নিপীড়নের বহুমাত্রিক রুপ

by Abu Siddik

আলতাফ কেন জেলে বন্দি
সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়
উদার আকাশ
৯৬ পাতা
মূল্য ১৩০ টাকা

লেখক ও সমাজকর্মী সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলতাফ কেন জেলে বন্দি মোট ৯৬ পাতা ৩২ টি ছোট ছোট গল্প নিয়ে রচিত। বিষয়গুলি খুবই সাধারণ এবং আমাদের অত্যাধুনিক যুগের হুবুহু ফল হাতে হাতে। সব গল্পেতেই মানুষ মানুষের প্রতি দুর্ব্যবহার, অন্যায়, অপরাধ, অত্যাচার, নিপীড়ন, উন্নাসিক মানসিকতা– এরকম অনেক ছোট ছোট কিন্তু ভয়ংকর ত্রুটিগুলো লেখক স্বল্প পরিসরে ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। লেখক আশা করেছেন এই গল্পগুলো পড়ে আমাদের হয়তবা কিছুটা আরো মানবিক হতে সাহায্য করবে।

গল্পগুলোর কয়েকটি শিরোনাম তুলে ধরলেই বোঝা যাবে গল্পকার কী বলতে চাইছেন। আলতাফ কেন জেলে বন্দি, সব জেল বন্দিই কি অপরাধী! কারাগারের ভিতরে, এনকাউন্টারে হত্যা, উন্নত দেশে কারাগার ও বিচার ব্যবস্থা, করোনা গেলেও মানসিক উন্নতি হবে কি?, গণপ্রহারের কেন এই প্রবণতা?, প্রতিবাদী এবং সংগ্রামী যুবক ‘ভানু’, প্রহসনের এই সমাজ, শহরে বাবুদের তাচ্ছিল্য, মানুষ নিয়ে বাঁদর খেলা, বাইরে এক, ভেতরে আরেক ইত্যাদি গল্পগুলো আমাদের সমাজের নানা অমানবিকতার ও কদর্যতার দিকগুলো তুলে ধরেছে।

‘আলতাফ কেন জেলে বন্দি’ গল্পের শেষে লেখক আক্ষেপ করে বলেছেন, আর অভাগা আলতাফের মত অবিচারের বলি শুধু বাংলাতেই নয় বহু দেশের বহু জায়গাতেই হয়। যারা আইন আদালত এর বিশদ খবর রাখেন না তারা বলেন বিনা দোষে একটা মানুষ কিভাবে জেলে থাকবে। কিন্তু আলতাফের ঘটনাটি প্রমাণ করে যে তাদের এই ধারণা ভুল।

‘সব জেলবন্দি কি অপরাধী?’- এখানে লেখক শুরু করেছেন এভাবে, সংবাদপত্র খুললেই মাঝে মাঝেই দীর্ঘদিন জেলে বন্দি থাকার খবর চোখে পড়ে। অনেকেরই ধারণা যে একজন কিশোর, যুবক অথবা বয়স্ক মানুষ অনেকদিন জেলে বন্দি ছিলেন মানেই তিনি নিশ্চয়ই কোন না কোন অপরাধ করেছিলেন। না হলে পুলিশ কেন শুধু শুধু তাকে ধরে জেলে ভরবে? সমাজের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের আইন, মামলা বা কারাগার ইত্যাদি নিয়ে খুব গভীর ধারণা থাকে না। কিন্তু খবরের কাগজের নানা ঘটনা প্রমাণ করে যে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে ছিল মানেই সে অপরাধ করেছে এই ধারণা ঠিক নয়।

অনেক ছোট ছেলে এবং বয়স্ক মানুষকে পাগল সাজিয়ে পাগলা গারদে ভরে দেয়া হয়। পাগলা গারদে পাঠানো হতভাগ্য মানুষটি সম্পর্কে লোকে বলে নিশ্চয়ই ওর মাথায় কোন গন্ডগোল আছে নয়তো কেন তাকে পাগলা গারদে দেয়া হবে? এইসব ঘটনাগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দলের কোন সম্পর্ক নেই। শাসন যন্ত্রের মাথায় একদল আসে, আর একদল চলে যায় কিন্তু এই মর্মান্তিক এসব কর্মধারা চলতেই থাকে। অভাগাদের চোখের জলে জেলখানার মাটি ভিজে যায়।

কারাগারের ভিতরে অনেকেই দীর্ঘদিন বিনা অপরাধে জীবনের অনেক সময় কাটিয়ে কোনো শুনানি না হয়ে অবশেষে বেকসুর খালাস পায়। এরকম ঘটনা আমরা মিডিয়ায় হামেশাই দেখিl লেখকের দুঃখ যে, আমরা মহার্ঘভাতা, বোনাস, ইলেকট্রিসিটি ইত্যাদির দাবিতে লড়ার জন্য বহু সংগ্রামী মানুষকে দেখতে পাই, কিন্তু কারাগারে আবদ্ধ, মুক্ত পৃথিবীর সবথেকে বঞ্চিত মানুষদের যন্ত্রণা কজন অনুভব করেন?

