মওলানা ভাসানীর আসাম জীবন

উপমহাদেশের গণমানুষের রাজনীতির আতুরঘর আসাম। আসামের ইতিহাস বাদ দিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, জমিদার উচ্ছেদ আন্দোলন ও কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস পূর্ণতা পায় না। পূর্ণতা পায় না তৎকালীন পূর্ববঙ্গ, বর্তমান বাংলাদেশের লড়াই সংগ্রাম ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস। যদিও কায়েমী স্বার্থবাদীদের হীন স্বার্থে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে চতুরতার সঙ্গে আসাম অধ্যায়কে প্রায় মুছে ফেলা হয়েছে। আসাম ও বাংলাদেশের মজলুম মানুষের লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস এক ও অভিন্ন। ব্রিটিশ শাসনামলের বিশ শতকের প্রথম দশক থেকে ব্রিটিশ সাম্ররাজ্যবাদ ও তাদের এদেশীয় দোসর স্থানীয় জমিদার, মহাজন, সুদখোর, শোষকদের শোষণ—অত্যাচারে টিকতে না পেরে ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট, কোচবিহার ও ত্রিপুরা (এখন ভারতের অন্তর্গত) সহ বিভিন্ন অঞ্চলের লাখ লাখ ভূমিহীন ও গরীব কৃষক পার্শ্ববর্তী প্রদেশ আসামের গোয়ালপাড়া, তেজপুর, নগাঁও, দারং ও কামরূপ জেলার অনাবাদী, গভীর ও দুর্গম জঙ্গল পরিষ্কার করে বসবাস শুরু করেছিল। পূর্ববঙ্গের মানুষ অন্য কোন স্থানে না গিয়ে আসামে যাবার কারণ শুধু অর্থনৈতিক নয়, জাতিগত ও সাংস্কৃতিকও বটে। আসামের দক্ষিণ অংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল শত শত বছর ধরে বাংলা বা বঙ্গের অন্তর্গত ছিল। এখানে অসমীয়া অধিবাসীদের চেয়ে বাঙালি সব সময়ই বেশি ছিল। ‘প্রথমদিকে দু’টি প্রধান কারণে আসাম সরকার বাঙালিদের স্বাগত জানিয়েছিল: ১) সেকালের প্রাণনাশী অসুখ কালাজ্বরে মৃত্যুর ফলে আসামের জনসংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছিল এবং ২) বিপজ্জনক জন্তুুর বিচরণক্ষেত্র জঙ্গল পরিষ্কার করে বাঙালিদের চাষাবাদের ফলে খাদ্যোৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি সরকারের ভূমি রাজস্ব আয়ও অনেক বেড়েছিল।’ অভিবাসী বাঙালি কৃষকেরা নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে আসামের স্বাপদসংকুল ঘন জঙ্গল পরিস্কার করে ফসল ফলিয়ে আসাম প্রদেশকে শস্যশ্যামল, সমৃদ্ধ ও সম্পদশালী করে তুলেছিল। তাদের হাত ধরে স্থানীয় জনসাধারণের খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত খাদ্য পূর্ববঙ্গেও পাঠানো হতো। সেসব বিবেচনায় আসামের অভিবাসী বাঙালি কৃষকেরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চাষী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিদার।

আসামের অভিবাসী বাঙালি কৃষকেরা যখন একটু সুখের নাগাল পেয়েছিল, আসাম সরকার ও স্থানীয় বর্ণ হিন্দুরা তখন তাদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন—নিপীড়িন চালানো শুরু করে। আসাম সরকার সিমান্তে পাহারা বসিয়ে পূর্ববঙ্গে খাদ্যশষ্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়। ঠিক সেই সময়ে আবির্ভাব ঘটে ভাসান চরের মওলানা খ্যাত আবদুল হামিদ খানের। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তখন জমিদার—মহাজন বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে প্রথমে ময়মনসিংহ জেলা থেকে এবং পরবর্তীকালে ১৯২৬ সালের শেষ দিকে বাংলা প্রদেশ থেকে বহিস্কৃত হয়েছিলেন। সে পরিস্থিতিতে সরকার কর্তৃক গ্রেফতার ও জমিদারদের নির্যাতন এড়ানোর জন্য ১৯২৬ সালে তিনি আসাম চলে গেলেও ১৯২৯ সালের আগে সেখানে তাঁর কোন বাড়িঘর ছিলো না। বছর তিনেক তিনি পুলিশের চোখ এড়িয়ে কখনো বর্তমান বাংলাদেশে, কখনো আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। ১৯২৯ সালের জানুয়ারী মাসে প্রচন্ড শীতের মাঝে গোয়ালপাড়া জেলার ধুবরী মহকুমার অন্তর্গত ঘাগমারী নামক জায়গায় কিছুটা জঙ্গল পরিষ্কার করে ‘এক টাকা চৌদ্দ আনা’ ব্যয় করে বাঁশ ও খড়ের একটি ঘর তৈরি করে সেখানে তিনি স্বপরিবারে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। পরে মওলানা ভাসানীর হাতে গড়া এই বিরাট জনপদের নাম পাল্টে যায়। ভক্তরা এর নতুন নামকরণ করেন— হামিদাবাদ। কিছুদিন পর তাঁর স্ত্রী এই ভয়াবহ বিপদসঙ্কুল স্থান ছেড়ে পিতৃভূমি বাংলায় ফিরে আসার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। স্ত্রীকে পাঁচবিবিতে তার পিত্রালয়ে পাঠিয়ে দিয়ে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘আমার নিরন্ন, বিবস্ত্র বাঙালি চাষীদের একটা সুরাহা যতদিন না হবে, ততদিন আমি আর বাংলায় ফিরে যাব না।’ সত্যিই মওলানা ভাসানী আর ফিরে আসেন নি, যতদিন পর্যন্ত সরকারী ক্ষমতা বলে তাঁকে আসাম থেকে তাড়িয়ে দেয়া না হয়েছে।

মওলানা ভাসানীর আসাম জীবনের শুরুর দিককার একটা চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় সাইফুল ইসলাম রচিত স্বাধীনতা ভাসানী ভারত বইয়ে তাঁর এক স্মৃতিচারণায়— ‘পথের ধারে বাঘ শুইয়া থাকে। দিনের বেলায় অস্ত্র হাতে নিয়া পথ চলতে হয়। অস্ত্রশস্ত্র নিয়া আগুনের বোন্দা (মশাল) জ্বালাইয়া রাইতে বাইর হয় নেহাত প্রয়োজনে। সাপের কামুড়ে দৈনিক মানুষ মরে। মশা একেকটা এত বড় যে পায়ে সুতা বাইন্ধা রাখা যায়। ডেঙ্গু জ¦র, ম্যালেরিয়া, কালাজ¦র নিয়াই ঘর সংসার। মরণ—বাঁচন এবেলা—ওবেলায়, পাহাড় থাইকা মহিষ, হরিণ নাইমা আইসা রাইতের আঁধারে ক্ষেতকে ক্ষেত কাবার কইরা ফ্যালায়। হাতির উৎপাত আরও বেশী। ঘর—দুয়ারে হামলা চালায়। আধহাতি জোঁক রক্ত চুইষা হয় তিন—পোয়া হাত। বিরান পাথারে পাঁচ—সাত মাইল পরপর বসতি। তাও হাতে গোনা। এমন দেশে আইসলাম। ঘাগমারীতে খড়ের ছাউনি দিয়া ঘর বাঁইধলাম। খরচ হইল এক টাকা চৌদ্দ আনা।’

