ব্রাহ্মণ্যবাদ ও আনুষঙ্গিক বিষয়

‘শ্রেণী-বর্ণ’ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থায় শোষকশ্রেণী ‘সম্পদ ও অর্থ’ কুক্ষিগত রাখার উদ্দেশ্যেই তৈরি করেছে জাত-পাত, লিঙ্গ, ধর্ম, দর্শন… ইত্যাদি । শ্রেণী-বর্ণ-ধর্ম কেন্দ্রিক ব্যবস্থার জন্য শোষিতশ্রেণী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ন্যায় থেকে বঞ্চিত। যারা বলেন শুধু বর্ণ-ব্যবস্থার জন্য তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষ শোষিত হন, এই ধারণা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। শ্রেণীকে বাদ দিয়ে ‘বর্ণ-ব্যবস্থা ও ধর্ম’-কে শোষণের ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরার ধারণা আত্মঘাতী। শ্রেণী-ব্যবস্থার সঙ্গে বর্ণ-ব্যবস্থা মিশিয়ে শোষণ ও শাসনের এক অখণ্ড সত্তা নির্মাণ করেছে এদেশের শোষকশ্রেণী। এটা ভারতের শ্রেণী-ব্যবস্থার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ আগে শোষণের অবধারণাই সৃষ্টি হয়েছে। তারপর তাকে কার্যকর করতে বিভিন্ন রূপের উপরিকাঠামো তৈরি হয়েছে। এটাই ব্রাহ্মণ্যবাদ।

শোষণ-শাসন একছত্রভাবে চালিয়ে যেতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্কারের পর ব্রাহ্মণ্যবাদ যে পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে সেগুলো নিম্নরূপঃ

কর্ম ভিত্তিক বর্ণ ব্যবস্থা + জন্ম ভিত্তিক বর্ণ ব্যবস্থা +ধর্মের সংমিশ্রণ + নিয়তিবাদ = বর্তমান ব্রাহ্মণ্যবাদ

নিয়তিবাদের তিনটি প্রধান দিক :
১) কর্মফল (যেমন কর্ম তেমন ফল )।
২) জন্মান্তরবাদ ( পূর্ব জন্মের কর্মের জন্য বর্তমানের সুখ বা দুখঃ )।
৩) ফলের কামনা ব্যতিরেকে কর্ম ( কর্ম করে যাও ফলের আশা করো না )।

ব্রাহ্মণ্যবাদ ( আধিপত্যবাদ ) ভারতীয় দাস-ব্যবস্থায় দাস অর্থনীতিকে পরিপুষ্ট করেছে, সামন্ত-ব্যবস্থায় সামন্ত অর্থনীতিকে পরিপুষ্ট করেছে এবং বর্তমানে ব্রাহ্মণ্যবাদ বিদেশি পুঁজির নিয়ন্ত্রণে থাকা জমিদার, জোতদার, নয়া-জোতদার, মহাজন, ফড়ে, সামন্তপ্রভু, দালাল এককথায় বিভিন্ন পুঁজির মালিকদের নির্মম শোষণ ব্যবস্থাকে সাহায্য করে চলেছে। সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত এদেশের শোষণ-শাসনে, ব্রাহ্মণ্যবাদ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। সুদূর অতীত কাল থেকে চলে আসা পরম্পরা অনুযায়ী উচ্চবর্ণীয়দের চালকের আসনে বসিয়ে রেখেছে। শ্রেণী-বর্ণ-ধর্ম ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্যবাদী দর্শন চিরাচরিত ভাবে উচ্চবর্ণীয়দের হাতে তৈরি হওয়ায় ও তার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে থাকায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সুবিধাও হয়েছে।

