আবু সিদ্দিক
হিংসা, দ্বেষ ও দাঙ্গা
“ভারতবর্ষে এত জাতি, এত সম্প্রদায়, তবু সাম্প্রদায়িকতার ভাগ দুটি—হিন্দু ও মুসলমান। মানুষের সম্মিলিত বাস্তব জীবনযাপনে এই বিভাজন যত কৃত্রিম যত মিথ্যাই হোক না, সাম্প্রদায়িকতা বলতে হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ-বিভাজন ছাড়া আর তেমন কিছু বোঝায় না।”
—–হাসান আজিজুল হক, “মানুষের জীবনযাপনঃ সাম্প্রদায়িকতা দেশভাগ দাঙ্গা”
শুরুতে
হিংসা, দ্বেষ এখন বিশ্ব তথা বাংলা তথা ভারতের ঘরে ঘরে। এবং এসব নিয়ে মানুষ খুব বেশি চিন্তিত নয়।হাতে হাতে ইন্টারনেট। বুকে বুকে হিংসা দ্বেষ। মুখে মুখে খিস্তি খেঁউড়। কথায় কথায় উগ্র গালিগালাজ।দিন শুরু হিংসাতে, শেষও হিংসাতে। যুদ্ধ, হত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংস, দাঙ্গা, আক্রমণ, শরণার্থী—এসবের খবর সব গা-সওয়া। শাস্ত্র মুখে মুখে, রক্ত হাতে হাতে। ঘৃণা অন্তরে অন্তরে। বিষ আকাশে বাতাসে। মৃত্যু আকছার। বেঁচে থাকার লড়াই সহিংস, অতীব নিষ্ঠুর। এক ইঞ্চি জমির জন্য লড়াই, বাসে ট্রেনে একটি সিটের জন্য লড়াই, দশটা টাকার জন্য হাটেবাজারে লড়াই, লড়াই অফিসে, হাসপাতালের লাইনে লড়াই—লড়াই সর্বত্র। লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই। এ যেন আমাদের বেদ-মন্ত্র, আমাদের কুরআনের শাশ্বত বাণী, আমাদের শত শত বছরের সাধনার অমৃত।
আমার এ প্রবন্ধে হিংসার কমবেশি সব প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য, কারণ ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয়। তার জন্য আলাদা বই আপনাকে লিখতে হতে পারে। আমি মনে করি একটি পিঁপড়ে হত্যাও হিংসার ঘটনা। জগতের এককোষী জীব থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষ—সবই এই প্রবন্ধের বিষয় হতে পারে।এমনকি বনজঙ্গল উচ্ছেদ এবং চাষের জমিতে ধারাবাহিক ও নির বিচ্ছিন্ন ফসল ফলানোর জন্য মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার, পেস্টিসাইডের ব্যবহার হিংসার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু আপনারা খেয়াল করুন প্রবন্ধের বিষয় শুধু হিংসা নয়। আছে দ্বেষ ও দাঙ্গার বিষয়। এখানেই আমি হিংসার বৃহৎ প্রেক্ষাপট থেকে সরে এসে আমার আলোচনার একটি সঙ্কীর্ণ সীমা টানতে চাইছি। খুলে বললে বলতে হয় মূলত ভারতের এবং বিশেষকরে বাংলার পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু-মুসলমানের হিংসার, বিদ্বেষের ও দাঙ্গার কথা বলতে চাইছি।না পাবেন এখানে সাদা ও কালো চামড়ার মধ্যে হিংসার কথা, না পাবেন শিয়া-সুন্নিদের হিংসার কথা, না পাবেন পৃথিবীর স্বর্গ বর্ণবিদ্বেষী দেশ আমেরিকার কথা। এছাড়া পাবেন না ইতিহাসের নিরিখে বাংলার হিংসা, দ্বেষ ও দাঙ্গার সম্পূর্ণ চালচিত্র।
তাহলে পাবেন কী? কিছু মোটা কথার বাহার।খুশবন্ত সিং (The End of India) বলেছেন, যে যেখানেই হিন্দু-মুসলমান থাকবে, সেখানেই সাম্রদায়িক চাপান উতোর থাকবে। সহাবস্থান, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কথাগুলো শুনতে ভালো। বাস্তব কিন্তু ভিন্ন কথা বলে। দুটি সম্প্রদায়ের নানামুখি চাহিদার তারতম্য থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই দুটি সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক চেতনা ভিন্ন থাকাও কিছু অস্বাভাবিক নয়।এ নিয়েই চাষ। এ নিয়েই বাস। মুসলমানরা মুসলমানদের ঝোল টানবে, আর হিন্দুরা হিন্দুদের। কারণ আমরা সবাই পছন্দ করি নিজের নিজের গন্ডির মধ্যে থাকতে। এখানেই আসে মৌলিক পরিচিতির প্রসঙ্গ। আর এই মৌলিক পরিচিতি কিন্তু শ্রেণী পরিচিতি নয়। এটি ধর্মীয় পরিচিতি। অমর্ত্য সেন (Identity and Violence) এই পরিচিতির সঙ্গে হিংসার যোগ দেখিয়েছেন। দেখিয়েছেন ধর্মীয় পরিচিতি আর সব পরিচিতিকে ছাপিয়ে গেলে মহাবিপদ। মানে হিংসার উদ্রেক ও জীবন ও সম্পদহানি। সুধীর কাকর (Indian Identity) কিন্তু ধর্মীয় পরিচিতিকে মানুষের মৌলিক পরিচিতি বলেছেন, যা থেকে মানুষ সহজে বেরুতে পারে না। তাই মেনে নিতে হয় ধর্মীয় পরিচিতির গুরুত্ব। আর আজকের ভারতে এই পরিচিতির বাইরে তো আর কোনো পরিচিতি আছে বলে মনে হয় না। হয় হিন্দু, না হয় মুসলমান। মেধাজীবীদের সব তর্কবিতর্ককে মোদী সরকার এক জায়গায় নিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। এটি কিন্তু কম কথা নয়। যদিও এর ভিত্তিভূমি ভারতে বরাবরই তৈরি ছিল।
