দেশভাগ পরবর্তী বাঙালি মুসলমানের মন এবং তাদের শিক্ষা প্রসঙ্গ

by আবদুস সালাম

বয়ে যাওয়া নদী সৃষ্টির রহস্যময় প্রাণস্পন্দনকে ভিন্ন ভিন্ন ধারায় হাজার হাজার বছর ধরে বয়ে নিয়ে চলেছে। প্রাণের সৃষ্টির এই ধারাবাহিকতা বাঁক নিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পথে। কখনো তার হয়েছে উত্থান আবার কখনো তার পতন। জীবন সংগ্রামের এই জটিলতম পথে নিজেদের বাঁচার তাগিদে মত ও পথ বদলেছে বারবার। প্রায় দুশো বছর ইংরেজদের দ্বারা অত্যাচারিত, পদদলিত, শোষিত ও শাসিত হতে হতে নিজেরাই উপলব্ধি করতে পেরেছি আমাদের পরাধীনতার দিন শেষ হয়েছে। ইংরেজরাও বুঝতে পারল ভারতের জনগণকে আর জাদু করে, সম্মোহনি মন্ত্র উচ্চারণ দ্বারা  বশ করে রাখা যাবে না। ফলস্বরূপ আমরা পেলাম স্বাধীনতা। পেলাম খন্ডিত ভারত। 

এতো দিনের অখন্ডিত ভারতবর্ষ পেল রক্তাক্ত যমজ দুটি শিশু রাষ্ট্র। স্বাধীন ভারত আর স্বাধীন পাকিস্তান। এই দুই রাষ্ট্রের গভর্ণর জেনারেল হলেন লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন। স্বাধীনতা ঘোষণা দিতেই  ১৪ই আগস্ট তিনি চলে গেলেন পাকিস্তান। মহম্মদ আলি জিন্নাহ কে শপথ বাক্য পাঠ করাতে। সেদিন জিন্নাহ হলেন উভয় (পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান) পাকিস্তানের রাষ্ট্র প্রধান। সেই অনুষ্ঠান শেষে তিনি ফিরে এলেন দিল্লী। এলেন নেহরুকে প্রধানমন্ত্রী পদের শপথ বাক্য পাঠ করাতে। 

অন্য দিকে ভারতে ও পাকিস্তানের ভিতর চলছে হত্যা যজ্ঞ। মর্মবিদারক ঘটনায় দেশের লোক স্তম্ভিত। সেদিন  হাজার হাজার দেশপ্রেমিকের চৈতন্য লোপাট হয়ে যায়। ক্ষমতা ভাগাভাগির খেলায়  স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা নেত্রীগণ মেতে ওঠে। অনবদ্য এই আনন্দোৎসব থেকে দূরে রইলেন মহাত্মা গান্ধী। ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার কেন্দ্র বিন্দু  ছিল কলকাতা । গান্ধীজী সকল সভা সমিতিতে বলে চলেছেন “আমার হৃদয় শুকিয়ে গেছে।” অন্য দিকে হিন্দু ধর্মের ধ্বজাধারীরা অপবাদ দিতে লাগলো যে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অন্যায় ভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছেন গান্ধীজি। এর ফলে তিনি দৈহিকভাবে আক্রান্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। সচেতনা মূলক  হুমকি স্বরূপ নিহত হওয়ার ১০দিন আগে এক  প্রার্থনা সভাতে  বোমা পড়ে। আতঙ্কে থাকেন সবাই। অবশেষে ১৯৪৮সালে ৩০ জানুয়ারী নাথুরাম গডসে গান্ধীজির শরীর ঝাঁঝরা করে দেন।

