিজস্ব ঘরানার লোকগান – আপন সম্পদ।
কাহিনীগানের শিল্পী
আব্দুল বারী সেখ ডোমকল থানার কুলবোনা গরীবপুরের মানুষ এবং ফতেপুরের হেদাতুল্লা সেখের জামাই। তিনিও সংস্কৃতি পাগল মানুষ। ওস্তাদের অনুমতি নিয়ে নিজ এলাকায় দল তৈরি করেন। জারি, একদিল, হাঁচো গান করতেন। শব্দগানও কিছুদিন করেছিলেন। করেছিলেন কাহিনীগানও। কিন্তু গলার স্বর মোটা ও ভারী হওয়ার কারণে কাহিনীগান তাঁর চলেনি। ১৯৬৭ এর রাজনৈতিক পালাবদলের আগে পর্যন্ত তিনি ছিলেন সঙ্গীত জগতের মানুষ। এই সুবাদে তিনি মানুষের কাছে ‘গান্যাবারী’ নামে পরিচিত হন। তিনি মারা গেছেন ২০১০ সালে।
হরিহরপাড়া থানার ৫৩নং সিদ্ধিনন্দী ও ৪৮নং তরতিপুর মৌজা মিলে রেজলাপাড়া গ্রাম। তাঁতশিল্পী নইমুদ্দিন কারিকরের ছেলে হারু কারিকর। তিনি গান পাগল মানুষ। দুপুর গড়ালেই হাঁটা দিতেন ফতেপুরের দিকে। জারি, সারি, শব্দ, হাঁচো, কাহিনীগান করতেন। বিয়ে করেছিলেন ওস্তাদ রিয়াজুদ্দিনের মেয়েকে। বিয়ের পর তাঁকে স্বাধীনভাবে গান করার অনুমতি দেন রিয়াজুদ্দিন। ২০০৪ সালে ৭৬ বছর বয়সে মারা যান।
ডোমকল থানার বানিয়াখালি গ্রাম। এই গ্রামে জন্ম খেলাবর ধাত্রীর। এলাকায় তিনি পরিচিত ‘খ্যালা দাই’ নামে। তাঁর পিতার নাম অধর ধাত্রী। লেখাপড়া বলতে পাঠশালায় পড়া। বংশগত পেশা ধাত্রীর কাজ। অবসরে করতেন কাহিনীগান। সুপুরুষ কাঠামো, দারাজ গলা, হাসি হাসি মুখ। কণ্ঠস্বর সুরেলা। তিনি গ্রাম ছেড়ে চলে যান নওদা থানা এলাকার টিয়াকাটা গ্রামে শশুরবাড়িতে। সেখানেই তিনি ১৯৮২ সালে মারা যান। তাঁর কাহিনীগানের কোনো উত্তরসূরী নেই।
আরেক কাহিনীকার ছিলেন রানীনগর থানার কাতলামারী গ্রামে। শিল্পীর নাম নমি বিশ্বাস। পিতা হরি বিশ্বাস। পিতামহ তজি বিশ্বাস। তাঁরা কাহিনীগান করতেন উত্তরাধিকার ক্রমে। তিনি শুধু কাহিনীগানই নয়, হ্যাঁচো গানও করতেন।
আরেক কাহিনীকার ছিলেন বাগড়ীর ডোমকল থানার গোকুলপুর গোবিন্দপুর মৌজা অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা সাহাবাজপুর গ্রামের মোহনপাড়াতে। ভৈরব নদীর বাঁকে। তিনি মীর চাঁদ আলী। তাঁর পিতার নাম এরাদ আলী মীর। চাঁদ আলী মীর ১৯৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে পরিণত বয়সে মারা গিয়েছেন। গলার স্বর মিহি ও সুললিত। শুধু কাহিনীগানই নয়, ভাসান, একদিল, ভারবোল, ভাটিয়ালি গানও করতে পারতেন।