সেসময়ের আরেকটা বর্ণনা পাওয়া যায় অজানা সূত্র থেকে পাওয়া এই লেখা থেকে— ‘১৯০৪ সালের কথা। বাবার বন্ধু ও পীর শাহ সৈয়দ নাসিরউদ্দিন আহমেদ বোগদাদীর সাহচর্যে প্রথম বারের মতো আবদুল হামিদ খান আসামের জলেশ্বর যাচ্ছেন। যমুনা বহ্মপূত্রের উত্তাল তরঙ্গ পেরিয়ে আসাম তখন দূর দেশ। নদীর দু’পাড়ে দেহাতি মানুষের ঘরবাড়ি। হাড্ডিসার মানুষগুলো দুমুঠো ভাতের জন্য জলে, মাঠে, জঙ্গলে কঠোর পরিশ্রম করে। তবুও তাদের পেটে ভাত জোটে না। তার ওপর জমিদার, জোতদার, মহাজন ও সুদখোর ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম। ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, জোঁকের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। আমরা যে আসামের কথা বলছি, গোয়ালপাড়া জেলার বিস্তৃত এক পাহাড়ি সমতল, হামিদাবাদ। গারো পাহাড়ের পাদদেশ। লাইনপ্রথা আন্দোলনের গড়। এখানে পড়ে রয়েছে লাখেরাজ অঢেল অরন্যাঞ্চল। আসাম প্রাদেশিক সরকারের খাস খামার। হিংস্র বাঘ—ভাল্লুক, শিয়াল—পয়মাল, জোঁক—মশার তালুক আর ঝোপ ঝাড় পরিস্কার করে পদ্মায় গৃহহারারা বসতি গেড়ে ফসল ফলাতে শুরু করলো। কালে জনসংখ্যা আর সম্পদের বাড়—বাড়ন্ত দেখে স্থানীয় অসমীয়ারা আতঙ্কিত হয়ে প্রাদেশিক সরকারের দ্বারা ‘লাইন প্রথা’ ঘোষণা করালো। পাঁচ—পনেরো বছর ধরে তারা আবাদ করে, খাজনা ট্যাক্স দিয়ে স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে লাগলো।’ এইসব অসহায় মজলুম মানুষেরা যারা প্রতিবাদ করতে জানতো না তাদের জন্য আমি এই হামিদাবাদে স্কুল, মাদ্রাসা, ডাকঘর, তাঁতশিল্প প্রশিক্ষণালয়, মুসাফিরখানা ইত্যাদি গড়ে তুলি। প্রথম যেদিন এখানে আসি সেদিন রাহাখরচ বাদে ছয় টাকা পুঁজি ছিল। তল্লাটে চিড়ে—গুড়ের দোকান খুঁজে না পেয়ে অগত্যা অদূরে ছন—বাঁশের তৈরি মসজিদে আসরের নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে গাঁওবুড়ার বৈঠকখানায় থাকার জায়গা হলো। মসজিদে ইমামতি আর ছেলে—মেয়েদের পড়ানোর শর্তে এক টাকা চৌদ্দ আনা ব্যয়ে খাস পতিত জায়গায় ঘর উঠলো। যেই ঘর সেই শিক্ষাপট। দিনে কাজ রাতে স্কুল চলতে লাগলো।’

মওলানা ভাসানী যে আসামে রাজনীতি করেছেন সেই আসামের সীমানা বর্তমান সীমানা নয়। বর্তমান ভারতের আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা রাজ্য নিয়ে এই প্রদেশ বিস্তৃত ছিল। ১৮২৭ সালে আসাম প্রদেশ ব্রিটিশের অধীনস্থ হলেও ১৮৭৪ সাল পর্যন্ত গোয়ালপাড়াসহ এর বেশ কয়েকটি জেলা বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে ছিল। বস্তুতঃ আসামের সঙ্গে বঙ্গ বা বাংলার সম্পর্ক দীর্ঘদিনের ও নিবিড়। ১৯০৫ সালে বঙ্গ বিভাগের পর পূর্ববঙ্গ ও আসাম মিলে একটি প্রদেশ গঠিত হয়েছিল। যদিও তার স্থায়িত্ব ছিল স্বল্পকাল অর্থাৎ ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গ বিভাগ রদ ঘোষিত হওয়া পর্যন্ত। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আসাম জুড়েই ছিল মওলানা ভাসানীর রাজনীতির বিচরণ ক্ষেত্র। আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগ নেতা ও পরবর্তীতে পাকিস্তানের মন্ত্রী, যিনি জিন্নাহ সাহেবেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন, আবদুল মতিন চৌধুরীর শিলং (বর্তমানে মেঘালয়ের রাজধানী) —এর বাড়ি ছিল তাঁর রাজনৈতিক ঘাঁটি। বেগম চৌধুরী ফখরুন নেসা খাতুনের সঙ্গে তাঁর ভাই—বোনের মতো সম্পর্ক ছিল। নাগা নেতা, এ. জেড. ফিজো, যিনি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট নাগা রাজ্যের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, মওলানার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল। আসামের অভিবাসী বাঙালি কৃষক ও নিপীড়িত জনগোষ্ঠির মাঝে তিনি প্রথম বর্ণবাদ বিরোধী ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক চেতনার জন্ম দেন। বাংলা—আসামে আন্দোলন সংগ্রামের নতুন এক ভাষা সৃষ্টি করেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কিংবা মুসলিম লীগের নবাব, জমিদার, নাইট, লাখেরাজদের রাজনীতির বাইরে নতুন এক গণমূখী ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সূত্রপাত ঘটে তাঁরই হাত ধরে। পরবর্তীতে এই গণমূখী রাজনীতিই তিনি সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন প্রথমে আওয়ামী লীগ ও পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠনের মধ্য দিয়ে।

মওলানা ভাসানী ১৮৯৭ সালে প্রথমবারের মতো উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি শাহ্ সৈয়দ নাসিরুদ্দীন আহমদ বোগদাদী (রহ.) এর সাথে আসামের জলেশ্বর গমন করেন। (Socio-Political Awakening of The Muslims of Assam- 1871 to 1980 by Shabnam Bahar Parveen)।বোগদাদী (রহ.) এর কাছে তিনি আরবি—ফার্সী—উর্দু শেখেন এবং কোরআন—হাদিস—ফেকাহ সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান লাভ করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গ ভাগের ফলে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা—হাঙ্গামা নিরসনে বোগদাদী (রহ.) এর নেতৃত্বে গঠিত ‘হক্কুল এবাদ’ মিশনের সদস্য হিসেবে তিনি জলেশ্বর ও এর আশপাশের অঞ্চলে জাতি—ধর্ম—বর্ণ—নির্বিশেষে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিরসনে কাজ করেন। এসময় স্থানীয় জনগণের কাছে তিনি ছোট হুজুর বা মৌলবী আবদুল হামিদ নামে পরিচিতি পান। আবদুল হামিদের প্রতিভার বিচ্ছুরণে মুগ্ধ হয়ে বোগদাদী (রহ.) তাঁকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের জন্য দেওবন্দ দারুল উলুমে (বিশ্ববিদ্যালয়) পাঠান। ১৯০৭—০৯ সাল পর্যন্ত সেখানে অধ্যয়নকালে তিনি শায়খুল হিন্দ মওলানা মাহমুদুল হাসান ও শায়খুল ইসলাম সৈয়দ হোসেন আহমদ মাদানীর প্রত্যক্ষ সাহচর্যে ইসলামের বৈপ্লবিকধারার সাথে পরিচিত হন। এখান থেকেই তিনি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক দর্শনে উদ্বুদ্ধ হন এবং রবুবিয়াতের দীক্ষা গ্রহণ করেন। অনুধাবন করেন, পৃথিবীতে শ্রেণি মাত্র দু’টি— একটি শোষক, আরেকটি শোষিত। সিদ্ধান্ত নেন শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতীত, নিপীড়িত, মেহনতি, মজলুম মানুষের পাশে থেকে তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করবেন। আসামের নিপীড়িত বাঙালি আর দারিদ্রপীড়িত মানুষগুলো তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে। ক্রমে মওলানা ভাসানী হয়ে ওঠেন অত্রাঞ্চলের নিপীড়িত মানুষের মুখপত্র। এরপর থেকে আসামে তাঁর পরিচয় একজন দুর্বিনীত কৃষকনেতা ও আধ্যাত্মিক পীর হিসেবে। ইত্যবসরে মওলানা ভাসানী ১৯১৭ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জাতীয়তাবাদী দলের সমর্থক হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯১৯ সালে তিনি মওলানা মোহাম্মদ আলী ও চিত্তরঞ্জন দাশের অনুপ্রেরণায় কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং অসহযোগ অন্দোলনে অংশগ্রহণের দায়ে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করেন।

ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ প্রথম যেদিন মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করে ধুবরীর পথে রওনা হচ্ছিল, পেছনে হাজার হাজার জনতার আহাজারী সেদিন আকাশ বাতাস ভারী করে তুলেছিল। ধুবরীর জেলখানা তাঁকে পরিশ্রান্ত করে তুলেছিল। কিছুদিন পর স্থানান্তরিত হয়ে চলে গেলেন কলকাতার দমদম জেলখানায়। কারাগারে তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রসেনানীদের— দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস, মহাত্মা গান্ধি, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, হাসান ইমাম, হেকিম আজমল খা, সাইফুদ্দিন কিচলু, ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী, গোপাল কৃষ্ণ গোখলে, মতিলাল নেহরু, সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফ্ফার খান, আচার্য প্রফুল্ল রায়, বলগঙ্গাধর তিলক, মদনমোহন মালব্য, সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় প্রমুখের সাথে। জেলখানায় এসব মহীরুহের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলাপচারিতা তাঁকে আরও বেশী শাণিত করে। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহনের কারণে ডিসেম্বরে ফের তিনি গ্রেফতার হন এবং সপ্তাহখানেক হাজতে কাটান। ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু স্বরাজ্য পার্টি গঠন করলে ভাসানী কংগ্রেসের ভেতরে থেকেই সেই দল সংগঠিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এসময় পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রামে গ্রামে সামন্তবাদবিরোধী আন্দোলন শুরু করায় জমিদাররা তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ব্রিটিশরাজ ও স্থানীয় জমিদারদের ষড়যন্ত্রে পূর্ববঙ্গে টিকতে না পেরে ১৯২৪ সালে তিনি আসামের ধুবরী গমন করেন। একই বছর ধুবরী জেলার ভাসানচরে অভিবাসী বাঙালি কৃষকদের বিশাল সম্মেলন আয়োজন করে ভাসানচরের মওলানা থেকে ‘মওলানা ভাসানী” উপাধি লাভ করেন। পরবর্তী প্রায় দুইদশক ধরে মওলানা ভাসানী আসামের অভিবাসী বাঙালিদের অধিকার রক্ষায় অধিক মনোনিবেশ করতে থাকেন। মূলতঃ এই সময়ে তিনি অতিমাত্রায় আসাম আসক্ত না হলে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারতেন বলে অনেকেই ধারণা করেন।

মওলানা ভাসানীর লড়াই—সংগ্রাম কেবল বাঙালি কৃষকদের ভূমির অধিকার নিয়ে ছিল না। তাদের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্যও তিনি কাজ করেছেন। শিক্ষা নিয়ে তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষার অপর্যাপ্ততাই সকল সমস্যার মূল। তাই তিনি দরিদ্র কৃষক সন্তানদের পড়াশোনার জন্য প্রত্যেক গ্রামে কমপক্ষে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেন। এছাড়া যারা দিনের বেলা স্কুলে যেতে পারতো না তাদের জন্য ১৯৩৮ সালে তিনি সরকারি উদ্যোগে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। দূরবর্তী ছাত্রদের পড়াশুনায় উদ্বুদ্ধ করতে তিনি ‘জাইগির’ (লজিং) প্রথা চালু করেছিলেন। ভাসানীর আসাম জীবনে তিনি সেখানে প্রায় ৩০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ভাসানীচর জে. বি. স্কুল, ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত আসামের প্রাচীনতম মাদ্রাসা ভাসানীচর এম. ই. মাদ্রাসা এবং ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হামিদাবাদ আদর্শ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় যাদের মধ্যে অন্যতম। আসাম—বাংলা মিলিয়ে তিনি প্রায় ৫০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জানা যায়। ১৯৩৫—১৯৩৬ সালের দিকে গৌরিপুরের মহারাজার সাথে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা নিয়ে তাঁর প্রত্যক্ষ লড়াই হয়েছিল। দক্ষিণ শালমারা নামক এলাকায় “প্রজাবন্ধু হাইস্কুল” নামে তিনি যে প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন, তাতে মহারাজার ছিল ঘোরতর আপত্তি। স্কুল প্রতিষ্ঠা শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে চাইলেও অন্ততঃ “প্রজাবন্ধু” নাম বদলাতেই হবে; মহারাজার এমন দাবি মওলানা মেনে নিতে পারলেন না। লেলিয়ে দেয়া হাতির পাল ঠেকাতে ব্রহ্মপুত্র বিধৌত দক্ষিণ শালমারায় তিনি ঘাঁটি গাড়লেন। এমন সময় ব্রহ্মপুত্রের অপর পাড় হামিদাবাদ থেকে স্নেহময় বড় পুত্রের টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ার খবর এলো। রণেভঙ্গ দিয়ে স্থানত্যাগ করলে প্রতিষ্ঠান থেকে প্রজার নাম মুছে যেতে পারে ভেবে তিনি পিতৃ—বাৎসল্য চেপে রাখলেন। এরপর আবার খবর এলো, আদরের আজীজুল হক খান মৃত্যুবরণ করেছেন। তখন তার বয়স হয়েছিল মাত্র ১২/১৩ বছর। তখনও মওলানা ভাসানী আপন—ভূবন পানে তাকাননি, তাকিয়েছিলেন মজলুম প্রজাবৃন্দের দাবি প্রতিষ্ঠার প্রতি। তাই সংবাদ—বাহককে জানিয়ে দিলেন, পুত্রের জানাজায় শরীক হবার ফুসরত তাঁর নেই। ‘আমার হয়ে সে কাজ তোমরা কর, তোমাদের কাজ আমি করছি।’ এই ছিল মওলানা ভাসানীর জীবন।

১৯৩৫ সালের দিকে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আসামে লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলন ব্যপকতা লাভ করে। এসময় প্রদেশের রাজধানী গৌহাটিসহ বাঙালি অধ্যুষিত জেলা ও মহকুমাগুলোতে প্রতিদিন মিছিল—সমাবেশ হতে থাকে। এমনি একটি প্রতিবাদ মিছিলে আসাম সরকারের পুলিশ গুলি চালালে ঘটনাস্থলে তিনজন আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয় এবং প্রায় ২৫ জন আহত হন। পুলিশ মিছিল থেকে অসংখ্য নেতা—কর্মীকে গ্রেফতার করে। প্রদেশের অন্যান্য এলাকা থেকেও আন্দোলনরত নেতা—কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। এই আন্দোলনের একপর্যায়ে ভাসানীকে গৌরিপুরের মহারাজার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়েছিল। সেকালে ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত গৌরিপুরের হিন্দু মহারাজারা বংশানুক্রমে কৃষক প্রজাদের ওপর নির্মম শোষণ—নির্যাতন চালাতো। খাজনা না দেয়ার অভিযোগে বাড়ি ও জমি থেকে প্রজাদের উচ্ছেদ করতো। এমনকি নিজেদের কর্তৃত্ব ফলানোর উদ্দেশ্যে প্রকাশ্যে হত্যা পর্যন্ত করতো। হিন্দু—মুসলমান নির্বিশেষে কৃষক প্রজাদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালালেও বিশেষ করে মুসলমানদের ওপর চলতো সাম্প্রদায়িক নির্যাতন। মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, এমনকি পবিত্র ঈদুল আজহার সময়ও তারা গরু জবেহ বা কোরবানী করতে পারতেন না। মহারাজার এ ধরনের শোষণ—নির্যাতনের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আন্দোলনের প্রাথমিক দিনগুলোতে কৃষক—প্রজাদের প্রতি শোষণ—নির্যাতন বন্ধ করে তাদের প্রতি সদয় ও মানবিক আচরণ করার জন্য তিনি মহারাজা প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়ার প্রতি আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু সে আবেদনে সাড়া দেয়ার পরিবর্তে নানাভাবে তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা পর্যন্ত করা হয়েছে। একবার প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়ার লাঠিয়াল বাহিনী হাতির পাল নিয়ে মওলানা ভাসানীর ওপর আক্রমণ করলে কৃষক নেতা কসিমউদ্দিন দেওয়ান (কিংবদন্তির কইছ্যা ডাকাত) তার কৃষক সমিতির দলবল নিয়ে রামদা দিয়ে হাতির সুর কেটে তাঁকে রক্ষা করেন বলে জনশ্রম্নতি রয়েছে।

মহারাজার শোষণ—নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও জমিদার—মহাজন বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে ১৯৩২ সালে মওলানা ভাসানী অনশন ধর্মঘট শুরু করেছিলেন। ফলে জমিদার—মহাজনবিরোধী আন্দোলন গৌরিপুর মহারাজার শাসনাধীন অঞ্চল ছাড়িয়ে বাংলা—আসামের বিভিন্ন এলাকায় দানা বাঁধতে শুরু করে। হিন্দু—মুসলমান নির্বিশেষে কৃষক—প্রজারা একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন মওলানার অনশনের সঙ্গে। বিশেষ করে গৌরিপুর অঞ্চলের উপজাতীসহ জঙ্গি কৃষক—প্রজারা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর আশংকায়। এমনকি তারা সশস্ত্র প্রতিরোধের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। উদ্বিগ্ন কৃষক—প্রজারা তাঁর প্রতি অনশন প্রত্যাহার করে নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। একই অনুরোধ জানাতে কৃষক—প্রজা পার্টির নেতা শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক কলকাতা থেকে আসামের ধুবরীতে এসেছিলেন। এসেছিলেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ। শেরে বাংলা ফজলুল হক আসাম সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন এবং তার ফলে বন্দি অনেক নেতা—কর্মী মুক্তি পেয়েছিলেন। আন্দোলনরত উদ্বিগ্ন কৃষক—প্রজা ও আগত ফজলুল হকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের অনুরোধে ১৩ দিন পর মওলানা ভাসানী অনশন ভেঙেছিলেন। এসময় আসামে বসবাসরত বাঙালিদের বৈধ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়াসহ আসাম প্রাদেশিক পরিষদে বাঙালিদের জন্য নয়টি সংরক্ষিত আসন যুক্ত করা হয়েছিল। এরকম একটি আসন থেকেই মওলানা ভাসানী ১৯৩৭—১৯৪৬ সাল পর্যন্ত নয় বছর আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচিত সদস্য বা এমএলএ ছিলেন।