১৯৪৭ সালের এপ্রিলেও বোঝা যায়নি আগস্টে দেশভাগ হবে। এপারের মানুষ ওপারে যাবে। ওপারের মানুষ এপারে। মুর্শিদাবাদ, খুলনার মানুষ বিভ্রান্ত —তাদের অংশে ভারত না পাকিস্তানের পতাকা উড়বে। সিলেটের করিমগঞ্জে পাকিস্তানের পতাকা উড়েও নেমে যাবে। প্রাক্তন এক ইংরেজ বিচারক স্যার সেরিল র‍্যাডক্লিফ যিনি আগে কোনোদিন ভারতবর্ষে আসেননি, ভালো করে ম্যাপ পড়ার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা (cartographic knowledge) যার নেই, প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই এ অঞ্চলের মানুষের জীবন সংস্কৃতি, ভাষা ও আনন্দ-বেদনার—তাকে কিনা দায়িত্ব দেওয়া হলো বাংলাকে বিভক্ত করার বাউন্ডারি কমিশনের। তার আঁকিবুঁকি ও নানা কূটকৌশলের রাজনৈতিক সমীকরণে কোটি কোটি মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা আর বিপর্যয় নেমে আসে। অনেকের নতুন পরিচয় হয় উদ্বাস্তু। ছেড়ে যেতে হয় সাত পুরুষের বসতি, স্মৃতি ও সংগ্রামের ভূমি, নদী, মাঠ-ঘাট, আশৈশব হেঁটে যাওয়া চেনা পথ, প্রান্তর।  তারা চিন্তাই করতে পারেনি  তাদের পেছনে পড়ে থাকবে ধূ ধূ স্মৃতির ভূমি, স্বজনের কবর আর শ্মশান। অসহায় অজস্র মানুষের স্থান হলো রিফিউজি ক্যাম্পে। কেউ যাবে দূর পৌরাণিক কাহিনীর অনুর্বর দেশে—দণ্ডকারণ্যে। তাদের সংগ্রাম ও গভীর বেদনা ফুরাবে না এক জীবনে।

বাংলা ভাগের ফলে ভারত থেকে প্রায় বিশ লাখ মুসলমান তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে আসেন। অন্যদিকে, পূর্ববঙ্গ থেকে ৫৮ লাখ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ভারতে দেশান্তরী হন। বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা আরও বেশি। বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে এই দেশান্তরী হওয়া ছিল বিরামহীন। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের উগ্রবাদী ও সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির কুশীলবরা সংখ্যালঘু অনেককেই ভয়-আতঙ্ক দেখিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। সাতচল্লিশের পর পঞ্চাশে, ১৯৬৪ সালে কাশ্মিরে হজরতবাল মসজিদের দাঙ্গার সময়, পঁয়ষট্টিতে পাক-ভারত যুদ্ধের প্রাক্কালে এবং একাত্তরে যুদ্ধের সময়ও অনেকে এপারে এসেছেন।

কেন এত দূরে, কাদের সিদ্ধান্তে এবং ফয়সলায় আজ জন্মভূমি থেকে নির্বাসিত। ক্লারিয়েটে বাজে অন্তহীন এক বেদনার সুর। তবে নিজ ভূমি থেকে নির্বাসিত অন্যরা এ অঞ্চলে বেশ আছে বলে জানায়। কেননা, দণ্ডকারণ্যের মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে সফল প্রকল্প। যেখানে মানুষ—প্রকৃতির বদান্যতায় একটু স্বস্তিতে ছিল। প্রজন্ম পরম্পরায় যাপিত জীবনে দুঃখের দহন কিছুটা প্রশমিত হলেও স্মৃতির দহন কী আমৃত্যু ফুরোয়? ভারতের বিভক্তিকরণ শুধু একটি সাংবিধানিক দেশবিভক্তিতেই নিষ্পত্তি হয়নি, বরং বহু ক্ষেত্রেই তা ছিল অসংখ্য ঘরগেরস্তালি, পরিবার ও মানুষের জীবনের মর্মান্তিক ব্যবচ্ছেদ। ইতিহাসবিদ  জ্ঞান পাণ্ডের মন্তব্য, “ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় দেশ বিভক্তির অবস্থান স্ববিরোধী।”