উন্নত দেশগুলোর কারাগার ও বিচার ব্যবস্থার কথা উঠলে, তিনি লিখেছেন, অনেকেই বোঝাতে চান শুধু এ দেশেই বিভিন্ন কারাগারের অবস্থা খারাপ। কিন্তু তা নয়। সমগ্র বিশ্বের বহু উন্নত দেশেই অবস্থা অত্যন্ত খারাপ এবং অমানবিক। অনেক দূরের ইউরোপ, আমেরিকার কোন দেশে যেতে হবে না একেবারে ঘরের কাছে পূর্ব এশিয়ার কিছু উন্নত দেশের ছবি দেখলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। চীন, কোরিয়া বা জাপান ইত্যাদি দেশগুলো যতই উন্নত তথা আধুনিক হোক না কেন, মানবিকতার দাবি রাখতে পারেনা। দীর্ঘ শত্রুতা তথা অব্যবস্থায় ভোগে যারা জেলে কষ্ট পান দেশের প্রশাসন তথা শাসন ব্যবস্থা তাদের হাতে নয়। যারা ওই দেশের কর্তা তারা মুক্ত পৃথিবীর মানুষ। একজন জেল বন্দির জ্বালা তারা অনুভব করতে পারেন না। দেশের অর্থনীতি, বিদেশ নীতি, শিল্প ও শিক্ষা নিয়ে বড় বড় ভাষণ দিলেও জেলে বছরের পর বছর যারা পচছে, তাদের ব্যাপারে কোন চিন্তা নেই।

লেখক বেশ কিছু গল্পে আরো বলেছেন যে বাংলার সমাজের একটা অতীব খারাপ বৈশিষ্ট্য হলো যে পাগল বা মানসিক রোগী ও জনবলের দিক থেকে কমজোর মানুষকে কষ্ট দিয়ে আমাদের আনন্দ পাওয়া। এতে লাভ কিছুই হয় না। তবু মানুষ এটা করে তৃপ্তি পায়। এইভাবে আনন্দ চরম অপরাধের। তবুও মানুষ এটা করে। মজার ব্যাপার, তারা সবাই সামাজিক মানুষ। কেউ সমাজবিরোধী নয়। এসব ঘটনা পীড়াদায়ক।
.
অফিসে সহকর্মীদের অত্যাচার করা, বা একজনকে টার্গেট করে তাকে দিনের পর দিন নির্যাতন করা, এ বিষয়য়েই তিনি দুটি গল্প আমাদের উপহার দিয়েছেন।

এরপর তিনি গণপ্রহারের ব্যাপার নিয়েও কিছু গল্প লিখেছেন। এবং তার প্রস্তাব যে একজনকে মানুষকে সন্দেহের বসে দোষী বা অপরাধী ধরে নিয়ে বহু জন মিলে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা উত্তর ভারতে হামেশাই ঘটছে। এককথায় মব লিঞ্চিং। এবং এর জন্য কেউ কোনো শাস্তি পাচ্ছে না। পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। ভারতবর্ষের মতো উদার ও সহনশীল দেশে যা অকল্পনীয়।

তাঁর কিছু গল্পে আর একটি সমস্যার কথা উঠে এসেছে সেটা হচ্ছে লকডাউন এবং এর সাথে মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব। অনেকেই লকডাউনের সময় চার দেয়ালের মধ্যে বদ্ধ থেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছেন। এবং ডাক্তার তাদেরকে পরামর্শ দিয়েছেন, রোগীকে একটু একটু বাইরে বেরোতে, দরকারে কেউ সঙ্গে থাকতে পারে এবং রোগীর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে। লকডাউনের পরিস্থিতিতে অনেকেরই এই অসুবিধা হয়েছে এবং তাতে মানসিক স্বাস্থ্যের অনেক অবনতি ঘটেছে।

‘কেন এ প্রহসন’ গল্পে তিনি ট্রেন ভ্রমণের কিছু মেনে নেওয়া সাধারণ অন্যায়কে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। যাকে এক কথায় আমরা বলি ডেলি প্যাসেঞ্জারের দাদাগিরিl এ দৃশ্য আমাদের শিয়ালদা কৃষ্ণনগর রানাঘাট লোকালে হামেশাই হয়ে থাকে l কামরার পর কামরা গুটি সাজিয়ে রাখা, গামছা পেতে রাখা, তাস বিছিয়ে রাখা হয়। মানুষ থরে থরে দাঁড়িয়ে। তবে কেউ বসতে পারবে না। তাদের সেই সাহস কোথায়? দাদারা আসবেন, বসবেন ও ইচ্ছে হলে বসাবেন, না হলে নেই।

