আর কত নির্ভয়া, আর কত হাতরাস, আর কত অভয়া?

by Vinnokatha

সীমা চক্রবর্তী

প্রসঙ্গ যখন আর জি কর: নির্ভয়া মৃত্যুর ১২ বছর ধর্ষকদেরই অভয় দানের কাজ করেছে!

সালটা ছিল ২০১২। সদ্য ভোটদানের অধিকার পেয়ে খুবই উৎসাহিত আর উত্তেজিত ছিলাম। নিজেকে উড়ন্ত পাখির মতো লাগতে শুরু করেছিল। এবার থেকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেব, পরিণত হওয়ার একটা গর্ব দিবারাত্রি কাজ করতে শুরু করেছে। ২০১২র ১৬ই ডিসেম্বর, তীব্র ঠাণ্ডা, দিল্লীর রাস্তায়, চলন্ত বাসে ঘটে গেল এক নৃশংস ঘটনা। আজ আমরা সকলেই জানি সে কথা। সেই রাতে ২২বছরের এক তরুণী নৃশংসভাবে গণধর্ষিত হয়, যার বিবরণ শুনলে যে কোনও সুস্থ মানুষের হাড় হিম হয়ে যায়। এদিকে আমার মতো সদ্য ভোটাধিকার পাওয়া এক তরুণী, অধিকারের প্রশ্নে উৎসাহিত, যার চনমনে বুকে সেই ঘটনাই ছিল প্রথম আচমকা এক দুঃসহ আঘাত। সেদিন নির্ভয়ার শারীরিক ধর্ষনের সাথে সাথে আমার মতো হাজারটা মেয়ের যে অস্পৃশ্য ধর্ষণ হয়েছিল, আর তার প্রত্যেকটা যন্ত্রণা, কামড়ের দাগ অনুভবে বার বার আঘাত করেছে দীর্ঘদিন ধরে, কখনও রাতের পর রাত চোখের জল ফেলে, কখনও নিজেকে ওই অবস্থানে কল্পনা করে আতঙ্কে।

যাই হোক, দিল্লীর রাজপথের আন্দোলন ও প্রতিবাদের স্বর তখন প্রায় ম্রিয়মাণ, একজন একা অসহায় মা অপেক্ষা করেছিল ৮ টা দুর্বিষহ বছর, ধর্ষকদের শাস্তি দেখার আশায়, দেশের মেয়েদের নিরাপদ রাত দেখার আশায়। তবে ঘটনার আট বছর বাদেও যখন ধর্ষকদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ঘটনা সম্পর্কে, তখন আশা ছিল হয়তো তাদের গলায় কিছু আক্ষেপের সুর শুনতে পাওয়া যাবে। কিন্তু উত্তরে যা এসেছিল তা ছিল এই রকম – অত রাতে মেয়েটা বাড়ির বাইরে ছিল, তাই এই ঘটনা খুবই স্বাভাবিক, তারা যা করেছে তার মধ্যে নৃশংসতা তো দূর, অস্বাভাবিকতা কিছুই নেই।