ধর্মীয় পরিচিতি আর সাম্প্রদায়িক পরিচিতি এক নয়। ধর্মীয় বিবাদ আর সাম্প্রদায়িক বিবাদ বিষয় দুটো আপাতদৃষ্টিতে এক মনে হলেও এদের মধ্যে ব্যবধান বর্তমান।But despite connections between religion and communalism, religious and communal identities are not identical. The former concerns personal allegiance to a set of practices and dogmas, often in search of a reward from a transcendental reality. Communalism, on the other hand, entails individual commitment to the special interests of a religious community in order to gain worldly advantages at the expense of other communities. Religious violence is provoked by sectarian and doctrinaire differences, communal animosities are primarily motivated by conflicts over political power and economic resources.[i] Some western sociologists have argued that although Hindus and Muslims had lived together peacefully for centuries there were insufficient mutual values to constitute a society (Das p. 7). Communalism essentially amounts to organizing an exclusive religious group on the basis of hostility to one or more of the others at the social level. The implied hostility becomes sharper two or more groups have to live together and share common economic, political and other scarce resources (Das p. 11). সম্প্রদায় চেতনা আর সাম্প্রদায়িকতা এক নয়। সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে অনিবার্যভাবে জড়িয়ে আছে সম্প্রদায়ের আর্থিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার দখলদারির ভাবনা। সম্প্রদায় চেতনার জগৎ মূলত ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা হল একটি সম্প্রদায়ের ক্ষমতা দখলের বিষয়, এবং তা অবশ্যই অন্য সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে দাবিয়ে রেখে। অন্য সম্প্রদায়ের মানুষদের চেপে রেখে।
ঘটা করে নবী দিবস পালন, মহরম-এর সশস্ত্র মিছিল, ইসলামি জলসায় গলা চড়িয়ে উগ্রতা; ২০১৬-২০১৭ সাল থেকে রামনবমী, গণেশ পুজোর জমক, বিসর্জনে সশস্ত্র মিছিল, মোটরসাইকেল বাহিনীর তান্ডব এখন হালফিলের পশ্চিমবঙ্গের চিত্র। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে কিছু জানালা খোলা থাকলেও দীর্ঘদিনের ও ব্যবহারে ধুলো জমেছে তাতে। বিশেষত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে। অবিশ্বাসের ফল্গুধারা বহমান ছিল অনেকদিন ধরেই। এই সময়ে ধর্ম যাপনের প্রকট রূপ, ধর্মীয় উৎসবের মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শন ক্রমে ক্রমে অবিশ্বাসের বাতাবরণকে ঘনীভূত করেছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, ধর্ম-বিহীন সামাজিক-সাংস্কৃতিক উদ্যোগগুলি ক্রমশ আড়ালে চলে যাচ্ছে। স্টিরিও টাইপিং এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কযুক্ত এমন একটি প্রক্রিয়া লক্ষ করা গেছে যার মাধ্যমে ক্ষমতাশালী ধর্মীয় গোষ্ঠী কিছু কিছু আচার, আচরণ, বিধি ক্ষমতার বিকাশ ও বৈধকরণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। রামনবমীর মিছিল, বিশেষত অস্ত্রসহ মিছিল সেই আবিষ্কৃত ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশ। নবী দিবসের মিছিল এই পর্যায়ে ঐতিহ্য প্রকাশের উদ্দেশ্যে সাম্প্রতিক কার্যক্রম। মিছিল থেকে, ভিন্নধর্মীদের আক্রমণ বা প্রতিরোধের সময়, ‘আল্লাহু আকবর’ বা ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান বিপরীত সম্প্রদায়ের মনে ভীতির সঞ্চার করে। একই সাথে স্বধর্মীদের সাহস দেয়, জানান দেয়, ভয় পেয়ো না, আমরা আছি। গোডাউন পাড়ার যুবকদের কথায়, যখন মুসলিমরা আক্রমণ করল, তখন আমরা ‘জয় শ্রীরাম’ বলে লোক জড়ো করলাম। উল্লেখ্য এর আগে কখনো এই শ্লোগান ওরা দেয়নি। শিশু-কিশোর মনকে বিষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে প্রবল উদ্যমে। