খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রিক বীর আলেকজান্দার সমগ্র এশিয়া জয় করার লক্ষ্য নিয়ে পাঞ্জাব প্রদেশ জয় করার পর সিদ্ধান্ত নেন আর পূর্বদিকে এগোবেন না, কেন? তিনি গুপ্তচর মুখে শুনেছিলেন যে বিপাশা নদীর দক্ষিণে একটি শক্তিশালী রাজ্য আছে যার নাম মগধ। তার রাজা তখন নন্দ বংশের সম্রাট ধননন্দ। আলেকজান্দার গুপ্তচরের কাছে আরও শুনেছিলেন যে গঙ্গার পূর্বে নিম্নবঙ্গে আরও একটি দুর্ধর্ষ শক্তিশালী রাষ্ট্র আছে। এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি ছিল। মগধ রাজ্যের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে ছিল বিপুল পদাতিক, রথ ও অশ্বারোহী সৈন্য। কিন্তু নিম্নগঙ্গার রাষ্ট্রে ছিল বিশাল রণহস্তীবাহিনী। আর এই রাষ্ট্রের যোদ্ধারা ছিল নৌযুদ্ধেও দারুণ পারদর্শী। সেই সময় অন্যান্য দেশীয় রাজাদের সৈন্যবাহিনীতে হস্তীবাহিনীর তেমন প্রচলন ছিল না। তাছাড়া আলেকজান্দারেরও হস্তীবাহিনী ছিল না। তিনি বুঝলেন ওই সংযুক্ত রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে গেলে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই তিনি ম্যাসিডনে ফিরে যেতে মনস্থ করলেন।
নিম্নবঙ্গে তখন যে রাষ্ট্র ছিল তার নাম গঙ্গারিডি। তাদের রাজধানী ছিল সমুদ্র উপকূলবর্তী বন্দর-শহর গঙ্গে (City of Gange)। আর এই রাজ্যের অধিবাসীরা হল গঙ্গারিডই।কোথা থেকে জানা গেল এই কাহিনী? দেশীয় কোনও লেখকের লেখা থেকে এসব জানা না গেলেও একাধিক গ্রিক, রোমান ও মিশরিয় লেখকের লেখা থেকে এই কাহিনির কথা জানা যায়। তন্মধ্যে অন্যতম মেগাস্থিনিসের লেখা “ইন্ডিকা”। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে তিনি লিখেছেন, গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের সামরিক শক্তির কথা শুনে তাদের আক্রমণ করতে বিদেশি রাজারা ভয় পেত। তিনি লিখেছেন, গঙ্গারিডিদের প্রচুর সংখ্যক বিশালাকার রণহস্তী ছিল। এই কারণে কোনও বিদেশি শক্তি তাদের পরাজিত করতে পারেনি।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে গ্রিক ঐতিহাসিক ডিওডোরাস “বিবলিওথিকা হিস্টোরিকা” গ্রন্থে লিখেছেন গাঙ্গেয় অববাহিকায় গঙ্গারিডইরা হল শ্রেষ্ঠ জাতি। তাদের বিরাট হস্তিবাহিনী থাকায় আলেকজান্দার তাদেরকে আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকেন। তাদের (গঙ্গারিডইদের) দেশ ৩০ স্টেডিয়া (এক স্টেডিয়া = ১৮৫ মিটার) প্রশস্ত সর্বাপেক্ষা বৃহৎ নদী দ্বারা ভারতের প্রত্যন্ত প্রদেশগুলি থেকে বিভক্ত। এ থেকে ধারণা করা অমূলক হবে না যে গঙ্গা ও পদ্মার মধ্যবর্তী অঞ্চল ছিল গঙ্গারিডি রাজ্য। আলেকজান্দার রাজা পুরুর মাত্র ৫০০ রণহস্তীবাহিনীর সাথে লড়াই করে শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করলেও খুব নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন। আলেকজান্দার কিছুটা ভাগ্যের সাহায্যও পেয়েছিলেন। যুদ্ধের আগের দিন বৃষ্টি হওয়ায় যুদ্ধক্ষেত্রে হাতিরা পিছলে যাচ্ছিল বলে হস্তীবাহিনীর সমস্যা হয়েছিল। সেখানে গঙ্গারিডি রাজ্যে ছিল চার হাজার রণহস্তীর বাহিনী। এই কারণেই তিনি যুদ্ধের