একদিকে জাতীয়তাবাদী এবং পেশাদার ঐতিহাসিকদের চেতনাবোধে দেশভাগ অনেকখানি আধিপত্য বিস্তার করেছিল। এর মূল কারণটি খুবই স্পষ্ট। এই উপমহাদেশের ইতিহাসে ভারত বিভক্তিকে বলা চলে বিশ শতকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই ‘সাম্প্রদায়িকতা’র ইতিহাসবেত্তারা অর্থাৎ উনিশ ও বিশ শতকের হিন্দু ও মুসলিম রাজনীতির ইতিহাস-রচয়িতারা এমনভাবে ইতিহাস লিখেছেন যে মনে হয় সবটাই যেন দেশ বিভক্তির পূর্ব ইতিহাস। এর একই সমান্তরালে ভারতীয় জাতি ও তার জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের জন্য ‘ভারতের সরকারি ইতিহাস ছিল অন্যতম সংকটের বিষয়’। এটি ছিল দেশভাগের ঘটনাবলির আড়ালে ঢাকা পড়া এক ষড়যন্ত্রের ইতিহাস, ভবিষ্যতের জাতির জন্য যেখানে রয়ে গেছে বহু শিক্ষণীয় বিষয়। এই ইতিহাস কখনও সেই সব মানুষের জীবন আর অভিজ্ঞতার কথা ধরে রাখেনি, যাঁরা সেই সংকটকাল পাড়ি দিয়েছেন। এই ইতিহাস লেখনি কীভাবে চল্লিশের দশকের ঘটনাপ্রবাহ তাঁদের মনে ছাপ ফেলেছে তা উল্লেখ করেনি। এই গণমানুষের পরিচিতির সংকট আর অনিশ্চয়তার কথা, যা দেশভাগের কারণেই তাঁদের জীবনে সৃষ্ট বা আরোপিত। সুমিত সরকার লিখেছেন, “শুধু ব্রিটিশ, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের আলাপ-আলোচনা প্রসঙ্গেই রয়েছে এক বিশাল পরিমাণ নথিপত্র, যার চূড়ান্ত পরিণতি হলো এমন এক স্বাধীনতাপ্রাপ্তি, যা ছিল পক্ষান্তরে এক ট্র্যাজিক দেশ বিভাগ।”

মাতৃভূমি থেকে উৎখাত হওয়ার বাস্তবতা, উদ্বাস্তু, সহস্র মানুষের দেশত্যাগ, সাম্প্রদায়িক ধর্ষণ, অপহরণ, বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ প্রভৃতি নির্মম ঘটনা দিয়ে নির্মিত হয়েছে দেশ বিভাগ নামক দেশ ব্যবচ্ছেদ, যা সংঘটিত হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট কালব্যাপী এবং অব্যাহত থেকেছিল সরকারিভাবে বিভক্তিকরণের প্রায় বহু দিন পর্যন্ত।

যদিও ভারতের জন্য দেশভাগ অবধারিতভাবে হয়ে উঠেছিল হারানোর এক কালো আখ্যান। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকত্ব প্রাপ্ত বহু মুসলমানের জন্য ওই সময় ছিল অত্যন্ত উচ্চাশা এবং নজিরবিহীন সামাজিক উত্থানের সময়। অতএব সাতচল্লিশ-উত্তর সরকারি ঘটনাপ্রবাহ এসব আনন্দোন্মাদনাপূর্ণ মুহূর্তে ভরা। নতুন মাতৃভূমি অর্জনের আনন্দে পূর্ব বাংলার উচ্চবর্গীয় মুসলিম জনগণ ওই মুহূর্তের সাক্ষ্যপ্রমাণ হিন্দু জনগণের হারানোর দুঃখ কিংবা দুর্ভোগের ইতিহাসের চিহ্ন নথিপত্র থেকে মুছে ফেলেছিল। একই সঙ্গে উচ্চবর্গের বিবরণীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বপ্ন এবং আকাঙ্খাকে তাদের নিজস্ব প্রকল্পের সঙ্গে এক করে দেখা হয়েছিল।

