প্রসঙ্গ : শিক্ষক নিয়োগ, দুর্নীতি, বিচারের রায় আর রাজনীতির পাটিগণিত

“সেই সত্য যা রচিবে তুমি,
ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি
রামের জন্মস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “কাহিনী” কাব্যের ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায় কবি বাল্মীকি সমগ্র বার্তা না জেনে ইতিবৃত্ত রচনা করলে পাছে সত্যভ্রষ্ট হন, সেই ভয়ে আক্রান্ত হলে নারদ উপরোক্ত কথাগুলি বলে তাঁকে অভয় দিয়েছিলেন। কিন্তু কথাগুলি কবির কল্পনায় অথবা কাব্যসত্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও বাস্তবের বিচারে তাকে মেনে নিতে আপত্তি আছে। ঠিক যেমন আপত্তি আছে আদালতের অনেক বিচারের রায়েই। সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চ যে রায় দিয়েছেন তাতে ক’রে পশ্চিমবঙ্গের সরকার পোষিত বিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা ও  শিক্ষকরা এক মহা সংকটের সম্মুখীন। গত ২২/৪/২৪ তারিখের রায়ে ২০১৬ সালের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে চাকরিররত ২৫৭৫৩ জনের চাকরি বাতিল ঘোষণা করেছেন ডিভিশন বেঞ্চ। খবরে প্রকাশ ২৪ হাজার ৬৪০টি শূন্য পদের ভিত্তিতে ২৫ হাজার ৭৫৩ জনের নিয়োগপত্র ইস্যু হয়েছে। যার মধ্যে ২২ হাজারের মতো নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ-এর শিক্ষক-শিক্ষিকা এই নিয়োগের ভিত্তিতে কর্মরত। আর আছে কিছু অশিক্ষক কর্মী।

এমনিতেই বহু স্কুল শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে, তার উপর এই চাকরি বাতিলের নোটিস শিক্ষাক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই এক তীব্র সংকট তৈরি করবে। এই রায়ের পর এঁদের সবার কপালেই অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। আমার অনেক ছাত্র-ছাত্রীও এই রায়ের শিকার হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এদের অনেকেই এতটাই দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা, যারা টিউশন পড়িয়ে, একশো দিনের কাজ করে, ক্ষেতমজুরের কাজ করে,  তাঁতের শাড়ি মাজা দিয়ে কোন রকমে অনার্স, এম এ, বি এড -এর পড়াশোনা চালিয়ে গেছে। অবশেষে ২০১৬ সালের বিজ্ঞপ্তিতে ভালো পরীক্ষা দিয়ে সাফল্য পেয়েছে। এতদিন ধরে নিত্য অভাবের সাথে যুঝতে যুঝতে  ক্লান্ত মন শ্রান্ত শরীর নিয়ে দিন যাপনের ফাঁকে ফোঁকরে স্বচ্ছলতার যে ভাঙা ভাঙা স্বপ্ন দেখতো, চাকরির এম প্যানেলে নিজের নাম ও রোল নম্বর দেখতে পেয়ে এতদিনের পরিশ্রমে কালো হয়ে যাওয়া মুখগুলো যে কী সাংঘাতিক উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তা খুব কাছ থেকেই আমি দেখেছিলাম। ওরা যখন আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল কেউ কেউ আনন্দে কেঁদেও ফেলেছিল। কিন্তু হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের এক রায়ে তাদের মুখগুলো আবার কালো হয়ে যেতে দেখলাম। দেশজোড়া চাকরিহীন বেকারত্বের এই বৃহত্তর পরিসরে এমন অসহায়তাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর দায় কার—চাকরিপ্রার্থীদের, আদালতের না সরকারের এসব প্রশ্ন সামনে আসবেই। এই নিয়ে রাজনীতির ময়দানে লাভ-লোকসানের বহুমাত্রিক হিসাব কষতে থাকবে ভোটবাজ দলগুলি। দেশের স্বাধীনতার এত বছর পর এই রাজ্যে এতবড়ো আশঙ্কার ঘটনা এর আগে আর ঘটেনি।  