পরিকল্পনা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ডিওডোরাস আরও লিখেছেন, আলেকজান্দার ‘ফেগেলাস’ নামে একজন দেশিয় রাজার কাছ থেকে গঙ্গা নদীর পরে প্রাসি ও গঙ্গারিডি রাজ্যের সংবাদ পেয়েছিলেন। এই রাজ্যের সম্রাট হলেন ‘জান্দ্রামেস’ (Xandrames)। তিনি কুড়ি হাজার অশ্বারোহী সৈন্য, দুই লক্ষ পদাতিক, দুই হাজার রথ এবং চার হাজার রণহস্তী নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত আছেন। আলেকজান্দার তাঁর মিত্র পুরুর কাছ থেকেও এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছিলেন। পুরু আলেকজান্দারকে জানিয়েছিলেন যে এই রাজা ছিলেন ‘নাপিতের পুত্র’। প্রথম শতাব্দীতে রোমান ঐতিহাসিক কুইন্টাস কার্টিয়াস রুফাস ‘ডি ভারবাস গেস্টো আলেকজান্দ্রি ম্যাগনি’ নামক গ্রন্থে আলেকজান্দারের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে ডিওডোরাসের অনুরূপ কথাই লিখেছেন। কেবল তিনি প্রাসি ও গঙ্গারিডি রাজ্যের রাজার নাম লিখেছেন ‘অ্যাগ্রাম্মেস’। মনে হয় জান্দ্রামেস ও অ্যাগ্রাম্মেস উচ্চারণভেদে একই ব্যক্তি। মগধে নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মহাপদ্মনন্দ। তিনি ভারতীয় বর্ণাশ্রমবিধি অনুযায়ী ছিলেন শূদ্র বংশীয় বা নাপিত। তিনি ‘উগ্রসেন’ নাম নিয়েছিলেন। তাঁর পুত্র ধননন্দ উগ্রসেনের পুত্র হিসেবে নাম নেন ‘ঔগ্রসেন’। জান্দ্রামেস বা অ্যাগ্রাম্মেস হল ঔগ্রসেন-এর বিকৃত গ্রিক উচ্চারণ। মহাপদ্মনন্দের পর নন্দ বংশের আট জন রাজা রাজত্ব করেন এবং ধননন্দের সময় আলেকজান্দার ভারত আক্রমণ করেন। গ্রিক শব্দে প্রাসি বলতে মগধ রাজ্যকে বোঝানো হয়েছে।
বিদেশি ঐতিহাসিকরা সম্ভবতঃ প্রাসি ও গঙ্গারিডি রাজ্যের একজন রাজা – এই ধারণা পোষণ করতেন। তবে ডাঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে বর্তমান বিহারের দক্ষিণ প্রান্তে প্রাসি বা মগধ এবং গঙ্গার মোহনায় ছিল গঙ্গারিডি রাজ্য। ডাঃ মজুমদার এবং সুন্দরবন গবেষক প্রয়াত নরোত্তম হালদারের মতে, সম্ভবতঃ বিদেশি আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে ধননন্দ মগধ ও গঙ্গারিডি রাজ্যের একটি কনফেডারেশন গঠন করেছিলেন। আর সেই কনফেডারেশনের সংযুক্ত রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র, যা বিদেশি ঐতিহাসিকদের লেখায় পালিবোথরা (Palibothra) নামে উল্লেখিত হয়েছে। ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, নীহাররঞ্জন রায় প্রমুখের মতে প্রাচীন গঙ্গোপদ্বীপে (Gangetic delta) গঙ্গারিডি গণরাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল এবং তারা এই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। সুদীর্ঘকাল এখানে কোনও রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এখানে সম্ভবতঃ দলগত প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা-চন্দ্রকেতুগড়ে ব্রাহ্মী ও খরোষ্টী লিপিতে খোদাই করা ‘গ ণ র ঝ দ’ শব্দ (যার অর্থ গণরাজ্যৎ) আবিষ্কৃত হওয়ায় এই মত সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী রোমান মহাকবি ভার্জিল (Virgil) তাঁর ‘ইনিড’ (Aeneid) কাব্যগ্রন্থে গঙ্গারিডি