ডোমকল থানার ১৫ নং জিতপুর মৌজা অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা শিরোপাড়া গ্রামের কমর আলি মণ্ডল, পিতা ফারাতুল্লা মণ্ডল করতেন কাহিনীগান। হালকা-পাতলা ছিপছিপে মানুষ ছিলেন তিনি। জমি জায়গা ভালো ছিল। ছিল দুখান হাল-বলদ। সুখী সংসার। দীর্ঘদিন ধরে তিনি কাহিনীগান করেছেন। গলার স্বর ভালো না থাকলেও দোহারা ছিল ভাল। দোহারদের জৌলুসে আশেপাশের গ্রামেও গান করতেন। কিন্তু তিনি কোন পয়সা নিতেন না। দোহাররা মরে যাওয়ার পর তিনিও গান ছেড়ে দেন। ১৯৯৮ সালে তিনি পরিণত বয়সে মারা গিয়েছেন।
ডোমকল থানার ২৮নং মৌজাগ্রাম বিলাসপুর। এই গ্রামে বাস করতেন রইসুদ্দিন মণ্ডল, পিতা- নানকু মণ্ডল। তাঁর গানের ভালো গলা জন্মাবধি। ফর্সা সুন্দর চেহারার মানুষ। কিন্তু তিনি খোঁড়া। গান করতেন দরদ দিয়ে। জারিগান, ভাদুগান, শব্দগানের সাথে কাহিনীগান করতেন। তবে প্রতিষ্ঠা পান কাহিনীগানে। গানের দৌলতে তাঁর নাম পাল্টে যায়। তিনি পরিচিত হন ‘গান্যা রইসুদ্দি’ নামে। সুখী পরিবারের সন্তান। পয়সার কোন চাহিদা ছিল না। গান করার পর কেউ পয়সা দিলে নিতেন। না দিলেও কিছু বলতেন না। কারণ তিনি গান পাগল মানুষ। তিনি মারা গেছেন ২০/২২ বছর আগে।
হরিহরপাড়া থানার ৫৯ নং মৌজা চোঁয়া। এই চোঁয়া নতুনপাড়া গ্রামের একজন বাসিন্দার নাম ধনী খাঁ। তাঁর পিতার নাম কালু খাঁ। তাঁর ৭৮ বৎসর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে ২০১৮ সালে। ধনী খাঁ কাহিনীগান করতেন। সোভান খাঁ ও জঙ্গলী খাঁ ছিলেন ধনী খাঁর কাহিনীগানের দোহার। ১৯৪০ দশক থেকে ২০১২ পর্যন্ত তিনি এলাকায় ও বাইরে দাপটের সাথে কাহিনীগান করেছেন।
কাহিনীগানের নমুনা
ডোমকল থানার ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা আবুবাক্কার কারিকর। বাগড়ীর কাহিনীগানের আসরে আবুবাক্কার কারিকর বিখ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। আবুবাক্কার কারিকরের শিক্ষাগত মান গ্রামের পাঠশালা। বাপ-চাচার গান শোনার নেশায় পড়াশোনা হয়নি। কিন্তু পড়াশোনা না হলেও তাঁর চর্চা ছিল। গানের আসর না থাকলে বাংলা পুঁথি পড়তেন। কাহিনীগানের গল্প-ঘটনায় যত চরিত্রই থাকুক সবই কাহিনীকার একাই করতেন। কিন্তু আবুবাক্কার একক কন্ঠে কাহিনীগান করলেও প্রত্যেক চরিত্রের কথা তার নিজ নিজ ভাষা ও ঢঙে করতেন। কাহিনী কথনের এই নাটকীয়তা তাঁকে কাহিনীকারদের জগতে রাজা করে রেখেছে। তিনি অবলীলাক্রমে মহিলা চরিত্রের ক্ষেত্রে মহিলা কন্ঠে কথা বলতে পারতেন এবং মহিলা কন্ঠে গানও গায়তে পারতেন। এখানেই তাঁর কাহিনীগানের সার্থকতা।