এরপর আসা যাক এর ১২ বছর বাদে আর এক গভীর রাতের ঘটনায়। কলকাতার জনবহুল হাসপাতাল আর জি কর এর পালমোনলজি ওয়ার্ডে, আরও এক অভয়া সেরাতে ছিল বাড়ির বাইরে, আরামের ঘুম ত্যাগ করে কর্তব্যরত ছিল তার কর্মক্ষেত্রে, রোগীর সেবায়। পর দিন পাওয়া গেল তার নৃশংস ভাবে ধর্ষিত ও খুন হওয়া নিথর দেহ। ভয়াবহ এই ঘটনা নাড়িয়ে দিল আমাদের! দিল্লী থেকে কলকাতা, মাঝখানে চলে গেছে ১২টা বছর; কুম্ভমেলার মতো গঙ্গাদেবী বা যমুনার জলে স্নান করার প্রবণতা যেন আগের থেকে আরও বেশী; আরও ভিড় , আরও আরও অত্যাচারে জল কে বিষাক্ত করে দিয়ে তার পর পাপ ধুয়ে নিজেরা শুদ্ধ হয়ে যাওয়ার অদ্ভুত ভন্ডামী। পতিতা, ধর্ষিতা এদের লিঙ্গ তো একটাই; তাদের বাঁচা মরা সব নির্ধারণ করবে সেই বিশুদ্ধ ভন্ডরা; তারাই নারীকে কখনও বানাবে দুর্গা, কখনও ডাইনী, কখনো পাঞ্চালী, কখনো সতী। উনিশ শতকের আশীর্বাদ হিসেবে যা পেয়েছি তাতে সতীদাহ প্রথা হিসাবে নিষিদ্ধ হয়েছে ঠিকই, তবে সত্যিই কি মেয়েরা সমাজের দহন থেকে মুক্তি পেয়েছে? আগুনের প্রত্যেকটা স্ফুলিঙ্গের ফোস্কা আজ ও কেন এত দগদগে? প্রমাণ লোপাটের তাগিদে আর জি কর ধর্ষিতার তাড়াহুড়ো করে পোড়ানো লাঞ্ছিত দেহের সাথে সাথে আরও হাজারো নারীর মান সম্মান ও বেঁচে থাকার স্বাভাবিক শক্তি, লাঞ্ছনার বিচার পাওয়ার আশা ভরসা, সবকিছু জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায় নি কি?

অর্থনীতির সূত্র যেমন বলে আপনি যতই ধনী ব্যক্তি হোন না কেন, আপনার দেশ যদি দেশবাসীর মৌলিক চাহিদা গুলো পূরণে অক্ষম হয়ে থাকে তাহলে আপনিও গরীব, তেমনি একজন প্রতিষ্ঠিত ডিউটিরত নারীর নৃশংস ধর্ষণ প্রমাণ করে যে আপনি নারী হিসেবে যতই স্বাধীন, প্রতিষ্ঠিত ও চকচকে চামড়াওয়ালা হোন না কেন ব্যাবস্থার কাছে আপনার, আর একজন রেল স্টেশনে ভিক্ষা করা সর্বহারা নারীর সংজ্ঞায় কোনো পার্থক্য নেই। সুযোগ তৈরির অপেক্ষা মাত্র। এই সুযোগের ব্যবহার করে নৃশংস ধর্ষণের প্র্যাকটিস আরো সুদক্ষ, নিপুণ হয়ে উঠছে প্রতিদিন। আরো নতুন নতুন অত্যাচারের উদ্ভাবন, প্রমাণ লোপাটের কৌশল আরও সুদক্ষ হচ্ছে। আরও নতুন নতুন রেসিপি আরও মডার্ন ভার্সনে নারী হয়ে উঠছে ভোগ্য পণ্য।

যাই হোক, জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিবাদী মিছিল যখন গণ মিছিলের রূপ নিয়ে কলকাতা শহরের রাজপথ থেকে শহরতলির অলিগলিতে সম্মিলিত আবেগের বিস্ফোরণে ছড়িয়ে পড়েছে, সেই কম্পা্ঙ্ক সাধারণ মানুষ থেকে দলীয় মিছিল বা স্কুল পড়ুয়া কাউকেই মুখ ফিরিয়ে থাকতে দেয়নি। কেউ অফিস বা অন্যান্য কাজ ফেলে, কেউ স্কুল কলেজ ফেলে ছুটে এসেছে, এমনকী আরামের রবিবার হয়ে উঠেছে আন্দোলনের রবিবার। মিছিল নামক চারাগাছে জল দেওয়ার জন্য মানুষের যেন প্রযোগিতা শুরু হয়েছিল। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে যখন সেই মিছিলে হেঁটেছি, মিছিলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটা সদ্য বেড়ে ওঠা লতা গাছের অনেক গুলো শাখা যেন কলকাতার রাজপথে দাঁড়িয়ে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে চোখ রাঙিয়েছে। আরো কতগুলো নারী বলি? আরো কতগুলো সংহার?