চল্লিশের দশকের এক তরুণ মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টে লেখা তাঁর ডায়েরির পাতায়, সদ্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া আর আনন্দকে এভাবেই তুলে ধরেছেন। তিনি ডায়েরির পাতার একদম ওপরে ‘স্বাধীনতা’ কথাটা বড় হরফে লিখেছিলেন, যা তাঁর সব আবেগ-অনুভূতির জমাটবদ্ধ প্রকাশ। তাঁর লেখাতেই জানা যায়, সেদিনকার উৎসবমুখর বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার বর্ণনা। ঢাকা শহরের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় অধিবাসীরা দিন-রাত ব্যস্ত থেকেছে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের উদ্দেশ্যে । তোরণ নির্মাণ, সাজসজ্জা প্রভৃতির প্রস্তুতি নিয়ে।

একজন প্রখ্যাত জেলা পর্যায়ের কংগ্রেস নেতা প্রভাষচন্দ্র লাহিড়ীর বক্তব্যেও এর সমর্থন মেলে, ‘উত্তরবঙ্গের জেলা রাজশাহীতে আগত অগণন মানুষের প্রতিটি মুখ উদ্ভাসিত ছিল বহু আকাঙ্খিত স্বাধীনতার বিজয়ানন্দে।তাজউদ্দীনের দিনলিপিতে আকর্ষণীয় বর্ণনায় উঠে এসেছে স্বাধীনতা ও মুক্তির আনন্দে মুখরিত সেদিনকার আনন্দে উদ্বেলিত প্রাদেশিক শহর ঢাকার জীবন্ত ছবি। এই বিপুল আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ‘জাতীয় শক্তির বিস্ময়কর প্রকাশ’, ‘আনন্দোন্মাদনা’ প্রভৃতি অভিব্যক্তি।

বোঝাই যায়, এই বিজোয়ৎসবের দর্শকদের ‘আনন্দোন্মাদনা’ ছিল একমাত্রিক। রাজনৈতিক মুক্তির মুহূর্তে জনগণের এই বিচিত্র ধরনের প্রতিক্রিয়াকে জাতীয়তাবাদীরা প্রায়ই এক সহজাত গভীর আনন্দবোধ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এক মুসলিম কবি স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দে শরিক হতে গিয়ে পাকিস্তানকে অভিহিত করেছেন ‘চির ঈদের দেশ’ হিসেবে। অবশ্য এই গণহারে আনন্দ- উৎসব পালনের হিড়িক দেখে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে স্বাধীনতার আগমন উদযাপনকারী সব মানুষই এক ও অভিন্ন অনুভূতির সমান ভাগীদার। কেননা ‘পাকিস্তান’ কে ঘিরে থাকা বিভিন্ন ও বিপরীত প্রত্যাশাগুলোকে ‘আনন্দোন্মাদনা’ কথাটি একই সঙ্গে প্রকাশ ও আড়াল করে।

এমনকি জাতীয়তাবাদী রচনা এবং বক্তব্য এ দিনকে ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাবের পরাজয়ের পর থেকে সংঘটিত সব আন্দোলনের শীর্ষ মুহূর্ত হিসেবে অভিহিত করেছে। আবার অন্যপক্ষ একে ১৮৫৭-এর ব্যর্থ অভ্যুত্থানের কালক্রমে স্থাপন করেছে, ‘স্বাধীনতার জন্য তাদের অবচেতনভাবে প্রায় এক শতাব্দী প্রতীক্ষা করতে হয়েছিল।’ ‘পাকিস্তান—প্রতিশ্রুতির ভূমি, আশার ভূমি, সহস্র মানুষের জীবনের বিনিময়ে প্রাপ্ত যে দেশ’, জাতীয় সাহিত্যের পাতায় তখন এ ধরনের বক্তব্যের ছিল অবিরাম ছড়াছড়ি। কিন্তু এসব অত্যুক্তি মুসলিম লীগের চারপাশে ভ্রাম্যমাণ হাজার হাজার মানুষকে পরিণতিতে শ্রেণী ও ধর্মীয় বিভেদবর্জিত এক অভিন্ন মুসলিম জাতির ভ্রান্ত চেহারা ও ভাবমূর্তি দিয়েছিল।

