মে-দিবস: শ্রমদাসত্ব থেকে মুক্তির আহ্বান

by Vinnokatha

বন্ধুগণ, সারা বিশ্বের সচেতন শ্রমিকশ্রেণী প্রতিবছর মে-দিবস উদযাপন করে আসছেন। কিন্তু ১৮৮৬ সালে ৮ ঘন্টা কাজ ও শ্রমদাসত্ব থেকে চিরতরে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে চিকাগোর হে-মার্কেটের শ্রমিকরা যে লড়াই শুরু করেছিলেন তা কি পূরণ হয়েছে? হয়নি।কেন হয়নি?সমস্যা কোথায়?শ্রমিকশ্রেণীর সচেতনতা,সংগঠন ও নেতৃত্বের অভাব ও সুবিধাবাদী কিছু নেতার বিশ্বাসঘাতকতা শ্রমিকশ্রেণীকে আজ অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে। তাই প্রতিটি দেশে শোষক-শাসকশ্রেণী গভীর সংকটে পড়ে গেলেও শ্রমিকশ্রেণী তার সুযোগ নিতে পারছে না। ফলে শাসকশ্রেণী তার সমস্ত সংকটের বোঝা জনগণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে।

৮ ঘন্টা কাজের অধিকার কেড়ে নিয়ে ১০/ ১২ ঘন্টা এমনকি তারও বেশি খাটতে বাধ্য করা হচ্ছে। জীবন ধারণের প্রয়োজনীয় খরচের অনেক কম মজুরিতে খাটতে বাধ্য করছে। গায়ে-গতরে খেটেও প্রতিশ্রুত মজুরিও অনেক সময় পাওয়া যায় না। কাজের শেষে মজুরিও অনেক সময় পাওয়া যায় না। যেমন, ১০০ দিনের কাজের মজুরি। পিএফ, ইএসআই সহ অর্জিত সকল অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত বেকারে ছেঁয়ে গেছে সারা দেশ। বিদেশি পুঁজির নির্দেশে সরকারি-বেসরকারি শিল্প, ব্যবসা,পরিসেবার সকল ক্ষেত্রে চুক্তিপ্রথা, ঠিকাপ্রথা লাগু করা শুরু হয়েছে। শ্রম আইন তুলে দেওয়া হয়েছে। মালিকশ্রেণীর নির্দেশে নতুন ৪টি মালিকঘেঁষা শ্রমআইন তৈরি করা হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন করার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এক কথায় শ্রমিকশ্রেণীসহ সকল মেহনতি জনগণের জীবন দুরবস্থার চরম পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে দুনিয়ার বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট পুঁজিপতি ও তাদের দালালরা।

দেশি-বিদেশি বড়ো ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিরা দেশের জল-জঙ্গল-জমি-খনি-পাহাড়-নদী-মানব সম্পদ লুটের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তার জন্য দেশের সংবিধান মানছে না। লুটের জন্য আইন-কানুন বদলে নিচ্ছে। প্রতিবাদ করতে গেলে জনগণের উপর রাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ছে। খুন,জখম,গ্রেফতার আকছার ঘটছে।

দেশের শিক্ষা, শিল্প, পর্যটন, ব্যাঙ্ক, রেল, বিমান, বন্দর, সড়ক নির্মাণ, প্রতিরক্ষা, ক্ষুদ্র ব্যবসা,পরিসেবার এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে বিদেশি পুঁজির নিয়ন্ত্রণ নিতে সুযোগ করে দিচ্ছে না সরকার। দেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করার পাশাপাশি শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক দলগুলো আকন্ঠ দুর্নীতির পাঁকে ডুবে আছে। তাঁদের কাছে প্রভুদের সেবা ও নিজেদের পয়সার থলিটাই সব। মনে রাখতে হবে, ভোটবাজ দলগুলো শোষক পুঁজিপতিদের টাকায় চলে। তাই যে নামের ভোটবাজ দল হোক না কেন সেগুলো সব দেশি-বিদেশি বড়ো ব্যবসায়ী ও কর্পোরেটদের দল।