অনশন ভাঙার কিছুদিন পর মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ভাসানচরে এক বিশাল কৃষক—প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। হিন্দু—মুসলমানের পাশাপাশি সম্মেলনে গারো, রাবা ও খাসিয়াসহ উপজাতীয়রাও যোগ দিয়েছিলেন। কলকাতা থেকে এসেছিলেন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকসহ বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ। তিন লাখেরও বেশি কৃষক—প্রজার সমাবেশ ঘটেছিল সেই সম্মেলনে। যোগদানকারীদের খাওয়ানোর জন্য চারশ’র বেশি গরু ও ছাগল জবেহ করা হয়েছিলো। এই সম্মেলন সম্পর্কে মওলানা ভাসানী পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘…সম্মেলনে মরহুম শেরে বাংলা ও পাক—ভারতের তিনশ’ বিখ্যাত নেতা যোগদান করেন। গৌরিপুরের মহারাজা প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়া মুসলমান প্রজাদেরকে গরু জবেহ করিতে দিতেন না। যদি কেহ গরু জবেহ করিত, তবে তাহাকে বাড়ি—জমি হইতে উচ্ছেদ করা হইত। ভাসান চরের সম্মেলনে লাখ লাখ লোককে গৌরিপুরের মহারাজের বে—আইনি আদেশের বিরুদ্ধে ৭ হাজার মণ চাউলের ভাত ও ৩৯৬টি গরু জবেহ করিয়া খায়ানো হয় এবং গৌরিপুরের মহারাজের বে—আইনি আদেশের অবসান ঘটানো হয়। সম্মেলনের বিরাট খরচ গরীব জনসাধারণই বহন করিয়াছিল।’ (সংগ্রামী জননেতা মওলানা ভাসানী’, মোশাররফ উদ্দিন ভূঞা ও আবুল ওমরাহ মুহম্মদ ফখরুদ্দীন সম্পাদিত সংকলন, প্রকাশক শফিউর রহমান খান, চলন্তিকা বইঘর, ঢাকা, জানুয়ারী ১৯৭০)। কিংবদন্তী কৃষক নেতা প্রাণেশ বিশ্বাস, যিনি একসময় মওলানা ভাসানীর সঙ্গে ভাসান চরে কৃষকসভার ইউনিট গড়ে তুলেছিলেন, মনে করতেন, মওলানা গৌরীপুর রাজ বিরোধী আন্দোলনের সময় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

আসামের বঞ্চিত জনসাধারণ, বিশেষ করে অভিবাসী বাঙালি কৃষকদের ওপর শোষণ—নিপিড়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে মওলানা ভাসানী যে আন্দোলন শুরু করেন; তা ‘লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলন’ নামে খ্যাত। আসাম সরকার ১৯২০ সালে এই কুখ্যাত ‘লাইন প্রথা’ প্রবর্তন করে। ‘লাইন প্রথা বিরোধী আন্দোলনকে’ বেগবান করতে ১৯৩৭ সালে তিনি অভিবাসী বাঙালি কৃষকদের সংগঠিত করে ‘আসাম চাষী মজুর সমিতি’ গঠন করেন। মওলানা ভাসানী ছিলেন এই সমিতির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নূরুল হক। এ সমিতি লাইন প্রথার বিরুদ্ধে সভা—সমাবেশের মধ্য দিয়ে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলে। এসময় তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বিপিন চক্রবর্তী ‘ধুবরী ম্যাচ ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে (অমলেন্দু গুহের মতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে) তিনি প্রথমবারের মতো আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েই পার্লামেন্টে ‘লাইন প্রথা বিরোধী’ বিল উত্থাপন করেন। একই সালে ‘ধুবরী ম্যাচ ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’ শ্রমিকদের ধর্মঘটে কেঁপে ওঠে আসাম অ্যাসেম্বলি। মওলানা ভাসানী সবসময় শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে কথা বলতেন এবং প্রয়োজনে অ্যাসেম্বলিতে বিরোধীদের সুরে কথা বলতেন। এক্ষেত্রে তিনি তাই করলেন। এসময় ব্যবস্থাপক সভায় তিনি বাংলায় বক্তব্য রাখতেন। একবার সংসদে প্রশ্নোত্তরকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী রামনাথ দাশ ইংরেজিতে উত্তর দিলে তিনি বলে ওঠেনঃ আমি বাংলায় উত্তর চাই…। পরবর্তীতে তারই প্রচেষ্টায় আসাম বিধান সভায় বাংলা ভাষা স্বীকৃতি লাভ করে। এটাই ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলা ভাষার প্রথম স্বীকৃতি।

১৯৩৯ সালের ১৯ নভেম্বর আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে লাইন প্রথার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় মওলানা ভাসানী কংগ্রেস সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। ১৯৪০ সালে ঘাঘমারীতে তাঁর নেতৃত্বে গোয়ালপাড়া জেলা প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন থেকে ‘গোয়ালপাড়া টিনেন্সি এক্ট’ এর সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়। সংশোধনীর প্রধান দাবিগুলো ছিল এরূপ: ১) বিজনি ও মেছপাড়া এস্টেটের ভাড়া কমানো; ২) কার্যকর ঋণ সমঝোতা বোর্ডের জন্য উপযুক্ত নিয়ম প্রবর্তন; ৩) গোয়ালপাড়ায় প্রাথমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ; এবং ৪) বাঙালি শিশুদের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি। পরে বিলটি ১৯৪৩ সালে ব্যবস্থাপক সভা কতৃর্ক সংশোধনকৃত আকারে পাস করা হয়।

১৯৪০ সালে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে মওলানা ভাসানী ‘লাইন প্রথা’ বিরোধী আন্দোলনের সাথে সাথে স্বাধীন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও যুক্ত হন। সেকালের অভিবাসী বাঙালী কৃষকদের আন্দোলনকে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ও সংহত করা ছিল তাঁর অন্য এক উল্লেখযোগ্য অবদান। এসময় জনহিতকর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সাধারণ মানুষ তাঁকে ‘খাদেমুল কওম’ খেতাব দিয়েছিলেন। একই বছর তিনি লাহোর অধিবেশনেও যোগদান করেন। অধিবেশনের প্রস্তাবসমূহ তাঁর মনে এক নতুন আশার সঞ্চার করে এবং অবিলম্বে তিনি লাহোর থেকে প্রত্যাবর্তন করে ভারতের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন—সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নেন। কিন্তু ১৯৪৬ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত লেজিসলেটার্স কনভেনশনে লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে মুসলমানদের রাষ্ট্রসমূহের জায়গায় ‘রাষ্ট্র’ শব্দটি ব্যবহার করা হলে তিনি এই বিকৃতির বিরোধিতা করেন।

আসামের অধিকারহারা বাঙালিদের অধিকার আদায়ের জন্য মওলানা ভাসানীর আত্মত্যাগ, সাধনা ও সংগ্রাম নিয়ে ভারতীয় গবেষক বিমল জে. দেব ও দিলীপ কে. লাহিড়ী অভিমত ব্যক্ত করেন, “Bhasani, one of the greatest leaders Assam has ever produced.” তৎকালীন আসামের প্রজাসাধারণ জমা—জমি আবাদ করতে পারলেও জমির মালিকানা তাদের ছিল না। জমিদার—ভূস্বামীরা তাদের খেয়াল খুশি মতো প্রজাদের উচ্ছেদ করতে পারতো। এহেন পরিস্থিতিতে মওলানা ভাসানী ভাসানচরে আসাম—বাংলা প্রজা সম্মেলন আয়োজন করে সীমিত আকারে হলেও তাদের ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এছাড়া আসামে গরু জবাই প্রথা চালুকরণ, ওজন পদ্ধতি সংস্কারসহ বিভিন্ন জনহিতকর কাজে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এসময় ভোক্তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা রাখার জন্য তাঁকে ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