 ইংরেজি লেখক  লিওনার্দো মোসেল তার লাস্ট ডেইজ অফ দ্য্য ব্রিটিশ রাজ গ্রন্থে স্বীকার করেছেন যে “ভারতবর্ষে ভারতীয় নেতৃবৃন্দ কি হিন্দু কি মুসলমান একটার পর একটা ভুল করেই গেছেন। তার ফলে  লক্ষ লক্ষ মানুষের চরমতম  নিগ্রহ ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে  ভারতবর্ষের অখন্ডতা নষ্ট হয়েছে।জন্ম নিয়েছে চরমতম ঘৃণা ও বিদ্বেষ। হত্যা হয়েছে  ভারতের অকলঙ্ক আশা ভরসা। হাজার হাজার দেশপ্রেমিকের চৈতন্য লোপাট হয়েছে। তাদের ত্যাগ তিতীক্ষাকে পদদলিত করা হয়েছে । সাধারণ মানুষের আশা আকাঙ্খা আজ প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। সবাই  মনে মনে বলছেন এর নাম কি স্বাধীনতা?”

গান্ধীজি, নেতাজি, বিবেকানন্দের ভাবনা আদর্শ আজ কোথায় যা পাবো বলে  ইংরেজদের হাত থেকে আদায় করে নিয়েছিলাম আমাদের স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার একি দুর্দশা? প্রশ্ন চিহ্ন উঁকি মারে।

ঐতিহাসিক কারণে মুসলিমরা অমুসলিমদের চাইতে অনেকটা পিছিয়ে আছে। উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর অ-মুসলিমরা কাজ পাওয়া আর উদ্দেশ্যে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা তথা আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু মুসলিমরা কিছুটা তাদের ধর্মীয় গোঁড়ামির জন্য চিরাচরিত মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।যুগোপযোগী পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে দূরে ঠেলে রেখেছিল প্রায় শতাব্দীকাল ধরে। মুসলিমরা অ-মুসলিমদের চাইতে একশ গুণ পিছিয়ে পড়েছিল শিক্ষাক্ষেত্রে। ফলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ব্যাবধান তৈরী হয়েছিল তা আর  পূরণ করা সম্ভব হয় নি।

দুই স্বাধীন দেশের উৎপত্তির গোড়া থেকেই  দুই  সম্প্রদায়ের লোকজন দেশের এপার ওপার করে। স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের মুসলমানরা কম স্বচ্ছল ছিল। কারণ অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল পরিবারের মুসলমান লোক ও চাকরি করা মুসলমান লোকেরা নবগঠিত  পাকিস্তান রাষ্ট্রের দিকে চলে যায়।অপর দিকে হিন্দু ধর্মের লোকেরা এপার তথা স্বাধীন ভারতে চলে আসে। থেকে যায় দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষের দল। সেটা উভয় দেশের পক্ষে একই ফর্মূলা। অপেক্ষাকৃত কম স্বচ্ছল পরিবারের মুসলমান জনসংখ্যা থেকে যায় এপারে। সব স্বচ্ছল পরিবার  যে চলে গেছে সেটা ভাবার ও কারণ নেই  তবে বেশিরভাগ মানুষ যে চলে গেছে তা না ভাবারও কোন  বিতর্ক নেই। শিক্ষা ব্যাপারটা  প্রাক স্বাধীন ভারতে স্বচ্ছল পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অস্বচ্ছল পরিবারের লোকজন এটা ভাবতেই পারতনা। বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠী। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের মুসলমানরা অশিক্ষার অন্ধকারে থেকে থেকে ব্যাবধানটা বাড়িয়েছে দিন দিন।

