হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি : প্রেক্ষিত দেশভাগ ও গণপ্রব্রজন 

মহঃ ইব্রাহিম

চল্লিশের দশকে বিশ্ব সাহিত্য বহু ঘটনার সাক্ষী।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গোটা বিশ্ব তোলপাড়।পরাধীন ভারতবর্ষ এ মহাযুদ্ধে সামিল। ভারতে স্বাধীনতা -কামী মানুষের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অভিমুখ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।দেশের স্বাধীনতাকে কেন্দ্র করে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব-মধুর বিন্যাস। দুর্ভিক্ষ,দাঙ্গা ও দ্বিতীয় বিশ্ব-যুদ্ধের কালোরাত পেরিয়ে দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা এলো তা খণ্ডিত । শুধু একটি দেশের ভূখণ্ড খণ্ডিত হয় নি। মানুষ এবং মানুষের মন খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গিয়েছিল। দেশভাগ পূর্ব এবং দেশভাগোত্তর দাঙ্গায় দেশের মাটি হয়েছিল রুধিরাক্ত।বিভাজক রাজনীতিবিদরা নিজেদের কায়েমি স্বার্থে দেশভাগ করেছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্ব ও ধর্মান্ধতাকে শিখণ্ডী করে; সাধারণ মানুষের কথা না ভেবেই। ফলে দেশভাগের পূর্বেই লক্ষ লক্ষ মানুষ ভাগ হয়ে গিয়েছিল ধর্মের টিকি-দাড়ির বিভাজনে। আজন্মের শেকড়কে ছিন্ন করে এক দেশের মানুষ হয় যায় দু’দেশের। কাঁটাতার বসবার আগে হাজার হাজার মানুষ রাতের অন্ধকারে ভিটেমাটি ত্যাগ করে হয়ে গেল ছিন্নমূল পরিযায়ী মানুষ। সাধারণ মানুষদের মনে গেঁথে দিয়েছিল পাকিস্তান হলো মুসলমানদের আর ভারতবর্ষ (হিন্দুস্থান)হলো হিন্দুদের দেশ। তাই, দুদিক থেকেই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে স্বভূমি ত্যাগের হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছিল নিজেদের বিপন্নতা থেকে বাঁচবার জন্যে।এই দেশভাগের আঁচ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলমানকে গভীর ভাবে দগ্ধ করেছিল। বাঙালি মুসলমানদের পরিচয় ঘটে এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার মানুষ রূপে। স্বাধীনতাকে নিয়ে সাধারণ মানুষ এতোদিন যে স্বপ্ন লালন করেছিল তা ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল

দেশভাগ ও দেশভাগোত্তর উদ্বাস্তু সমস্যা, দাঙ্গা ও দাঙ্গা-বিধ্বস্ত যন্ত্রণা,দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তর—-ইত্যাদির ফলে মানুষের জীবনে গভীর বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছিল।জীবনে ও মননে তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল।সাহিত্য- শিল্পের নানা শাখায় এই সংকটের প্রতিবিম্বন ঘটেছিল। যদিও বাংলা কথাসাহিত্যে দেশভাগ নিয়ে রচনা তুলনামূলকভাবে অপ্রতুল।বিশিষ্ট অধ্যাপক এবং সমালোচক, প্রাবন্ধিক অশ্রুকুমার সিকদার আফসোস করে লিখেছেন, ” পশ্চিম ভারতের দেশভাগ-জাতি অভিজ্ঞতা নিয়ে তবু কিছু সাহিত্য রচিত হয়েছে, লিখিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ইতিহাস ,কিন্তু পূর্ব ভারতে নীরবতা যেন আরো বেশি প্রগাঢ়।….. বাংলা সাহিত্যের নীরবতা যে আছে সে বিষয়ে সংশয় নেই।”১ দেশভাগ পরবর্তীকালে অনেকের গল্প উপন্যাসে দেশভাগের কথা উঠে এসেছে। জীবনানন্দ দাশের ‘জলপাইহাটি’, অমিয়ভূষণ মজুমদারের ‘গড় শ্রীখণ্ড’, দেবেশ রায়ের ‘উদ্বাস্তু’, প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকা’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্ব পশ্চিম’ও জ্যোতির্ময়ী দেবীর ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা’ ইত্যাদি উপন্যাসে এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘একটি তুলশী গাছের কাহিনী’, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ‘দাঙ্গার সময়’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কলিকাতার দাঙ্গা ও আমি’, সমরেশ বসুর ‘আদাব’, অমলেন্দু চক্রবর্তীর ‘ভিটেমাটির রূপ কথা’, ‘ইত্যাদি গল্পে দেশভাগের ইতিহাস চিহ্নায়ন হয়ে রয়েছে। কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্যে দেশভাগ এবং বাঙালি জীবনে তার প্রভাবের প্রসঙ্গ নানাভাবে উঠে এসেছে। তাঁর রচিত ‘আগুনপাখি’ বাংলাসাহিত্যে দেশভাগকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ অবিস্মরণীয় উপন্যাস।