১৯৪১ সালের ৩০—৩১ ফেব্রুয়ারি আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্মেলনে মওলানা ভাসানী আসামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্তির আবেদন জানান। ১৯৪২ সালের ৮ ও ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা—আসাম প্রজা সম্মেলনে তিনি সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন ৩১ মার্চ এর মধ্যে লাইন প্রথা বিলুপ্ত করা না হলে এপ্রিল থেকে তিনি ‘আইন অমান্য আন্দোলন’ শুরু করবেন। আল্লামা আজাদ সোবহানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে তিনি সবাইকে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ারও আহ্বান জানান। এতে ভীত হয়ে সরকার পরবর্তী এক বছর মওলানা ভাসানীর সভা সমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে। তারপরও তিনি আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁর চাপে পরে ১৯৪৩ সালের ২৪ আগস্ট এক সরকারি নির্দেশে লাইন প্রথাকে অনেকটা শিথিল করা হয়। ১৯৪৪ সালে তিনি ঘাঘমারীতে আরেকটি কৃষক সভা করেন। যেখানে কমিউনিস্ট নেতা কীর্তি বরদুলই উপস্থিত ছিলেন। মওলানা ভাসানী যদিও কখনোই কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন না, তবুও তিনি ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকদের সংগঠিত করতে কোনো ধরণের প্রচেষ্টাই বাকি রাখেননি। এটি ছিল সেই সময় যখন মুসলিম কৃষকেরা যেখানে যেখানে লাইন সিস্টেম অতিক্রম করেছিল, সেখান থেকেই তাদেরকে উচ্ছেদ করা হচ্ছিল। কৃত্রিমভাবে আদিবাসী ও স্থানীয় মুসলমান কৃষকদের সাথে বিরোধ বাঁধিয়ে দেয়া হচ্ছিল। ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসে ব্যবস্থাপক সভার বাজেট অধিবেশনে একজন উপজাতীয় বিধায়কের প্রশ্নের উত্তরে তিনি প্রদেশের অতিরিক্ত জমি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উপজাতি, হিন্দু ভূমিহীন কৃষক ও অভিবাসী বাঙালিদের মধ্যে বন্টনের দাবি জানান। একই বছর ৭—৮ এপ্রিল আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বড়পেটা অধিবেশনে আসামের মুক্তি আন্দোলনে স্যার সা’দ উল্লাহকে যুক্ত হবার আহ্বান জানান। এই অধিবেশনেই তিনি সর্বসম্মতিক্রমে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে তিনি কোকরাঝাড়ে অনুষ্ঠিত গৌরাঙ্গ—তরং কৃষক সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল।

১৯৪৪—৪৫ সালের দিকে ‘অহোম জাতীয় মহাসভা’র উস্কানীতে আসামে ‘বাঙ্গাল খেদা’ আন্দোলন চরম আকার ধারণ করতে থাকে। এর প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী মঙ্গলদই, বরপেটা, গৌহাটিসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বাঙালি উচ্ছেদ ও সরকারি নিপীড়নের প্রতিবাদ করেন এবং ‘বাঙ্গাল খেদা বিরোধী’ আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে আসামের সাধারণ নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ শুধুমাত্র তিনটি আসন ছাড়া বাকি সবকটি মুসলিম আসনে জয়লাভ করে। মে মাসের প্রথম থেকে তিনি বসতি উচ্ছেদ ও সরকারী নিপীড়নের প্রতিবাদে বরপেটায় আমরণ অনশন শুরু করেন। ৩১ মে তিনি অনশন ভঙ্গ করে মঙ্গলদই যান। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আবু জাফর শামসুদ্দিন তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ‘গন্তব্যস্থানে গিয়ে যে দৃশ্য দেখতে পাই কখনো ভুলতে পারব না। একটি পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে—পুড়িয়ে ভস্মীভূত করে দেওয়া হয়েছে, একটি কুঁড়েঘরও অবশিষ্ট নেই। গ্রামবাসীগণ যার যার ভিটায়, উন্মুক্ত আকাশতলে দুপুর রোদে দাঁড়িয়ে আছে। পানির কলসী পর্যন্ত ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এক স্থানে জীপগাড়িটা রেখে আমরা সবাই ঘুরতে লাগলাম। ভস্মীভূত একটা বাড়িতে স্ত্রী—পুরুষ মিলে ৮—১০ জন লোক। সহসা তাঁর মধ্য হতে ৫০—৬০ বছর বয়স্ক একটি লোক মওলানা ভাসানীকে দুই হাতে বুকে চেপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো, “আবদুল হামিদরে, এত দিন তুই কই আছিলি?” চোখ বুজলে এখনো আমি সেই দৃশ্য দেখতে পাই। মওলানা সহেবসহ আমরা কেউ চোখের পানি রুখতে পারিনি।’

আসামের অভিবাসী বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে সংহতি জাগানোর লক্ষ্যে ১৯৪৬ সালের ২৬ জুন মওলানা ভাসানী মঙ্গলদই করোনেশন ময়দানে এক মহাসম্মেলন আয়োজন করেন। সম্মেলনের ভাষণে তিনি অভিবাসী কৃষকদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘যেখানে পতিত জমি পাবে, সেখানেই চাষবাস শুরু করবে, অথবা বাড়িঘর নির্মাণ করে বসবাস করবে।’ তিনি সরকারের বিরুদ্ধে আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দেন। জনগণকে খাজনা বন্ধ এবং প্রয়োজনে বিনা টিকিটে রেলভ্রমণে উৎসাহিত করে তিনি বরদলৈ সরকারকে যক্ষার জীবাণুর সঙ্গে তুলনা করেন। হাজার হাজার অভিবাসী কৃষক লাঠিসোটা নিয়ে সে সম্মেলনে উপস্থিত হয় এবং পাকিস্তানের পক্ষে স্লোগান দেয়। সম্মেলন থেকে ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষসংগ্রাম দিবস’ ঘোষণা করে তিনি বলেন, ‘প্রত্যক্ষসংগ্রাম দিবস’ শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হবে। তবে নগাঁও ময়দানের সমাবেশ থেকে মিছিল করে গিয়ে তিনি কালেক্টরেটের ট্রেজারি বিল্ডিংয়ে ‘পাকিস্তান পতাকা’ ওড়াবেন। এ অবস্থায় সংঘাত এড়াতে কর্মকর্তারা এক কৌশল অবলম্বন করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, সূর্যাস্তের সময় কালেক্টরেটের সিপাইয়েরা ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে ফেলার পর ওই ফ্লাগস্ট্যান্ডে আন্দোলনকারী তিনটি মেয়ে এসে প্রস্তাবিত পাকিস্তানের পতাকা ওড়াতে পারবে। তারা সরে যাওয়ার পর সরকারি লোকেরা তা নামিয়ে ফেলবে। তাতে ভাসানীর দাবিও পালিত হবে, আবার অপ্রীতিকর প্ররিস্থিতিও এড়ানো যাবে। সরকারের এক গোপন নথিতে বলা হয়, “Before the meeting thousands of immigrants paraded the streets of Mongoldoi by Bhasani on the elephant back. The immigrants were armed with lathis and traffic was closed for several hours. The treasury and the court compound were surrounded and League flag planted [Confidential File No. RD 56 of 1946.]” ৭ নভেম্বর আইন অমান্য আন্দোলন উপলক্ষ্যে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে আসাম প্রাদেশিক লীগের সব জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের এক সম্মেলনে কংগ্রেস সরকারের ‘অত্যাচার, দুঃশাসন ও নৃশংসতা’র বিরুদ্ধে প্রস্তাব গৃহীত হয়।

আসামে হিন্দু—মুসলমান—আদিবাসী কৃষকের স্বার্থে কথা বলতে গিয়ে মওলানা ভাসানী শুধু কংগ্রেস সরকার নয়, তাঁর নিজ দল মুসলীম লীগ সরকারের বিরুদ্ধেও কথা বলতেন। একবার চাষীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম লীগের সা’দউল্লাহ সরকার সংসদে ভাগচাষী বিল উত্থাপন করে। সরকার জমির মালিক ও বর্গাচাষীদের মধ্যে অর্ধেক—অর্ধেক করে ফসল ভাগের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। কিন্তু মওলানা ভাসানীর দাবি ছিল— তিন ভাগের দুইভাগ পাবে বর্গাচাষী, আর একভাগ পাবে জমির মালিক। তিনি বিলের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাঁর প্রভাবে কংগ্রেসের পাশাপাশি সরকারি দলের সদস্যরাও বিলটির বিপক্ষে ভোট দেয়। ফলে সংসদীয় রীতি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়। মওলানা বলতেন, সা’দউল্লাহ ও বরদৈলয়ের মধ্যে তফাত শুধু টুপি ও টিকিতে। প্রকৃতপক্ষে কৃষকের স্বার্থের কারণে তিনি নিজ দলের প্রধানমন্ত্রীকেও বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি।