উনিশ শতকের গোড়ার দিকে Mountstuart Elphinstone  মন্তব্য করেছিলেন  “The special  measures were required to uplift the backward section of the Muslim community.” ১৯৩৫ সালের গভর্ণমেন্ট আইন এ একথারই পুনরাবৃত্তি করা হয়েছিল, “a Government act in 1935 offering Dalit Muslim reservation along with Dalit Hindus.” গত শতাব্দীর আটের দশকে  গোপাল সিং কমিটির  প্রতিবেদনে বলা হয়, “Sense of Discrimination prevailing among the minorities and that it must be eliminated root and branch we want the minorities to form  an effective part of the main stream.”

এরপর ৭৫ বছর পার হয়ে গেল। কনো সরকারের তরফ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আর স্বাভাবিক কারণেই মুসলমানেরা পিছিয়ে আছে। সরকার এস সি/ এস,টি এলাকায়  শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে যেভাবে এগিয়ে চলেছে সেভাবে মুসলিম সংখ্যালঘুদের এলাকায় শিক্ষা প্রসারের জন্য এগিয়ে আসেনি। প্রত্যন্ত এলাকায় স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও  শিক্ষার আলো জ্বালবার জন্য প্রদীপের (স্কুল) ব্যাবস্হা করতে এগিয়ে আসেনি। অবশ্য এর জন্যে মুসলমান কিছু অর্ধ- শিক্ষিত নেতাদের প্রশ্রয় পেয়ে ঐ প্রদীপ (স্কুল) নির্মাণ করা থেকে বিরত থাকার অঙ্গীকার করেছে। মুসলমান জনগণের এই অনিহা আর মাদ্রাসা নির্মাণের আগ্রহ আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে তাদেরকে পিছিয়ে রেখেছে। উন্নত মনস্কের লোকের অভাব এর জন্যেও দায়ী। ইদানিং পশ্চিমবঙ্গের কিছু বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসছে। এটা একটা ভালো দিক। তবে অনেক দেরিতে হওয়ায়  হিন্দুদের সঙ্গে একই রাস্তায় হাঁটতে অনেক ঘাম ঝরাতে হবে। তবে একটা ইতিবাচক দিক পরিলক্ষিত হচ্ছে যে শিক্ষার মানচিত্র বদলে যেতে শুরু করেছে। 

একবিংশ শতকে সারা পৃথিবীতে শিক্ষার প্রসার ও হালচাল  দ্রুতগতিতে পাল্টে যাচ্ছে। হিন্দুরা এটা যতো তাড়াতাড়ি আপন করে নিতে পেরেছে, মুসলমান জনসংখ্যা অনেক দেরি করে বুঝতে পেরেছে। তাই তাদের সমকক্ষ হতে আমাদের হিমসাম খেতে হচ্ছে বইকি। এর মূল কারণ আমাদের ধর্মীয় গোঁড়ামি। মুসলিম জনগোষ্ঠী নামাজ, রোজা আর তালাকের ফতুয়া দিতে দিতে মূল্যবান সময়কে নষ্ট করে চলেছে। বিশ্ব যেখানে বিজ্ঞান কে অবলম্বন করে শিক্ষা ব্যাবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে ব্যাস্ত, সেখানে মুসলমান জনগণ খারেজী মাদ্রাসা তৈরি করে  মৌলভী তৈরি আর চেক বই হাতে নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে জাকাত  আদায় করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ছে। একটা জাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে যে শিক্ষার দরকার  তা আমরা না শিখে পরকালের চিন্তায় বিভোর। দিকে দিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এর থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় সমাজের নমস্য ব্যাক্তিগণ যে  উপদেশ দিয়েছেন তা তারা মেনে নিয়েছেন। তাই তারা অনেক সুবিধার ও ক্ষমতার জায়গায় আছেন। অবশ্য একথা না বললেই নয় বাঙলায় বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় , বিবেকানন্দের মতো মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিখ্যাত মণীষীদের আবির্ভাব ঘটে নি। স্যার সৈয়দ আহমেদ খান বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেকে এবং সমাজ কে  কিছু দেওয়ার জন্য চেষ্টা করেছেন। 

এখানে সাচার কমিটির রিপোর্ট দেখে নিলে এই চিত্র অনেকটা পরিস্কার হবে। “The community exhibits deficits and deprivation in practically all dimension of development.” এটি আরও বলে, ” by and large , Muslims rank somewhat above SC/ ST but below Hindu OBC Others minorities and Hindu general (mostly upper class) in almost all indicators considered.”