দেশভাগ পরবর্তীকালে হিন্দু-মুসলমানের ভিটেমাটি হস্তান্তর ছিল সেই সময়ের এক বাস্তব দলিল। দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে ওপার বাংলা থেকে উদ্বাস্তু হিন্দুরা জীবন ও ধর্ম রক্ষার তাগিদে এপার বাংলাসহ ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে বসতি গড়েছিল,ঠিক তেমনি এপারের সংখ্যালঘু মুসলিমরা সামাজিক ও ধর্মীয় নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে পূর্ব পাকিস্তান বা ওপার বাংলায় পালিয়ে গিয়েছিল। দু’টি নতুন দেশের বাস্তুচ্যূত মানুষেরা “চোরের মতো” (শঙ্খ ঘোষ) ভিটেমাটি বিনিময়ের মাধ্যমে সাত পুরুষের মায়া কাটিয়ে সব হারানোর বোবা যন্ত্রণা নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল,অনিশ্চিত ভবিষ্যতকে সঙ্গী করে অজানা এক দেশে। হাসান আজিজুল হক ‘কথাসাহিত্যের কথকতা’ বইতে লিখেছেন, “যারা কখনোই, কোনো কারণেই দেশত্যাগ করবে না, দেশত্যাগর কল্পনা পর্যন্ত যাদের মাথায় আসে নি, তাদের যখন হাজারে হাজারে, লাখে লাখে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে ছিন্নমূল উদ্বাস্তুতে পরিণত হতে হয়েছে—-আমাদের সেই সাম্প্রতিক ইতিহাসের সেই বৃহত্তম বেদনা ও যন্ত্রণার কথা কেউ লেখেন নি।”২ বস্তুনিষ্ঠ কথাকার দেশভাগজনিত এই গভীর সংকটকে তুলে ধরলেন তাঁর ‘আগুনপাখি’ নামক উপন্যাসে। 

১৯৩৯ সালে কথাকার হাসান আজিজুল হকের জন্ম অবিভক্ত বাংলার বর্ধমানের যবগ্রামে।পরাধীন ভারতে নয় বছর এবং স্বাধীন ভারতে আট বছর জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। তারপর, বরা- বরের মতোই চলে গিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গে। দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক হলেও বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক। ভারতবর্ষের প্রায় ১৬/১৭ বছরের জীবনে রাজনৈতিক ঝড়’ ঝঞ্ঝা, দাঙ্গা, অগণন মানুষের লাশ, দেশভাগ, দেশগঠন, উদ্বাস্তু সমস্যা সর্বোপরি মানুষের বিপন্নতা প্রতিনিয়ত তাঁর দার্শনিক মন-মননকে বিচলিত করেছে। এই সমকালে তাঁর রচিত গল্পগুলির বিষয়বস্তু দেশভাগ। যেমন: ‘আত্মজা ও একটি করবীগাছ’, ‘খাঁচা’, ‘উত্তরবসন্তে’, ‘মারী’, ‘ঘরগেরস্থি’ ,’পরবাসী’ ইত্যাদি অসংখ্য গল্প।গল্পগুলিতে যেমন দেশভাগের যন্ত্রণার কথা এসেছে তেমনি ফুটে উঠেছে দেশভাগ পরবর্তী বিপন্ন জীবনের ছবি। দেশভাগের গল্প সংকলনের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন, “দেশভাগ নিয়ে একটির পর একটি গল্প বা উপন্যাস লেখা হয়তো আমার দায়িত্ব ছিল। কিন্তু কোনোদিন সেই পথে এগোনোর সাহস বা সংকল্প করতে পারলাম না। তবু বুকের পাঁজর ফাটিয়ে দীর্ঘদিনের ব্যবধানে দু’টি করে গল্প বেরিয়ে এসেছে।ঠিক যেন করাত তলে হৃদয় পিণ্ড চেরাই হচ্ছে এরকম তীব্র কষ্টের সব মুহূর্তে এক একটি গল্প লেখা হয়েছে। অথচ ঠিক জানি একালের পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারা যাবে না। …… কোনো ভাবেই কি তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব কতবড় বিপর্যয়  ঘটেছিল ১৯৪৭ সালে। ঠিক কতটা ক্ষতি হয়েছিল মানুষের সংসারে, কতটা খর্বাতায় ভেতরে  ঢুকে গিয়েছিলাম আমরা।”৩ একটি সাক্ষাতকারে একথাও তিনি বলেছিলেন, “দেশভাগ আমার জীবনের ক্ষত স্বরূপ,ক্ষত সারলেও দাগ থেকে যায়, আমি সেই দাগের কারণ অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি।”

উপন্যাসটি লেখার আগে  ‘প্রথম আলো’-র পত্রিকার এক সাক্ষাতকারে হাসান আজিজুল হক বলেন, “বর্ধমানে আমার যে ফেলে আসা বসত বাড়ি, শৈশব-তারুণ্যের স্মৃতি, পারিবারিক সাংসারিক চলচ্চিত্র, রাঢ়ের গ্রাম্য মুসলমান, গৃহস্থ পরিবারের উত্থান-পতন, মা-বাবার কথা, দেশভাগের নির্মমতা, সাধারণ মানুষের উপরে এর অভিঘাত—-এই সবকিছু প্রেক্ষাপটে রেখে একটি উপন্যাস আমার লেখা উচিত। এই ভাবনা থেকেই ‘আগুনপাখি’ লেখার শুরু।”৪ উপন্যাসটির প্রথমাংশ ২০০৫ সালে ‘প্রথম আলো’ ঈদ সংখ্যায় ‘অপরূপকথা’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় নাম পাল্টে ‘আগুনপাখি’ রাখেন।৫  ২০০৬  সালে ‘আগুন পাখি’ প্রকাশিত হয়।তবে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘শামুক’ মাত্র ১৮ বছর বয়সে কলেজে পড়ার সময় (১৯৫৭) রচনা করেন। উপন্যাসটি ‘পূর্বমেঘ’ পত্রিকায় তিনটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এ উপন্যাসে আধুনিক শিক্ষা সম্পর্কে মুসলমান সমাজের সীমাবদ্ধতা, প্রতিকূল মানসিকতাকে ও সংকটকে তীব্র শ্লেষের সঙ্গে তুলে ধরেছেন।

