শ্রেণি বাদে অন্য পরিচিতিগুলো সামনে আসছে কেন, কবে থেকে

by Vinnokatha

সন্দীপ ব্যানার্জি

কোনো কারণে যদি কেউ শোষিত, নির্যাতিত হয়, এবং যদি তার সুরাহা নিয়ে সমাজে কোনো শক্তি কার্যকরী কিছু না করে, তবে সেই শোষিতেরা, নির্যাতিতেরা এককাট্টা হয়ে লড়ার পথে যেতে বাধ্য হয়। যেমন ধরা যাক আমেরিকায় কালো চামড়ার জনগণ একজোট হয়েছে। বারবার লড়াই-এ নেমেছে। ভবিষ্যতেও নামবে যতদিন বর্ণবিদ্বেষ, কালো চামড়ার মানুষদের প্রতি ঘৃণা ইত্যাদি নোংরামো সমাজে থাকবে।

এটা ঠিকই যে, আব্রাহাম লিঙ্কনের নেতৃত্বে এক বিরাট বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধ হয়েছে আমেরিকাতে – ১৮৬১ সাল থেকে টানা দু’বছর। সেই যুদ্ধে লিঙ্কনদের বিজয়ের মধ্যে দিয়ে কালো চামড়ার লোকেদের ক্রীতদাস হিসেবে খাটানো বন্ধ হয়। কিন্তু বর্ণবিদ্বেষ কি উঠে গেছিলো? না। আর তাই বারে বারে কালো জামার লোকেদের বিদ্রোহ। বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে বিরাট লড়াই তো ৫০ ব হয়েছে। তবে এখনও নানা বড়ো প্রতিবাদ হচ্ছে নিগ্রোদের ওপর পুলিশের গুলি চালানো, নিছক সন্দেহবশে গুলি করে হত্যা ইত্যাদির বিরুদ্ধে।

সেরকমই, ভারতে নিচু জাতেরা জনগণ, বিশেষ করে দলিতরা (যাদেরকে এদিকের লোকেরা শিডিউলড কাস্ট বা তপশিলি জাতি হিসেবেই লোকে বেশি জানেন তারা) সংগঠিত হয়েছে, লড়েছে। তাদের নিয়ে অন্যেরা যদি নিছক ভোটের জেলা খেলে, তাদেরকে যদি পার্টিগুলো শুধু “ভোটার” হিসেবেই দেখে তো তারও পার্টিগুলোকে ধান্দাবাজ ও কার্যত উঁচুজাতের পার্টি হিসেবেই দেখবে। নারীদের আলাদা করে সংগঠিত হতে হয়েছে তাদের দাবির দিকে বিশেষ জোর দেওয়ার জন্য। শোষিতদের কোনো পার্টি যদি এরকম থাকতো যারা নারীদের সমস্য নিয়ে লড়তো, সত্যিই লড়লো দলিতদের সমস্যা নিয়ে, কাশ্মীরি, মণিপুরি সমেত জাতিদের সমস্যা নিয়ে, অবহেলিত ভাষার সমস্যা নিয়েও লড়তো, তাহলে হয়তো এরকমও হতে পারতো যে, তার মধ্যে দিয়েই সব ধরনের লড়াই হতো। তবে, কী হতে পারতো ভেবে তো আর লাভ নেই। হয়নি এটা বাস্তব। আর তাই নিপীড়িত, শোষিত বর্গগুলোকে লড়াই নিজেরাই সংগঠিত হয়ে করতে হয়েছে।

এই আলোচনাটা অনেক বড়ো। অর্থাৎ বিভিন্ন পরিচিতি নিয়ে সমাজে সংগঠিত হওয়া ও সমাজের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, কবে কোথায় কীভাবে শুরু হলো। আমরা এখানে অতটা করতে পারবো না। শুধু শ্রেণিপরিচিতি, শ্রেণিবোধ- এর জায়গায় ধর্ম-পরিচিতি বা ‘আমি হিন্দু’ বনাম ‘আমি মুসলমান’ এসব সামনে আসলো কী করে, কবে, কেন এসব দেখবো।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ হিন্দু জনগণের উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়া ও এপাড়ে চলে আসা, এবং তারপরে আবার ১৯৫৯ ও ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ- এসব সত্ত্বেও কিন্তু পশ্চিমবাংলায় শ্রমিক অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা তেমন মাত্রায় ঘটেনি। যদিও কিছু গন্ডগোল কিছু কিছু বিশেষ ও মিশ্র ধরনের অঞ্চলে হয়েছে। সেসবও মূলত কিছু দুষ্কৃতকারীর কাজ ছিল। সাধারণ খেটে যাওয়া জনগণ খুব তাতে অংশ নিয়েছে তা নয়। অন্তত ১৯৮০-৮৪ পর্যন্ত এরকম চিত্র ছিল। দাঙ্গা বললেই সাধারণত অন্যান্য রাজ্যের কথা মনে আসতো। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর সারা দেশে যে শিখ বিরোধী দাঙ্গা হয়, তা দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এরাজোও বেশ কিছু শহরাঞ্চলে ঘটে যায়। তারপর সেই কুখ্যাত ১৯৯২-এর বাবরি মসজিদ ভাঙার পরের দাঙ্গা। নানা শ্রমিক অঞ্চল থেকে বহু কমবয়সি হিন্দু যুবকেরা করসেবক হয়ে অযোধ্যায় গেছিল।