চীন, রাশিয়া, আমেরিকাসহ অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী লুটেরা দস্যুদেশগুলোর পণ্য বিক্রির জন্য ভারতের দরজা পুরোমাত্রায় খুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে দেশের শিল্পগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না। অর্থ্যাৎ এককথায় দেশটাকে আমদানি নির্ভর অর্থনীতির দেশে পরিণত করে ফেলা হয়েছে। এটাই বেকার সমস্যা ও স্বল্পমজুরির প্রধান কারণ।

শুধু তাই নয়, কেন্দ্রের ঋণের পরিমাণ প্রায় দুইশো লক্ষ কোটি টাকা। রাজ্যগুলোর ঋণের পরিমাণ প্রায় ঐরকম। অর্থাৎ দেশটাকে শাসকশ্রেণী ঋণনির্ভর ও দেউলিয়া করে ফেলেছে। এইসব ঋণের সুদ মেটাতে সরকার নানারকম কর, সেচ, পেট্রোপণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছে। ফলে দারিদ্র্য বেড়েই চলেছে। এভাবে দেশ চললে বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সমস্যার সমাধান হবে না।


ধর্ম-বর্ণ-জাতিতে বিভক্ত শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠলে তীব্র শোষণ-লুটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। তাই দেশি-বিদেশি শোষকশ্রেণী ষড়যন্ত্র করে ধর্মে-ধর্মে, বর্ণ-বর্ণে, জাতিতে-জাতিতে, গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে, প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ তৈরি করছে, আর অন্ধভক্ত লুম্পেনদের দিয়ে দাঙ্গা তৈরি করছে। শ্রমজীবী জনগণের এক অংশের বিরুদ্ধে অন্য অংশকে লেলিয়ে দিচ্ছে, ফলে শ্রমিকশ্রেণীর মানুষ শ্রমিকশ্রেণীর শত্রুতে পরিণত হচ্ছে। এভাবে শোষিত শ্রমজীবী জনগণের ঐক্য নষ্ট হচ্ছে। আর শ্রমজীবী জনগণের কাছে তাদের প্রকৃত শত্রু শোষকশ্রেণীগুলো আড়াল হয়ে যাচ্ছে। ভেবে দেখেছেন কি এতে কাদের লাভ,কাদের ক্ষতি?দেশি-বিদেশি শোষকশ্রেণীগুলো নিরাপদে শ্রমজীবী জনগণকে লুট করে সম্পদের পাহাড় বানাচ্ছে,আর দারিদ্র্যের অতল গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছে শ্রমজীবী জনগণ। তাঁদের বর্তমান ও ভবিষ্যত,ছেলে-মেয়েদের বর্তমান ও ভবিষ্যত অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। আর ভাগ্যের দোহাই দিয়ে আমরা হাঁ-পিত্যেশ করছি।

ব্রাহ্মণ্য(বর্তমানে হিন্দুধর্ম বলে প্রচার করা হচ্ছে), ইসলাম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, সারনা প্রভৃতি ধর্মে শ্রমিকশ্রেণী আছে, আছে শোষকশ্রেণী। বাঙালি, বিহারি, ওড়িয়া, তামিল, তেলেগু, মারাঠি, গুজরাটি প্রভৃতি জাতিতে বেশিরভাগ আছে শ্রমিকশ্রেণী, আছে সংখ্যালঘিষ্ঠ শোষকশ্রেণী।বেশিরভাগ ওবিসি, দলিত,আদিবাসী জনগণ শ্রমিক ও দরিদ্র কৃষক। তাঁরা শোষিতশ্রেণী। একই ধর্ম ও জাতির শোষকশ্রেণী কি ঐ ধর্মের ও জাতির শ্রমিক ও কৃষককে শোষণের হাত থেকে ছাড় দেয়? দেয় না। তাই শ্রমজীবী জনগণের প্রথম পরিচয় তাঁরা শ্রমিকশ্রেণী, শোষিতশ্রেণী।এই পরিচয় ও শ্রমজীবীদের ঐক্যটা ভেঙে দিতে পারলে শোষণে বাধা থাকে না শোষকশ্রেণীর। তাই বিশ্বের চরম সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীদের শোষণ টিকিয়ে রাখার উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে নির্মম লুটপাট, অবিরাম যুদ্ধ ও অন্যদিকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভাজন, আর দাঙ্গা। এই সার কথাটি সকল ধর্ম-বর্ণ-জাতির শ্রমজীবী মানুষকে বুঝতে হবে। অন্যকে বোঝাতে হবে।