‘আগুনপাখি’ আশ্চর্যজনকভাবে এমন একটি নারী চরিত্র সৃষ্টি করলেন, যা এ যাবতকাল কেউ পারেন নি। বলা যায়, এই চরিত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নারী সত্তাকে ভিন্নভাবে তিনি বিনির্মাণ করলেন।তাঁর ছোটগল্পগুলিতে এমন চরিত্র দুর্লভ। তবে, ‘একটি নির্জল কথা’ গল্পে দেশত্যাগর মর্মজ্বালায় এক নারী বলেছেন, “কুন দোজখিরা দ্যাশ ভেঙেছে, তাতে আমার কি?…..আমার মাটিটো ক্যানে কেরে লিবি?”এ যেন একই স্বর— একই প্রশ্ন। এমন কি পরবর্তী উপন্যাস ‘সাবিত্রী উপাখ্যান’-এ নারীর ভিন্ন ধর্মী চরিত্র সৃষ্টি করলেন যার দ্বারা সমাজকে চাবকাতে চাবকাতে এগোতে থাকলেন। বাস্তবের আপতিক স্তরকে ছিন্ন ভিন্ন করে নিহিত বাস্তবকে দেখাতে চেয়েছেন। একটি সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, “যে বাস্তব থেকে অভিজ্ঞতা আহরণ করি, সেই অভিজ্ঞতা দিয়েই নির্মাণ করি দ্বিতীয় বাস্তব।”৬  আগুনপাখির মেজবউ সরল অথচ এক কঠিন যুক্তিগ্রাহ্য অপরিহার্য বাস্তবকে তুলে ধরেছেন।

কথাকার উপন্যাসটিকে ২৮-টি পরি চ্ছেদে ভাগ করেছেন এবং প্রতিটি পর্বের স্বতন্ত্র শিরোনাম দিয়েছেন। প্রথম পরিচ্ছেদের নাম ‘ভাই কাঁকালে পুটুলি হলো’ এবং শেষ পরিচ্ছেদের নাম ‘আর কেউ নাই, এইবার আমি একা’।প্রতিটি পরিচ্ছেদের এই নামকরণ ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের শুরুটা হয় এক নিঃসঙ্গ নারীর আত্মকথনের মধ্য দিয়ে। লেখক সবর্দা থেকেছেন অন্তরালে।এভাবে শুরু হয়েছে —- ” আমার মায়ের য্যাকন মিত্যু হলো আমার বয়েস ত্যাকন আট-ল বছর হবে। ভাইটোর বয়েস দেড়-দু’বছর । এই দুই ভাই-বুনকে অকূলে ভাসিয়ে আমার মা চোখ বুজল।”৭,  পিতৃতন্ত্রের বৃত্তে ভাইকে দেখভাল করার দায়িত্ব বোনকেই পালন করতে হবে।পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর কোনো মূল্যই ছিল না সেদিন। মেয়েদের লেখা- পড়া ছিল ‘বেয়াদপি’।”মেয়েদের তো রাঁধাবাড়া আর ছেলে মানুষ করা ছাড়া আর কুনো কাজ ছিল না।”৮

গাঁয়ের মাতৃহীন মেয়ে। ‘বাপজি’ আবার বিয়ে করলেন। নতুন মা ঘরে এলো। “মা ফিরে প্যালাম না ঠিকই, তবে মায়েরই মতুন আর সেই সাথে সখির মতুন একজনাকে প্যালম।”৯  নতুন মায়ের খোকা হলে মামারা এসে ভাইকে নিয়ে গেল। মানুষ করবে তারাই। আর “মেয়ে হলো বাপের আঘিন্নে দায়”। ১০  সুতরাং, সে নতুন মায়ের কাছেই রইল। মাতৃহীন মেয়ে মাটির বাড়ির চালা ধ’রে মানুষ হতে হতে ‘উট ছুড়ি তোর বিয়ে’,এভাবে অবস্থাপন্ন ঘরে বিয়ে হয়ে গেল। উপন্যাসের তৃতীয় পরিচ্ছেদেই বিয়েটা সেরেছেন লেখক। হিন্দু পাড়ায় এক বাড়ির সিংহ দরজায় পালকি নামল। সে রাজবাড়ির গৃহকর্ত্রী তাকে গয়নায় সাজিয়েছিল। বড়ো ছেলের মতো তার স্বামীকে ভালোবাসেন বলেই এ আয়োজন। সত্যি,তখন এমন  ভালোবাসা উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজমান ছিল।আজ এটা স্বপ্নের অতীত। এই নারীর কথায় এক গভীর মুগ্ধতা নিয়ে শাশুড়ির কথা যেমন এসেছে, তেমনি স্বামীর কথা এসেছে। সংসার জীবনের ছোট ছোট ঘটনা, কত ওঠা-নামা, কত টানাপোড়েন—- এসব দিয়ে যেন জীবনকে বুঝে নিতে থাকল।