হাই স্কুলগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের জন্য ১৯৯৭ সালে পাশ হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন আইন’। সেই মতো ১৯৯৮ সাল থেকে এই কমিশনের দ্বারা শিক্ষক নিয়োগ শুরু হয়।  শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন হলে সরকারের নির্দেশে কমিশন তার মতো করে পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি জারি করে পরীক্ষা নিয়ে প্রার্থী নির্বাচন করে ফাইনাল প্যানেল তৈরি করে  রেকমেন্ডেশন লেটার দিয়ে স্কুলে স্কুলে সেইসব  নির্বাচিত প্রার্থীদের পাঠাতেন, স্কুল পরিচালন সমিতি যাতে তার নিয়োগপত্র দিয়ে স্কুলে জয়েন করিয়ে নেয়। ১৯৯৮ সাল থেকে এই নিয়মেই ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক বছরেই নিয়মিত শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। তখন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা চরম উদ্দীপনা ছিল। এমনও দেখা গেছে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা অনেক ছেলেমেয়ে জয়েণ্ট এন্ট্রান্স না দিয়ে গ্র্যাজুয়েশন মাস্টার্স করেছে শিক্ষকতার চাকরিকে সামনে রেখে এবং লক্ষ্য পূরণে সফলও হয়েছে। সেই সময়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়েছে কিনা তার কোন প্রমাণ আমার মতো অনেকের কাছেই হয়তো নেই। কেউ কেউ অবশ্য এই মত মানতে না চেয়ে দুর্নীতির পক্ষেই মত দেন। তবে এটাও বলেন যে,  সেই দুর্নীতি ছিল খুবই কম এবং এমন লেবেলে হতো যা বেশিরভাগ মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল। অন্তত আজকের মতো সংগঠিত দুর্নীতির পর্যায়ে পৌঁছয়নি।

তার আগে পর্যন্ত  সরাসরি পরিচালন সমিতি বিজ্ঞাপন দিয়ে ইন্টারভিউ নিয়ে প্রার্থী নির্বাচন করে নিয়োগপত্র দিত। সেইসব নিয়োগের কিছু কিছু গল্পও আমরা কমবেশি শুনেছি। কোথাও নাকি চাকরিপ্রার্থীকে সেক্রেটারি বা সভাপতির মেয়েকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে, কোথাওবা টাকা-পয়সা ঘুষ দিতে হয়েছে, কোথাওবা উপরের কর্তার সুপারিশপত্র দিতে হয়েছে। সর্বত্রই এমন হয়েছে তা নিশ্চয় নয়। বহু জায়গায় খুব স্বচ্ছভাবে উপযুক্ত প্রার্থীকেই নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে।  যাইহোক, স্কুল সার্ভিস কমিশন গঠিত হবার লক্ষ্যও ছিল ম্যানেজিং কমিটির  সদস্যদের স্বজন পোষণ, পক্ষপাতিত্বমূলক অসদাচরণ দূর করে স্বচ্ছ নিয়োগ চালু করা। যার ফলে গ্রাম-বাংলার হাজার হাজার ছেলে মেয়ের সামনে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবার সুযোগ আসে। ধনী -গরিব, কেন্দ্রীয়-প্রান্তিক ঘরের বহু ছেলে মেয়ে শিক্ষকতার চাকরিতে নিযুক্ত হন। প্রান্তিক ঘরের আরও বহু ছেলে মেয়ে দুচোখে স্বপ্ন নিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়ে ওঠে। এইভাবেই শত শত গরীব প্রান্তিক ঘরের ছেলেমেয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে, মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, অভাবী সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছে। অর্থ ও ক্ষমতার দম্ভে আধিপত্যবাদী সমাজের উচ্চ বর্গের অবজ্ঞা আর অপমানকে একটা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে সামাজিক সম্মান আদায়ের জায়গা তৈরি করেছিল এরাই। এইভাবেই গ্রামীণ অর্থনৈতিক,  সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা বিকল্প প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছিল।

