শেরে বাংলা ফজলুল হক: এক অসামান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাহিত্য চেতনা

ব্রিটিশ-শাসিত বাংলার সমাজব্যবস্থা ও জনজীবনের পুনর্গঠন, বাঙালি জাতির রাজনৈতিক জাতিসত্তার নির্মাণ, বাঙালির গণজাগরণ, রাজনৈতিক সাহিত্যসৃষ্টি এবং সমাজসংস্কার আন্দোলনের দিশারী ছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক৷ শ্রেণিসংগ্রাম ও সৃষ্টিশীলতার সূত্র ধরে অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক রাজনৈতিক সাহিত্য নির্মাণের অন‍্যতম পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন৷ আবুল কাশেম ফজলুল হক (২৬ অক্টোবর ১৮৭৩-২৭ এপ্রিল ১৯৬২) একাধারে আইনজীবী, লেখক, সংসদ সদস্য ও সাহিত্যিক ছিলেন । বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি কূটনীতিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের নিকট শের-ই-বংগাল এবং ‘হক সাহেব’ নামে বিশেষ পরিচিত।

তিনি রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন ১৯১২ সালে৷ ১৯১৩ সালে সর্বপ্রথম ঢাকা বিভাগ হতে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তদবধি বাঙালীর প্রিয়তম জননেতা ‘হক সাহেব’ প্রতি নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করেন৷তিনি রাজনৈতিক অনেক পদে অধিষ্ঠান করেছেন, তার মধ্যে কলকাতার মেয়র (১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী (১৯৩৭-১৯৪৩), পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী (১৯৫৪), পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৫৫), পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর (১৯৫৬-১৯৫৮) অন্যতম। যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।

বাংলায় তাঁর ‘কৃষক প্রজা পার্টি’ নিচু জাতের হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কৃষকদের স্বার্থের পক্ষেই সওয়াল করতো। তিনি হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার ক‍রতে ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্য পরিষদ’ গঠন করেন৷ আজকের বাংলায় সাহিত্য, সমাজ ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ফজলুল হকের চর্চা খুবই প্রাসঙ্গিক৷ বাঙালির রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে শূণ্যতা তা পূরণের জন্য উনার মতো ব‍্যক্তিত্ব খুবই প্রয়োজন৷ তিনি একদিকে বাংলার রাজনৈতিক সাহিত্যের অগ্ৰদূত ছিলেন, অন্য দিকে বাঙালি রাজনীতির পথিকৃৎ ছিলেন তিনি ৷বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে শেরে বাংলা ফজলুল হক সাহেব কে “বাঙালি জাতির রাজনৈতিক পিতা” বা (Father of Bengal Politics) বললেও অত্যূক্তি হবে না৷

