চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলা যায় ইতিহাস আর বর্তমানের নিষ্ঠুরতম সত্য। নির্দ্বিধায় নির্ভয়ে দাঁড়ানো যায় কালের সমস্ত ভণ্ডামি আর সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে। সকালের স্নিগ্ধতার চেয়ে রাতের আঁধার গ্রাস করতো তাকে। সাম্প্রদায়িকতা, দাঙ্গা, বিভীষিকা, তার সাহিত্যের নিষিদ্ধ হওয়া, কোনটিই বাদ যায়নি। তার ওপর আঘাতের পর আঘাত এসেছে। তাকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল শাসকেরা। কিন্তু তিনি তো চিরকালের।
দেশভাগ
-
-
জীবন দেখে যে দুচোখ দিয়ে যেতে পারে আরো গভীরে
প্রতিটি মুহূর্তে চেটেপুটে নেয় বেঁচে থাকার স্বাদ আর ঘ্রাণ
প্রশ্ন ঘিরে রাখে তার চিন্তন মনন কাণ্ডজ্ঞান -
কেন এত দূরে, কাদের সিদ্ধান্তে এবং ফয়সালায় আজ জন্মভূমি থেকে নির্বাসিত। ক্লারিয়েটে বাজে অন্তহীন এক বেদনার সুর। তবে নিজ ভূমি থেকে নির্বাসিত অন্যরা এ অঞ্চলে বেশ আছে বলে জানায়। কেননা, দণ্ডকারণ্যের মধ্যে এটিই ছিল সবচেয়ে সফল প্রকল্প। যেখানে মানুষ—প্রকৃতির বদান্যতায় একটু স্বস্তিতে ছিল। প্রজন্ম পরম্পরায় যাপিত জীবনে দুঃখের দহন কিছুটা প্রশমিত হলেও স্মৃতির দহন কী আমৃত্যু ফুরোয়? ভারতের বিভক্তিকরণ শুধু একটি সাংবিধানিক দেশবিভক্তিতেই নিষ্পত্তি হয়নি, বরং বহু ক্ষেত্রেই তা ছিল অসংখ্য ঘরগেরস্তালি, পরিবার ও মানুষের জীবনের মর্মান্তিক ব্যবচ্ছেদ। ইতিহাসবিদ জ্ঞান পাণ্ডের মন্তব্য, “ভারতীয় ইতিহাসচর্চায় দেশ বিভক্তির অবস্থান স্ববিরোধী।”
-
এক বিকেলে নিঃশব্দে দুজনে সাঁকো পেরিয়ে নদীর ওপারে মল্লিকাদির বন্ধুর বাড়ি যাই। পথে আমাদের একবাক্য কথারও চালাচালি হয় না যেমনটা সবসময় হয়। নোমান আলী খানের সাথে সেই দিঘির শাণবাঁধানো-ঘাটে মল্লিকা’দির শেষআলাপ হয়। এবং বিকেল নেমে এলে নিঃশব্দে বাড়িরপথে ফিরতে পা বাড়াই।
সাঁকোর মাঝপথে দাঁড়িয়ে পশ্চিমদিকে দৃষ্টি ফেরালে লাল-টকটকে বিদায়ী সূর্যটায় চোখ আটকে যায়। “সূর্যাস্তে বিষাদের সুর থাকে ঠিক যেমন সূর্যোদয়ে থাকে সুখস্বপ্ন”-মল্লিকাদির কথা। তিনি এমনতরো কতো কথা আমাকে প্রায়ই বলতেন। আমরা প্রায়ই সূর্যাস্ত দেখতে বাঁশের সাঁকোর মধ্যিখানে নীরবে দাঁড়িয়ে যেতাম আজও স্বভাব মতো থমকে দাঁড়াই। পশ্চিম আকাশ, আজকে একটু বাড়াবাড়ি রকমের বিষাদের লাল আভায় মুড়ে আছে। মল্লিকা’দির কান্নাভেজা চোখজোড়ায় বিষাদের রঙের বড়বেশি মাখামাখি টের পাই। আমি আমার বাড়িরপথে পা বাড়াতে উদ্ধত হলে, মল্লিকাদি আমার হাতজোড়া তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখে। দিঘিরজলের মতো টলমল অশ্রুফোঁটা আমার হাতে গড়িয়ে পড়ে। আমি আলতোভাবে হাত ছাড়িয়ে বাড়ির পথ ধরি। -
হাসান আজিজুল হক ‘কথাসাহিত্যের কথকতা’ বইতে লিখেছেন, “যারা কখনোই, কোনো কারণেই দেশত্যাগ করবে না, দেশত্যাগর কল্পনা পর্যন্ত যাদের মাথায় আসে নি, তাদের যখন হাজারে হাজারে, লাখে লাখে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে ছিন্নমূল উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে হয়েছে—-আমাদের সেই সাম্প্রতিক ইতিহাসের সেই বৃহত্তম বেদনা ও যন্ত্রণার কথা কেউ লেখেন নি।”২ বস্তুনিষ্ঠ কথাকার দেশভাগজনিত এই গভীর সংকটকে তুলে ধরলেন তাঁর ‘আগুনপাখি’ নামক উপন্যাসে।