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই তার সমান তালে চলছে। নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে চলছে পরস্পর সম্পর্কে ঘৃণা আর সন্দেহের বীজ বোনা, দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নানা গুজব। শেখানো হচ্ছে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী প্রতিবেশীকে ঘৃণা আর সন্দেহ করতে! তুলে দেওয়া হচ্ছে শিশু-কিশোরদের হাতে নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র। প্রকাশ্যে সশস্ত্র মিছিল, হিংসাত্মক স্লোগান, সামরিক প্রশিক্ষণ … সবই চলছে বেপরোয়াভাবে। ধর্মীয় পরিচয়-এর ওপর ভিত্তি করে আলাদা হয়ে যাচ্ছে স্কুলের বেঞ্চ। বন্ধুত্ব থেমে যাচ্ছে, ‘কম কথা বলি মুসলিম সহপাঠীদের সঙ্গে’ এখন নিষ্ঠুর বাস্তব।
‘ক্ষত নিরাময়’ –এ জরুরি ভিত্তিতে সমাজের সংবেদনশীল মানুষের ভূমিকা নিতে হবে। শিশু-কিশোর মনে সহযোগিতা, সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা, বন্ধুত্ব আর মানবিকতাবোধ, যুক্তিশীল মনন, বিজ্ঞানমনস্কতার বিকাশের উদ্যোগ আজ বড়ই সীমিত। ধর্মান্ধতার বিদ্বেষের মুখোমুখি হতে এই উদ্যোগ আজ খুব জরুরি!হিন্দু আরো হিন্দু, মুসলিম আরো মুসলিম হতে নেমে পড়েছে। প্রতিবেশী থাকা পরিবারটির কাছে পৌঁছতে হবে। জরুরি আজ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে আলাপ- পরিচয় আত্মীয়তার দরজা জানলা খুলে দেওয়া! পরস্পরকে জানা-বোঝার মধ্যে দিয়েই সম্ভব ঘৃণা আর সন্দেহের বিদ্বেষ বিষকে নির্মূল করা। কথা বলা, আরো কথা বলা। কিছু উদ্যোগের কথা আমরা জানতে পারছি। ‘এবং আলাপ’ নামের একটি সংস্থা মেটিয়াবুরুজের মানুষের কাছে পৌঁছানোর উদ্যোগ সম্প্রতি নিয়েছে। আমরা’ও শামিল হয়েছি ‘কারওয়া এ মুহব্বত’ দলের সঙ্গে। এমন আরও অনেক উদ্যোগ জরুরি। অবিশ্বাসের বাতাবরণ দূর করার উদ্যোগ শুরু হোক সর্বত্র। এই সমাজের মধ্যেই, এই সংস্কৃতির মধ্যেই আছে সাম্প্রদায়িকতা থামানোর রসদ। আমাদের ‘অস্ত্র’ হোক লালন, হাছন, দুদ্দু শাহ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দের আদিগন্ত বাংলা।[ii] প্রতিবেদনটির মূল আবেদন এখানেই- “মানুষ যখন অন্য সব পরিচয় এক পাশে ঠেলে দিয়ে ধর্মীয় পরিচয় মুখ্য করে পথে নামে তখন নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনে।”
ভাবতে ভালো লাগে বাংলার বুকে শান্তিপ্রিয়, সহাবস্থানে বিশ্বাসী লোকের অভাব নেই আজও। তাইতো ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’-এর মতো দলের সক্রিয় উপস্থিতি। এবং তাদের কাজ অবশ্যই প্রসংশার দাবি রাখে। আমি শুধু এর সাথে কিছু কথা যোগ করতে চাই।ধর্মীয় পরিচিতির বাইরেও কিছু কথা আছে। প্রথমত, পুরো প্রতিবেদনে গোঁড়া হিন্দুত্বের প্রতীক আর এস এসের উল্লেখ চোখে পড়েনি। বিজেপি দলের কথা এসেছে অনিবার্যভাবেই। কিন্তু বিজেপির মূল চালিকাশক্তি কে? আর এস এস। বাংলার রাজনীতিতে, বাংলার ধর্মীয় সংস্কৃতিতে আর এস এসের উত্তরোত্তর সক্রিয়তা সম্পর্কে প্রতিবেদনে সেরকম কিছু নেই।দ্বিতীয়ত, দাঙ্গার পেছনে ধর্মীয় পরিচিতির সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির বিষয়গুলো জড়িত। হিন্দুরা চায় গেঁয়ো মুসলমানরা কায়িক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকুক। যুগ যুগ ধরে তাই তো হিন্দুরা দেখে এসেছে। এখন এরা মাথাচাড়া দেওয়ার ক্ষীণ চেষ্টা করছে। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা—সবেতেই। মুসলমানরাও পয়সা চিনতে শিখেছে। প্রতিবেশী বাঙালি মুসলমান ভ্যানওয়ালা, ঠ্যালাওয়ালা, রাজমিস্ত্রি, মাঠের মুনিশ, ইত্যাদি হলে কিছুই অসুবিধে নেই। কিন্তু সে যদি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর, মাস্টার বা অফিসের চাকরি—সরকারি বেসরকারি যাই হোক না কেন, তাতেই প্রতিবেশী হিন্দু ভাইয়ের গায়ে যত জ্বালা। অর্থাৎ জীবন-জীবিকা ও রুজি- রোজগারের প্রশ্নে মুসলমানরা তাদের তুলনামূলক ‘উন্নত’ জীবনের অধিকারী হিন্দু ভাইয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতার যোগ্যতা অর্জন করলেই সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান হয়। অত মারপ্যাঁচ না করে এই কথাগুলো হোল ধ্রুব বাস্তব। মুসলমান নামাজ পড়লে কোণ হিন্দুর কিছু আসে যায় না। অনুরূপভাবে হিন্দুর মন্দির দর্শনে মুসলমানের কিছু আসে যায় না। