শহীদ ক্ষুদিরাম

ক্ষুদিরাম
সোনালী দত্ত
র‍্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন (২০১৯)
১১২ পাতা
হার্ডকভার
বিনিময় ১২৫/-

দেশপ্রেম বলতে আমরা বুঝি দেশের প্রতি গভীর, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা যা কোন পরিস্থিতিতেই আমাদেরকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে দেয় না। যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দেশকে রক্ষা করায় প্রত্যেক ভারতবাসীর মহান ও পবিত্র কর্তব্য। আমাদের অতীতের গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস সেই কথায় বারবার স্মরণ করায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আজকের পুঁজিবাদী, ভোগবাদী পৃথিবীতে, প্রতিযোগিতামূলক দৈনন্দিন জীবনে আমরা আমাদের সমৃদ্ধশালী ঐতিহ্য ও অতীতকে ভুলতে বসেছি। দেশ লুট হচ্ছে। জনগণ ঘুমিয়ে আছে। দেশপ্রেম এবং শহীদদের কথা এখন অবান্তর হয়ে পড়েছে। এমন সংকটময় সময়ে ক্ষুদিরামের জীবনী আবার আর একবার পড়ে মনের ভার কিছুটা লাঘব হলো। স্বপ্নের মৃত্যু মানে জীবনের মৃত্যু।

সোনালী দত্তের লেখা ক্ষুদিরাম গ্রন্থ থেকে আমরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মবলিদানের গৌরব গাঁথা রচনা করা এক সর্বকনিষ্ঠ সশস্ত্র সংগ্রামী, বেপরোয়া বালকের কথা জানতে পারি। তিনি হলেন ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করার জন্য মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে জীবনের জয়গান গাওয়া এক অসীম সাহসী প্রতিবাদী বালক ক্ষুদিরাম। তিনিই প্রথম বাঙালি বিপ্লবী যাকে ব্রিটিশ সরকার ফাঁসি দিয়েছিল। সারা বিশ্বব্যাপী একসময় গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশদের উপনিবেশিক সাম্রাজ্য। যাদের সাম্রাজ্যে নাকি কখনো সূর্য অস্ত যেত না। সেই সাম্রাজ্যের ভিতকে কেমন কাঁপিয়ে দিয়েছিল এই কিশোর। ইংরেজদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তাইতো তাঁকে ফাঁসি কাঠে ঝুলিয়ে সেই ঘুমকে নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা এটা উপলব্ধি করতে পারেনি ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান ভারতের ঘরে ঘরে জন্ম দেবে সহস্র বিপ্লবীর।

লেখক খুব সুন্দরভাবে এক সাহসী বালকের স্বল্পায়ু জীবনের হৃদয়বিদারী, মর্মস্পর্শী সংগ্রামের জীবন্ত কাহিনী তুলে ধরেছেন যা তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। ক্ষুদিরাম এক বেপরোয়া বালকের নাম, যার কাছে যুক্তি-তর্কের চেয়ে হৃদয়ের আবেদন অনেক বড়। মেদিনীপুর শহরের হাবিবপুরে ত্রৈলোক্যনাথ বসু ও লক্ষীপ্রিয়া দেবীর ঘর আলো করে তিন কন্যা সন্তানের পর জন্ম নিয়েছিল অগ্নিযুগের বীর সন্তান ক্ষুদিরাম। কোন পুত্র সন্তান বাঁচত না বলে প্রচলিত রীতি বা বিশ্বাস অনুযায়ী তিন মুঠো খুদ দিয়ে তাঁকে কিনেছিলেন তাঁর বড়দিদি অপরূপা দেবী। তাই তিনি সবার প্রিয় ক্ষুদিরাম‌। অতি সাধারণ একটা নাম যে অসাধারণ হয়ে উঠবে, আসমুদ্র -হিমাচল সে নাম মন্ত্রের মত ছড়িয়ে পড়বে কেউ সেদিন কল্পনাও করতে পারেনি। অপরূপা দেবীর সেদিন মনে হয়েছিল তাঁরা তিন বোন আগে জন্মেছেন ঠিকই আবার যেন ঠিক জন্মাননি। এইবার জন্ম একটা হল বটে।