ভারতের  মুসলমান জনগণের প্রায় ৯৯ শতাংশ জনগণ  ধর্মান্তরিত হওয়া। ব্রাহ্মণ তথা উচ্চবর্ণের  হিন্দুদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে এরা ইসলামের ছত্রছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করে। আবার কোনো কোনো রাজ্যে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের ভিতর থেকেও অনেকেই ইসলামের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেয়। এরা মূলত দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করা জনগণ। এরা প্রথমে যেমন নীচু স্তরের  কাজ  করতো তেমনি এখন ও তারা সেই কাজ করে । শিক্ষা দীক্ষা থেকে ওরা পিছিয়ে ছিল আর এখনও পিছিয়েই আছে । 

এস সি /এস টি তালিকাভুক্ত ওরা নয়। ওরা মুসলমান হওয়ার সুবাদে সাধারণ তালিকায় চলে এসেছে। ফলে ওরা সরকারের উদাসীনতার স্বীকার। যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরে তারা রয়ে গেছে। বিগত ৭৫ বছরে  হিন্দু  এস সি /এস টি সম্প্রদায়ের লোকজন যে সুবিধা পেয়ে এসেছে  মুসলমান জনগণ সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত থেকেই গেছে। তার থেকে স্বাভাবিক ভাবেই পিছিয়ে পড়া জাতি হিসেবে পরিচিত হয়ে যায়। কিন্তু এখন অনেক মুসলমান ছেলেমেয়ে ওবিসির আওতায় পড়ে। এর ফলে চাকরি-বাকরিতে তাদের কিছুটা জায়গা হচ্ছে।

 নিম্ন বর্গীয় মুসলিম জনগোষ্ঠী সরকারি আধিকারিক ও রাজনৈতিক নেতাদের  নিম্ন মানসিকতার স্বীকার  হয়। মাঝখানে তাদের লেখা পড়ার ইতি ঘটে।প্রতীচী শিক্ষা প্রতিবেদনের রিপোর্ট  তো মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো।তাদের প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে বহু বর্ণ হিন্দু শিক্ষক, সরকারি আধিকারিক, রাজনীতিবিদগণ এস সি/এস টি, মুসলমান জাতির ছেলে মেয়েদের তীব্র ঘৃণা করে। ওরা আবার ফলাও করে প্রচার করে যে ওরা নাকি তাদের ছেলে মেয়েদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে আগ্রহ দেখান না। “অথচ দেখা যায় মুসলমান   সমাজের ছেলে মেয়েদের তারা  বিদ্যালয় মুখী করতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু সরকার ও কিছু নিম্ন মানসিকতার লোকেদের  ব্যাবহারে অতীষ্ট হয়ে মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। যতো তাড়াতাড়ি এটা থেকে বেরিয়ে না আসে ততোদিন উন্নয়ন ধীর গতিতে এগুবে।দেশের  যা হাল তাতে চাকরি বাকরি হওয়ার আশা আকাঙ্খা খুব কম। পড়ালেখা করে কিছুই হবেনা  এই ধরনের মানসিকতার স্বীকারও হচ্ছে অনেকেই । তবে অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে মেয়েদের বিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যাদের দারিদ্র্যতা নিত্য সঙ্গী তাদের এই মানসিকতা পরিলক্ষিত হয়।