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সরকারও চাই সব হিন্দু মন্দিরে যাক, আর সব মুসলমান মসজিদে। সরকারের কোন মাথা ব্যথা নেই কে কোন ধর্ম পালন করছে। The supposedly secular state thus wants the ideal Muslim to go to the mosqueand his Hindu counterpart to go to the temple…the plan seems to be to fasten unsusupecting people to unquestioning and unbridled social control.[iii] মাথা ব্যথার কারণ তখনই যখন কোনো হিন্দু বা মুসলমান তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অধিকারের কথা বলতে আসবে।কিন্তু সেই মুসলমান যদি অর্থে, শিক্ষায়, রাজনীতিতে তার পাশের বাড়ির হিন্দু ভাইকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, তাহলেই সর্বনাশ। কারণ পেছনের সারির লোক সামনের সারিতে আসুক কেউ চায় না। লিবারেল, মার্কসবাদী, লেনিনবাদী, গুরুজির ভক্তরা—এক্ষেত্রে সবাই সমান। বাংলায় এটিই চলে এসেছে।এস ওয়াজেদ আলীর কথায় বলতে হয় ‘সেই tradition সমানে চলেছে।’
বাংলার মুসলমানদের ভয়ের ছবি আমি এঁকেছি এই কবিতাটিতে,“Fear of Being Stateless”, যেটি লেখা হয় এন আর সি আন্দোলনের সময়। তাজ্জব হয়ে যাবেন জেনে, যে মুসলমানরা কী অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন রাত কাটিয়েছেন সে সময়। পোস্টঅফিসে লাইন, ব্যাঙ্কে লাইন, অফিসে লাইন, লাইন আদালতে। কি না ‘কাগজ’ ঠিক করতে হবে। না হলে দেশে আর জায়গা হবে না। বেনাগরিক হতে হবে। লাইনে লাইনে চারদিক ছয়লাপ। অসহায় মুখের ছাপ সর্বত্র। সবই কি মুসলমান। কিছু হিন্দু ছিল নিশ্চয়। বেশিরভাগই মুসলমান। নামের বানান ভুল—শুধুমাত্র এই কারণে রাত একটা থেকে লাইন আমি দেখেছি। বাবু হিন্দুরা চায়ের দোকানে বসে এসব তারিয়ে তারিয়ে দেখেছে। তাদেরও কিছু করার নেই। কিন্তু নিজের কাগজ ‘ঠিক’ রাস্তাকে অবলম্বন করে ঠিক করে নিয়ে নিশ্চিন্তে আছেন। আর তার থেকে বড় সার্টিফিকেট সে হিন্দু। কাটুয়া নয়। তাই অতো ভাববার কি আছে? এ সময় অনেক হিন্দু ভায়েরা মুসলমানদের দেশ থেকে তাড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। আজও দেখেন। মুসলমানরা চলে গেলে, মরে গেলে, কে কোন জমিটার কে কোন বাড়িটি্র দখল নেবে এ নিয়ে হিন্দু পাড়ায় আলোচনা চলতে থাকে।
Fear of being stateless
Because of NRC
Is everywhere—homes, offices,
Trains, buses, fields and firms.
Faces dull and dark and
Woes, worries, anxieties
Known, unknown, imagined,
Dry body fluids.
অনেক মুসলমানের রক্ত ঠান্ডা হয়ে এসেছিল। কি জানি কি হয়। ভয়ের পাশাপাশি আন্দোলনও চলেছে বাংলার প্রায় প্রতি গ্রামে। দাঙ্গার কথা ভুলে গেলেও, মুসলমানরা এন আর সি-র হয়রানির দিনরাত গুলো ভুলবে কী করে। মুসলমানরা সব মনে রেখেছে। হিংসা, দ্বেষ, দাঙ্গা নয়। একেবারে বেনাগরিক। একেবারে রিফুজি রাতারাতি। যেমনটি আসামে হয়েছে।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের ধনবাদী বিকাশের পথ সাম্প্রদায়িকতাবাদের বৃদ্ধির জমি তৈরি করেছিল দুইভাবে।প্রথমত, ধনবাদী অর্থনীতি জনসংখ্যার এক বিপুল বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে অপেক্ষাকৃত কম হারে বৃদ্ধির ফলে দারিদ্য, বেকারত্ব, ও অসাম্যের মতো মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে, যে সমস্যাগুলি হতাশার জন্ম দেয় এবং অপ্রতুল অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধার জন্য অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা গড়ে তোলে। দ্বিতীয়ত, কৃষি ও শিল্পের ধনবাদী বিকাশের সঙ্গে এসেছিল নতুন সামাজিক টানপড়েন ও নতুন সামাজিক দুশ্চিন্তা। এর ফলে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব, ক্রমবর্ধমান উচ্চাশা, আয়ের অসম বন্টন, এবং ধারালো ও দৃশ্যমান অসাম্য জন্ম নিয়েছে তা সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করেছে ও নতুন করে সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও জনপ্রিয়তার রাজনীতির সম্প্রসারণ হতে পারে এমন জমি তৈরি করেছে। উপরন্তু, নতুন গোষ্ঠীদের যেমন সামাজিক শক্তি বাড়ে, তেমন অন্যদের ক্ষমতা ও মর্যাদা হ্রাস পায় ও তারা ধর্মীয় পুনরুত্থানবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদের আবেদনের প্রতি মনোযোগ দেয়।[iv] হিংসা ও দাঙ্গার কথা বলতে গেলে এর পেছনের কারণগুলি বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে।দাঙ্গা এমনি এমনি হয় না। মসজিদের সামনে মাইক বাজানো বা মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট করার মতো ঘটনা তাৎক্ষণিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে দাঙ্গা ঘটাতে সক্ষম ঠিকই। কিন্তু এর পেছনে থাকে হিন্দু-মুসলমানের মনের মধ্যে দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, দ্বেষ ও হিংসা।