খ্রিস্টীয় ২০০০ সালের বন্যার পর কাহিনীগানের প্রতিযোগিতার আসর বসে নওদা থানার ঝাউবোনা গ্রামে। সাতদিন ধরে চলে সেই গানের অনুষ্ঠান। বাগড়ীর সমস্ত কাহিনীকার, গায়ক, দোহার উপস্থিত হয়েছিল। শ্রোতা-দর্শক ছিল অগণিত। আবুবাক্কার গান করেছিলেন প্রথম রাউন্ডে ‘কোঠ্যারাজা’, দ্বিতীয় রাউন্ডে ‘লোহাচোরের বেটা পাত্যা চোর’। কোয়ার্টার ফাইনালে ‘রাধাবল্লভ’ আর সেমিফাইনালে ‘কহক কুণ্ডল পাখি’।
২০২০ সালের অক্টোবরের ৪ তারিখে আবুবাক্কারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সাক্ষাৎকারে তাঁর বলা কথাগুলি তুলে ধরা হল – “ ‘কোঠ্যারাজা’, ‘লোহা চোরের ব্যাটা পাত্যা চোর’ ও ‘রাধাবল্লভ’ কাহিনী ছোট, গানও কম। কিন্তু গলার স্বর ও ভঙ্গিমাতে আমি উত্তীর্ণ হয়ে যাই। ‘কহক কুণ্ডল পাখি’ কাহিনীর ঘটনাও মিষ্টি, গানও করুণ। আমি জিতে যাই। এমন সময় বাজ পড়লো মাথায়। জেতার বাজ। নেশায় বুঁদ হয়ে গেলাম। হৃদয় নিঙড়ানো দরদ দিয়ে করলাম ফাইনালে করলাম ‘জানে আলম বাদশাহ’ কাহিনী। আমার বিপক্ষ পাল্লাদার হরিহরপাড়া থানার চোঁয়া নতুনপাড়া গ্রামের ধনী খাঁ। তিনি করলেন ‘আকবর বাদশাহ’র কাহিনী, আর আমি করলাম ‘জানে আলম বাদশা’। তাঁর গান আড়াই ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে গেল। আর আধঘন্টা পরে আমি উঠি গান করতে। সমস্ত লোক মনে করেছিল যে, রাত্রি বারোটার মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আমি শেষ করলাম ভোর চারটেতে। মঞ্চে উঠেই উপস্থিত সর্বসাধারণের নিমিত্তে ভক্তি নিবেদন করি যা কেউ করে না। তারপর আসর বন্দনা করি। চিরাচরিত প্রথায় আল্লা, আল্লার রসুল, পীরকে বন্দনা না করে পরিস্থিতিকে বন্দনা করলাম। গান তৈরি করা, সুর দেওয়া ও গাওয়া একসঙ্গে। গাইলাম –
লৈকা ছাড়লাম বদর রে বলে
ও লৈকা ঠেক হইল ঘাটে রে,
ও লৈকা ঠেক হইল ঘাটে।
কি দোষে পেল্যা মা গঙ্গা, ও গঙ্গা, গঙ্গা রে
ও গঙ্গা বাঁধিলি লৈকা ত্রিমোহিনীর ঘাটে।
যাবার ছিল তজির হাটে
বাঁধা পড়লাম ত্রিমোহিনীর ঘাটে, ঘাটে রে,
ও লৈকা ঠেক করিল কে ঘাটেরে
দুখে দুখে দুখের জীবন বিধি, ও বিধি রে
আবার দিলে ত্রিমোহিনীর দুখ রে, ত্রিমোহিনীর দুখ ত্বরাও বিধি দুখের সাগর, ত্বরাও দুখের সাগর
সইতে নারি বিধি রে, সইতে নারি এ দুখ।।
গান শেষ হতে দোহারসহ আমি উঠে দাঁড়িয়ে সর্বসাধারণের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। তারপর বলি – আমার আজকের কাহিনী পালা ‘জানে আলম বাদশাহ’। বিপুল করতালি পড়ল। কাহিনী শুরুর আগে নিবেদন রাখি জনগণের কাছে। কাহিনী শুরু করার আগেই জনগণ ফুল, টাকা ও মিষ্টি দিয়ে আমাকে বিজয়ী ঘোষণা করে দিল। আমি সেগুলোকে কুড়িয়ে স্টেজের পাশে রেখে শুরু করলাম ‘জানে আলম বাদশাহ’র কাহিনী। শুরু করলাম গান দিয়ে –