বড়ো সংসার। যেন ডোবা থেকে দিঘিতে এসে পড়ল। ফলে নতুন বউ হয়ে বেশিদিন থাকা গেল না।”চোখে ঠুলি লাগিয়ে সোংসারের ঘানিতে জুতে গ্যালম দু-দিন যেতে না যেতেই।”১১ চারপাশের বেশিরভাগ মানুষই হিন্দু। মানুষ-জনের সঙ্গে গভীর মমতায় নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলল। হিন্দু-মুসলিম বলে আলাদা কিছু সে জানে না। গভীর মমতায় গড়ে তোলে একান্নবর্তী পরিবার। এক্কান্নবর্তী পরিবারে নানা ঝক্কি- ঝামেলার মধ্যে স্বামীর সমস্ত কিছুকে মানিয়ে নিল দিব্যি। রাতের নিরালায় স্বামীর কাছ থেকে কিছু লেখা-পড়া শিখতে থাকল। আলো ও কালোর তফাত আরো ভাল করে বুঝতে শিখল। স্বামী সামাজিক নানা কাজে জড়িয়ে পড়েন। ইউনিয়ান নির্বাচনে জয়ী হন তিনি।স্বামী হয়ে উঠলেন হিন্দু-মুসলমাল দুই সম্প্রদায়ের প্রিয় নেতা। সুখদুঃখ ও নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গড়ে তুলতে থাকল নিজেকে। সংসারে নারীরও যে পরিসর প্রয়োজন, মুসলিম পরিবারে তা ভাবা অলীক। তাই, শুরু হলো সংসারের ঘানি টানা। বোঝার জন্য জীবনটাকে ভাল করে মাপতে হয়। তার মূল্যায়ন,”সেই যি ঘানি টানতে লাগলাম, সারা জীবন একবারও আর থামতে পারলাম না। ডাইনে বললে ডাইনে। বাঁয়ে বললে বাঁয়ে। শুদুই হুকুম তামিল করা। অ্যাকন মনে হয়, জেবনের কাজ নিজে নিজে করি নাই …… আমি মানুষ না ছেঁয়া? তা কি আমার নিজের ছেঁয়া।”১২ এ যেন তার আত্ম-অন্বেষণ। আত্ম-উন্মোচন ।

উপন্যাসটিতে দেশ,কাল ও সমাজের   পটভূমিতে  পরিবার জীবনের কথা একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। নায়িকা নারী চোখের সামনে দেখে ইতিহাসের ক্রান্তিকালকে। বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী মন্বন্তর, খাদ্যাভাব, আকাল, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দেশভাগের ভয়াবহ পরিনতির যন্ত্রণা মর্মে মর্মে ভোগ করেছে। নানা ঘটনার আন্বয়িক পরম্পরায় জীবনের তল-উপরিতল আলোড়িত হয়েছে।স্বদেশি আন্দোলনের ঢেউ বাংলার মানুষের মনে তীব্র প্রতিবাদ দেখা দিয়েছে। যুব-ছাত্র বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে।বিদেশি দ্রব্য বর্জন, দেশি খাব, দেশি পরব জোয়ারে ভাসছে দেশ। তার বড়ো ছেলে আন্দোলনে যোগ দিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। এবার বিশ্বযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ভারতবর্ষ। ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকা পড়ে যুদ্ধের খবর জানতে পারে। কর্তার কাছ থেকে জানতে পারে যুদ্ধ এবার ভারতের দিকে এগিয়ে আসবে ভারতবর্ষের বাজারে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব — মানুষের জীবনে সংকট দেখা দিয়েছে—“ঘরে ঘরে সব তাঁত বন্ধ।সুতো নাই, তাঁতীরা সব পেটে কাপড় বেঁধে বসে আছে।”১৩  বাজারে অগ্নিমূল্য। পরনের সামান্য কাপড় অলভ্য। নারীরা উলঙ্গ জীবন যাপন করছে। বাইরে বেরোতে পারছে না। কর্তা জানায়–“যুদ্ধ কি এইবার একটু একটু বুঝতে পারছ তো? প্রথমে দেখলে মানুষের পরনের কাপড় নাই। এখন দেখছ একটি একটি করে জিনিশ গরমিল হচ্ছে—-নুন নাই, কেরোসিন নাই, চিনি নাই।তার মানে গাঁয়েগঞ্জে যা যা তৈরি করতে পারা যায় না, তাই তাই নাই।”১৪  শুধু কি তাই, ১৩৫০-এর ঝড়ে ফসল নষ্ট হয়ে যায় মাঠ ফসল শূন্য, অজন্মা। চারিদিকে “আকাল “। মেলেটারি ছাউনিতে জীবজন্তু থেকে নারী—সবই সহজলভ্য। এ সমস্ত কিছুই ঔপনিবেশিক শক্তির কারসাজি। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাবের চেয়ে পরোক্ষ প্রভাব ছিল আরও ভয়ংকর। দুর্ভিক্ষের ফলে গ্রামের যৌথ পরিবারগুলিতে ভাঙন দেখা দিল। উপন্যাসে কথক নারীর সংসারে অভাব নেমে আসে। যে বাড়িতে তিনবেলা রান্না হতো, সেখানে চুলো জ্বলে না ,হাঁড়ি চড়ে না। এই অভাবের অজুহাত ধরে গল গল করে হিংসা মুখব্যাদন করে বেরিয়ে আসতে শুরু করল। “ভাত কাপড়ের টান বড় টান।”এই আর্থ-সামাজিক টানাপোড়েনে যৌথচেতনা, একান্নবর্তী পরিবারের ভাবনা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।ভাতের অভাবেই একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে পড়ল। সংসারে কোনো কাজে কোনোদিনই অবহেলা করে নি। অথচ নিজের হাতে গড়া সংসার পরিবার ধরে রাখতে পারল না।ঘটে গেল পরিবারের ভাঙন, মনের ভাঙন। কোথায় যেন ‘চুলের মতো’ একটা ফাঁটল ছিল। সেটাই একদিন বড় ফাঁটলে পরিনত হলো। ভায়েরা পৃথকগন্ন হলো।এখানে মানুষের ঘামের গন্ধ ছিল, প্রকৃতি ছিল, আজানের সুর ছিল, ছিল কাসর ঘন্টার ধ্বনি।কিন্তু গ্রাম পতনের শব্দ শুরু হলো