ক্ষুদিরাম ছোট থেকেই ছিলেন খুব দুরন্ত বেপরোয়া একগুঁয়ে ও অসীম সাহসী আর পাঁচটা সাধারণ ছেলের মতন না। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস মাত্র ছয় বছর বয়সেই সে মাকে হারান। বাবাও কিছুদিনের মধ্যেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। বাবা-মা হারানোর ব্যথা বোঝার আগেই সে অনাথে পরিণত হয়। ছোট দিদির বিয়ে আর বাবার ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে বসত ভিটে বিক্রি করতে হয়। অবশেষে তাঁর ঠাঁই হয় দিদি অপরূপা দেবীর বাড়িতে। দিদিই তাঁর সব, দিদির মাঝে ক্ষুদিরাম মাকে খুঁজে পেত। দিদির কোলে মাথা রেখে ভুলে যেত সব কষ্ট। আর ছিল ভাগ্নে ললিত তার সুখ – দুঃখের সাথী।

ক্ষুদিরামের প্রাথমিক শিক্ষা গ্রাম্য বিদ্যালয়ে সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে তমলুকের হ্যামিলটন স্কুলে ভর্তি হন। তারপর মেদনীপুরের কলেজিয়েট স্কুল। পড়াশোনাতে তার মন বসত না কোনদিনই। পড়াশুনোর চেয়ে দুষ্টুমি ও দস্যিপনা করতেই বেশি পছন্দ করতেন ‌। মন সব সময় ঘুরে বেড়াত মাঠে-ঘাটে বনে বাদাড়ে। ঝাঁপ দিয়ে নদীতে পুকুরে সাঁতার কাটতে, ঢিল মেরে পাখির বাসা ভাঙতে, ছাদ থেকে কখনো বা গাছ থেকে লাফ দিতে। পাড়া পড়শিরা তাঁর দুষ্টুমিতে অস্থির হয়ে নালিশ করত অপরূপা দেবীর কাছে। তবে ক্ষুদিরাম ছিলেন ভীষণ দয়ালু প্রকৃতির অন্যের দুঃখ কষ্ট বা অন্যায় দেখলে সহ্য করতে পারতেন না। একবার স্কুল গেটের সামনে এক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে একটা ছোট্ট ছেলে খাবার কেনার পর ফাও চেয়েছিল। ফেরিওয়ালা ছেলেটিকে গালাগালি করতে থাকে। ক্ষুদিরাম সহ্য করতে না পেরে পিটিয়ে দিয়েছিল লোকটাকে। তমলুক শহরে একবার কলেরা মহামারীর আকার ধারণ করে। জীবনের পরোয়া না করে ক্ষুদিরাম ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রোগীদের সেবাসুশ্রূষায়। দেশ মানে মা। আর মা মানে দেশের মানুষ।