১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে বাহাদুরাবাদে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে বাংলা ও আসাম মুসলিম লীগ নির্বাহী কমিটির এক যৌথ জরুরী সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায়ও তিনি আসামের অভিবাসী বাঙালিদের উচ্ছেদ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। একই বছর ৩—৪ মার্চ ধুবরীতে তিনি বাংলা—আসাম মোজাহিদ সম্মেলন, সাহিত্য সম্মেলন, নওজোয়ান সম্মেলন ও ন্যাশনাল গার্ড সম্মেলন অনুষ্ঠিত করেন। এই সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়ে মাহমুদ আলী তাঁর স্মৃতিকথা Resurgent Assam– এ লিখেছেন, ‘খোলা মাঠ, সেখানে অনেক নতুন চালাঘর তৈরি হয়েছে। মাঝখানে প্রকান্ড প্যান্ডেল। চালাঘরগুলোতে প্রতিনিধিদের এবং অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মওলানা ভাসানী ঘুরে ঘুরে নিমন্ত্রিতদের সকল প্রকার সুবিধার দিকে নিজেই নজর রাখছেন এবং এ চালাঘর থেকে ও চালাঘরে ছুটোছুটি করছেন। …নজরে পড়ল মওলানা নিজ হাতে কুয়ো থেকে পানি তুলে বড় বড় বালতি ভরছিলেন বাংলাদেশ থেকে আগত মেহমানদের গোসলের জন্য। সম্মেলনে তিনি বাংলা এবং আসামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্ত করে দ্রুত পাকিস্তানের স্বাধীনতা দাবি করেন।’ ইনাম আহমদ চৌধুরী তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা প্যান্ডেলে ফেরার পর কিছুক্ষণের মধ্যে সম্মেলন আরম্ভ হলো। তার এতটুকু স্থানও খালি নেই। প্যান্ডেলের বাইরে খালি জায়গাতেও লোকে লোকারণ্য। মওলানা ভাসানী দাঁড়ালেন লাউড স্পিকারের সামনে। মুহুমুর্হু জিন্দাবাদ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল আকাশ—বাতাস। মওলানা ভাসানী পুরো দু’ঘন্টা ধরে বক্তৃতা দিলেন। তিনি দেশের ও জনসাধারণের সকল প্রকার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলেন। তিনি বললেন, “আসামের স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আসুন, আমরা সবাই এই মহান সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করি। আমরা ইস্পিত স্বাধীনতা লাভের পূর্বে সংগ্রাম বন্ধ করবো না।” বক্তৃতাকালে সবাই স্তব্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনছিল। অত বড় সভায় কোথাও টুঁ—শব্দটি পর্যন্ত হয়নি।’ ৫ মার্চ তিনি মুসলিম লীগের বিধান সভার সকল সদস্য ও নেতাদের নিজ নিজ এলাকায় তথা সমগ্র আসামে ‘অহিংসা ও অসা¤প্রদায়িক’ প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। অভিবাসী বাঙালি কৃষকদের ওপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে শুধু মুসলমান নেতারাই নন; অবলাকান্ত গুপ্ত, ব্রজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী প্রমুখ হিন্দু নেতা কঠোর ভাষায় সরকারী নীতির নিন্দা করেন।

মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ১৯৪৭ সালের ১০ মার্চকে ‘আসাম দিবস’ পালনের ঘোষণা করা হয়। নেতৃবৃন্দ জানান, ওইদিন গোয়ালপাড়া স্বাধীন হবে এবং সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আসামের বাকি অঞ্চল মুক্ত হবে। এ সময় হিন্দু—মুসলিম সাম্প্রদায়িক সংঘাতের আশঙ্কায় মওলানা ভাসানী অনেকটা ‘অহিংস অসহযোগের’ পন্থা অবলম্বন করেন। ‘আসাম দিবসে’ অহিংস অসহযোগের ভিত্তিতে আইন অমান্য আন্দোলনের কর্মসূচী উদ্বোধন করার জন্য তিনি দরং জেলায় এক সভা করার কথা ঘোষণা করেন। এদিন শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার অযুহাতে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। মাহমুদ আলী তাঁর Resurgent Assam গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ওই দিন ভাসানী গোয়েন্দা পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে একটি নৌকায় ব্রহ্মপুত্র পার হন। নদী পাড় হয়ে একটি গরুর গাড়ি জোগার করে, চাদর দিয়ে মাথা—শরীর ঢেকে গাড়োয়ান সেজে নিজে গাড়ি চালিয়ে তেজপুর টাউন হলে গিয়ে উপস্থিত হয়ে সবাইকে অবাক করে দেন। গোয়েন্দা পুলিশও, যারা তাঁকে আটক করার জন্যে সর্বত্র নিয়োজিত ছিল, হতবাক হয়ে যায়। কয়েক হাজার লোকের সমাবেশে তিনি নির্দেশ দেন, “দাবি আদায়ের জন্যে তোমরা জেলে যাও এবং বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হওয়ার পরিবর্তে প্রয়োজন হলে মৃত্যুবরণ করো। নিহত হলে তোমরা যে যেখানে বাস করছো, সেখানেই যেনো তোমাদের কবর দেওয়া হয়। সরকারি নির্দেশ মতো তোমরা ঘরবাড়ি ছাড়বে না।” সাম্প্রদায়িক সংঘাত এড়াতে তিনি এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ রাখারও নির্দেশ দেন। তারপরও সভাস্থল থেকে তাঁকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। এ সময়ের প্রভাবশালী কংগ্রেসী পত্রিকাগুলো লিখে, ‘মানকার চরে “কেল্লা” প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেখানে গোলাবারুদ নিয়ে মুসলমান মুজাহিদ বা স্বোচ্ছাসেবকেরা অবস্থান করছে আসামকে পূর্ব বাংলার সাথে যুক্ত করার জন্য এবং সে সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মওলানা ভাসানী, চর এলাকায় যাঁর সীমাহীন প্রতাপ ও প্রভাব।’ এসব প্রচারণার প্রত্যুত্তরে আবদুল্লাহ নুরুল হক, যিনি ভাসানীর কারাবাসকালে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অস্থায়ী সভাপতি ছিলেন, বলেন, ‘মানকার চর একটি রিলিফ ক্যাম্পমাত্র, অত্যাচারিত মুসলমান কৃষকেরা, যাঁদের ঘর নেই, বাড়ি নেই, সেখানে জড়ো হয়েছেন। তাঁরা একবারেই নিরস্ত্র।’ এদিকে কথিত কেল্লা ভেঙে ফেলার জন্য কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার এক বিশাল নিরাপত্তা বাহিনী সেখানে পাঠায়। তবে সেখানে কোনো রক্তপাত বা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি।

জনগণের অব্যাহত আন্দোলনের মুখে ১৯৪৭ সালের ২১ জুন মওলানা ভাসানী গৌহাটি জেল থেকে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়েই তিনি ৬—৭ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য সিলেটের গণভোটের প্রচারে নেমে পড়েন এবং পাকিস্তানের পক্ষে ‘কুঠার মার্কা বাক্সে’ ভোট চান । এই গণভোটে তিনি হিন্দু—মুসলমান উভয়েরই সমর্থন চান। সিলেটের গণভোটে সফলতার পর তিনি নতুন করে ধুবরী, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, শিলচর, গোয়ালপাড়া, নগাঁও, কাছার প্রভৃতি জেলায় গণভোট দাবি করেন। আসামকে পাকিস্তানে অন্তর্ভূক্তকরণের জোড়ালো দাবি জানান। ফলে আগস্টে ফের নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা প্রাপ্তির দিনও তিনি ভারতের কারাগারে বন্দি ছিলেন। অবশেষে সেপ্টেম্বরে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয় এই শর্তে যে, তিনি পাকিস্তানে চলে যাবেন। মুক্তি পাবার পরে তিনি গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারেন; এই আশঙ্কায় ভারত সরকার তাঁকে একটি জিপে করে আসাম সীমান্তে এনে পূর্ব পাকিস্তানে ঠেলে দিয়ে যায়। তিনি যেদিন আসাম ত্যাগ করেন, সেদিন ধুবরীতে এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়। সেখানে তিনি তাঁর ভক্ত, অনুসারী, সহকর্মীদের অন্যায়, অবিচার, শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে টিকে থাকার আকুলতা জানিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে বিদায় গ্রহণ করেন। এরপর সীমান্ত থেকে সোজা তিনি টাঙ্গাইল চলে আসেন।