সৈন্যদের আক্রমণকে গঙ্গা নদীর উন্মত্ত প্লাবনের সাথে তুলনা করেছেন। আবার ‘জর্জিস’ (Georgics) কাব্যগ্রন্থে তিনি লিখেছেন যে তাঁর দরজায় তিনি গঙ্গারিডিদের যুদ্ধের দৃশ্য নিখাদ সোনা ও আইভরি দিয়ে উপস্থাপন করবেন। খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে রোমান কবি ভ্যালেরিয়াস ফ্লাক্কাস ‘আরগোনটিকা’ (Argonautica) নামক কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন, কৃষ্ণসাগরের উপকূলে গঙ্গারিডিরা সৈন্য সমাবেশ করে পৌরাণিক বীর জ্যাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। গঙ্গানদীর মোহনা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে রোমে বসে কবিরা যখন তাঁদের কবিতায় গঙ্গারিডিদের কথা উল্লেখ করেন তখন এটা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে গঙ্গারিডিদের শৌর্য-বীর্য তাঁদের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে রোমান ঐতিহাসিক প্লিনি “ন্যাচারালিস হিস্টোরিয়া” গ্রন্থে লিখেছেন, গঙ্গা নদীর শেষাংশ গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের উপর দিয়ে প্রবাহিত ছিল। খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতকে ভৌগোলিক সলিনাস লিখেছেন, গঙ্গা নদীর শেষ প্রান্তে বাস করে গঙ্গারিডই জাতি। মেগাস্থিনিসের বিবরণ উদ্ধৃত করে প্লিনি লিখেছেন যে একশো একটি জনগোষ্ঠী ছিল এবং তাদের আলাদা আলাদা রাজ্য ও রাজধানী ছিল। এই একশো একটি জনগোষ্ঠীর অন্যতম হল গঙ্গারিডই বা উচ্চারণভেদে গঙ্গাঋদ্ধ। নিম্নবঙ্গে এরাই ছিল সংখ্যাধিক্য। এরাই গঙ্গা নদীমুখে অবস্থিত সমস্ত দ্বীপ অধিকার করেছিল। আর এদের নাম অনুসারেই রাজ্যের নাম গঙ্গারিডি। সম্রাট হর্ষবর্ধনের সময় চিন দেশ থেকে আগত পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ (৬২৯-৬৪৫ খ্রিঃ)-ও গঙ্গে বন্দরের কথা উল্লেখ করেছেন, যদিও সেই সময় স্বতন্ত্র গঙ্গারিডি রাজ্য ছিল কিনা নিশ্চিত নয়।
যদি ধরেই নেওয়া যায় যে মেগাস্থিনিসের পরবর্তী লেখকরা তাঁর লেখার সাহায্য নিয়ে লিখেছেন তবে মিশরবাসী এক গ্রিক নাবিক নিজস্ব অভিজ্ঞতায় তাঁর সমুদ্রযাত্রার ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখেছিলেন খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে। বানিজ্য উপলক্ষ্যে তিনি বেশ কয়েকবার ভারতবর্ষে এসেছিলেন। তিনি ভারতের উপকূল ধরে পূর্বদিকে যাওয়ার সময় বামদিকে যা যা নদী বা জনপদ বা নগর দেখেছেন তার নিখুঁত বর্ণনা করেছেন। তাঁর এই ভ্রমণকাহিনীর নাম “পেরিপ্লাস্টেস ইরিথ্রাস থ্যালাসসেস” (ইংরেজিতে পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সী)। একসময় গ্রিকরা পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরকে একত্রে বলত ইরিথ্রি বা ইরিথ্রিয়ান সী। আর ‘পেরিপ্লাস’ কথাটির অর্থ সমুদ্রপথের নিশানা। সুতরাং বইটির নামের বাংলা অর্থ হল ইরিথ্রিয়ান সমুদ্রের পথনির্দেশিকা। বইটির প্রথম বঙ্গানুবাদ করেন ১৯২২ সালে যোগীন্দ্রনাথ সমাদ্দার। ১৯৮০ সালে কমল চৌধুরিও বঙ্গানুবাদ করেন। এই বইতে সেই নাম না-জানা বণিক গঙ্গা নদীর মোহনায় ‘গঙ্গে’ বন্দরের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন এই বন্দর-শহরে ব্যাপক বানিজ্য চলে। তেজপাতা, সুগন্ধি অঞ্জন তেল (Spikenard essential Oil), প্রবাল, মুক্তো ও উৎকৃষ্ট মসলিন সর্বাধিক রপ্তানি হয়। তিনি লিখেছেন, এই রাজ্যে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ছিল, যার নাম ‘ক্যালটিস’।