আর একদিন ফনিভূষণ দেশি মিলের মোটা কাপড় পরে স্কুলে এসেছিল। সকলে তাকে খুব খেপাচ্ছিল। ক্ষুদিরাম সকলকে ধমকে চুপ করিয়েছিলেন। পরে ফনিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তুই বিলিতি কাপড় ছেড়ে মোটা কাপড় পরলি কেন? উত্তরে ফনি বলেছিল আচ্ছা খুদে তোকে যদি তোর দিদির বদলে একটা গাউন পরা মেম সাহেব দিদি দিই তুই নিবি? কখন ও না। ফনি হাসে। মোটা কাপড় খারাপ মানের, দেখতে বাজে তবুও সেটা আমার দেশের।কথাটি ক্ষুদিরামের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। একবার জনার্দনপুর কাসাই নদীর বন্যায় ভেসে গিয়েছিল। গৃহহারা অসহায় মানুষজন খোলা আকাশের নীচে। দুঃখে কেঁদে উঠেছিল ক্ষুদিরামের মন। দিনরাত এক করে শহরে ঘুরে ঘুরে হাত পেতে জোগাড় করেছিলেন টাকা পয়সা জামা কাপড়। নিজের হাতে দুর্গতদের জন্য বেঁধে দিয়েছিলেন অস্থায়ী চালাঘর‌। এক শীতের সকালে এক ভিক্ষুক তাঁর বাড়িতে এসে হাজির। প্রচন্ড ঠান্ডায় কাঁপছে। তাকে দেখে বড্ড মায়া হল ক্ষুদিরামের। একমাত্র সম্বল পিতার শেষ স্মৃতি বিজড়িত একটি দামি শাল। তুলে দিলেন ভিক্ষুকের হাতে। তার মন ছিল সংবেদনশীল, মানুষের জন্য ভালোবাসায় ভরা, মানুষের দুঃখ কষ্ট বেদনা তাঁর কচি মনকে নাড়া দিত বারবার ‌। তার এমন বিভিন্ন মহান কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে বোঝা যায় তিনি আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা।

মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাজনারায়ণ বসু ও তাঁর ভাইপো জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু ছাত্রদের দেশপ্রেমের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করতেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কদর্য রূপ তুলে ধরতেন। খুব তাড়াতাড়ি ক্ষুদিরাম জ্ঞানেন্দ্রনাথের পরমপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ক্ষুদিরামকে চিনতে ভুল করেননি, বুঝেছিলেন স্ফুলিঙ্গ থেকে হয়ে উঠতে পারে অগ্নিশিখা। ক্ষুদিরামের ভেতরের সুপ্ত দেশপ্রেমকে তিনি জাগিয়ে তুলেছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ভারতবর্ষ তখন উত্তাল। বাংলার বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠছে গুপ্ত সমিতি। মেদিনীপুরে গুপ্ত সমিতির দায়িত্ব ছিল জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু, তাঁর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং হেমচন্দ্র কানুনগোর উপর। গুপ্ত সমিতিতে কুস্তি ছোরা চালানো, লাঠি খেলা শেখানো হতো। বিপ্লবী মন্ত্র প্রচার করে বেড়াতেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। জ্ঞানেন্দ্র নাথ বসু ক্ষুদিরাম কে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কাছে নিয়ে এসেছিলেন। এক ঝলক দেখে চিনেছিলেন। কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন দেশমাতার তোমার মত বীর সন্তানের প্রয়োজন। তিনি ছিলেন ক্ষুদিরামের দীক্ষাগুরু। তার নির্দেশে ক্ষুদিরাম ‘সোনার বাংলা’ শীর্ষক বিপ্লবাত্মক ইশতেহার বিলি করে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

অল্প দিনের মধ্যেই তিনি লাঠি খেলা কুস্তি অস্ত্র চালনা এমনকি বন্দুক রিভলবার চালানোর শিক্ষাও নিয়েছিলেন। অত্যাচারী ব্রিটিশ তাড়াতে আমাদের শক্তি চাই, সাহস চাই, লড়াই করতে জানা চাই, আর চাই মনোবল, বুঝেছিলেন তিনি। কোনোটার অভাব ছিল না তাঁর মধ্যে ।দেশের কাজে নিবেদিত প্রাণ। স্বদেশী জিনিস বিক্রি, কাগজপত্র বিলি করা, পিকেটিং সভা মিটিং মিছিল খবরা-খবর পৌঁছে দেয়া, সব কাজে সিদ্ধহস্ত। পরিবারের সাথে চূড়ান্ত বিরোধ। দিদি তাঁকে ঘরে ফেরানোর জন্য বিয়ের ব্যবস্থা করেন। ক্ষুদিরাম বলেছিলেন ওটা এখন থাক দিদি।