কিন্তু এটাই কি সব? না। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মানুষকে নতুন করে ভাবাচ্ছে। শ্রমজীবী জনগণের এগিয়ে থাকা একটা অংশ অতীতের ভুলগুলো চিহ্নিত করছে, অতীত থেকে শিক্ষা নিচ্ছে। তাঁরা দেখছেন শ্রমিকশ্রেণীকে রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠতে হবে। আর এটা তাঁদের পক্ষে সম্ভব। দরকার শুধু ইচ্ছাশক্তির। শ্রমিকশ্রেণী তার মেধা ও শ্রম দিয়ে দুনিয়ার সবকিছু তৈরি করে আসছে যুগ যুগ ধরে। অতীতে তাঁরা বিদ্রোহ করে শোষণমূলক দাসব্যবস্থা, জমিদারি ব্যবস্থা পাল্টে দিয়েছে। ফ্রান্স, রাশিয়া, অন্যান্য কয়েকটি দেশে শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে তাঁরা শোষণহীন সমাজ চালু করেছে, দেশ পরিচালনা করেছে। সুতরাং উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তন ও দেশ পরিচালনার কাজ সবটাই তাঁরা করেছেন। কিছু ভুলের জন্য পিছিয়ে পড়তে হয়েছে। জীবনে আমরা অসংখ্য ভুল করি, তাতে কি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকি? না, ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনে এগিয়ে চলি। এটাই বিশ্ব-জগতের নিয়ম।

সারাবিশ্বের শ্রমিকশ্রেণীর একটা অংশ এটা বুঝতে পেরেছে যে তাঁদের বেঁচে থাকার লড়াই তাঁদের করতে হবে, সেই লড়াইয়ের সংগঠন তাঁদের নিজেদের গড়ে তুলতে হবে, সেই লড়াইয়ে তাঁদেরকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে পরাস্ত করতে হবে। ৮ঘন্টার কাজ ও বাজারমূল্যে মজুরির দাবিতে শ্রমিক ঐক্য গড়ে তুলে লড়াই তীব্রতর করতে হবে। ১০০ দিন নয়, সারা বছর কাজের দাবিতে ও নারী, পুরুষ, ট্রান্সমেনসহ সকলের কাজের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ঠিকাপ্রথা, চুক্তিপ্রথা, অস্থায়ী নিয়োগের বিরুদ্ধে ও স্থায়ী নিয়োগের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষা শেষে কাজের দাবিতে ছাত্র ও বেকার যুব আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।সমান কাজে সমান মজুরির দাবিতে ও সমস্ত ধরনের শোষণ লুটপাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, নারী, ট্রানসমেন, শ্রমিকশ্রেণী ও সকল মেহনতি জনগণের উপর শাসকশ্রেণী ও তার গুণ্ডাবাহিনীর প্রতিটি অন্যায়, অবিচার, শোষণ, জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের উপর যৌন নির্যাতন ও দেশব্যাপী নারীধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। জাতপাত, ধর্ম, আঞ্চলিকতা, উগ্রজাতীয়তার বাধা অতিক্রম করে শ্রমজীবী জনগণের ঐক্য গড়ে তোলার উপর জোর দিতে হবে। পুঁজিবাদী- সাম্রাজ্যবাদী, সামন্তবাদী শোষণের রূপগুলোকে বোঝার উপর জোর দিতে হবে।শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থবিরোধী শোষকশ্রেণীর সমস্ত রাজনীতির স্বরূপ উন্মোচন করতে হবে। এভাবে শ্রমজীবী জনগণের রাজনৈতিক চেতনা উন্নত করতে হবে। শহরের শ্রমিক ও মেহনতি জনগণের সংগ্রাম এবং গ্রামের কৃষকদের গণতন্ত্রের লক্ষ্যে কৃষক সংগ্রামের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। ভবিষ্যতে শ্রমিক-কৃষকের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব কায়েমের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে।

( লিখেছেন সমীরণ সর্দার )


You may also like

Vinnokatha
Prothom Khondo
Price: Rs.260/-
www.vinnokatha.in
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে। সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে।সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
Vinnokatha
Prothom Khondo