উপন্যাসে ইতিহাসের ঘটনাক্রমে উঠে এসেছে দেশভাগ ও দাঙ্গা। সে সারা জীবন দেখেছে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি ও ভালবাসা। আর আজ হিন্দু মারছে মুসলমানকে, মুসলমান মারছে হিন্দুকে। দেশভাগের অনিবার্য ঘটনার অনুক্রম দাঙ্গা।ছেচল্লিশের দাঙ্গার ভয়াবহতা আজও মানুষ শিহরিত হয়। ছেচল্লিশের দাঙ্গার সঙ্গে অন্য কোনো সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের তুলনা চলে না। একটি শহরে এত ব্যাপক এবং এত ভয়ানক দাঙ্গা আগে বা পরে কখনও হয় নি।মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।গাঁ উজাড় হলো কলেরায়। কোথা থেকে কানাঘুষোয় রটে গেল, দেশটা নাকি ভাগ হবে। ” যেখানে যেখানে হিন্দু বেশি সেইসব জায়গা নিয়ে হিন্দুস্থান, আর যেখানে যেখানে মোসলমান বেশি সেসব জায়গা নিয়ে পাকিস্তান। বাঙালি মোসলমানদের জন্য পুব পাকিস্তান আর একটা ভাগ।”১৫   স্বামীর কাছ থেকে জানতে পারে হিন্দু-মুসলমালের বিরোধের কথা। কিন্তু কেন এই বিরোধ সে কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না।তার মনে হলো— “বিনা কারণে শুদু হিঁদু-মোসলমানের মাঝেখানে একটো ছেঁয়া পড়ে গেল।সেই ছেঁয়া আর কুনোদিন গেল না।কুনোদিন যাবে কিনা তা জানি না।” ১৬  তাঁর জীবনবোধ অজানা আতঙ্কে ধাক্কা পায়।

বহু ঘটনার পরম্পরা —- মানুষে মানুষে বিরোধ, রাজনীতিবিদদের ক্ষমতার লিপ্সা, নানান কূট-চাল জড়িয়ে দেশভাগ এল। মুসলমানদের জন্য আলাদা একটা দেশ হলো। সেই স্বধীনতা আন্দোলনের পেটের ভেতর আর একটা দেশ পূর্ব পাকিস্তান। এবার উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে দেশ ছাড়ার হিড়িক শুরু হয়ে গেলো। হিন্দু হিন্দুস্থানকে আর মুসলমান পাকিস্তানকে পরম আশ্রয়স্থল মনে করে সাত পুরুষের ভিটেমাটি ত্যাগ করতে শুরু করল। মূল আখ্যানে দেখা গেল স্বামী-পুত্র-কন্যা সবাই সাত জন্মের ভিটে ত্যাগ করে দেশান্তরি হলো, কিন্তু মেজবউ কোনো ভাবেই  তার স্বদেশ ত্যাগ করতে রাজি হলো না। যে কোনোদিন স্বামীর কথার পরে কথা বলেনি আজ সে প্রতিরোধ গড়ে তুলল। তার পাঁজরভাঙা কথা, “আমার বিশ্ব-বোম্ভান্ডো ভেঙে যেচে যি।”১৭ , তার অকাট্য যুক্তি, “একই দ্যাশ, একইরকম মানুষ, একইরকম কথা,শুদু ধম্মো আলেদা সেই লেগে একটি দ্যাশ একটানা যেতে যেতে একটো জায়গা থেকে আর একটো দ্যাশ হয়ে গেল, ই কি কুনোদিন হয়? এক লাগোয়া মাটি, ইদিকে একটি আমগাছ একটি তালগাছ, উদিকেও একটি আমগাছ, একটি তালগাছ ! তারা দুটো আলেদা দ্যাশের হয়ে গেল?”১৮ এমন যুক্তিগ্রাহ্য বোধ চরিত্রটিকে মহিমান্বিত করেছে। হাসান আজিজুল রাজনীতিবিদদের ভ্রান্তিকে চোখে আঙুল দিয়ে তুলে ধরেছেন।