‘বাইরে এক ভেতরে আরেক’ গল্পটির তাৎপর্যবাহী। এখানে যারা শ্রেণী সংগ্রামে বিশ্বাস করেন সেই শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যে একই রকম ফাটল দেখা যায়। দুজনেই সর্বহারার দলে। কিন্তু পেশাগত বা বস্তুগত অবস্থান অনুযায়ী তাদের দুজনের মধ্যে ফারাক বিস্তর। আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বড়লোকদের শোষণ গরিবদের প্রতি, ইত্যাদি কথা বলি। কিন্তু দুজন গরিব সুযোগ পেলে এক অপরকে শাসন ও শোষণ করে। তার উদাহরণ কিন্তু ‘আমরা বাইরে, এক ভেতরে আরেক’ গল্পটি।

এছাড়াও বিভিন্ন গল্পে তিনি শহরের বাবুদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ব্যাপারের মতো সামাজিক ব্যাধিগুলোকে তুলে ধরেছেন। শিক্ষকতার সাথে যুক্ত মানুষদের নৈতিক অধঃপতনের করুণ কাহিনী তুলে ধরেছেন। শিক্ষাদানের পেশায় এরা কতটা উপযুক্ত? শিক্ষকদের হওয়া উচিত উন্নত চরিত্রের অধিকারী। কারণ শিক্ষাদানের পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের চরিত্র গঠনের কাজটাও তাদেরই। কিন্তু ইদানিং কিছু কিছু শিক্ষক শিক্ষিকার ধারণা অভ্যাস ও রুচিবোধ দেখে প্রশ্ন জাগে। ছাত্র-ছাত্রীদের চরিত্র গঠনের কাজে এরা কতটা সহায়ক। এবং সেই সঙ্গে তিনি কিছু ছবি তুলে ধরেছেন যা নেতিবাচক কিন্তু সত্য। শিক্ষকদের একাংশ শিক্ষা এবং সমাজের কল্যাণের কথা বাদ দিয়ে আর সব ধরনের আলোচনা ও কাজকর্ম যেমন নিজেদের ভোগ বিলাস ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।

সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি বাস, তবু কেন উদাসীন গল্প গ্রন্থের মতো আলতাফ কেন জেলে বন্দি একইভাবে সমাজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবিচারের চিত্র তুলে ধরেছেন যেগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মানুষ হিসাবে আমাদের পতন কত গভীর। এবং সব ধরনের অন্যায় অবিচার আমাদের সমাজে বিদ্যমান। খুব ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে ছোট ছোট চরিত্র এঁকে, বিভিন্ন ছবির মাধ্যমে তিনি আমাদের একটি বার্তা দিয়েছেন- মানবিক হওয়ার।

অনেকেই অন্যায়গুলো করছে এবং আমরা তা হাসিমুখে মেনে নিয়েছি। সেই ছোট ছোট অন্যায় গুলোর বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেছেন এবং আমাদের মানসিক বিকারের হাত থেকে উদ্ধার করার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস তিনি করে চলেছেন।

বইয়ের বিষয়কে মাথায় রেখে আমরা একবার দেখে নিতে পারে ভারতে বেশিরভাগ জেলবন্দি কারা এবং কেন। ২০২১ সালে পার্লামেন্টে পেশ করা এক রিপোর্ট অনুসারে ভারতে মোট ৪৭৮৬০০ জেলবন্দির মধ্যে, ৩১৫৪০৯ অর্থাৎ ৬৫.৯০% হলো এস সি, এস টি ও ওবিসি মানুষজন । যেখানে এরা সব সরকারি মানদণ্ডের নিরিখে নিম্নের স্তরে অবস্থান করে, সেখানে এঁদের অপরাধীর সংখ্যা এত বেশি হয় কীভাবে? প্রশ্ন জাগে। এঁরা কি সবাই সত্যিই অপরাধী। না, অপরাধী সাজিয়ে এঁদেরকে বছরের পর বছর ধরে জেলে পচানো হয়?

পাঠকের মন ও মান যদি কিছুটা হলেও উন্নত হয় এবং তার ভেতরের কালিমা গুলি অল্প হলেও মুছে যায় , রাষ্ট্র যদি জেলবন্দিদের দ্রুত শুনানির ব্যাপারে সদর্থক পদক্ষেপ নেয়, জেলবন্দিদের দুর্দশা সম্পর্কে যদি বলিষ্ঠ জনমত তৈরি হয়, তাহলে লেখকের এই প্রয়াস আরও বেশি সার্থক হবে বলে আমি মনে করি।

You may also like

Vinnokatha
Prothom Khondo
Price: Rs.260/-
www.vinnokatha.in
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে। সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে।সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
Vinnokatha
Prothom Khondo