সবচেয়ে অস্পৃশ্য,  সবচেয়ে বঞ্চিত, সবচেয়ে অভাবী ছেলেটিও হয়তো কেবল মেধার জোরে এই প্রক্রিয়ায় সমাজের পাদপ্রদীপের আলোয় এসে দাঁড়িয়ে অন্য বহুজনের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল। অশিক্ষিত অথবা স্বল্প শিক্ষিত বড়লোকের ছেলের গা-জোয়ারি করা, মস্তানি করা, সামন্ততান্ত্রিক কায়দায় শোষণ-শাসন করা কিংবা মানুষকে ভুল-ভাল  বুঝিয়ে নিজের প্রভাব বজায় রাখার দিনও শেষ হয়ে যেতে লাগলো এই নব্য শিক্ষিত ছেলে-মেয়েদের কাছে। খুব যে ঝগড়া বা  সন্মুখ সমর এমন  নয়, ভেতর থেকেই একটা বিকল্প ধাক্কা খেয়েছিল এই অর্থ ও ক্ষমতাদম্ভীরা।  অন্তত গ্রামে কথা বলার মতো একটা জায়গা নিশ্চয় তৈরি হয়েছিল। চাকরি পাওয়া এইসব ঘরের অনেক ছেলে-মেয়ে গ্রাম থেকে শহরে  এসে জমি বাড়ি কিনে বসবাস করতে শুরু করলো। তাদের ছেলে মেয়েরাও নামীস্কুলে কলেজে পড়াশোনা করার সুযোগ পেল। শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে গেল অনেকটা। এইভাবেই যেন এক-দেড় দশকে একটা নতুন শ্রেণি তৈরি হয়ে গেল। যাদের ঘর ছিল না ঘর হল, অভাবী সংসারে কেউ না খেয়ে না পরে থাকলো না।  বড়লোকদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হল না। ছেলে-মেয়ে পরিজনদের পড়াশোনার ব্যবস্থা হল। এদের একটা অংশ হয় শাসক দলকে সমর্থন করে নিরাপদ  নিশ্চিত যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। কোন অংশ পুরোপুরি রাজনীতি বিমুখ ও সুবিধাবাদী অবস্থানকেই বেছে নিয়ে  আদর্শ বিচ্যুত হয়ে মূল্যবোধহীন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে অর্থ ও ক্ষমতার আনাচে কানাচে থাকতে চাইলো। কোন অংশ আবার ভিতরের আগুনে জ্বলে উঠে বিকল্প ভাবনা চিন্তাকে লালন করে সমাজ- সংস্কৃতি- রাজনীতিতে ভিন্ন সক্রিয়তা নিয়ে উঠে এলো।

 এরই মধ্যে রাজ্য রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-ইতিহাসে নানা প্রশ্ন সামনে চলে এলো। আমরা দেখলাম, জনগণের সমর্থনকে পুঁজি করে ক্ষমতায় গিয়ে ক্রমশই জনবিরোধী হয়ে ওঠার প্রায় সাড়ে তিন দশকের প্রেক্ষাপটে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ২০১১ সালে শাসনের পালাবদল হয়ে গেল। দীর্ঘ চৌতিরিশ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটে শাসন ক্ষমতায় পরিবর্তন এল। সেই পরিবর্তন ছুঁয়ে গেল চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়াকেও।  আমরা আবারও দেখলাম সরকারে থাকা একটা দলের নেতা, মন্ত্রী, তাদের এজেন্টরা নানাভাবে টাকা তুলতে লাগলো। গ্রামে গ্রামে দালাল এজেন্টদের সেই কেরামতির কথা আমরা শুনলাম, দেখলাম। পরিবর্তনের জন্য যে উদ্যম ও উদ্যোগ নিয়ে বাম-শাসনকে অপসারিত করলো মানুষ, তারা এবার একটা নতুন কারবারকে প্রত্যক্ষ করলো। অথচ সরকার তার প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বজায় রাখতে বিন্দুমাত্র উদ্যোগ নিল না। ফলে প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রী তো বটেই বহু দালাল, হাফনেতারাও রাতারাতি ফুলে ফেঁপে উঠলো। আর সেইসঙ্গে অভাবী মেধাবি ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠা পাবার ও স্বচ্ছল জীবন যাপনের স্বপ্ন বিকিয়ে গেল। গ্রাম-বাংলার পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মান বিকৃত পথে হাঁটতে লাগলো।