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আদর্শ নমুনা হল দাঙ্গা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সাধারণত অংশগ্রহণকারীরা হল শহরের দরিদ্র মানুষ এবং লুম্পেন-গুন্ডা প্রকৃতির মানুষজন। মধ্য ও উচ্চশ্রেণিদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের নজির প্রায় মেলে না, যদিও তারা অনেক সময় লুম্পেন-গুন্ডা প্রকৃতির লোকেদের বস্তুগত ও নৈতিক সমর্থন যোগায়। কিন্তু একবার উন্মাদনা প্রশমিত হলে, উত্তেজনা চলে গেলে, এবং তাৎক্ষণিক ভীতির পরিবেশের অবসান হলে, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দ্রুত বিলীন হয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক ফিরে আসে। প্রত্যেক ঘটনা একটি ঐতিহ্য রেখে গেলেও , সাধারণভাবে দাঙ্গার সঙ্গে যুক্ত বা দাঙ্গা কর্তৃক সৃষ্ট চাপা উত্তেজনা দ্রুতবেগে এবং সামগ্রিকভাবে দূর হয়ে যেত (বিপান চন্দ্র, পৃ.৩)।সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দ্রুত বিলীন হলেও এর ক্ষত সহজে সারে না। এন আর সি বিরোধী আন্দোলনের সময় বাংলায় কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে—ট্রেনে অগ্নিসংযোগ তার মধ্যে অন্যতম। আন্দোলনে গণতন্ত্রপ্রেমী সব সম্প্রদায়ের সব স্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করলেও এক সময় এই আন্দোলন মূলত মুসলমানদের আন্দোলন হয়ে ওঠে। বেনাগরিক হওয়ার ভয় তো হিন্দুদের নেই, তাই তাদের অংশগ্রহণও নাম কা ওয়াস্তে হয়ে আসে একসময়। সি এ এ-এর বিরোধী আন্দোলনের স্লোগানগুলোকে অনেক হিন্দু ভদ্রলোককে কাকের ক্যা ক্যা চিৎকারের সঙ্গে তুলনা করতে আমি শুনেছি। শিয়ালদা-লালগোলা লাইনে ট্রেন বন্ধ থাকাতে সাধারণ মানুষকে অনেক ভুগতে হয়েছে। এবং এর সব দোষ মুসলমানদের উপর এসে পড়ে। এমনকি সেসময় বাজারে আমি দেখেছি অনেক হিন্দু ভদ্রলোকদের মুসলমান সব্জিওয়ালার কাছ থেকে বেলডাঙ্গার বাঁধাকপি, লঙ্কা না কিনতে।দাঙ্গা তো হয়নি। শুধুমাত্র উত্তেজনা ছড়িয়েছিল তাতেই এ অবস্থা।
আমার একটি কবিতা ‘Distrust’। এখানে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে ভেতরের অমিল, দ্বেষ রয়েছে তা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। মুখে মুখে ভাই ভাই। আর তলে তলে নাম্বার ওয়ান শত্রু। হিন্দু-মুসলমানের এই সম্পর্কের টানপড়েন বরাবরই ছিল, আছে ও থাকবে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সময় তা প্রকাশ্যে আসে। আর সাধারণ সময়ে তা থিতিয়ে থাকে। তাই বলে টানপড়েন একেবারে বিলীন হয় না কখনও।
You call me bhai
and pat my back
flashing smiles
that is fine.
But I know
you are the first
who will harm me
at accursed hour.
সুতরাং হিংসা দ্বেষ আমাদের শিরায় শিরায়। মুখের কথা আর মনের লেখনে বিস্তর ব্যবধান।ধার্মিক মুসলমানের মধ্যে হিন্দু বিদ্বেষ নেই—একথা বলা যাবে না। আবার ধার্মিক হিন্দুর মনে মুসলমান বিদ্বেষ নেই—তাও বলা যাবে না। আবার উদার গণতন্ত্রপ্রেমী হিন্দু-মুসলমানের মনের মধ্যে একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ থাকবে না—তারও নিশ্চয়তা নেই।
আজকে সব দোষ মুসলমানদের। এমনকি ওজন লেয়ার ছিদ্র বা বিশ্বউষ্ণায়নের জন্য মুসলমানদের দায়ী করা হতে পারে। কিন্তু বাস্তবটা কী? তার উত্তর কবিতার, ‘Muslims are to be blamed’ দ্বিতীয় অংশে পাবেন। মুসলমানদের হাল কি আর তাদের কিভাবে সংবাদে, সাহিত্য সংস্কৃতির নানা মাধ্যমে তুলে ধরা হয় তারই একটি প্রতিচ্ছবি আমার কবিতাটি।
1
Ha ha ha …
Who damaged our education?
Muslims
Who killed our culture?
Muslims
Who looted us?