চেতনার স্তর ক্রমে ক্রমে উন্নতি হওয়ায় কর্মজীবী ও চির বঞ্চিত বহুজন সম্প্রদায়ের ক্ষোভ স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে তাঁদের ক্ষোভ নিরসন করে, একচেটিয়া শোষণ চালিয়ে যেতে প্রয়োজনে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ( লাটাইয়ের দড়ি হাতে রেখে ) বহুজন সম্প্রদায়ের “ক্রিমি লেয়ারকে” অর্ধ-চালকের আসনে বসিয়ে দিতে পারে। এখনও তো সেটাই আছে। কেন্দ্রে ও বিভিন্ন রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদ, রাষ্ট্রপতি হয়ে বসে আছেন বহুজন সমাজের মানুষজন। তাতে মেহনতী দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষকদের ( যার বেশিরভাগই বহুজন ) অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে কি? কে শাসন ব্যবস্থার নেতৃত্বে থাকল, তার চেয়ে নিরাপদ শোষণ কায়েম কীভাবে রাখা যায় এবং সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজির মালিকদের কাছে সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তৎকালীন সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কোনও মহৎ উদ্দেশ্যের জন্য নয়, তাঁদের মুনাফা ও শাসন বজায় রাখার প্রয়োজনে এদেশের বহুজন কমিউনিটির একটা অংশকে শিক্ষিত করতে উদ্যোগী হয়। চির বঞ্চিত, শোষিত বহুজন সম্প্রদায়ের সামগ্রিক অবস্থা পরিবর্তনে ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তনের উদ্দেশ্য তাদের ছিল না, তা কখনও থাকতেও পারে না।

ব্রাহ্মণ্যবাদ ও উচ্চবর্ণ সমান নয়। উচ্চবর্ণ ও বহুজন উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্থিক ও মানসিক উপাদান আছে। তবে বর্তমান শাসন কাঠামো থেকে প্রাপ্ত সুবিধা অনুযায়ী অধিকাংশ উচ্চবর্ণ মানুষই ব্রাহ্মণ্যবাদী। প্রকৃত অর্থে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ উচ্চবর্ণের মানুষই ৩৫০০ বছর ধরে সামাজিকভাবে সংরক্ষিত হয়ে আছে। সমস্ত সুযোগ সুবিধা তারা ভোগ করে আসছে। বর্তমানে সরকারি ক্ষেত্রে ঐ ১২-১৫ শতাংশের জন্য ৫০.৫০ শতাংশ এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে উপরের দিকে প্রায় সবটাই সংরক্ষিত। আর ৮৫-৮৮ শতাংশের জন্য সরকারি ক্ষেত্রে ৪৯.৫০ শতাংশ সংরক্ষিত।

বলা হয়, যে কেউ জেনারেল দরিদ্র কোটায় জেনারেল হিসেবে অধিকার পেতে পারে। ব্যতিক্রম বাদ দিলে যা প্রায় অসম্ভব। বর্ণ-ব্যবস্থায় তথাকথিত নিম্নবর্ণদের পদবি এ ক্ষেত্রে বড়ো বাধা। প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্ত উচ্চপদে ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণহিন্দুরা থাকায় সে কাজটি হওয়ার উপায় নেই। দেখা যায় সংরক্ষিত আসন থেকে নানা অজুহাতে সংরক্ষিতদের বঞ্চিত করে সেই পদগুলোতে উচ্চবর্ণের লোক নিয়োজিত হয়।

শ্রেণীর সঙ্গে বর্ণ অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। তাই শ্রেণী ব্যবস্থাকে আঘাত না করে অর্থাৎ উৎপাদনের বিষয় ও উপকরণের মালিকানা তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষের হাতে হস্তান্তরিত না হলে এবং সাথে সাথে শোষিত নিম্নবর্ণের মানুষ পরিপূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রাপ্ত না হলে বর্ণ-ব্যবস্থা নির্মূল করা অসম্ভব বিষয়।