গুপ্ত সমিতির জন্য টাকার প্রয়োজন। ক্ষুদিরাম পিয়নের কাজ থেকে মেলব্যাগ কেড়ে নিয়ে দৌড় দেয়। এই ঘটনার পর দিদির বাড়ি থাকা বন্ধ হয়ে যায়। আশ্রয় নেন সত্যেনদার তাঁতশালায়। সামনে তাঁত বোনা হয় কিন্তু পিছনে চলে বিপ্লবী কাজকর্ম। সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও ক্ষুদিরাম এর মধ্যে ছিল গুরু- শিষ্যের সম্পর্ক‌। স্বদেশীদের উপর যখন ডগলাস কিংসফোর্ডের অত্যাচার বেড়েই চলেছে। তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই মহান দায়িত্ব প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরামের উপর দেওয়া হয়। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মন অতিরিক্ত স্নেহপরায়ণ হয়ে ওঠে। তিনি হেমদাকে বলেছিলেন কিশোর বয়সের একটা ছেলেকে এ কাজে লাগালে কেন? জীবনের কতটুকু দেখেছে ও?

ক্ষুদিরাম তিল তিল করে নিজেকে গড়ে তুলেছিল যে কাজের জন্য সেই শুভক্ষণ উপস্থিত হল। অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যার দায়িত্ব নিয়ে দুই বিপ্লবী রওনা হলেন মজ:ফরপুরের দিকে। দিদির কাছ থেকে বিদায় নিলেন। ললিতকে জড়িয়ে ধরলেন। ভাগ্য যে ক্ষুদিরামের জন্য অন্য কিছু লিখে রেখেছে। সে যে আর ফিরে আসবেনা। আর দেখা হবে না। বিদায় এর আগে দিদিকে দূর থেকে দেখেছেন। জীবনের চরম সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ঐ মহিলার দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে মা থাকলে ঠিক দিদির মতই হতো। ঘেমে নেয়ে যতবার দিদি আঁচল দিয়ে কপাল মুছেছে ততবার মনে হয়েছে ছুটে গিয়ে ওই আঁচলে মুখ লুকায়। আমাকে বেঁধে রাখো, যেতে দিও না দিদি। ধীরে ধীরে ঐ আঁচল তাঁর কাছে ভারতবর্ষ হয়ে গেছে।

৩০শে এপ্রিল রাত সাড়ে আটটা নাগাদ ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনে কিংসফোর্ডের গাড়ি ভেবে বোমা ছোঁড়া হয়। তারপর দুজন দুদিকে দৌড়াতে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য সে গাড়িটিতে ছিল মিসেস ও মিস কেনেডি। দুজন মহিলার মৃত্যু হয়। প্রফুল্ল চাকী গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই আত্মহত্যা করেন। ক্ষুদিরাম ‘ওয়াইনি’ স্টেশনে জল খেতে গিয়ে ধরা পড়েন। চলে শারীরিক নির্যাতন। তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি বুঝতে পারেন। এমন পরিস্থিতিতে বিপ্লবী দলের প্রতি কতটা আনুগত্য থাকলে, দেশের প্রতি আবেগ দৃঢ় প্রত্যয় ভালোবাসা কতটা গভীর থাকলে তবেই বিপ্লবী দলের কোন গোপন খবর ফাঁস না করে অপর সঙ্গী প্রফুল্ল চাকী কে নির্দোষ প্রমাণিত করে সব দায় নিজের কাঁধে নেওয়া যায়। উডম্যান তাঁকে জেরা করে। সে ভয় পায় না। বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা, বঙ্কিমের আনন্দমঠ ইত্যাদির কথা ভাবতে থাকে। তাঁর মনে হয় পড়া যতটা সহজ করা ততটা নয়। অতীতের সব স্মৃতি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নরম হলে চলবে না। এ লড়াই তাঁকে একাই লড়তে হবে। উডম্যান ভাবছিলেন তার দেশের এই বয়সী ছেলেরা ঠিক কেমন জীবন কাটায়। কোথায় স্কুলে যাবে, একটু-আধটু ধূমপান করবে, গার্লফ্রেন্ড হবে, ক্লাবে গিয়ে ফুটবল পিটাবে তা নয় বন্দুক পকেটে নিয়ে বোমা ছুঁড়তে বেরিয়েছে।