Muslims
Who raped our women?
Muslims
Who rioted in Gujrat, UP, Delhi?
Muslims
Who divided our land?
Muslims
Who destroyed Kashmir?
Muslims
Who cleaned our forests?
Muslims
Who caused global warming?
Muslims
Who made a hole in Ozone?
Muslims
Who melted ice in Arctic?
Muslims
Who stole our minerals?
Muslims
Who polluted our seas?
Muslims
Who kill you with words?
Muslims
Who spread Corona?
Muslims
Who disturb your sleep?
Muslims
Who betray you?
Muslims
2
Who build your homes?
Muslims
Who plough your lands?
Muslims
Who water your seeds?
Muslims
Who drive you home?
Muslims
Who sew your shoes?
Muslims
Who sell vegetables at your steps?
Muslims
Who tailor your wears?
Muslims
Who guard your malls?
Muslims
Who labour like slaves
Muslims
Who vote you to power?
Muslims
And who are falling like dry leaves?
Muslims
এ যদি অবস্থা হয়, তাহলে মুসলমানদের আর কী করার আছে? ভাবতে অনুরোধ করি, সত্য প্রকাশ করতে অনুরোধ করি, মিথ্যার বেসাতি বন্ধ করতে সনির্বন্ধ আবেদন করি।
দাঙ্গা সম্পর্কে আর একটি কবিতার ‘New Year Celebration’ কিছু অংশ উল্লেখ করে আমার লেখার ইতি টানব।
Yesteryear (2021) it was North Delhi and Bengaluru
the year before was a miss
and i am puzzled how?
in 2018 it engulfed Bihar,
in 2017 it blackened parts of
Haryana, Punjab, U P, Rajasthan, Delhi
and our Baduria homes,
Dhulagarh, Coimbatore, Kaliachak
fell from grace in 2016,
Bashirhat became a national name in 2015
how can we forget, friends,
Saharanpur of 2014,
Muzaffarnagar of 2013,
Assam and Canning of 2012?
should i make more backward leap or stop?
should i include Gujarat of 2002?
২০০২-২০২১ এর মধ্যে হওয়া বাংলা তথা ভারতের বড় দাঙ্গার উল্লেখ আছে। তবে ছোটখাটো দাঙ্গার ছবিগুলো এতে অনুপস্থিত। তাতে অসুবিধা নেই। কারণ এই প্রবন্ধে ইতিহাসের নিরিখে দাঙ্গার সম্পূর্ণ রূপরেখা আমি লিখতে চাইনি। চেয়েছি বাংলা তথা ভারতে হিন্দু-মুসলমানের মনের হিংসা, দ্বেষ ও তাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করে দাঙ্গার অনিবার্যতা। দাঙ্গাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু নয়। বরং দাঙ্গার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ও সর্বোপরি মানসিক আনুষঙ্গিকতা।
দাঙ্গার বাহ্য ক্ষয়-ক্ষতির চেয়েও অধিকতর বিপজ্জনক ব্যাপার হল হিন্দু-মুসলমানের মনোজগতে সৃষ্ট বিভেদের পাঁচিল।প্রকৃতির ব্যবস্থায় শতাব্দীর পর শতাব্দীর বিবর্তনে হিন্দু-মুসলমান এই দুটি সম্প্রদায় একই গ্রামে, শহরে, পেশায় পাশাপাশি আছে এবং থাকতে বাধ্য হবে। জার্মানিতে একদা হিটলার ইহুদিদের জন্য অথবা দক্ষিণ আফ্রিকাতে শ্বেতাঙ্গ সরকার কৃষ্ণকায়দের জন্য পৃথক রাখার যে ঘেটো ব্যবস্থা করেছিল, এদেশে হিন্দু-মুসলমানদের সেভাবে কেউ পৃথক রাখতে চাইলেও রাখা সম্ভব নয়।আমাদের পাশাপাশি পরস্পরের গায়ে গা লাগিয়ে থাকতে হবে। দেশবাসীর সামনে দুটি পথ—সৌহার্দ্যের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা, না নিত্য অশান্তির দ্বারা পীড়িত হওয়া?স্বাধীনতা-পূর্ব দাঙ্গার কথা ছেড়ে দিলেও স্বাধীনতার পর ভারতে অসংখ্য দাঙ্গা হয়েছে।নাগরিকদের একটি বড় অংশ যদি নিজেদের সুরক্ষিত মনে না করে এবং প্রতিবেশীদের প্রতি নিজেদের প্রাণ-ইজ্জত-সম্পত্তি-রুজি-রোজগার ও নাগরিক অধিকারের নিরাপত্তার ব্যাপারে নির্ভর করতে না পারে, তাহলে রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্রের নির্মাণ অপরিহার্য।প্রথমে মানসিক দিক দিয়ে এবং তারপর মুখের ভাষায় ও পরে প্রতিষ্ঠানগতভাবে।[v]
