ঔপনিবেশিক শাসকরা যবে থেকে অরণ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, অরণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে যেভাবে আদিবাসীদের সাথে আচরণ করা হয়েছে তা একটি চরম অন্যায়। কারণ বনের ঐতিহ্যগত ব্যবহারে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত অধিকার সবচেয়ে বেশি। স্বাধীনতার পর ভারতের নতুন শাসকশ্রেণী একই প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে তা হল অরণ্যের উপর চূড়ান্ত অধিকার দাবি করা। নির্বিচারে গাছ কাটা হয়েছে। কাঠ মাফিয়াদের অরণ্যকে ধ্বংস করতে দেওয়া হয়েছে।আদিবাসীদের উপেক্ষা করা হয়েছে। এবং তাদের অরণ্যের উপর ঐতিহ্যগত অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত অরণ্য অধিকার আইন ২০০৬ পাস করেছিল ইউপিএ সরকার। এই আইনের লক্ষ্য ছিল আদিবাসী এবং চিরাচরিত অরণ্যবাসী সম্প্রদায়ের অরণ্যের উপর যে ঐতিহ্যগত অধিকার সে বিষয়ে তাদের প্রতি ঐতিহাসিক অবিচার সংশোধন করা। এই আইন ঘোষণা করে যে সমস্ত আদিবাসী পরিবার অরণ্য-ভূমির আড়াই হেক্টার (৬.২৫) একরের অধিকারী হবে। সেখানে তারা বংশানুক্রমিক থেকেছে এবং চাষ করেছে। আর অ-আদিবাসী পরিবার যারা অরণ্যচারী তিন পুরুষ ধরে বাস করছে ও চাষ করছে ওই একই রকম মালিকানার অধিকার হবে। এই অনুযায়ী সরকারের নির্দেশ বেরুলো। সে অনুযায়ী তিন স্তরের কমিটি ও গঠন হয়। গ্রাম সভা, ব্লক স্তর ও জেলা স্তর কমিটি গঠিত হল।যে ফর্মে আবেদন করা যাবে তাও প্রকাশিত হল।
আদিবাসী অধিকার কর্মীদের মধ্যে এই নিয়ে প্রচন্ড উৎসাহ দেখা যায়। এই খবরে অরণ্যবাসী খুব খুশি হয় এবং তারা মানুষের মধ্যে এই নিয়ে প্রচার করতে শুরু করে দিল। হাজার হাজার আবেদন জমা পড়ল। যে অরণ্য জমিতে তারা যুগের পর যুগ বাস করে এসেছে তার মালিকানা দাবি নিয়ে স্রোতের মতো পৌঁছতে লাগলো।তাদের ভবিষ্যৎ খুব সম্ভাবনাময় দেখাচ্ছিল। জাতীয় স্তরে ৪১ লক্ষ আবেদন জমা পড়েছিল এক দশক ধরে। কিন্তু আঘাত আসতে বেশি দেরি হল না।এর মধ্যে ১৮ লাখ অনুমোদন পেল ৩ লাখ ঝুলে রইল আর কুড়ি লাখ প্রত্যাখ্যাত হল। একমাত্র ঝাড়খন্ড রাজ্যেই ত্রিশ হাজার আবেদন জমা পড়েছিল। এর মধ্যে ১১ হাজার কে মালিকানা মঞ্জুর করা হলো ৪০ হাজার ঝুলে রইল ১৫ হাজার প্রত্যাখ্যাত। এক কথায়, সমস্ত আবেদনের ৫০ শতাংশ জাতীয় ও রাজ্যস্তরে খারিজ হল।
উদ্বেগের বিষয় হল গ্রাম সভা প্রায় সব আবেদনই অনুমোদন করেছিঈ। কিন্তু আটকে গেল ব্লক স্তরে কিছু। আর জেলা স্তরে আরও বেশি। কারণ ছিল যে গ্রাম সভার সদস্যরা পরস্পরকে ভালো করেই জানে। তারা জানে কার জমি কোথায়, এবং তা কতদিন ধরে তারা চাষ করে। তাই প্রায় সব আবেদনের মঞ্জুর হয়ে যেত।অন্যদিকে ব্লক এবং জেলা স্তরের কমিটি সদস্যরা বেশিরভাগ বহিরাগত। অ-আদিবাসী কার্যকর্তা বেশিরভাগই আদিবাসীদের সমব্যথী নয়।বেশির ভাগ অফিসাররা অরণ্যবাসীর জমির মালিক অধিকারের বিরুদ্ধে।
এরপর ২০১৯ সালের প্রথমদিকে হঠাৎ মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট একটি একতরফা আদেশের বলে অবিলম্বে সমস্ত আদিবাসী ও অরণ্যবাসী পরিবারকে উৎখাত করার কথা বললেন।এই আদেশের কবলে পড়লেন তারা যারা বনভূমির জন্য দরখাস্ত করেছিলেন কিন্তু তাদের মালিকানা অগ্রাহ্য হয়েছিল। এরপর সারা দেশ জুড়ে আদিবাসীদের মধ্যে নানা রকম আন্দোলন শুরু হয়। সুপ্রিম কোর্টের আদেশের ভিত্তি হল কোন এক পশুপ্রেমীর বনবিভাগের বিরুদ্ধে তাদের কর্তব্য পালন করছেন না বলে অভিযোগ।
এখন প্রশ্ন হল পশু জীবন কি মানব জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান? সুপ্রিম কোর্টের এই আইন মোতাবেক বনবিভাগ এখন অনেক সক্রিয় হল। তারা এই প্রতিশ্রুতি দিতে চায় যে সমস্ত বন্যপশুদের ভারতের অরণ্যে সুনিশ্চিত করিডর প্রদান করা হবে। তারা এটাও নিশ্চিত করতে চায় যে কোন পশু মানুষের মাঝখানে এসে পড়বে না।’বন্য জীবন করিডর’, ‘হাতি করিডর’, ‘বাঘ করিডর’ এবং হয়তো আরো অনেক করিডর ছড়িয়ে পড়বে মধ্য ভারতের অরণ্য অধ্যুষিত জেলায় জেলায়। এই ধরনের রোমান্টিক পরিবেশগত উদ্যোগের বিপর্যয়কর পরিণতির ফলে হাজার হাজার আদিবাসী গ্রাম থেকে বিতাড়িত হচ্ছেন। আগেও যেমন হয়েছে, এখনও তাই। যদি শত শত গ্রামকে তাদের বহু কালের বনভূমি ও চাষবাসের জমি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয় তাহলে তারা যাবে কোথায়?
এসব বিষয়ে সরকার ও বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে আশ্চর্যজনক নীরবতা রয়েছে। তাদের নিজস্ব গ্রামসভার আদিবাসী সমাজ স্থিরপ্রতিজ্ঞ যে তারা নড়বেন না।অপরদিকে তারা দাবি করে চলেছেন যে প্রকৃতি ও পশুদের সঙ্গে অতীতের শতাব্দীগুলিতে সমন্বয়ের মধ্যে একত্রিত হয়ে যেভাবে তাঁরা বেঁচে ছিলেন, এখনও তাদের সেই দাবী। তারা দাবি করেন যে অবশিষ্ট সমাজ তাদের প্রকৃতির সঙ্গে সুরেলা সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিক এবং প্রশংসা করুক।এবং তাদের পশু পাখি ধরিত্রী মায়ের অন্যান্য সমস্ত অঙ্গের সঙ্গে শান্তিতে বসবাস করার অনুমতি দেয়া হোক।
( স্ট্যান স্বামী, আমি নীরব দর্শক নয়, ঝলক ৮)