শিল্প সাহিত্যের সাথে এ. কে. ফজলুল হকের সান্নিধ্য ঘটে বরিশালে। বরিশাল ছিল ফজলুল হকের জন্মস্থান৷ কিশোর-কিশোরীদের জন্য এ সময় তিনি নিজের সম্পাদনায় ‘বালক’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর কিছুদিন পর তিনি ‘ভারত সুহৃদ’ নামে যুগ্ম সম্পাদনায় আরো একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯১৪ সালে তাঁর নেতৃত্বে প্রথম প্রজা আন্দোলন শুরু হয় এবং জেলায় জেলায় প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কৃষকের দুঃখ-দুর্দশা ও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে শুধু যে তিনি আন্দোলন করে গেছেন তাই-ই নয় তাদের সম্পর্কে নিয়মিত বিভিন্ন খবরাখবর যাতে আম-জনতার দৃষ্টিগোচর হয় সেজন্য প্রকাশ করেন কৃষক সমাজের মুখপত্র ‘দৈনিক নবযুগ’ (১৯১৯) নামের একটি পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা; সম্পাদনায় ছিলেন কমরেড মুজাফফর আহমদ ও কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এদেশের মানুষকে রাজনৈতিক সচেতন করে তুলতে হলে দেশ ও সমাজের কথা,মেহনতি মানুষের কথা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হলে চাই তার একটি অবলম্বন বা মাধ্যম৷ আর জনগণের সাথে যোগাযোগ সংরক্ষণের এই মাধ‍্যমই হল খবরের কাগজ৷এই পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্যেই তিনি সেদিন (১৯১৯ সাল) তাঁর কলকাতাস্থ ৬ নং টার্নার স্ট্রীটের বাসায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন কয়েকজনকে৷ এদের মধ্যে ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ,কমরেড মুজাফফর আহমেদ, সাংবাদিক মুহাম্মদ ওয়াজেদ আলি, ফজলুল হক সেলাবর্ষী ( সিলেট), এবং মঈনুদ্দিন হোসেনকে।আলোচনা করে ঠিক করা হয়েছিল একটি সান্ধ্য দৈনিক প্রকাশিত হবে৷ তখনকার রাজনৈতিক সমাজ অনুযায়ী হিন্দুরা মুসলমান পরিচালিত কাগজ কিনবে না ফজলুল হক সাহেব আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। আজও এই পরিস্তিতির খুব একটা বদল হয়নি৷ যদিও ফজলুল হক সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, তথাপি তিনি চাইছিলেন কাগজটির মুসলিমঘেঁষা নাম হবে৷ তখন কমরেড মুজাফফর আহমেদই নজরুল ইসলামকে বললেন তোমার কবিতার শব্দেই না হয় তুমি একটা নাম ঠিক করে দাও৷ তুমি কবিতায় তো অনেক আরবি-ফারসি শব্দ ব‍্যবহার করো৷ এখানে বলা ভালো বাংলার বেশিরভাগ শব্দই আরবি-ফারসি৷ নজরুল একটু ভেবে নিয়ে বললেন পত্রিকার নাম “নবযুগ” হলে কেমন হয়? তখন শেরেবাংলাসহ সবাই একবাক্যে ” নবযুগ” শব্দটি পছন্দ করলেন৷ তারপর সমস্ত বন্দোবস্ত করার পর ১৯২০ সালের ১২ জুলাই সত্যি সত্যি আত্মপ্রকাশ করল ‘দৈনিক নবযুগ’৷ কবি নজরুল ইসলামের লেখার ফলে কাগজটি প্রথম দিনেই দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল৷পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে এ কে ফজলুল হকের অনুপ্রেরণায় কৃষক-প্রজা সমিতি প্রকাশ করে ‘কৃষক’ পত্রিকা;পত্রিকার প্রধান পরিচালক ছিলেন ‘কৃষক-প্রজা পার্টির’ সম্পাদক শামসুদ্দিন আহমেদ ও সম্পাদনায় আবুল মনসুর আহমেদ।বিশেষত আর্থিক অসুবিধার কারণে পত্রিকা দুইটি বেশিদিন স্থায়ীত্ব লাভ করেনি।

‘কৃষক প্রজা পার্টি’র আন্দোলনের স্লোগান ছিল ‘লাঙ্গল যার জমি তার’৷ এই স্লোগান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে৷ কৃষক প্রজা পার্টি ‘চাষী’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতো৷ রাজনীতি যেহেতু জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং জীবন নিয়েই সাহিত্যিকের কারবার। তাই রাজনীতিসম্পৃক্তি সাহিত্যিকের স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি তাঁর সাহিত্যে স্বীয় রাজনৈতিক চিন্তাকে তুলে ধরে ছিলেন।তিনি জানতেন সাহিত্য নান্দনিক, কিন্তু রাজনীতি নানা কৌশল ও জটিলতায় পূর্ণ। এ কথা মেনে নিয়ে রাজনীতি ও সাহিত্যকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় বটে, কিন্তু এ দুটোকে পরস্পর সম্পর্কহীন করে তোলা সম্ভব নয়।তাই শেরে বাংলা ফজলুল হক চেষ্টা করে ছিলেন সাহিত্য সৃষ্টি হোক গণমানুষের জন্য৷ গণমানুষের পক্ষে৷ তাঁর সাহিত্য বিপ্লবী চেতনায় সমৃদ্ধ হতে থাকে বাংলার জনগণ। আর আমরা জানি বিপ্লবী ধারার সাহিত্য যুগে যুগে রাজনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু রাজনীতির চরিত্রই হলো কারো মাধ্যমে প্রভাবিত না হওয়া। সকলের ওপর প্রভাব বিস্তার করাই রাজনীতির ধর্ম। সাহিত্যের ধর্মও তাই। ফলে বিপ্লবী সাহিত্য রাজনীতির প্রতিপক্ষ হয়েই টিকে আছে আজও।