বাম সরকার শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি শেষ বার জারি করেছিল  ওই বছরেই অর্থাৎ ২০১১সালে। তারপর মমতা ব্যানার্জি নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় এসে ২০১২ সালে আগের সরকারের জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে পরীক্ষা নিল এবং ২০১৩ সালে নিয়োগ দেওয়া হল প্রায় তেইশ চব্বিশ হাজার শিক্ষককে। ততদিনে অবশ্য কমিশনের ও নিয়োগের খোল নলচে বদলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নতুন সরকার। প্রবাদ আছে না ‘যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা’ সেইমত বাম সরকারের ভালো অনেক কিছুকেই বদলাতে লাগলো। সেই ২০১৩ সালের নিয়োগের পর  এস এস সি পরীক্ষায় দেখা দিল একটা সাংঘাতিক ডামাডোল।  ২০১৪ সালে আপার প্রাইমারির জন্য টেট পরীক্ষা নেওয়া হল, যার নিয়োগ এখনো হয়নি। কিছুদিন আগে অবশ্য স্কুল পছন্দের কাউন্সেলিং হয়েছে। তারপর ২০১৬ সালে গিয়ে নতুন সরকারের ক্ষমতায়নের পাঁচ বছর পর নতুন করে নবম-দশম, একাদশ -দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি হল। আগের সরকারের আমলে এস এস সি পরীক্ষা হবার যে নিয়মিত ঐতিহ্য ছিল, যাকে প্রেরণা করে এই বাংলার হাজার হাজার ছেলে মেয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিল, তাকে এক লহমায় ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল নতুন তৃণমূল সরকার।  সরকারের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন,  ‘এস এস সি কি দুর্গা পুজো, যে প্রত্যেক বছর হবে!’ সেই ২০১৬-র বিজ্ঞপ্তিতে নিয়োগ হয় ২০১৮ সালে। তারপর এক দীর্ঘ শূন্যতা। আর কোন পরীক্ষা নেই। চাকরি পাবার ব্যবস্থা নেই। ২০১১-র বিজ্ঞপ্তি বাদ দিলে ২০২৪-এর  এই পর্যন্ত  প্রায় চৌদ্দ বছরে ২০১৬ সালে একবার মাত্র বিজ্ঞপ্তি জারি করে পরীক্ষা নিয়ে যে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করেছিল তা ছিল পরিকল্পিত দুর্নীতির মোড়কে মোড়ানো। এর দায় কীভাবে সরকার অস্বীকার করবে?

জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার কাজের সুরক্ষা না দিয়ে এত বছরে সারা রাজ্যে শিক্ষিত-বেকারত্বের পাহাড় গড়ে যে ক’জনকে চাকরি দিয়েছিল, তাও মহামান্য হাইকোর্টের বিচারের রায়ে বাতিল হয়ে গেল। এটা বিচার,  কিন্তু ন্যায় বিচার কখনোই নয়।  এতদিন পর্যন্ত তো ক্রিমিনাল জুরিসপ্রুডেন্সের সেই নীতিতেই আমরা বিশ্বাস রেখেছিলাম যে,  ‘দোষী যদি ছাড়াও পেয়ে যায়, একজন নির্দোষেরও যেন সাজা না হয়’, সেই নীতিকে কি এই রায়ে অক্ষুন্ন রাখা গেল? আমার যেসব ছাত্র-ছাত্রী এই ২০১৬-র  পরীক্ষায় চাকরি পেয়েছিল, আমার বিশ্বাস তারা সকলেই সৎভাবেই পেয়েছিল। শুধু এরাই নয়, আরও হাজার হাজার ছেলে মেয়ের ক্ষেত্রেও একথা বলা যায়। তবে দুর্নীতি যে হয়েছে সেটাও কিন্তু সত্য।

খবর থেকে জানা, প্রায় পাঁচ হাজারের কাছাকাছি নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে।  অনেকেই হয়তো সাদা খাতা জমা দিয়ে, কাট আপের চেয়েও বহু কম নম্বর পেয়েও এম প্যানেল লিস্টে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে কেবল টাকার জোরে। কারা এরা? আমার বিশ্বাস এরা কেউ গ্রাম বাংলার আদর্শবাদী ঘরের সন্তান নয়। নয় মেধাবী এবং পরিশ্রম করে পড়াশোনা করা ছাত্র-ছাত্রী। হয় কুপথে বিপথে পিতা-পিতামহের উপার্জিত অর্থের অধিকারী, নয়তো মূল্যবোধহীন আদর্শহীন রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, চামচা, দালালদের কেউ। নয়তো পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার গর্ভে জন্ম নেওয়া কন্ট্রাক্টর, প্রোমোটার, মাফিয়াদের আপনজন। যদি শিক্ষকদের সন্তান-সন্তুতিও হন, তবে সেই শিক্ষকরা আসলে সেই শ্রেণির, যারা নীতি আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে অর্থ ও ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিল। যারা এই পেশাটাকে সামাজিক সম্মান ও প্রতিষ্ঠা পাবার মাধ্যম মনে করে নিজেদের স্বচ্ছল ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য  গচ্ছিত লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েছে। এরা আর যাইহোক শিক্ষকতার মহান পেশাকে কলুষিত করেছে।

