চৈত্র সেলের বাজারে বিপন্ন আমি ও আপনি

বেশ কয়েক বছর আগে।আমি তখন ছাত্র। আমি তখন যুব। চোখে তখন ম্যাৎসিনী,গ্যারিবল্ডি হবার প্রবল বাসনা।মাসটা ছিল আজকের মতোই চৈত্র মাস। বাঙালি জীবনে চৈত্র সেলের বাজারের গুরুত্ব অপরিসীম।সে বছর একদিনও সেলের বাজারে যাওয়া হয়নি৷তাই মেসের বন্ধু অসীমকে সঙ্গে করে গেলাম।

আসলে পূর্ব অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়৷ তাই যাবো না ঠিক করেই ছিলাম এতোদিন৷ গতকাল সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ মনে হল আবার এক বছর পর আসবে একবার গেলে কেমন হয়৷ কত রকম লীলা খেলা চলছে তা দেখাও তো দরকার! মূল বাজারে ঢোকার আগেই রাস্তার দুধারে ফুটপাত, দেখলাম কতরকম নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা৷ আমার বড্ড কৌতূহল হল সবটা ঘুরে দেখা ও জিনিসের বাজারদর জানার৷ বাজারে ঘোরা অভ্যাস থাকায় জানি দুধরণের ব্যাবসাদার আছে, একশ্রেণী কম লাভে বেশি বিক্রি চায়, অপর শ্রেণীর কাছে অধিক লাভই মুখ্য,তাতে বিক্রি কম হয় হোক! সেলের বাজারেও এ সত্য অটুট থাকে৷

স্কুলে পড়ার সময় দেখেছি মফস্বলের সেলের বাজার বলতে বুঝতাম সারা বছর বিক্রির পর অবিক্রিত জিনিসের মধ্যে যে গুলো কিছুটা নোংরা, সেলাই খসা সে গুলো খুব জলের দরে বেচে দেওয়া৷ সে পোশাক একবার কিনলে আর বদল করা যেতো না। তাই ভদ্র রুচিশীল লোকেরা সেখানে যেতো না। হ্যাঁ সত্যিই যেতো না।সময়ের বয়ে চলা গতিতে বাজার ও ভদ্রবিত্তের মানসিকতায় বদল এসেছে অনেকটা। বাজারে প্রতিযোগিতা বেড়েছে বেশ।তাই সেলের বাজারে একদিকে যেমন সেলের জন্যই তৈরী জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে, অন্য দিকে বড় ব্যাবসিকরা কিছু ডিসপুট, নোংরা জিনিস অধিক ছাড়ে বেচছে।

আবার কোনো কোনো দোকানে বিজ্ঞাপনী মানসিকতা নিয়ে দোকানের ভালো জিনিসেও সামান্য ছাড় দিয়ে বিক্রি বাড়াতে চাচ্ছে। এমনকি সেলের বাজারের কেনা পোশাক এখন অতি সহজেই বদলানো যাচ্ছে। সব মিলিয়ে দোকানির পেশাদারীত্ব ও খদ্দেরদের খুব সস্তায় জিনিস কেনার প্রবণতা বেড়েছে।

ফুটপাতের দুয়েকটা দোকানে জিনিসের দাম জিজ্ঞেস করলাম৷ তাতে যা বুঝলাম জিনিসের দাম কিছুটা কম কিন্তু মোটের ওপর পোশাকের মান ভালো নয়৷পোশাক গুলোতে কাপড় কম, কাপড়ের মান তেমন ভালো না কিংবা সেলাই এর মান খুব নিচু মানের! তাই শুধু দেখলাম, নিলাম না৷খুব ছোট থেকেই ব্র্যান্ডের প্রতি বিশেষ টান যেমন নেই তেমন খুব সস্তার জিনিসও আমাকে টানে না তেমন। আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু অসীম তো ফুটপাতের জিনিস দেখতেই চাইছিল না। আমি গেলাম এই ভেবে যে, তাদের প্রতি আমরা সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলে তাঁরা জীবন যুদ্ধে টিকে থাকবে কিভাবে। তাছাড়া তাঁদের কাছেও মধ্য মানের ভালো জিনিস থাকে।