বিপ্লবী সাহিত্য গণমানুষের পক্ষে এ কথার সাথে এটাও বলা যায় যে সকল সাহিত্যই মানুষের পক্ষে। এই মানুষ অবশ্যই ব্যক্তিমানুষ।মানুষের স্বাধীনতা ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত বলে স্বাধীনতা ও অধিকারের কথা বলতে গেলে একজন সাহিত্যিককে রাজনীতির ভাষা ব্যবহার করতে হয়। তখনই সাহিত্যে রাজনীতির কথা উঠে আসে৷ এই চিন্তা চেতনার ধারক বাহক ছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক৷

বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। সাহিত্য ও রাজনীতি দুটোকেই রবীন্দ্রনাথ আত্মজাগরণের উপায় বলে মনে করেছেন। ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতি ছিল নজরুলসাহিত্যের মৌলিক চেতনা। প্রথম বিশযুদ্ধের পর নজরুল যখন নিয়মিতভাবে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন তখন বিশ্বের ৭০ ভাগ রাষ্ট্র ছিল উপনিবেশ এবং ৭২ ভাগ মানুষ ছিল পরাধীন। সকল সর্বভারতীয় নেতা যখন ব্রিটিশ সরকারের নিকট থেকে সীমিত আকারে স্বায়ত্বশাসন কিংবা স্বরাজের দাবি আদায় করা নিয়ে ব্যস্ত তখন একা নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখলেন ‘ স্বরাজ টরাজ বুঝি না…ধূমকেতু সর্বপ্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।’ এটা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় রাজনীতি।

সাহিত্য রাজনীতির জ্বালানি সরবরাহ করে এসেছে যুগে যুগে ৷তাই রাজনীতিকে সাহিত্যের কাছে যেতে হয়েছে। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’, ‘ দেবী চৌধরাণী’, রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’, ‘চার অধ্যায়’, শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’, নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’, ‘কুহেলিকা’ রাজনীতির জ্বালানি সরবরাহকারী সাহিত্য। মানবিক রাজনৈতিক আন্দোলনকে উজ্জীবিত করা সাহিত্যের একটি কাজ। তবে এটি খুব বেশি বড় কাজ নয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল দর্শনকে যুগে যুগে মানুষের চেতনায় বহমান রাখাই সাহিত্যের সবচেয়ে বড় কাজ।সাহিত্যের সাথে রাজনীতির এই মেলবন্ধন চিরন্তন। তাই আজও ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী সাহিত্য, ভাষা আন্দোলনের চেতনাবাহী সাহিত্য,মানুষের চেতনায় বহমান।এ.কে. ফজলুল হক রচিত গ্রন্থের নাম ‘বেঙ্গল টুডে’৷ এই চেতনার মূর্ত প্রতীক ছিলেন শেরে বাংলা ফজলুল হক৷

আজ ২৬ শে অক্টোবর শেরে বাংলা ফজলুল হকের সার্ধশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দিন৷ বাঙালি জাতির গণচেতনার দিন৷ বাঙালির রাজনৈতিক সচেতনতার দিন৷

সূত্র:
১। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক – ভবেশ রায়, প্রকাশক – স্বপ্না নাথ, পন্ডুলিপি ৩৮/ ২খ, বাংলা বাজার, ঢাকা-১১০০, সাল-২০০৪।

২।পূর্ব বাংলার রাজনীতি ও মুসলিম লীগ ( ১৯০৬-১৯৪৭)– গবেষক নাজমুন নাহার, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সাল -২০১৯৷

৩। বিশেষ ঋণস্বীকার – প্রাবন্ধিক দীপক সাহা।

You may also like