আজ শিক্ষকদের প্রতি যে সামাজিক অসম্মান তৈরি হয়েছে তার একটা কারণ এই অপজাতকদের ক্রিয়াকর্ম। আদালতের উচিত ছিল নিয়োগের প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও  কারচুপি যতই গভীর ও জটিল হোক না কেন তার মধ্যে থেকে এই ‘বেনো জল’কে  আলাদা করা। তা না করে, সবাইকে এক পাল্লায় পরিমাপ করে এক রায় দেওয়া আমার মতে সঠিক নয়। তাই এই বিচার, কখনোই ন্যায় বিচার নয়। আর দুর্নীতির পুরো প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদেরকেও সে নেতা, হাফ নেতা, মন্ত্রী সান্ত্রী, আধিকারিক যেই হোন না কেন,  তাদেরকেও চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করলে বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে। আর তা না করে, তাদেরকে বহাল তবিয়তে রেখে এবং ‘চাল’ ‘কাঁকর’ আলাদা না করে সৎ ও স্বচ্ছভাবে চাকরি পাওয়া প্রার্থীদেরকে একই তালিকাভুক্ত করে তাদেরকে চাপে রাখার যে রায় আদালত দিয়েছেন তাকে কিন্তু সমাজের বেশিরভাগ মানুষই খুশি হয়েছেন। চাকরি হারানো এই প্রায় ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকরা একদিক দিক থেকে সমাজ-মানুষের সহানুভূতি ও সমর্থন সেই ভাবে পাচ্ছেন না। অন্তত গ্রামে-গঞ্জে, ট্রেনে-বাসে, হাটে-বাজারে, চায়ের দোকানে, পাড়ার মোড়ে মোড়ে যে আলোচনা চলছে তার প্রেক্ষিতে একথা বলাই যায়।

একটা শ্রেণির সমুহ সর্বনাশের অথবা বাঁচা-মরার এহেন খবরেও এত মানুষের নির্মম-পুলকিত হবার কারণ কী? এর পিছনেও শিক্ষকদের নিজেদের ভুমিকাই দায়ী। কেননা আমরা দেখেছি শিক্ষিকদের একটা বড়ো অংশ ক্রমশই সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থকেই বড়ো করে দেখেছে, নিজেদের প্রিলেজড্‌ মনে করেছে। সমাজের বৃহত্তর মানুষের বাঁচা-মরা, শোষণ-বঞ্চনা, দুর্গতি-অসহায়তা, লড়াই-আন্দোলন তাদের বিন্দুমাত্র ভাবায় নি। শিক্ষা নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য একের পর এক নিত্য-নতুন নীতি প্রকল্পের বেড়িতে যখন শিক্ষাকে মুক্ত পরিসর থেকে ক্রমশই বেঁধে ফেলে কর্পোরেট পুঁজিবাদের কাছে বিকিয়ে দিতে চেয়েছে তখন এই শিক্ষকরা চুপ করেই থেকেছেন এবং থাকছেন। লক ডাউনের সময় যখন অবৈজ্ঞানিক ভাবেই দীর্ঘদিন ধরে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে রেখেছিল সরকার তখন তাদের বেশিরভাগই ছুটি ভোগ করেছেন। বেতন পেয়েছেন। সেটা পেতেই পারেন, কিন্তু দেশের এত অগনন মানুষ ঘর-হারা, কাজ-হারা বেকার হয়ে গেল তার জন্য বিন্দুমাত্রও তাঁরা ভাবলেন না। এমনকি সেই অভাবের সময়ে কচি কচি ছেলে মেয়েদের অন্তত মিড-ডে মিল খেয়েও ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে পারার মতো উপায়ও থাকলো না দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধ থাকায়। সেদিন এই শিক্ষক সমাজ তার জন্য একটি কথাও খরচ করেননি। এমনকি করোনার পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও স্কুল খোলার জন্য কোন দাবিও তোলেননি। এইভাবেই তাঁদের সাথে সমাজের গণমানুষের দূরত্ব তৈরি হল। তাই নানা ক্ষেত্রে শিক্ষকদের প্রতি সমাজের সেই ক্ষোভ নানা সময়ে ঝরে পড়েছে।