গ্রিক ভৌগোলিক ও জ্যোতির্বিদ ক্লদিয়াস টলেমি তাঁর “জিওগ্রাফিকে হুফোগেসিস” গ্রন্থে ‘ইন্ডিয়া ইন্ট্রা গাঙ্গেম’ অধ্যায়ে ভারতের বিবরনী ও মানচিত্রে নিম্নগাঙ্গেয় অববাহিকায় গঙ্গারিডি রাষ্ট্র ও গঙ্গে নামক বন্দর-রাজধানী উল্লেখ করেছেন। মানচিত্রে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ সঠিক না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে পেরিপ্লাসের লেখকের বিবরণ ও টলেমির মানচিত্রে ভিন্ন কিছু নেই। তাঁর মানচিত্র অনুযায়ী পশ্চিমে প্রাচীন সরস্বতী নদী থেকে পূর্বদিকে পদ্মা-মেঘনা পর্যন্ত ভূভাগকে তিনি গঙ্গারিডি রাষ্ট্র বলেছেন। সুতরাং নিম্নগাঙ্গেয় অববাহিকায় অর্থাৎ বর্তমান সুন্দরবন যে গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং সুন্দরবনের পশ্চিম প্রান্তে গঙ্গার মোহনায় যে গঙ্গে নগর ছিল তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
প্রাচীনকালে জনপদগুলিকে চার ভাগে ভাগ করা হত, যথা গ্রাম, ঘোষ, নগর ও সংবাহ। গ্রাম ও নগরের মধ্যবর্তী অবস্থা হল ঘোষ। এটি মূলতঃ নদীর তীরে যাযাবর বা গোপালকদের বাসভূমি। প্রাচীন ভারতীয় বৈয়াকরণদের লেখায় দেখা যায় “গঙ্গায়াং ঘোষঃ”। সুতরাং গঙ্গা নামক ঘোষ যেহেতু ছিল, পরবর্তীকালে তা থেকে নগরে উন্নীত হওয়া সম্ভব। অর্থাৎ গঙ্গানগর নামক বন্দর-নগর (যা রোমান লেখনিতে গঙ্গে) গড়ে ওঠা কল্পনা নয়।
খ্রিস্টের জন্মের ৪০০-৩০০ বছর আগে বেদব্যাসের লেখা মহাভারতে দেখতে পাই নিম্নগঙ্গা অঞ্চলে দ্বিতীয় পান্ডব ভীম ‘সাগরকূলের ম্লেচ্ছজাতি’-কে পরাস্ত করেছিল। শুধু তাই-ই নয়, ভীম সাগরতীরের সমস্ত ‘ম্লেচ্ছ’ নরপতিদের কাছ থেকে কর আদায় করেছিলেন। সুতরাং সুন্দরবন অঞ্চল জনমানবহীন ছিল না। সেখানে ‘ম্লেচ্ছ’ প্রজা ও শাসক ছিল। এই ম্লেচ্ছ জাতি বলতে কি গঙ্গারিডইদের বোঝানো হয়েছে?
রামায়ণে মহর্ষি বাল্মিকী যে ভগীরথের ‘রসাতলে’ গঙ্গা আনয়ণ লিখেছেন সেই রসাতল কি গঙ্গারিডি রাষ্ট্রভুক্ত সুন্দরবন? মহারাজ সগরের নাম অনুসারে সগরবংশীয় রাজাদের অধিকৃত দ্বীপের নাম হয়েছে সাগরদ্বীপ। রামায়নে লেখা হয়েছে যে সেখানে কপিলমুনির আশ্রম ছিল। প্রাচীন কাল থেকে গঙ্গাসাগরধামে কপিলমুনি, সগররাজা ও ভগীরথের প্রস্তর মূর্তির পূজা হয়ে আসছে। সুতরাং রামায়ণে বর্ণিত রসাতল আর গ্রিক ও রোমান লেখকদের গঙ্গা নামক জনপদ যে আসলে বৃহত্তর সুন্দরবন সে ব্যাপারে অধিকাংশ সুন্দরবন গবেষক সহমত পোষণ করেন।
বিশিষ্ট সুন্দরবন গবেষক প্রয়াত নরোত্তম হালদারের মতে, গঙ্গারিডি বা গঙ্গারিডই নামগুলি গ্রিকদের দেওয়া নাম। আসলে সেই সময় কী নাম ছিল তা আজ জানা মুশকিল। তবে তাঁর মতে, এই রাষ্ট্র আসলে ছিল শক্তিশালী পুন্ড্রবর্ধন রাষ্ট্র। আর এর রাজ্যবাসীদের বলা হত পৌন্ড্র। এরাই প্রাচীন সাগরকূলের বাসিন্দা। এই জনগোষ্ঠীকেই রোমান ও গ্রিক ঐতিহাসিকরা গঙ্গারিডই জনগোষ্ঠী নামে অভিহিত করেছেন। এই গঙ্গারিডই জনগোষ্ঠী অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সাথে মিলিতভাবে একটি রাজ্য ও জাতি (Nation) গঠন করেছিল।