নামাজ পড়ে বাদশাহর চোখে ঝরে পানি গো আল্লা, চোখে ঝরে পানি
একটা ব্যাটা দাও মোরে আল্লা – ওগো বারিতাল্লা করে মেহেরবানি,
ওগো আল্লা করে মেহেরবানি।
বন্ধ্যা রানি। নিঃসন্তান বাদশাহ। রাজা আছে – রাজ্যপাট আছে কিন্তু রাজপুত্র নেই। সেই বাদশাহীর আর কি দাম! গোপনে কাঁদাকাটি করে, মনের দুঃখে ছাড়তে চায় সংসার, ছাড়তে চায় রাজ্য। কাউকে মুখ দেখাতে চায় না বাদশাহ। কারণ প্রজারাও ধিক্কার জানাই বাদশাহকে। বাদশাহের মুখ দেখে কেউ কেউ যাত্রাও করে না। প্রজাদের কাছে বাদশাহ আঁটকুড়া। প্রজাদের অপবাদ রাজার কাছে বড় যন্ত্রণার। তাই, বাদশাহ দেশত্যাগ করছেন। ছেড়ে যাচ্ছে রাজধানী ও রাজপ্রাসাদ। রাস্তায় নেমে বিবির উদ্দেশ্যে প্রবোধ বচন –
থাকো – থাকো – থাকো বিবি, থাকো ইমানেতে
আমারে পাইবা দেখা রোজ-কিয়ামতে
শোনো – শোনো – শোনো – বিবি, থাকো সহি সালামতে।
বিবিকে এই বলে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় চলতে থাকেন বাদশাহ। তাঁকে চলে যেতে দেখে রাজমহিষী বলেন – এ আমার কি হলো, স্বামী আমাকে ত্যাগ করে সত্যি সত্যিই চলে যাচ্ছেন। কাঁদতে থাকেন বিবিও, কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন –
শোনো শোনো ওহে বাদশা বলি যে তোমারে,
ওরে তুমি যাচ্ছো ফকির হয়ে
তোমার বাদশাহী করিবে কেডারে।
শোনো শোনো শোনো বাদশাহ বলি যে তোমারে।
বাদশাহ ঘুরে দাঁড়ায় এবং জবাব দেয় রানীকে –
ইমান ধরে রাখো বেগম, থাকো সহি-সালামতে।
আমার বাদশাহী আল্লা চালাবে তোমার ইমানের দৌলতে।।
বাদশাহ রাস্তায় চলেছেন। হাঁটছেন উদভ্রান্তের মতো। বাদশাহর দুঃখ দেখে, ধর্মের প্রতি নিষ্ঠা দেখে আল্লাহ খুশি হলেন। পাঠালেন এক ফেরেস্তা। আল্লাহ ফেরেস্তাকে নির্দেশ দিলেন, যে ওষুধ খেলে রানী সন্তানসম্ভবা হবে সেই ওষুধ রাজাকে প্রদান করতে। আল্লাহর নির্দেশে ফেরেস্তা মর্ত্যে নেমে এল। পথ আগলিয়ে ধরল বাদশাহর। ফেরেস্তা বাদশাহকে একটা গাছের শিকড় ও গাছের পাতা তুলে দিল এবং সেগুলি শিলপাটায় বেঁটে রস তৈরি করে আধাআধি বাদশাহ ও বেগমকে খাওয়ার নির্দেশ দিল এবং রানীর শীঘ্রই সন্তান হবে এই আশ্বাস জানিয়ে অন্তর্ধান হল ফেরেস্তা। বাদশাহ সেই শিকড় ও পাতা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসল। রানিকে সকল কথা বলল এবং ফেরেস্তার নির্দেশ ব্যাখ্যা করল। সেইমতো রানি শিকড় ও পাতা শিলপাটায় বেঁটে দুই পেয়ালা রস তৈরি করল এবং স্বামী-স্ত্রী মিলে সেই রস সেবন করল। তারপর যথাসময়ে পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করল। তখন বাদশা আল্লার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল এইভাবে –