আজ যখন এত শিক্ষক চাকরিহারার নোটিশে বিপন্নবোধ করছেন তাতে জনগণের খুশি হওয়ার পিছনে আছে শিক্ষক বনাম গণমানুষের দূরত্ব বাড়ার এই ন্যারেটিভ। কিন্তু এর মধ্যেও লুকিয়ে আছে ব্যর্থতার ইতিহাস। কারণ টাকার জোরে চাকরি পাওয়া দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকদের আড়ালে আছে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা। একদিকে আদর্শহীন মূল্যবোধহীন কুপথে-বিপথে প্রভূত অর্থ করা এইসব ঘর ও ঘরের ছেলে-মেয়েরা অন্যদিকে দুর্নীতির আঁতুর ঘরে থাকা সরকার এবং তার প্রশাসন এই উভয়ের প্রতি জনগণের বিক্ষোভ একরকম ভুল পথে চালিত হয়ে চোখের সামনে থাকা শিক্ষকদের উপরই তাই ঝরে পড়ছে। এটা একদিক থেকে জনগণের রাজনৈতিক চেতনার অভাবেরই ইঙ্গিত বহন করে।         

       

 এস এস সি পরীক্ষা নিয়ে এই রাজ্যের ছেলে মেয়েরা যে স্বপ্ন দেখেছিল, তৃণমূল সরকার দায়িত্ব নিয়ে সেই স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। হয়তো সেই সরকারই এখন ভুল স্বীকার না করে সৎ এবং অসৎ উভয়ের পক্ষ নিয়ে উচ্চতর আদালতে যাবার নোংরা রাজনীতি করবে। আর একজন নেতা যিনি সদ্য দল পরিবর্তন করে বোমা ফাটানোর ইঙ্গিত দিচ্ছেন, তিনিও কিন্তু এই নিয়োগ দুর্নীতির সময়ে রাজ্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন। তিনি নিজেও কি এর দায় অস্বীকার করতে পারবেন? নারদাকাণ্ডে তাঁকেও টাকা নিতে দেখেছেন রাজ্যবাসী, তাঁর কাছ থেকে কি আমরা সততা শিখবো? আর তাঁর নতুন দলের শাসনকালেই ত্রিপুরাতে দশ হাজারের বেশি শিক্ষকের চাকরি গেছে। তাঁর দলের সর্বোচ্চ নেতারা আজ কর্পোরেটের বন্ধু সেজে এদেশের রাষ্টায়ত্ত সংস্থাসহ জল জঙ্গল জমি প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ বিক্রি করে দেশটাকে ছিবড়ে করে দিচ্ছে। পেটিএম, ইলেক্ট্রোরাল বন্ডের নামে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো দুর্নীতির এই কারিগররা যখন দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সততার মেকি মুখোশে নিজেদের আসল রূপটাকে আড়াল করতে চায়, তখন তার মতো নোংরামি আর কিছু হতে পারে না। এই চাকরিহারাদের অসহায়তাকে বিদ্রূপ করে, বেকারদের দুঃখমোচনের মেকি প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোট রাজনীতির খেলায় জেতার অঙ্ক কষার আগে মানুষের বোধ-বুদ্ধি ও সচেতনতার কাছেও কিন্তু জবাবদিহি করতেই হবে। সচেতন মানুষ এতদিনে নিশ্চয় ভোট রাজনীতির পাটিগণিতের শেষ উত্তরটা জেনে গেছে, নির্বাচন আসলে একটা সুবিধাবাদকে সরাতে গিয়ে আর একটা সুবিধাবাদেরই জন্ম দেওয়া। 

       

You may also like

Vinnokatha
Prothom Khondo
Price: Rs.260/-
www.vinnokatha.in
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে। সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে।সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
Vinnokatha
Prothom Khondo