তাই সমাজ সচেতন প্রত্যেককে এদেশে শোষণ, বঞ্চনাহীন সমাজ ব্যবস্থা গঠনের লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ-শাসনের সঙ্গে ভারতের বিদ্যমান শ্রেণী-বর্ণ ব্যবস্থার সম্পর্ক না বুঝলে ব্রাহ্মণ্যবাদ বা আধিপত্যবাদকেও বোঝা যাবে না। বিশ্লেষণ করতে হবে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, ভিত্তি ও শ্রেণী চরিত্রকে। ব্রাহ্মণ্যবাদী দর্শনের সমালোচনায় শুধুমাত্র উচ্চবর্ণীয়দের সমালোচনা করলেই হবে না, সাম্যের দর্শন বিকল্প হিসেবে রাখতে হবে, তবেই প্রকৃত অর্থে আমরা সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও ব্রহ্মাণ্যবাদকে মোকাবিলা করে বৈষম্যহীন সমাজের দিকে এগিয়ে যেতে পারব। নচেৎ ব্রহ্মান্যবাদকে অটুট রেখে জাতি বৈষম্য ছড়িয়ে অবচেতনভাবে জাতি দাঙ্গার পক্ষেই অবস্থান নেওয়া হয়ে যাবে।

অস্তিত্ব রক্ষায় লড়াই সংগ্রাম আবশ্যক। পৃথিবীর আসল চালিকাশক্তি শ্রমিক, কৃষকসহ অন্যান্য মেহনতি মানুষের নেতৃত্বে শ্রেণীসংগ্রাম। মানবজাতির ইতিহাস শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস। শোষিত নিপীড়িত মানুষের শুধু পরাজয়ের ইতিহাস নয়, আছে বিজয়ের অসংখ্য ঘটনা। তাই শ্রেণী চেতনার সমৃদ্ধি, শ্রেণীর সংগঠন ও শ্রেণীসংগ্রাম শোষণ মুক্তির একমাত্র পথ। শ্রেণীসংগ্রাম বাদ দিয়ে অতীতেও হয়নি, বর্তমানেও কোন সমস্যার সমাধান হবে না। অতীতে বিভিন্ন শাসন ও উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনে বিক্ষুব্ধ দাস শ্রমিক,বিক্ষুব্ধ কৃষকসহ বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত কর্মজীবী মানুষের শ্রেণীসংগ্রামের ভূমিকা অসীম। ব্যক্তি মালিকানা অটুট রেখে সংস্কারের মধ্য দিয়ে ব্যবস্থা পরিবর্তনের শ্রেণীসংগ্রামকে প্রশমিত করতে চায় শাসকশ্রেণী। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তি মালিকানা অটুট রেখে শোষণবিহীন সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। কাঁঠালের আমসত্ত্ব। কারণ ব্যক্তি মালিকানা থাকলে, সমাজে শোষণও থাকবে।

এ যাবৎ মানব সভ্যতা চার ভাগে বিভাজিত। যথা, ১) আদিম গোষ্ঠী ব্যবস্থা বা অবৈজ্ঞানিক সাম্যবাদী ব্যবস্থা, ২) দাস ব্যবস্থা, ৩) সামন্ত ব্যবস্থা, ৪) পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। বর্তমানে যার বর্ধিত রূপ হচ্ছে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা।

আদিম গোষ্ঠী ব্যবস্থা বা অবৈজ্ঞানিক সাম্য ব্যবস্থার পরবর্তী সময়ে ব্যক্তি মালিকানাকে সামনে রেখে দুনিয়া জুড়ে সমাজ ব্যবস্থা শ্রেণী বিভাজিত হয়। এক শ্রেণী হয় শোষক এবং অবশিষ্টাংশ হয় শোষিত, যাদের অধিকাংশই আবার শ্রমজীবী। এই শ্রমজীবীদের শ্রম ও উৎপাদিত শ্রম লুঠে সহায়তা করতে তৈরি করা হয় মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়, যারা শাসক বর্গের শোষণের কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে এবং বিনিময়ে শ্রমজীবীদের তুলনায় অধিক সুযোগ ও সুবিধা পেয়ে থাকেন।

বিশ্বব্যাপী প্রথম তিনটি শাসন ব্যবস্থা বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে, আঞ্চলিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হলেও বর্তমানের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণে একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। যা বিশ্বের বৃহৎ পুঁজির গোষ্ঠীগুলি ( শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কিং এলিট) দ্বারা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত। তাই আঞ্চলিক দর্শন ও অর্থনৈতিক মতবাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরের শোষণের কাঠামোকে প্রতিরোধ করা অসম্ভব। প্রয়োজন সাম্যর আন্তর্জাতিক মতবাদ।

You may also like