এরপর যা হলো। ক্রমশ সেই গাছের তরুণ তাজা ডাল কেটে তার সাথে সংকরায়ন করানো হলো কিছু ভিন্ন জাতের শাখার। উদ্যেশ্য ছিল মিছিলের মূল ভাবনা ও মূল স্রোতকে অন্যদিকে প্রবাহিত করা। তারপর ধীরে ধীরে প্রশ্নের লতা গাছকে অন্য জাতের গাছে পরিনত করা। তাতে প্রয়োজনে রাজার নিজের দড়ি ধরে সাময়িক টান মারতেও আপত্তি ছিল না। তারই মধ্যে অন্যান্য দলের দলীয় রাজনীতি চরিতার্থ করার কাজ ও থেমে ছিল না। মানুষের সম্মিলিত প্রশ্নগুলোকে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়ার শক্ত হাতে প্রচেষ্টা। মিছিল হয়ে উঠল উৎসব। প্রতিবাদ যখন আন্দোলনের রূপ নেবে বলে রূপ বদল শুরু করেছে এমন সময় গাছের এক একটা শাখা কোনও কোনও রোগের স্বীকার হল, যেমন স্কুল পড়ুয়াদের সেলফি, কখনো লাইভ ভিডিওর কনটেন্ট তৈরি করে ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রিপশন চাওয়া, অভয়ার ছবি এডিট করে ভিউ জোগাড় করা, কখনও নারীবাদের পোশাকি নামে নারীর পণ্য হওয়া ও উশৃঙ্খলতার প্রচার, কিছু শিল্পীর শিল্প কর্মের নামে দেদার ব্যবসা, এরই মধ্যে শাসকের ভয়ে ও ত্রাসে কোনও কোনও শাখা আবার শুকিয়ে পাতা ঝরে গেল, আবার কিছু শাখা শক্তিশালী হয়ে যাত্রা শুরু করতে আগ্রহী হল।

আর এসবের মধ্যে আবারও ১২ বছর আগের এক মায়ের মতো এক অসহায় দম্পতি ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ঝড়ের মুখে দুলতে থাকল বিচারের আশায়? আবারও কী আট বছর? নাকি দুলতে দুলতে উপড়ে যাবে তাদের আশা।

যুগের সাথে চন্দ্রযানের প্রযুক্তি আবিষ্কার হলেও কেন আবিষ্কার হল না ধর্ষণের প্রতিষেধক। মুম্বাই এর অরুণা শানবাগ থেকে দিল্লির জ্যোতি, তারপর নিভে গেল কলকাতার তরুণী, এত পর্যন্ত সময়ে কিসের এত অপেক্ষা? ব্যবস্থার পক্ষপাত যদি নারীর শরীর সর্বস্বতাতেই হয় তবে পর্দাপ্রথা ও গৃহবন্দি জীবন তথাকথিত আধুনিক জীবনের চেয়ে কী বেশি উৎকৃষ্ট ছিল না?

আন্দোলনের ফল হিসেবে কলকাতা পেয়েছিল নারীর রাত দখল, স্বাধীনতা দিবসের দিন স্বাধীনতার সংজ্ঞাকে আর একবার ঝালিয়ে নেওয়া। কিন্তু রাত যেন আরো অন্ধকারের আশঙ্কা নিয়ে ডুবে যাচ্ছে রোজ। এর অন্যতম কারণ মিছিল নামক চারাগাছের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রোগাক্রান্ত হয়ে, শুকিয়ে যাওয়া।

রোগ প্রতিরোধের শক্তি অর্জন তাই একান্ত প্রয়োজন। রোগের সঙ্গে পরিচয় থাকলে তবেই তার প্রতিষেধক বার করা সম্ভব। আগামীদিনের লক্ষ্য হোক এই প্রতিষেধক অর্জন।

মিছিল যেন কখনও শুকিয়ে না মরে। হাজার কণ্ঠের আওয়াজই পারে ব্যবস্থার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে। নাহলে অভয়াদের বিচার অধরাই থেকে যাবে। একজন মেয়ে হয়ে প্রত্যেক মেয়েকে অনুরোধ করবো অলংকার, বসন-ভূষণ, সৌন্দর্য ও সাজসজ্জায় আবদ্ধ না থেকে বাস্তবতায় ফিরতে। আগামী প্রজন্মের স্বার্থে, নিজেদের স্বার্থে মেয়েদের ফুল নয়, ফুলন হতে হবে।

You may also like

Vinnokatha
Prothom Khondo
Price: Rs.260/-
www.vinnokatha.in
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে। সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে।সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
Vinnokatha
Prothom Khondo