ক্ষুদিরামের বিচার শুরু হয়। বিচারে তাঁর ফাঁসির রায় দেন বিচারক। ক্ষুদিরাম কে অবিচল ও নির্বিকার দেখে বিচারক বলেছিলেন –ফাঁসিতে মরতে হবে সেটা বুঝেছ? মৃত্যুকে যে জীবনের সাথে মিলিয়ে নিয়েছে তাঁর কাছে মৃত্যু আর জীবনের মাঝে কোন বিভেদ নেই ‌। মৃত্যুকে যে কত সহজে বরণ করা যায় তা শিখিয়েছেন ক্ষুদিরাম। ক্ষুদিরামের দেশপ্রেম সাহস তেজ আত্মমর্যাদাবোধ সেদিন গোটা দেশের যুবশক্তিকে এক ধাক্কায় জাগিয়ে তুলেছিল।

১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট। ভারতবাসীর কাছে এক সীমাহীন বেদনার ভোর। ১৮ বছরের তরতাজা যুবক বীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছেন ফাঁসির মঞ্চের দিকে। যেন প্রহরীরা ওঁকে নিয়ে আসছে না ক্ষুদিরাম নিজেই তাদের টেনে আনছেন। আজ তাঁর মনে কোন ভার নেই। শরীর মন জুড়ে রয়েছে তাঁর দেশ, মাতৃভূমি। যা হবার তাড়াতাড়ি হোক, বিলম্ব আর সয় না যে।

ক্ষুদিরামের কাছে শেষ ইচ্ছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন–তিনি বোমা বানাতে জানেন। ব্রিটিশদের অনুমতি পেলে তিনি এই বিদ্যা ভারতবাসীদের শিখিয়ে যেতে চান। সত্যি কি অসীম সাহস থাকলে মৃত্যু মুখে দাঁড়িয়েও দেশের কথা এভাবে ভাবা যায়। তিনি হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়িকে বরণ করেছিলেন। মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়ে জীবনবোধ কতটা গভীর হলে এই ভার বহন করা যায়?

ক্ষুদিরাম কে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন উপেন্দ্রনাথ। কদিনেই ছেলেটি তার বড্ড আপন হয়ে গিয়েছে। ক্ষুদিরামের চিতাভস্ম বুকের কাছে নিয়ে হাঁটছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল তিনি ভারতবর্ষের ইতিহাসকে বুকে নিয়ে হেঁটে চলেছেন। তিনি একা নন, নগ্ন পদে হাঁটছে সমগ্র বাংলা। স্কুল-কলেজের ছাত্ররা নগ্ন পদে হেঁটে চলেছেন শোকের পোশাক পরে। আজ ভাত কারো গলা দিয়ে নামবে না, বাংলায় আজ অরন্ধন।

অন্যদিকে উড়িষ্যার র‍্যাভেন -শো কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রাবাসে ও চলছে উপোস। ক্লাসে বসে আছেন ১১ বছর বয়সের এক মেধাবী ছাত্র। ‌আজ কোন পড়া তাঁর মাথায় ঢুকছে না। কি যেন ভেবে চলেছেন। এক বীর সন্তান মায়ের পরাধীনতা শৃঙ্খল মোচনের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, স্বাধীন ভারতবর্ষের স্বপ্ন দুচোখে নিয়ে। অপরদিকে অন্য এক বীর সন্তান ক্ষুদিরামের সেই স্বপ্নকে তাঁর অজান্তেই পূরণ করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। তিনি আর কেউ নন তিনি হলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু । মৃত্যু এই দুই মহান দেশ প্রেমিকের জীবনকে এক সরলরেখায় যেন মিলিয়ে দিয়েছে।


You may also like