প্রথম প্রকাশ ১৯৪৮। উপমহাদেশের ইতিহাসের নির্মম পরিহাস পাতায় পাতায়। আসে ফিরে ফিরে। লালসালুর মজিদ ঘরে ঘরে।
রাত্রে বিছানায় শুয়ে মজিদ গম্ভীর হয়ে থাকে। রহীমা গা টেপে, কিন্তু টেপে যেন আস্ত পাথর। অবশেষে মজিদকে সে প্রশ্ন করে,
আপনার কি হয়েছে?
মজিদ কিছু বলেনা।
উত্তরের জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করে রহিমা হঠাৎ বলে এক পীর সাহেব আইছেন না হেই গেরামে, তানি নাকি মরা মানুষ জিন্দা কইরা দেন?
পাথর এবার হঠাৎ নড়ে। আবছা অন্ধকারে মজিদের চোখ জ্বলে ওঠে। ক্ষণকাল নিরব থেকে হঠাৎ কটমট করে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে,
মরা মানুষ জিন্দা হয় ক্যামনে ?
… মজিদ ঘুমায় না। সে বুঝেছে ব্যাপারটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এবার কিছু একটা না করলে নয়। আজও অপরাহ্ণে সে দেখেছে মতিগঞ্জের সড়কটা দিয়ে দলে দলে লোক চলছে উত্তর দিকে।
মজিদ ভাবে আর ভাবে। রাত যত গভীর হয় তত আগুন হয়ে ওঠে মাথা। মানুষের নির্বোধ বোকামির জন্যে। আর তার অকৃতজ্ঞতার জন্যে একটা মারাত্মক ক্রোধ ও ঘৃণা উষ্ণ রক্তের মধ্যে টগবগ করতে থাকে। সেই ছটফট করে একটা নিষ্ফল ক্রোধে।
…. মজিদ যখন আওয়ালপুর গ্রামে পৌঁছালো তখন সূর্য হেলে পড়েছে। মতলুব মিঞার বাড়ির সামনেকার মাঠ লোকে -লোকারণ্য। তারই মধ্যে কোথায় যে পির সাহেব বসে আছেন বোঝা মুশকিল। মজিদ বেঁটে মানুষ। পায়ের আঙুলে দাঁড়িয়ে বকের মত গলা বাড়িয়ে পির সাহেবকে একবার দেখবার চেষ্টা করে। কিন্তু কালো মাথার সমুদ্রে দৃষ্টি কেবল ব্যাহত হয়ে ফিরে আসে।
…. মুখ তুলে রেখে সে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে লাগলো। সামনে শত শত লোক সব বিভোর হয়ে বসে আছে, কেউ কাউকে লক্ষ করবার কথা নয়। মজিদকে চেনে এমন লোক ভিড়ের মধ্যে অনেক আছে বটে কিন্তু তারা কেউ আজ তাকে চেনে না। যেন বিশাল সূর্যোদয় হয়েছে, আর সে আলোয় প্রদীপের আলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
পির সাহেব আজ দফায় দফায় ওয়াজ করছেন। যখন ওয়াজ শেষ করে তিনি বসে পড়েন তখন অনেকক্ষণ ধরে তাঁর বিশাল বপূ দ্রুত শ্বাসের তালে তালে ওঠা নামা করে, আর শুভ্র চওড়া কপালে জমে ওঠা বিন্দু-বিন্দু ঘাম খোলা মাঠের উজ্জ্বল আলোয় চকচক করে। এ সময় পির সাহেবের প্রধান মতলূব মিঞা হুজুরের গুনাগুন সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করে বলে।এ-কথা সর্বজনবিদিত যে, সে বলে, পির সাহেব সূর্যকে ধরে রাখবার ক্ষমতা রাখেন। উদাহরণ দিয়ে বলে হয়তো তিনি এমন এক জরু্রি কাজে আটকে আছেন যে ওধারে জহুরের নামাজের সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাহলে কী হবে, তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত না হুকুম দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সূর্য এক আঙুল নড়তে পারে না। শুনে কেউ আহা-আহা বলে, কারো বা আবার ডূকরে কান্না আসে। কেবল মজিদের চেহারা কঠিন হয়ে ওঠে।
আমি দোয়া দরুদ পড়তেছি তাহারে পাক দেবার কোন ডান দিক থেকে পাক দিবেন আগে ডান পা বাড়াইবেন বাড়ানোর আগে বিসমিল্লাহ কইবেন।
মজিদ কোণে বসে। একবার সামনে দিয়ে যখন আমেনা বিবি ঘুরে যায় তখন তার চোখ চকচক করে ওঠে আবছা অন্ধকারে। কালো রঙের পাড়ের তল থেকে আমেনা বিবির পা নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে। একবার ডান পা আরেকবা্র বাঁ। শব্দ হয় না। কাছাকাছি যখন আসে তখন মজিদের ভেতরে সাপের গলাটা সামান্য চমকে পেছনে যায়, যেন ছোবল দেবে। মজিদ একবার ঢোক গেলে, তারপর কণ্ঠের সুর আরো মিহি করে তোলে।
… মজিদ ভাবে এক কথা। যে-আমেনা বিবির পিরের পানি পড়া খাবার সখ হয়েছিল, সে-আমেনা বিবির ওপর– আকার-ইঙ্গিতে বা মুখের ভাবে প্রকাশ না করলেও– মজিদের মনে একটা নিষ্ঠুর রাগ দেখা দিয়েছিল। তবে একটা নিষ্ঠুর শাস্তিও সে স্থির করেছিল। আজ সন্ধ্যার আবছা অস্পষ্ট আলোয় আমিনা বিবির সাদা কোমল পা দেখে শাস্তি বিধানের সে-প্রবল বিন্দুমাত্র প্রশমিত না হয়ে বরঞ্চ আরো নিষ্ঠুরতমভাবে শাণিত হয়ে উঠেছিল।
কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে অসময়ে আমেনা বিবির মূর্ছা যাওয়া সমস্ত কিছু যেন গোলমাল করে দিল। মুঠোর মধ্যে এসেও সে যেন ফস্কে গেল, যে-মজিদের ক্ষমতাকে সে এতদিন উপেক্ষা করেছে তার প্রতি আজও অবজ্ঞা দেখাল, তাকে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করতে সুযোগ দিয়েও দিল না…
তাই ক্যান তানি অজ্ঞান হয়েছেন?