শেষ পরিচ্ছেদের শিরোনাম “আর কেউ নেই ,আমি একা। ” একে একে ছেলেমেয়েরা সবাই দেশান্তরি হলো। এবার স্বামীর সঙ্গে তাকেও যেতে হবে। ছেলেমেয়েদের পাকিস্তান যাওয়া সাত-আট বছর হয়ে গেল। কর্তা পাকা বন্দোবস্ত করতে ব্যস্ত। ছেলে- মেয়েরা বার বার চাপ দিচ্ছে।”হিন্দুস্থান পাকিস্তান সবাই মেনে নিয়েছে।”১৯ “আমার খালি মনে হতে লাগল, ক্যানে যাব কেউ আমাকে বুঝিয়ে দিক। বুঝিয়ে দিলেই আমি যাব, “২০ মেতের বউয়ের এই অকাট্য যুক্তির কাছে কেউ কিছুই বলতে পারছে না। কর্তার সমস্ত ব্যবস্থা পাকা। দিন ঠিক হয়ে গেল—“এই রোববারের পরের রোববার যাওয়া।”২১ তারপরেও সে বলল, এই বাড়িতেই আমি থাকব।”২২ কর্তার রাগ-দুঃখ-যন্ত্রণা বেরিয়ে এল। ভায়েরা এল, জায়েরা এল, ঝগড়াঝাঁটি, কাঁদাকাটি সবই হলো। জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা হতে লাগল। কিন্তু তার মতের কোনো পরিবর্তন হলো না।এ যেন জীবনানন্দের কবিতা—-“তোমার যেখানে সাধ চলে যাও—- আমি এই বাঙলার পারে/রয়ে যাব।” এ তো শুধু মুখের কথা নয়; অন্তরের যুক্তিনিষ্ঠ সত্য বচন।  “আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না ক্যানে আলাদা একটা দ্যাশ হয়েছে গোঁজামিল দিয়ে যিখানে শুদু মোসলমানরা থাকবে কিন্তুক হিঁদু কেরেস্তানও আবার থাকতে পারবে। তাইলে আলাদা কিসের ? আমাকে কেউ বোঝাইতে পারলে না যি সেই দ্যাশটো আমি মোসলমান বলেই আমার দ্যাশ আর এই দ্যাশটি আমার লয়। আমাকে আরও বোঝাইতে পারলে না যি ছেলেমেয়ে আর যায়গায় গেয়েছে বলে আমাকেও সিখানে যেতে হবে। আমার সোয়ামি গেলে আমি আর কি করবো? আমি আর আমার সোয়ামি তো একটি মানুষ লয়, আলেদা মানুষ। খুবই আপন মানুষ, জানের মানুষ, কিন্তুক আলেদা মানুষ।”২৩ এ নারী মনে করে একটি দেশ যুক্তিহীনভাবে সৃষ্টি হয়েছে। “যে-পাকিস্তান গোঁজামিলের সৃষ্টি,তাকে ঐ নারী প্রত্যাখ্যান করে তাই। কীভাবে হিন্দুর দেশ মুসলমানের দেশ আলাদা হয়ে গেল—-তা যুক্তি দিয়ে বোঝানো হয় নি। ধর্মীয় ভিত্তিতে কি জমি নদী আকাশ বিভক্ত করা যায়? আলাদা কিসে তবে।”২৪

উপন্যাসের শেষে কথক নারীর এই বীক্ষণ উপন্যাসটির মৌল সত্তা। একজন মা, একজন নারী নিজের মতো করে সমাজ-সত্তা, দেশ-দেশভাগ ও ছিন্ন-মূল মানুষের হৃদয় যন্ত্রণাকে বুঝে নিতে চেয়েছে। যা এর পূর্বে কেউ এমন করে ভাবে নি। আর তার এই প্রশ্ন গোটা দেশের বা দেশভাগ জনিত দুঃখ-যন্ত্রণার শরিক যে মানুষগুলি, তাদের প্রাণের কথা।যেসব মানুষ দেশত্যাগ করে যায়,তাদের মনের শেকড় তো জন্মভূমির মাটিতে পোঁতা থাকে। ফলে তাদের সত্তাও দেশের মতো দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। আমৃত্যু বিভাজিত সত্তা নিয়ে যন্ত্রণা ভোগ করে। তাই, মাঝে মাঝে শেকড়ের টানেই ফিরে আসে পূর্বের জন্মভূমিতে। তার উপলব্ধি—“অ্যাকটো গোটা মানুষও আর গোটা থাকবে না, আমিও থাকব না, কত্তাও থাকবে না। কত্তা এইবার দুটো হবে।”২৫

এতোদিন সে স্বামীর এবং পরিবারের উত্তাপ সহ্য করেছে। চুপচাপ দহন যন্ত্রণা ভোগ করেছে। কিন্তু আজ সে জ্বলন্ত অঙ্গার। আগুন পাখি যে খাঁচায় বদ্ধ সেই খাঁচা আজ জ্বলে পুড়ে গেল। নিজে পুড়ে যেমন খাটি সোনায় পরিনত হয়েছে, তেমনি সেই উত্তাপে ঝলসে গেল সমাজ-সংসার, পরিবার। আগুন তাকে পোড়াতে পারে না। সে হলো আগুনপাখি। আগুনপাখি চিরন্তন। এ যেন গ্রীক পুরাণে কথিত ফিনিক্স পাখি।জাতিস্মর হয়ে বেঁচে থাকে। দেশভাগ শুধু বাস্তু কেড়ে নেয় না, মন ভাঙে, সংসার ভাঙে। সে বার বার আত্মসমালোচনা করেছে—– “আমি কি ঠিক করলম? আমি কি ঠিক বোঝলম?…..মানুষ কিছুর লেগে কিছু ছাড়ে ……. আমি কিসের লেগে কি ছাড়লম? অনেক ভাবলম।শ্যাষে একটি কথা মনে হলো, আমি আমাকে পাবার লেগেই এত কিছু ছেড়েছি।”২৬  এ বোধই একজন গ্রাম্য বধূকে শান দেওয়া অস্ত্রের মতো তীক্ষ্ণ করেছে। স্বামী স্ত্রী তো আলাদা সত্তার অধিকারী। সুতরাং, সংসারের বাইরে বৃহত্তর জগতে সবসময় একই পথের যাত্রী হতে হবে এমন তো নাও হতে পারে।