যাইহোক, সেদিনকে ফুটপাতে পছন্দ মতো পোশাক হলো না।তাই শহরের একটা নামী কাপড়ের দোকানেই গেলাম৷দোকানের একদিকে দেখি বহু মানুষের ভিড়, ঠেলাঠেলি অবস্থা ! সবাই হন্যে হয়ে খুঁজছে পছন্দ সই পোশাক৷ কাছে যেতেই বুঝলাম একটা কিনলে আর একটা ফ্রি! রঙ বেরঙের কাপড়ের লাট পড়ে আছে বেছে বেছে নিজের পছন্দ মতো পোশাকটা সবাই নিচ্ছে৷ মনে হল ওর মধ্যে একটা খুঁজে দেখলে কেমন হয়! একটার দামে দুটো হবে ভেবে দুজনে বাছতে লাগলাম! সমস্যা হল ওর মধ্যে যেটা পছন্দ হচ্ছে সেটা হয় কোন স্থানে একটু খুঁত আছে অথবা সাইজ ঠিক হচ্ছে না৷ অনেক ক্ষণ চেষ্টা করেও বাছতে পারলাম না৷ হঠাৎ আমার মনে পড়ল আরে এই বাছাই করা মানেই তো নির্বাচন! জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই নির্বাচন অর্থাৎ সঠিক বাছাই খুব জরুরী।

জীবনে চলার পথে আমরা ভুল নির্বাচন করি বারবার, ঠকিও বারবার। মনে পড়ল ঠিক আগের বার অধিক ছাড়ের জামা কিনে ঠকেছিলাম। মনে পড়তেই দুই বন্ধু মেসে ফিরে আসছিলাম৷ আসার সময় দুজনে ঠিক করলাম যে যতই কিনুক আমি আর সেলের বাজারে আসবো না! এতো সস্তা গোলোক ধাঁধা বাজার আমাদের জন্য নয়।তবে বাজারে এসেছি পরার জন্য পোশাক লাগবে ভেবে নরমাল কাউন্টার থেকে দুজনে দুটো পছন্দসই গরমের জন্য আরামদায়ক টি শার্ট কিনলাম৷

সেলের বাজারে ঘুরে একটা প্রশ্ন তাড়া করতে লাগল আমাদের দুই বন্ধুকে দেশের একটা বৃহত্তর অংশের গরিব,অসহায় সাধারণ মানুষের জন্য সেলের বাজার কতটা প্রাসঙ্গিক! কতটা লোক ঠকানো কারবারি।কম দামে মোজা কিনে পস্তানোর পরও তারা আবার যায়! বারবার যায়, বারবার কিনে ঠকে! কীই বা করবে? আমরা জানা বোঝার জন্য কতরকম বই গিলছি, দেশ দেশান্তরের খবর রাখছি তবুও কি পুঁজির চাল সবটা বুঝে উঠতে পারলাম? না পারিনি। তাদের আর দোষ কী!



বেশ কিছু উন্নত দেশ যখন মঙ্গলে জমি কিনে বাজার বসানোর কথা ভাবছে, আমরা তখন সেলের বাজারে নিজেকে দেদার বিকোচ্ছি! হায় দেশের পোড়া আম আদমি! কবে যে উন্নততর বিকল্পের খোঁজে সাধারণ মানুষ হন্যে হবে এসব ভাবতে ভাবতেই পরাধীন প্রবাস জীবনে মেসের পথে পা বাড়ালাম আমি আর অসীম৷

You may also like

Vinnokatha
Prothom Khondo
Price: Rs.260/-
www.vinnokatha.in
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে। সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে।সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
Vinnokatha
Prothom Khondo