আপননে তানার স্বামী– ক্যামনে মনে কই মুখের উপরে?
… মজিদের হাত তখনো ব্যাপারী ছাড়েনি। সে হাতে একটা টান দিয়ে ব্যপারী অধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করলে,
আপনে কী কিছু সন্দেহ করেন?
সন্দেহের কোন কথা নাই। পানিপড়াডা খাইয়া তানি যখন সাত পাক দিবার পারলেন না, মূর্ছা গেলেন তখন তাতে সন্দেহের আর কোন কথা নাই। খোদার কালামের সাহায্যে যে কথা জানা যায় তা সূর্যের রোশনাইয়ের মতো সাফ। আর বেশি আমি কিছু কমু না। তানারে তালাক দেন।
না, মজিদের কথাই ভুল নেই। সহসা খালেক ব্যপারী মনস্থির করে ফেলে।
এবং এর তিনদিন পর যে-আমেনা বিবি হঠাৎ সন্তান কামনায় অধীর হয়ে উঠেছিল সে-ই সমস্ত কামনা-বাসনা বিবর্জিত একটা স্তব্ধ আহত মন নিয়ে সে-দিনের পাল্কিতে চড়ে বাপের বাড়ি রওয়ানা হয়। বহুদিন বাপের বাড়ি যায়নি। তবু সেখানে যাচ্ছে বলে মনে কিছু আনন্দ নেই। পাল্কির ক্ষুদ্র সংকীর্ণতায় চোখ মেলে নাক বরাবর তাকিয়ে থাকে বটে কিন্তু তাতেও অশ্রু দেখা দেয় না।
তবে পথে একটা জিনিস দেখলে হয়তো হঠাৎ তার বুক ভাসিয়ে কান্না আসতো। সেটা হল থোতামুখো তালগাছটা। বহুদিনের গাছ, ঝড়ে পানিতে আরো লোহা হয়ে উঠেছে যেন। প্রথম যৌবনে নাইয়র থেকে ফিরবার সময় পাল্কির ফাঁক দিয়ে এ-গাছটা দেখেই সে বুঝত যে, স্বামীর বাড়ি পৌঁছেছে। ওটা ছিল নিশানা আনন্দের আর সুখের।
অবশ্য দু’বছর তিন বছর অন্তর মাজারের গাত্রাবরণ বদলানো হয়, এবং বদলাবার খরচ বহন করে খালেক ব্যাপারীই। খরচ করে তার আফসোস হয় না। বরঞ্চ সুযোগটা পেয়ে নিজেকে শতবার ধন্য মনে করে। এদিকে মুজিবও লাভবান হয়, কারণ পুরানো গাত্রাবরণটি কেনবার জন্যে এ-গ্রামে অনেক প্রার্থী গজে ওঠে, এবং প্রার্থীদের মধ্যে উপযুক্ততা বিচার করে দেখতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সে বেশ চড়া দামে বিক্রি করে সেটা। কাজেই ঝালরটার কোন খানে যদি রং চটে যায়, বা সালু- কাপড়ের কোন স্থানে ফাট ধরে তবে মজিদের চিন্তা করার কারণ নেই। কিন্তু তবু জিনিসটার প্রতি কী যে মায়া– তার সামান্য ক্ষতি নজরে পড়লেও বুকটা কেমন কেমন করে ওঠে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মজিদের সামনেই রহিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমিনা বিবির জন্যে সারাদিন আজ মনটা ভারী হয়ে আছে। একটা প্রশ্ন কেবল ঘুরে ফিরে মনে আসে। কেউ যদি হঠাৎ কিছু অন্যায় করে ফেলেও, তার কী ক্ষমা নেই? কী অন্যায়ের জন্যে আমেনা বিবির এত বড় শাস্তিটা হল তা অবশ্য জানে না, তবু সে ভাবতে পারেনা আমেনা বিবি কিছু গর্হিত কাজ করতে পারে। আবার করেনি এ-কথাও বা ভাবে কী করে? কারণ খোদাই তো জানিয়ে দিয়েছেন মানুষকে সে অন্যায়ের কথা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে রহিমা বিড়বিড় করে বলে, — তুমি এত দয়ালু খোদা, তবু তুমি কী কঠিন।
সে বিড়বিড় করে আর আওয়াজটা এমন শোনায় যেন মাজারের সালু-কাপড়টা ছেঁড়ে ফড়ফড় করে। মুহূর্তের জন্যে চমকে ওঠে মজিদ। মন তার ভারী। রূপালি ঝালরের বিবর্ণ অংশটা কালো করে রেখেছে সে-মন।