যে জিনিসটা ১৯৪৭ থেকে ধরুন ১৯৮৪ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের খেটেখাওয়া জনগণের একজোট ঠাসা সামাজিক বুনট বজায় রেখেছিল, সেটা শ্রেণি হিসেবে একসাথে থাকা, একসাথে কাজ করা, একসাথে মালিকশ্রেণি ও সরকারের বিরুদ্ধে লড়া- কখনও কারখানায়, কখনও নিজের অঞ্চলে, কখনও নিজেদের শিল্পে- যেমন গোটা পাট, বা চা শিল্পে, কখনো সারা রাজ্যে বা আরো বড়ো আকারে। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশক শ্রমিক-কৃষকদের লড়াই-এর জন্য বিখ্যাত। না হলে চিন্তা করুন না- ১৯৭০ দশক থেকে সংগঠিত শিল্পে চালু হলো ডি.এ. ব্যবস্থা, যাতে বাজারের দামের সাথে আয়ও কিছু বাড়ে; তৈরি হলো ঠিকা ও অস্থায়ী শ্রমিকদের স্থায়ী করার আইন…।

কিন্তু বাম দলগুলো ১৯৭৭-এ একাধিক রাজ্যে সরকার তৈরি করে সরকার যে করেই হোক টিকিয়ে রাখার যে লাইন নিল, তাতে মালিকশ্রেণির সাথে সমঝোতা, সহযোগিতা বাড়ালো। শ্রমিকদের ভয় পাওয়ানো শুরু হলো। বেশি কিছু করতে গেলে কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এভাবে মালিকশ্রেণির জুলুম জোর করে গিলিয়ে দেওয়া শুরু হলো। দুর্নীতি ধীরে ধীরে গ্রাস করলো। পার্টির যে, কোনো আদর্শ বলে ব্যাপার আছে তা উবে গেল। লালবান্ডা তার ইজ্জত হারাতে লাগলো, তার আকর্ষণ হারাতে লাগলো। বরং তখন যুবকদের মনে হচ্ছে ধর্মীয় বা গোঁড়া হিন্দু বা গোঁড়া ইসলামপন্থি সংগঠনগুলোর যেন তবু কিছু আদর্শ আছে। খেটেখাওয়া জনগণের কাছে তার মেহনতি শ্রেণি পরিচয়ের থেকে বড়ো হিসেবে মনে হতে লাগলো ধর্মীয় পরিচয়কে।

অন্যদিকে দেখুন- বহু বছর ধরে লড়াইহীন পরিবেশে থাকার ফলে, মেনে নেওয়ার পরিবেশে থাকার ফলে, দিনরাত নেতার কাছে শোনা বেশি লড়ার কথা বোলো না কারখানা বন্ধ হযে যাবে, চাকরি চলে যাবে, কেউ বাঁচাবে না- এসব শুনতে শুনতে লড়াই-এর ওপর আস্থাও চলে গেল। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। নিয়তির লিখন কি বদলানো যায়! ধীরে ধীরে ‘তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’, বা ‘লড়াই ছাড়া বাঁচার কোনো পথ নেই’ এসব স্লোগানের বদলে বেশি করে কানে আসতে লাগলো ‘ভোলে বাবা পার করেগা’, ‘জয় জগদীশ হরে’।

সিপিএম-দের বামফ্রন্ট ১৯৭৭-এ সরকারি ক্ষমতায় আসার কিছু পরে বেরোনো সিনেমা “জয় বাবা তারকনাথ” তখন বাস্তবের মাটিতে রমরম করে চলছে। ওদিকে সারা পৃথিবীতে যেটা ‘কমিউনিস্ট’ বা সমাজতন্ত্র নামে পরিচিত ছিল- সেসব সাঙ্ঘাতিকভাবে মুখ থুবড়ে পড়লো। যেই হেরে যাওয়ার মধ্যে গৌরব নেই- আছে গ্লানি। আদর্শের জগতে এলো শূন্যতা।

১৯৯০-৯১ থেকে যেন একটা আলাদা সময় এসে গেল। যেন সব বদলে গেল। অন্যদিকে ১৯৮৮ থেকে টি.ভি.তে রামায়ণ, তারপরে এলো মহাভারত। আফগানিস্তানে এলো মুজাহিদিন, তালিবান। বিজেপি নেতা আদবানীর “রাম রথের” যাত্রা হলো। ১৯৯২-র ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদ ভাঙা হলো। এইভাবে ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ, পরস্পরকে অবিশ্বাস, সন্দেহ, ভালোমাত্রায় সামনে চলে এলো সমাজে।

(লেখাটি ‘অপ্রচলিচ-র বিশেষ বইমেলা সংখ্যা, জানুয়ারি-মার্চ , ২০২৪ এ প্রকাশিত)

You may also like