বিশিষ্ট সমালোচক অশ্রুকুমার সিকদার তাঁর ‘ভাঙা বাংলা ও বাংলাসাহিত্য'(২০০৫) গ্রন্থের কভার পেজে লিখেছেন, “ভারতবর্ষের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে বিপর্যয়ের ঘটনা দেশভাগ। যুদ্ধ নেই, আপাতত সব শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে এমন পরিস্থিতিতে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণপ্রব্রজন  ঘটেছে ভারতভাগের ফলে। ছিন্নমূল মানুষ ভিটেমাটি, চিরাভ্যস্ত জীবন ছেড়ে অনির্দিশ্যের পথে বেরিয়েছিল। “সেই সঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করেছেন, “কেন বাংলা সাহিত্য নিজেকে দরিদ্র করলো, কেন দেশভাগের এক শ্বাশত সাহিত্যিক স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তুললো না,”  তপোধীর ভট্টাচার্যের কথায়, “সাধারণভাবে দেশভাগ ও প্রব্রজন সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গীয় লেখকদের মধ্যে চূড়ান্ত অনাগ্রহই চোখে পড়ে। তার মানে আবহমান বাংলার মানচিত্র ও সাহিত্য-সংস্কৃতি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও এতে তাঁরা প্রকৃত কোনো পীড়া বোধ করেননি।”২৭ আমরা আখ্যানে দেখতে পাই বৃটিশ দেশ ছেড়ে চলে গেল,কিন্তু দেশটাকে দুভাগ/ তিনভাগ করে দিয়ে গেল। আর এদেশের সমস্ত মুসলমান পাকিস্তানে চলে যাবে; পাকিস্তানের সমস্ত হিন্দু হিন্দুস্থানে চলে আসবে। রাজনৈতিক নেতারা দ্বিজাতিতত্ত্বের যুক্তিহীন কৌশলে দেশটা ভাগ করেছিলেন। ধর্ম শুধু মানুষ ভাগ করে না, দেশও ভাগ করে। দেশভাগের পূর্বপর্যন্ত মানুষের সঙ্গে মানুষের সহাবস্থান ছিল ঈর্ষনীয়। রাজনীতি-তাড়িত মানুষের মনের অন্তরে ধর্মভেদ-জাতিভেদ জন্ম নেয়। এক অপরিচিত মানুষের মিছিল দেখা যায়। এই গোঁজামিল চিন্তাক্রান্ত হয়ে মানুষ গণপ্রব্রজন করেছিল। প্রব্রজিতরা বিভাজনের ক্ষত, ‘রক্তাক্ত যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা’, আত্মগানি ভোগের শিকার। বংশ পরম্পরা গতভাবে আজও তা বহন করে চলেছে। প্রব্রজন আজও বন্ধ হয় নি। ঐতিহাসিকভাবে চরম সত্য। তবে, মুসলমানদের একটা বড়ো অংশ তো দেশত্যাগ করেন নি। সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কিছু সুবিধাবাদী মানুষও ছিল। যারা আপ্লুত হয়েছিল। কথক নারীর সন্তানেরা ওপারে এসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুসলমানদের নিজস্ব রাষ্ট্রের কথা ভেবে তারা আনন্দ চিত্তে গ্রহণ করেছে দেশভাগকে। তারা দেশান্তরি হয়েছে। ‘আগুনপাখি’নিসন্দেহে নির্মমভাবে গণপ্রব্রজনের ‘মহাকাব্যিক’ আখ্যান।

আর মহা প্রব্রজনের বিরুদ্ধ বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর আগুনপাখি নামিক এক নারী। এই নারী চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রচলিত প্রব্রজনের মিথকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। মেজ বউয়ের আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় ভীষণ প্রবল। তাই তো সে বলতে পারে, “সুরুজের আলোর দিকে চেয়ে আবার উঠে দাঁড়াব আমি। আমি একা” ২৮ “একা,” প্রকৃত অর্থে সে একা নয়,সবাইকে কাছে টেনে নিতে পারবে। এই আত্মবিশ্বাস যেন ‘অনিকেত হয়ে-যাওয়া মানুষের সামুহিক বাচনেরই’ প্রতিধ্বনি।২৯  এ শুধু এক মুসলমান নারীর আত্মকথন নয়—-   প্রব্রজনের বিপক্ষে সমগ্র বাঙালি নারীর আত্মদর্শন। প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ।