১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে মওলানা ভাসানী আসামের ভক্ত—অনুসারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কয়েক দিনের জন্য আসাম যান। এটি ছিল তাঁর ব্যাক্তিগত ও অরাজনৈতিক সফর। তবুও ভারত সরকার এটিকে ভালো চোখে দেখেননি। যাবার কয়েকদিন পর ১৭ মার্চ তিনি গ্রেফতার হন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল তিনি নাকি সেখানে রাষ্ট্রবিরোধী কাজে লিপ্ত ছিলেন। তাঁর গ্রেফতারের প্রতিবাদে বাংলা ও আসামে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়। এসময় পূর্ব পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ জননেতা মওলানা ভাসানীকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করায় বিভিন্ন মহল থেকে আসাম সরকারের তীব্র নিন্দা করা হয়। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ধুবড়ী কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি কয়েকদিন সেখানে অবস্থান করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

১৯৫৪ সালে মওলানা ভাসানী ইউরোপ সফর শেষে দেশে ফিরতে চাইলে তাঁর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। তৎকালীন প্রাদেশিক গভর্নর ইস্কান্দার মীর্জা ঘোষণা করেন, দেশে ফেরামাত্র মওলানা ভাসানীকে একজন হাবিলদার দিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হবে। ফলে ইউরোপে স্বেচ্ছা নির্বাসন শেষে ৩১ ডিসেম্বর তিনি লন্ডন থেকে বোম্বের উদ্দেশ্যে রওনা হন। প্যারিসে যাত্রাবিরতি ও প্রবাসী বাঙালিদের অনুরোধে কয়েকদিন সেখানে কাটানোর পর তিনি ১৯৫৫ সালের ৫ জানুয়ারি বোম্বে পৌঁছান। এরপর বোম্বে থেকে কলকাতা এবং কলকাতা থেকে ১৫ জানুয়ারি তিনি বিমান যোগে আসামের রাজধানী গৌহাটি পৌঁছান। ওই দিন রাতেই তিনি গোয়ালপাড়া যান। ‘মৌলানা ভাসানীর আসাম ভ্রমণ— আসাম সরকার বিব্রত’ শিরোনামে আনন্দবাজার, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড প্রভৃতি পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কংগ্রেস সরকারের অসম নেতৃবৃন্দ ও দেশটির সংবাদপত্র দেশ বিভাগের পূর্ববর্তী সময়ের কর্মকান্ডের জন্য মওলানা ভাসানীকে একজন সাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করে। অথচ বাঙালি অভিবাসীদের উচ্ছেদ করতে তারা নিজেরাই ‘লাইন প্রথা ও বাঙ্গাল খেদার’ মতো বর্ণবাদী আচরণ অব্যাহত রেখেছিল। মওলানা ভাসানীর অনুসারীদের মধ্যে হাজার হাজার বাঙালি হিন্দু, আদিবাসী, বিশেষ করে দরিদ্র শ্রেণির সনাতন ধর্মাবলম্বী ছিল। অনেক হিন্দুবাড়িতে মাটির তৈরি ভাসানীর মূর্তি থাকতো। মৃৎশিল্পীরা মওলানার মাটির মূর্তি তৈরি করে হাট—বাজারে বিক্রি করতো।

গোয়ালপাড়ায় মওলানা ভাসানী তাঁর এক মুরিদের বাড়িতে ওঠেন। শীতের মধ্যে ক্লান্ত মওলানা দু’চার দিন সেখানে বিশ্রাম নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আগমনের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ায় স্রোতের মতো মানুষ তাঁর কাছে ভিড় করতে থাকে। যার বেশিরভাগই হতদরিদ্র মানুষ। এসময় দর্শনার্থীদের সঙ্গে তিনি রাজনৈতিক কথা—বার্তা এড়িয়ে চলতেন। তাঁর পুরোনো ভক্ত, অনুসারী, কর্মীদের খোঁজখবর নিতেন। ধর্মের কথা ও ইউরোপ সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতেন। এরপর ঘাগমারীতে (হামিদাবাদ) অবস্থিত তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল, মাদ্রাসা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেন। যতদ্রুত সম্ভব তিনি দেশে ফিরে যেতে চাইছিলেন। তাঁর দেশে ফেরা নিয়ে এক প্রতিক্রিয়ায় গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা বলেন, ‘ভাসানী যে ভারতের নাগরিক তার প্রমাণ তিনি কলকাতা থেকে আসাম যাবেন সে কথা নিজেই সাংবাদিকদের বলেছেন। আসামে তাঁর সম্পত্তি রয়েছে, তিনি সেখানে সেই সম্পত্তি দেখাশোনা করবেন।’ তিনি বলেন, ভাসানীর মতো একজন বিদেশি নাগরিক সম্পর্কে যে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন সরকার তাই নেবে।’ ফলে কলকাতায় তাঁকে প্রায় পৌনে চার মাস আটকে থাকতে হয়।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিলের মাঝামাঝি মওলানা ভাসানী আসাম সিমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সেখানে তাঁর এক সময়ের সেক্রেটারী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মঈনুল হক তাঁকে স্বাগত জানান। এরপর কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি ভারতীয় বাহিনীর কাছে অন্তরীণ হয়ে পড়েন। কলকাতা, দিল্লি, কোচবিহার, দেরাদুনে ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকেন। এসময় তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তাঁকে যেন আসামে থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। কিন্তু ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার নিশ্চয়ই ‘৪৭ পূর্ব তাঁর ভূমিকার কথা স্মরণ করে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সরে আসেনি। তখনও কংগ্রেসের বিরোধীতার কারণে মওলানা ভাসানীর চাওয়া সত্বেও আসামের কিয়দংশ বাংলার অংশ হতে পারেনি। আসামে তাঁর দুর্গ থাকা নিয়ে নিঃসন্দেহে ভারত সরকার এব্যাপারে কোন ঝুঁকি নিতে চাননি। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গকেও তিনি বাংলার সাথে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন বলে খবর প্রকাশিত হয়। এ প্রসঙ্গে ১৯৭০ সালের ১১ ডিসেম্বর কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা একটি সংবাদ পরিবেশন করে, যার শিরোনাম ছিল এমন— ‘স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য মওলানা ভাসানী আন্দোলন করবেন।’ সংবাদে বলা হয়: ‘বাঙালি বামপন্থি নেতা মওলানা ভাসানী গতকাল এখানে বলেন, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য তিনি আন্দোলন শুরু করবেন।

এক সাংবাদিক বৈঠকে ৮৯ বৎসর বয়স্ক মওলানা ভাসানী বলেন, আগামী মাসে ময়মনসিংহ জেলায় তাঁর গ্রাম সন্তোষে একটি সর্বদলীয় কমিটি করা হবে। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গ যদি ভারত থেকে বিভক্ত হয়ে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে চায় তবে স্বাগত জানানো হবে।’ এ সংবাদ থেকে মওলানা ভাসানীর প্রতি ভারতের মনোভাব অনেকটা আন্দাজ করা যায়। প্রসঙ্গক্রমে একবার ভারতীয় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে নির্মল সেন বলেছিলেন, ‘তাঁরা মওলানা সাহেবকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিত্রিত করতে চাইলেন। আমি বলেছিলাম, ধীরে বন্ধু ধীরে। মওলানা ভাসানী সম্পর্কে কোনো কথা বলতে গেলে একটু ইতিহাসের পাতা উল্টাতে হবে। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী বিধান রায় ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নামে তোরণ করেছিলেন। তখন তাঁকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ‘ভারতীয় এজেন্ট’ বলে, আর যাঁরা আখ্যা দিয়েছিলেন তাঁরাই সবার আগে ভারতে এসেছিলেন বাংলাদেশকে স্বাধীন করার নামে। নয়াদিল্লীর সাংবাদিক বন্ধুদের প্রশ্ন এরপর আর বেশিদূর এগোয়নি।’

মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মওলানা ভাসানী তাঁর শিষ্য মানিকউদ্দিন সরকারকে আসামে বসবাস করার জন্য জমি ক্রয় করার কথা জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন (ভাসানী সমীপে—নিবেদন ইতি,পৃষ্ঠা—১০১)। সেপ্টেম্বর—অক্টোবরে সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বসবাসের জন্য জমি—ঘর চেয়ে পরপর দু’টি চিঠি লিখেছিলেন (চাষী—মজুরের মওলানা ভাসানী,পৃষ্ঠা: ৭৪৯,৭৫০,৭৫১) তিনি। এসময় দিল্লিতে অবস্থানরত মওলানা ভাসানী আশঙ্কা করেছিলেন ভারত সরকার নানা অজুহাতে তাঁকে তাঁর নিজ দেশে ফেরাটা বিলম্বিত কিংবা অনিশ্চিত করতে পারে। অথবা নানান কারণে স্বাধীনতা যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে পারে। তখন ভারত সরকার কর্তৃক তাঁর ওপরে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া বহিস্কারাদেশ প্রতিসারণ ও নির্বিঘ্নে বসবাসের জন্য ইন্দিরা গান্ধীর দেওয়া জমি—ঘর কিংবা তাঁর ক্রয় করতে চাওয়া জমিকে সামনে এনে আসামে থেকে যেতে চাওয়ার বাসনা তাঁর অমূলক নয়। ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা শেষোক্ত চিঠিতেও তাঁর এই আকুতি প্রকটভাবে ফুটে ওঠে, ‘এই বুড়ো বয়সে স্ত্রী ও নাতনিদেরকে নিয়ে আসামের ধুবরী মহকুমার যে কোনো স্থানে বাস করার জন্য যদি আপনি পাঁচ একর জমিসহ কটি টিনের ঘরের ব্যবস্থা করে দেন তাহলে এই বদান্যতার জন্য আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকব। আসামের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আমি কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করব না।’ কিন্তু ভারত সরকার তাতেও মওলানা ভাসানীর ওপর আস্থা রাখতে পারে নাই। স্মর্তব্য যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে লন্ডন—দিল্লী হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারলেও মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরতে মওলানা ভাসানীকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ভারত সরকারের কাছে বঙ্গবন্ধুর পাঠানো টেলিগ্রামে সবুজ সংকেত পেয়ে তিনি দিল্লী থেকে সেনা প্রহরায় তাঁর প্রিয় আসাম হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন।

মওলানা ভাসানীকে বুঝতে হলে তাঁর আসাম জীবন বোঝাটা জরুরী। আসামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর হাজারো উপাখ্যান। এই আসামের ধুবরী জেলার আদাবাড়িতে ১৯৪৩ সালে তিনি প্রায় ৯৩২ বিঘা জমি ‘হামিদাবাদ ওয়াকফ্ স্টেট’ এর নামে দান করে গেছেন, যার দলিল নং ২০৫৬। সেখানে আজও তাঁর বসতভিটা রয়েছে। রয়েছে তাঁর ব্যবহার্য জিনিসপত্র। এই স্টেট দেখভালের জন্য ভারতীয় সরকারের আসাম ওয়াকফ্ বোর্ডের অধীনে একটি পরিচালনা কমিটি রয়েছে। যার প্রেসিডেন্ট হিসেবে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত একজন প্রথম শ্রেণির পদমর্যাদা সম্পন্ন কর্মকর্তা এবং মোতোয়াল্লী হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত একজন সরকারি কর্মকর্তা নিযুক্ত রয়েছেন। এছাড়া ভাসান চরে প্রায় ১৩ বিঘা জায়গা জুরে ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ভাসানীচর জে. বি. স্কুল, ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীচর মাদ্রাসা, মসজিদ, দরবার শরীফ ও তাঁর বড় ছেলে আজিজুল হক খান ভাসানীর কবর; ফকিরগঞ্জে ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হামিদাবাদ আদর্শ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়; সাতশিয়ায়— হামিদাবাদ মহাবিদ্যালয়, হামিদাবাদ কণিষ্ঠ মহাবিদ্যালয়, দরবার শরীফসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানে তিনি প্রায় পৌনে দুই’শ বিঘা জমি ভক্ত, মুরিদদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। তাঁর জন্য আসামে পাঁচ একর জমিসহ ক’টা টিনের ঘর চাওয়া নিশ্চয়ই আরাম—আয়েশ ভোগ করার জন্য নয়?

মওলানা ভাসানী প্রায়ই বলতেন, আসাম আমাকে টানে। ১৯৭৬ সালের নভেম্বরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি হয়তো সেইদিন জীবিত থাকিব না। একদিন না একদিন “বৃহত্তর বাংলা” হইবেই হইবে। কোনো জাতিকে চিরদিন বিভক্ত করিয়া রাখা যায় না।’ আসামকে তিনি তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করতেন। তাই একাত্তরের শেষ দিকে বাংলাদেশ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, সেই সময় অন্তরীণ থাকাবস্থায় ভাসানী তাঁর প্রিয় আসামের ভাগ্য বিড়ম্বিত মানুষের কথা নতুন করে ভেবেছিলেন কি? তিনি কি ভবিষ্যতের ডাকে সাড়া দিয়ে আসামের মজলুম মানুষের পাশে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে বসবাসের স্বীকৃতি স্বরূপ ভারত সরকারের কাছে জমি—ঘর চেয়েছিলেন? এই মানুষগুলোই যে একদা তাঁকে আবদুল হামিদ খান থেকে ‘মওলানা ভাসানী’ বানিয়েছিলেন। সেই দায়বদ্ধতা আজীবন তাঁকে দংশন করেছে। তাইতো শেষ বিদায় কালে তিনি তাদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থেকো।’ সংগৃহীত কবিতাটি সেই সময়ের আসামের মানুষের মনে মওলানা ভাসানীর প্রতি ব্যাপক ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ—

সাধের মওলানা আমার

সাধের মওলানা আমার

আই. এ. কলেজ কইরাছো জীবনে

বাড়ি করেছো আসাম বেঙ্গলে

লুঙ্গি জামা পরিধানো সর্বদা তোমার

সাধের মওলানা আমার

তুমি যেথায় বিরাজ কর

ব্রিটিশ গভমেন্ট হয় জড়োসড়ো

ভয়েতে তোমার

সাধের মওলানা আমার।

মহাত্মা গান্ধী ১৮৯৩ সালে আইনজীবী হিসেবে সর্বপ্রথম দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে পা রাখেন এবং ১৯১৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ প্রায় ২২ বছর সেদেশে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন। অপরদিকে মওলানা ভাসানী ১৮৯৭ সাল থেকে (সৈয়দ আবুল মকসুদের মতে ১৯০৪ সাল থেকে) ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় পাঁচ দশক আসামের নিপিড়িত বাঙালিদের অধিকার রক্ষায় বিশেষভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করেন। আসামের ‘লাইন প্রথা’ ও ‘বাঙ্গাল খেদা’ নামক বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তিনি প্রায় একা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। দু’জনেই নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ের বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে রাজনৈতিক জীবনের গোড়াপত্তন করেন। কিন্তু শ্রেণিচেতনার বৈপরিত্য ও সাধারণ মানুষের জন্য অতি সাধারণ বেশ—ভুষা সম্পন্ন একজন মজলুম জননেতা বলে মওলানা ভাসানীর এই বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন ইতিহাসের প্রাণপ্রদিপের আলোয় স্থান পায় নাই। যেমনটি মওলানা ভাসানীর অনুরোধ সত্ত্বেও সেদিন মহাত্মা গান্ধী কিংবা জিন্নাহ সাহেবেরা আসামের নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ান নাই। উপমহাদেশের রাজনীতিতে সেই বৈপ্যরিত্ত্বের রাজনীতি এখন আরও প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই গণমানুষের রাজনীতি আর ইতিহাসের প্রয়োজনেই মওলানা ভাসানী বারবার ফিরে আসে। যেখানে গণমানুষ ও মওলানা ভাসানীর আসাম জীবন একাকার।

সহায়ক গ্রন্থ:

১।শতাব্দীর জননেতা মওলানা ভাসানী (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড)— খন্দকার আব্দুর রহীম।

২। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, ভাসানীচরিত, ভাসানীর ভারত প্রবাস— সৈয়দ আবুল মকসুদ।

৩।চাষী—মজুরের মওলানা ভাসানী— আরেফিন বাদল।

৪।রাজনীতির মওলানা— মহিউদ্দিন আহমদ।

৫। ভাসানীর কথা, ভাসানী অ্যালবাম— আজাদ খান ভাসানী।

৬। Socio-Political Awakening of The Muslims of Assam- 1871 to 1980 by Shabnam Bahar Parveen under the supervision of Prof. B.L. Bhadani, Centre of Advanced Study, Department of History, Aligarh Muslim University, India, 2010.

৭। উইকিপিডিয়া ও বাংলাপিডিয়া।

You may also like