ইংরেজ আমলে আমরা বিশ্বাস করতে ভালবাসতাম যে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিছক সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে বিদেশি শাসকদের দ্বারা সৃষ্টি করা।ভেদনীতির জনক ও পরিপোষক ইংরেজ-শাসন অপসৃত হলেই আমরা ভাই-ভাই হয়ে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করব।কিন্তু আমাদের সেই আশা মরীচিকা প্রতীয়মান হয়েছে। স্বাধীনতার সন্ধিক্ষণের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিকায় মনে হত যে দেশে গণতান্ত্রিক বিধি-বিধান এবং জনপ্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে সম অধিকারসম্পন্ন নাগরিকদের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নামে বিবাদ করা অতীতের স্মৃতিতে পর্যবসিত হবে। কিন্তু আশা নিরাশায় পরিণত। সাম্প্রাদায়িক সংঘর্ষ ও দাঙ্গার মাথা তোলা বন্ধ হয়নি। স্বাধীনতা-লগ্নের তুলনায় সমগ্র দেশে শিক্ষিতের হার বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে—শহরগুলিতে তো এ হার বেশ উঁচু। শিক্ষাবিস্তারেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বন্ধ হয়নি।বরং প্রচলিত অর্থে শিক্ষিত রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী এবং সাংবাদিকরা যে দাঙ্গার আগুনে ঘৃতাহুতি দিতে পিছপা নন, তার বহু প্রমাণ বিগত বছরের অগ্নিস্নানের সময়ে পাওয়া গেছে (শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ. ৫)।
স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরেও আমাদের মধ্যে সমাজবাদী দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিরা বলেছেন যে হিন্দু-মুসলমান বিবাধ আসলে শোষক শ্রেণী কর্তৃক তাদের শোষণ-ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার কৌশল মাত্র।শ্রমিকরা সচেতন ও সংগঠিত হলে শ্রেণীস্বার্থে তারাই এসব ছলনার অবসান ঘটাবে।কিন্তু ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে জামসেদপুর, রাঁচি, রাউরকেল্লা এবং পশ্চিমবঙ্গে চন্দননগরকে কেন্দ্র করে গঙ্গার পশ্চিম কূলের শিল্পাঞ্চলের হিন্দু-মুসলমান শ্রমিকেরা যেভাবে পরস্পরের বুকে ছুরি মেরেছে তাতে পূর্বোক্ত বিশ্বাস অলীক প্রমাণিত হয়েছে।আহমেদাবাদ, বোম্বাই, কানপুর, আলীগড়, ইন্দোর—সংগঠিত শ্রমিকদের বহু শিল্প-নগরীতে বার বার প্রচণ্ড দাঙ্গা ঘটেছে। দাঙ্গার পূর্বোক্ত সমাজবাদী ব্যাখ্যার একটি ধারা এও ছিল যে শোষণপীড়নকারী জমিদাররা প্রধানত হিন্দু এবং শোষিত-পীড়িত কৃষকরা সাধারণত মুসলমান বলে গ্রামাঞ্চলের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বহুক্ষেত্রে আসলে শ্রেণী-সংগ্রাম। ফরাজী আন্দোলন থেকে শুরু করে কেরলের মোপালা বিদ্রোহকে এক শ্রেনীর ঐতিহাসিক তাই শ্রেণী-সংগ্রাম রূপে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, ঐসব আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত জোর করে ধর্মান্তরকরণের প্রয়াস, নারী-নিগ্রহের ঘটনাবলী ইত্যাদি উপেক্ষা করে।কিন্তু জমিদারি প্রথা ভারতে অতীতের স্মৃতিতে পর্যবসিত হলেও গ্রামাঞ্চলে দাঙ্গা ঘটেই চলেছে (শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ.৫-৬)।
আধুনিক সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান প্রভাবিত কেউ কেউ বিচ্ছিন্নতাবাদের (alienation) তত্ত্বের আলোকে মনে করেন যে এটি আসলে শহরের সমস্যা, যেখানে স্বাভাবিক সংস্কৃতির আধার গ্রাম থেকে শিকড়চ্যুত হয়ে মরুভূমির বালুকণার মতো (atomised)গাদাগাদি কিন্তু পরস্পর অসম্পৃক্ত ভাবে মানুষ বসবাস করতে বাধ্য হয়।তাঁদের মতে নাগরিক জীবনের অভাব-অতৃপ্তি-হিংসা- বিক্ষোভের এক রূপ হল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, স্রোতের শৈবালদামের মত উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে সঞ্চরণকারী নর-নারীদের সামাজিক অস্মিতার (identity)খোঁজে।কিন্তু ভাগলপুর, মীরাট, কর্ণাটক ও দেশের অন্যত্র গ্রামাঞ্চলের দাঙ্গার ব্যাখ্যা পূর্বোক্ত তত্ত্বে পাওয়া যায় না।একসময় মনে করা হত যে ইংরেজ ভেদনীতির বাইরে থাকা দেশীয় রাজ্যগুলি বোধহয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রভাবমুক্ত। অতীতে ভুপাল এবং সাম্প্রতিক কালে জয়পুর, কোটা, উদয়পুর, ইন্দোর, এবং এমন কি গৌরবজনক মিলিত সংস্কৃতির (composite culture)পীঠস্থান হায়দ্রাবাদ শহরের ভীষণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সে বিশ্বাসকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। আবার কেউ কেউ আমরা ভাবতাম যে মায়ের জাত নারী অপেক্ষাকৃত ভাবে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব মুক্ত।কিন্তু তাঁরা ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। নারীদের মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢুকে পড়েছে।তাঁদের ভিতর সাম্প্রদায়িকতার ইনজেকশান দেবার জন্য ভারতীয় জনতা পার্টি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আর এস এস, শিবসেনা, জমাত-এ-ইসলামীর মত সাম্প্রদায়িক দল ও গোষ্ঠীর বিশেষ সংগঠন খাড়া করছেন যাতে নারীদের মাধ্যমে ঐ সব দল ও গোষ্ঠীর বিশেষ মতবাদ পরিবারের মধ্যেও ব্যাপ্ত হয়।শিশুরা যাতে বাল্যকাল থেকেই ঐ বিশেষ সাম্প্রদায়িক মতে দীক্ষিত হয়ে ওঠে (শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃ.৬)।
শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া দরকার। প্রয়োজন সাম্প্রাদায়িক সংঘর্ষ ও দাঙ্গা বন্ধ করে সকল সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সম্পর্কে সম্প্রীতি স্থাপন এবং সভ্য-সংস্কৃতিসম্পন্ন মানবীয় আচার-আচরণের অনুবর্তী হওয়া। আর তা করতে হলে দীর্ঘ দিনের এই বিবাদের মূলে যেতে হবে। অনেক প্রাচীন বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণাকে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে। সর্বোপরি চাই আপাত দৃষ্টিতে অনুপাদেয় মনে হলেও বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি ও মতকে শান্ত বুদ্ধিতে বিচার করার প্রস্তুতি। মনের দরজা খোলা রাখা।
প্রায় সকলেই মনের দরজাকে খোলা রাখার মতে ও পথে। রামকৃষ্ণের সেই অমোঘবাণী যত মত, তত পথ-ই ঠিক মনে হয়। সুফি-সাধু-সন্ত-পীর-ফকির-আউল-বাউলদের দেখানো পথেই মুক্তি মিলতে পারে এই হিন্দু-মুসলানের বিবাদ থেকে। আপাতদৃষ্টিতে এই ভক্তিবাদ-সহজীয়া-মরমীবাদ-ভাববাদ একমাত্র পথ বলে মনে হতে পারে। এবং অনেকের মতেই এ পথেই মনের বাঁধন আলগা হবে। মিলবে সব পাওয়ার দেশের ঠিকানা।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি হিন্দু-মুসলমানের সমস্যার বহুমাত্রিক স্তর আছে এবং এ সমস্যা খুব জটিল ও সহজে নির্মূল হবার না। এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসা, দ্বেষ ও দাঙ্গা দিনের পর দিন বাড়বে, কমবে না। তা সে যতই আমরা সহজীয়ার বড়ি গুলে খাই না কেন।আছে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনা। আছে রাজনৈতিক বৈষম্য ও বঞ্চনা। আছে সামাজিক বিভেদ ও অসাম্য। আছে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিভেদের হাজার রূপরেখা।আছে সংখ্যালঘুদের ন্যায্য রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্ন। তাঁরা আর অবহেলা সইতে রাজি নয়। তাঁরাও অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাবান বাংলার বাবুদের জায়গা ছেড়ে দিতে গররাজি।রুজি-রোজগার, শিক্ষা-বাসস্থান, সম্পদ-সম্মান, সাহিত্য-সংস্কৃতি-এসবের প্রশ্নে বাংলার মুসলমান যেমন জেগে উঠেছে, তেমনি বাংলায় আর এস এসের শাখা পাড়ায় পাড়ায় পৌঁছে গেছে। সন্মুখ সমর। পান থেকে চুন খসলেই, হিংসা, দ্বেষ ও দাঙ্গা।
তাই রবীন্দ্রনাথের কবিতা স্মরণ করে বলতে ইচ্ছে হয়,
হত্যা অরণ্যের মাঝে/ হত্যা লোকালয়ে
হত্যা বিহঙ্গের নীড়ে/ কীটের গহ্বরে
অগাধ সাগর জলে/ নির্মল আকাশে
হত্যা জীবিকার তরে/ হত্যা খেলাচ্ছলে
হত্যা অকারণে/ হত্যা অনিচ্ছার ফলে
আহমদ শরীফের কথায় বলি, গোত্রের, গোষ্ঠীর, পরিবারের, ব্যক্তির, জাতির, সরকারের, রাজার ও রাষ্ট্রের স্বার্থে চিরকালই হয়েছে, হচ্ছে, হবে হত্যার প্রয়োজন ও আয়োজন।
(প্রবন্ধটি লেখকের বঙ্গের মুসলমানঃ সমাজ পীড়নের দহনবৃত্তান্ত (২০২৩) গ্রন্থের একটি অধ্যায় )
[i] Suranjan Das, Communal Riots in Bengal 1905-1947, New Delhi: Oxford University Press, 1993, pp. 9-10
[ii] “পশ্চিমবঙ্গ : সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ২০১৭ বসিরহাট, বাদুরিয়া” https://bit.ly/3eRH5rR
[iii] Jawed Naqvi, “The Indian Intellectual and the Hindu-Muslim Trap” in The Public Intellectual in India, ed. By Romila Thapar, et all. New Delhi: Aleph, 2015, pp. 135-36
[iv] বিপান চন্দ্র, আধুনিক ভারত ও সাম্প্রদায়িকতাবাদ, অনুবাদ, কুনাল চট্টোপাধ্যায়, কলকাতাঃ কে পি বাগচী অ্যান্ড কোম্পানী, ২০১১, (তৃতীয় সংস্করণ), পৃ. ২৭০-২৭১।
[v] শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, দাঙ্গার ইতিহাস, কলকাতাঃ মিত্র ও ঘোষ, ১৪২৫ (পঞ্চম মুদ্রণ), পৃ. ৩।