জন্ম নিয়ন্ত্রণের দিকে তাকালে আমরা আরও এক নতুন চিত্র দেখতে পাই। ধর্মের কঠোর বাণী ভ্রূণ হত্যার ব্যাপারে অনেকটাই সংযত। অনেক পরিবার মেয়েদের বেশি শিক্ষার প্রয়োজন নেই বলে মনে করে। আবার অনেক পরিবার ছেলে মেয়েদের  নিজের অর্থনৈতিক কাজে  সংপৃক্ত রেখে ধর্মীয় শিক্ষা নেওয়া কে শ্রেয় বলে মনে করে। সন্তানের সংখ্যা তুলনামূলক কিছু বেশি হওয়ায় সুবাদে শিক্ষায়তনে যাওয়ার দিকে কোপটা মেয়েদের দিকে পড়ে। দারিদ্র্যতার কারণে ও অনেক ছেলে মেয়েদের মাঝখানে পড়াতে ইতি টেনে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে লাগানো হয়। এতে শিশু শ্রমিক বেশি হওয়ার ভাগটা মুসলমান জনগণের উপর বর্তায়। তবুও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় শিশু শ্রমিক বিষয়ক কড়া আইন করছে বলে অনেকটা উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দেওয়া মুসলমান জনগণের একটা বড়ো রোগ।কোন রকমে একবার বাড়ী থেকে মেয়েকে তাড়াতে পারলে জানে শান্তি। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলার স্কুল কলেজে এখন মুসলমান মেয়েদের সংখ্যা মুসলমান ছেলেদের থেকে বেশি। এর পেছনে অর্থনৈতিক সুরাহার জন্য ভিন রাজ্যে কাজে যাওয়ার প্রবণতা দায়ী।

 বিগত শতাব্দীর আটের দশকে গোপাল সিং কমিটির রিপোর্ট এতোটা বিস্তারিত না হলেও অনেকটাই পরামর্শ দিয়েছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের  উন্নতির জন্য। মাননীয় বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার কমিটির রিপোর্ট সরকারের কাছে অনুন্নত জনগণের (বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের) উন্নতির জন্য যে সব তথ্য সামনে এনেছেন  তা অত্যন্ত ভয়াবহ। সরকার যদি সৎ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসে তবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারা আলোড়ন তুলতে পারবো বিশ্বের দরবারে।প্রায় ২৫ কোটি মুসলিম সংখ্যালঘুদের পেছনে ঠেলে দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিচার পতি সাচার সেদিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন।

এখানে আরও একটা কথা না বললেই নয় দেশের খারেজী মাদ্রাসাগুলো গ্রাম্য মুসলিম সমাজের প্রাণকেন্দ্র। তেমনি আবার মাথা ব্যথারও কারণ। এই দুই মতবাদের মাঝখানে মুসলমান সমাজ দ্বিধায় পড়ে আছে। এর ফলে সমাজের একটা বড়ো অংশ  সমাজের মূল স্রোতে মিশতে পারছে না। এমনকি আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার সুফল দিতে বেসরকারি ভাবে অনেক সংস্থা এগিয়ে আসছে এই অবহেলিত পদদলিত সমাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আমাদের রাজ্যে আল আমিন মিশনের মতো অনেক প্রতিষ্ঠান সংখ্যালঘু সম্প্র‌‌দায়ের  শিক্ষার উন্নয়নে এগিয়ে আসছেন।

আমরা আশাবাদী ‘ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’ আদিবাসী, দলিত ও মুসলমান ছেলেমেয়েদেরকে সঙ্গে নিয়েই। নয়তো অসাম্য, অন্য্যায়ের গ্লানি এই দেশ মুছতে পারবে না কিছুতেই। চাই সকলের শিক্ষা, সকলের ক্ষমতায়ন।

তথ্যসূত্রঃ

আলমগীর শাহরিয়ার, “দেশভাগ: ইতিহাসের বিস্মৃতি ও বেদনার আখ্যান”, https://bangla.thedailystar.net/node/229525

You may also like