উপন্যাসটিতে কথাকার নিজের গ্রাম যব গ্রামের উপভাষা ব্যবহার করেছেন।যে ভাষাকে ছেড়ে গেছেন পঞ্চাশ বছর আগে—চেনা মাঠ ঘাট, চেনা মানুষজন ত্যাগ করে একসময় চলে গিয়েছিলেন লেখক। কিন্তু রয়ে গিয়েছিল তার মুখের ভাষা— নাড়ীর কথা। গ্রামীণ সেই কথ্য-রীতির সাহায্যে আটপৌরে নারীর প্রতিবাদী বাচনভঙ্গি রচনা করেছেন।প্রাবন্ধিক তপোধীর ভট্টাচার্য ‘আগুনপাখি’-র ভাষা নিয়ে সুচিন্তিত মত প্রকাশ করেছেন—- “এই বাস্তবের অভিব্যক্তি যে-ভাষায় ঘটবে, তা নিঃসন্দেহে প্রচলিত পণ্যলোভন উপন্যাসের ভাষায় সম্ভব নয়। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে প্রমিত বা মান্য ভাষার দাবি খাটবে না। বাস্তব থেকে উপাদান নিয়েই উপস্থাপিত কুশীলবদের জীবনযাপন ও অস্তিত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্বাভাবিক ভাষার আদলে নতুন শিল্পভাষার নির্মাণ অনিবার্য।”৩০ হাসান উপভাষা ও বাচনিক অভিজ্ঞতা থেকে এই উপন্যাসে এমন জীবন্ত ভাষা নির্মাণ করেছেন। “তা প্রমিত বা মান ভাষা কী না, এই নিয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না তাঁর। তিনি তাঁর বক্তব্যকে প্রত্যক্ষ , স্থায়ী ও শরীরী বাস্তবতায় নিহিত করতে চাইছিলেন।”৩১ লেখক তা চমৎকারভাবে করেছেন এই আখ্যানে। এই ভাষা ব্যবহারে বুঝিয়েছেন এপারের প্রতি ভালবাসা অটুট।এই মুখের ভাষাই চিনিয়ে দেয় তাঁর শেকড়।এ ভাষা ব্যবহারে আগুনপাখি চরিত্রটি বেশি তীক্ষ্ণ ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সে প্রশ্নবানে বিদ্ধ করে চারপাশকে। স্বতঃস্ফূর্ত সংলাপগুলোতে যেন যব গ্রামের সত্যিকারের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

আর মেজবউয়ের থেকে যাওয়াটা নতুন দেশ পাকিস্থান সৃষ্টির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। এভাবেই আটপৌরে মমতাময়ী মেজবউ হয়ে ওঠেন আগুনপাখি।

তথ্য সূত্র

১|অশ্রুকুমার সিকদার :ভাঙা বাংলা ও বাংলাসাহিত্য, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০০৫ ,পৃষ্ঠা-২৩ 

২|তদেব, পৃষ্ঠা-২১ 

৩|হাসান আজিজুল হক : দেশভাগের গল্প, ভূমিকা, মওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, ২০১১ 

৪|মতিউর রহমান : প্রথম আলো, ঢাকা, ২০১৮ 

৫l ছিন্নমূল মমানুষের কথাকার হাসান আজিজুল হক: মামনি মণ্ডল, পৃষ্ঠা-২৮৯,তবু একলব্য ৩৮,বাংলাদেশের কথাসাহিত্য, বিশেষ সংখ্যা, সম্পাদক-দীপঙ্কর মণ্ডল, ২০২০ 

৬|অশ্রুকুমার সিকদার : গদ্য সমগ্র (৪র্থখণ্ড),দীপ প্রকাশন, ২০১৯ , পৃষ্ঠা-৪৫৪

৭|হাসান আজিজুল হক : আগুনপাখি,দেজ পাবলিশিং ২০০৮, প্রথম প্রকাশ, ২০০৮ ,পৃষ্ঠা-৭ 

৮|তদেব, পৃষ্ঠা-১৭

৯|তদেব,পৃষ্ঠা-১০ 

১০|তদেব,পৃষ্ঠা-২১  

১১|তদেব, পৃষ্ঠা-২৮-২৯ 

১২|তদেব,পৃষ্ঠা-২৯ 

১৩|তদেব ,পৃষ্ঠা-১৩৩ 

১৪|তদেব, পৃষ্ঠা-১৫০ 

১৫|তদেব, পৃষ্ঠা-২৩২ 

১৬|তদেব, পৃষ্ঠা-২৩৮ 

১৭|তদেব, পৃষ্ঠা-২৪৪ 

১৮|তদেব, পৃষ্ঠা-২৪৯ 

১৯|তদেব, পৃষ্ঠা-২৪২

২০|তদেব, পৃষ্ঠা-২৪৩ 

২১|তদেব, পৃষ্ঠা-২৪৬ 

২২|তদেব, পৃষ্ঠা-২৪৬ 

২৩|তদেব, পৃষ্ঠা-২৫২ 

২৪|তপোধীর ভট্টাচার্য: কথাপরিসর বাংলাদেশ, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ২০১৭,পৃ-১৬৮ 

২৫|হাসান আজিজুল হক : আগুনপাখি, দে’জ পাবলিশিং ২০০৮,পৃ-২৩৯ 

২৬ |তদেব পৃষ্ঠা- ২৫১-২৫২ 

২৭|তপোধীর ভট্টাচার্য: কথাপরিসর বাংলাদেশ, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ২০১৭,পৃ-১৭৪ 

২৮|হাসান আজিজুল হক : আগুনপাখি,দে’জ পাবলিশিং,২০০৮,পৃ-২৫২

২৯|তপোধীর ভট্টাচার্য: কথাপরিসর বাংলাদেশ,বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ২০১৭,পৃ-১৬৫ ??

৩০|তদেব,পৃ-১৬৫ 

৩১।তদেব,পৃ-১৬৬ 

You may also like