হায় গো আল্লা বারিতাল্লা
ধনীকে নির্ধনী কর, ও আল্লা আল্লা রে
ধনীকে নির্ধনী কর হে, নির্ধনী কর ধনী
তোমার কুদরতের খেলা কে বুঝিতে পারে
ওগো আল্লা কে বুঝিতে পারে।।
বাদশা নিজের বাদশাহী কর্ম সুখে করতে থাকে। পুত্রও বড় হয়। একসময় সেই বাদশাকে বন্দী করে সেই পুত্রই। এই ভাবে কাহিনী এগিয়ে যায় কথায় ও গানে। কাহিনী ও গান দুই-ই একসময় শেষ হয়। তুমুল হর্ষধবনিতে ঘোষণা হয় রায়। প্রথম স্থান অধিকার করে আবুবাক্কার ও তাঁর দল। জিতে নিলাম পিতলের বড় ঘড়া। এই খবর ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। কাহিনীগান করার ডাক আসে। হঠাৎ ডাক পড়ে শিবনগর গ্রামে। মাইনুদ্দিন মাস্টারের বাড়িতে গান। গানের পালা ‘কোঠ্যারাজা’। কোঠ্যারাজা পালার কাহিনী এইরকম – পালার প্রধান চরিত্র রাজা ও সন্ন্যাসী কোঠ্যারাজা। রাজা নগর ভ্রমণে বেরিয়েছেন। পৌঁছেছেন এক জঙ্গলে। সেই জঙ্গলে কোঠ্যার আশ্রম। কোঠ্যা ধূলায় বসে কাঠাকাঠা ধূলাবালি মাপছে আর এক এক নাম করে একপাশে ফেলছে। রাজা জিজ্ঞেস করেন কোঠ্যাকে যে সে কি করছে। এই প্রশ্ন গানের মধ্যে –
বিধি রে – ও না বিধি
এই না বালুচরে রে
ওরে কিসের ধূলা মাপো তুমি
কিসের ধূলা মাপো?
কোঠ্যা সন্ন্যাসী সটান উত্তর দেয় যে সে সকল লোকের আহার মাপছে। রাজা প্রশ্ন করে মানুষ ধূলা খেয়ে বালি খেয়ে থাকবে নাকি? কোঠ্যা উত্তর দেয় –
আরে না – না, যার নামে আহার মাপব, সে খেতে পাবে আর যার নামে আহার মাপব না, সে হাজারো চেষ্টা করলেও খেতে পাবে না।
আরে এই না কোঠ্যা মাপি কোটায়
এই না বালুচরে রে – এই না বালুচরে।
ওরে সকল লোকের আহার মাপি
সকল লোকের আহার মাপি রুজির নিশানাতে
এই না বালুচরে রে – এই না বালুচরে।
কোঠ্যা সাধুর উত্তর শুনে রাজা বিস্মিত হয়। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। বিহ্বল দৃষ্টিতে জানতে চায় রাজা তার আর কি কাজ? কোঠ্যা উত্তর দেয় –
বিধি রে আরে ও বিধ
এই না খড়ে রঙ দিয়ে রে
এই না খড়ে গিঁট দিয়ে রে
ওরে কিসের ঝোঁট বাধো তুমি
হায় রে কিসের ঝোঁট বাধো।
অর্থাৎ আমি এখানে আল্লার ইচ্ছায় ঝোঁট (জোট) বাধি। যার সঙ্গে যার বিয়ে হবে, আমি তাদের ঝোঁট বেঁধে দিই, তার নামের সাথে নাম দিয়ে।
রাজা বিশ্বাস করতে পারে না। রাজকীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করার কথা বলে রাজা। কোঠ্যা চিৎকার করে ওঠে। বলে, রাজার সাথে গৌরীর এই ঝোঁট বেঁধে দিচ্ছি। গৌরীর সাথে বিয়ে হবে রাজার। কারো রোধ করার ক্ষমতা নেই। এই বলে রাজা ও গৌরীর নাম দিয়ে খড় ধরে মাথায় একটা গিঁট দিয়ে ছেড়ে দিল কোঠ্যা। সঙ্গে সঙ্গে রাজা মন্ত্র মুগ্ধ সর্পের মত চলে গেল গৌরীর বাড়ি দিকে। রাজার মুখে শুধু একটাই বচন – আমি গৌরীকে নিয়ে যাবই।
গৌরী – ও গৌরী রে –
কোথায় গৌরী প্রাণেশ্বরী, কোথায় তোমার ঘর
চলে এসো আমার সাথে বাঁধিব সংসার।
এইভাবে কোঠ্যারাজার কাহিনী ও গান এগিয়ে যায়। রাজা গৌরীকে বিয়ে করে নিয়ে যায়। ওঠে রাজপ্রাসাদে। রানী মেনে নিতে অসম্মতি প্রকাশ করে। রাজা ও রাজ পারিষদগণ বুঝিয়ে শান্ত করে এবং যৌথভাবে সংসার করতে থাকে।
গৌরী রাজার সঙ্গে সংসার করে। তার ভূমিকা কখনো মন্থরার, আবার কখনো কৈকেয়ীর। রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকা হাতছাড়া হয়ে গেছে। রাজপ্রসাদ সহ সামান্য অংশ রাজত্বের পরিধি। প্রজারা কর দেয় না। বন্যা, খরা, মহামারী লেগেই আছে। গৌরী শুরু করে পরিবারের মধ্যে সামাজিক অত্যাচার। তাড়াতে চায় প্রধান রানিকে। অবলম্বন করে কুটিল পথ ও তার নিমিত্তে কুটিল পাথেয়। গৌরীর ভূমিকায় কথা বলার মধ্যে মানুষ চাক্ষুষ করত গৌরীর মানবী রূপ। আবুবাক্কারের ঠিক সামনেই বসেছিলেন মাইনুদ্দিন মাস্টারের বাবা। গভীর মনোযোগ সহকারে শুনছিলেন অভিনয়রূপী কাহিনীগান। গৌরীর চরিত্রে রাগে-ক্ষোভে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। প্রতিশোধ স্পৃহায় মেতে ওঠেন। মুষ্টিবদ্ধ হাত সটান বসিয়ে দেন গৌরী রূপী আবুবাক্কারের স্কন্ধে। আরেক মুষ্টি তুলতেই ধরে ফেলেন মাইনুদ্দিন মাস্টার। হৈ হল্লা শুরু হয়ে যায়। পণ্ড হয়ে যায় কাহিনীগান। আবুবাক্কার তাঁর দোহারদের নিয়ে দ্রুতপদে পালিয়ে আসেন। শত ধরাধরি করেও তিনি আর ফিরে যাননি। সেই ২০০০ সালের শেষ মাস থেকে আজ পর্যন্ত আর কোথাও গানও করেননি।
আবু বাক্কারের বর্তমান বয়স ৯২ বছর। সক্ষম ও সচল। প্রতিবেদক বর্তমান গবেষিকা, গবেষক তাজউদ্দিন বিশ্বাস ও সাংবাদিক আশিস জানা গিয়েছিলেন আবুবাক্কারের কাছে গত ২০২০ সালের অক্টোবরের ৪ তারিখে। তাঁর দোহার চাচাতো ভাই সৌরভের বাড়িতে গিয়ে কাহিনীগানের নমুনা চাইতে উপরের গানগুলি করলেন। আবুবাক্কার ২০২০ সালের ১৫-ই ডিসেম্বর মারা যান। তাই, এই গান অচিরেই লুপ্ত হয়ে যাবে।