এই গঙ্গাবন্দরের সৌজন্যে একসময় গঙ্গারিডইদের খ্যাতি বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিদেশের বহু বানিজ্যতরী যেমন এই গঙ্গানগরে এসে ভিড়ত তেমনই গঙ্গারিডইদের বহু বানিজ্যতরী এই বন্দর থেকে পাড়ি জমাত বিদেশে। নরোত্তমবাবুর মতে, গঙ্গারিডইদের আদি যুগ হল “নিম্নবঙ্গের গৌরবময় যুগ”। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টিয় তৃতীয় শতক পর্যন্ত সময়কালকে বলা যেতে পারে গঙ্গারিডইদের যুগ। সাতশ বছর ধরে যে গঙ্গারিডইরা সুন্দরবন অঞ্চলে সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে তুলেছিল তারা আজ কোথায়? তারা কি ম্যাজিকের মতো অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে? না, মনে হয় তারা সমাজ বিবর্তনের স্রোতে অন্যান্য জনজাতির সাথে মিশে গেছে। আবার ভিন্নমতও আছে। অনেক গবেষকের মতে, বর্তমানে সুন্দরবন অঞ্চলের আদি বাসিন্দা হিসেবে থাকা পৌন্ড্র (পোদ), বাগদি, কেওড়া, নমঃশুদ্র, রাজবংশী প্রমুখ জাতি হল গঙ্গারিডইদের বংশধর।
কোথায় ছিল ওই গঙ্গানগর বা গঙ্গে বন্দর? বিভিন্ন সুন্দরবন গবেষক এক্ষেত্রে বিভিন্ন মত দিয়েছেন। পরেশনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় “বাঙ্গালার পুরাবৃত্ত” গ্রন্থে বলেছেন যে গঙ্গানগরের অবস্থান ছিল বর্তমান বাংলাদেশের যশোহর জেলায়। সতীশচন্দ্র মিত্র তাঁর “যশোহর-খুলনার ইতিহাস” গ্রন্থে বলেছেন যে গঙ্গানগরের অবস্থান ছিল বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার দেগঙ্গায়। দেগঙ্গা নামটি এসেছে দ্বিগঙ্গা অর্থাৎ দ্বিতীয় গঙ্গা থেকে। তার মানে দ্বিতীয় গঙ্গানগর থাকা অসম্ভব নয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয়প্রবণ সুন্দরবনে প্রথম বন্দর-রাজধানী গঙ্গানগর হয়তো ধ্বংস হয়ে গেলে দেগঙ্গাতে গড়ে উঠেছিল দ্বিতীয় গঙ্গানগর রাজধানী। তবে ‘পেরিপ্লাস’-এর লেখকের বর্ণনাকে গুরুত্ব দিলে গঙ্গার মোহনায় ছাড়া অন্য কোথাও গঙ্গানগরের অস্তিত্ব ছিল বলে মনে হয় না। টলেমির আঁকা মানচিত্রও এই বক্তব্যকে সমর্থন করে। বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কল্যাণ রুদ্রের মতে, ডায়মন্ড হারবার শহর থেকে দক্ষিণে কুলপি ব্লকে গঙ্গার তীরে অবস্থিত হরিনারায়নপুর নামক প্রত্নস্থলটি সম্ভবতঃ গঙ্গানগর ছিল। তবে নরোত্তম বাবুর মতে, বর্তমান সাগরদ্বীপ হল ‘পেরিপ্লাস’-এ বর্ণিত অতীতের ওই গঙ্গানগর বন্দর। ঐতিহাসিক ডঃ দীনেশচন্দ্র সরকারও বলেছেন যে গঙ্গা নদী ও সাগরের মিলনস্থল ছাড়া অন্য কোথাও গঙ্গারিডিদের রাজধানী গঙ্গানগর হওয়া সম্ভব নয়। তবে সময়ের স্রোতে গঙ্গানগর তলিয়ে গেছে সমুদ্রগর্ভে। আজ সেই লুপ্ত সমৃদ্ধ নগরের কিছু অবশেষ মিলতেও পারে সাগরদ্বীপে খননকার্য চালালে।
গঙ্গারিডইরা যে ছিল মূলতঃ পৌন্ড্র জাতি সে বিষয়ে সব ঐতিহাসিকই একমত। এদের ভাষা ছিল পূর্ব-প্রাকৃত থেকে প্রাকৃত-অপভ্রংশ। আর এদের লিপি ছিল ব্রাহ্মী, খরোষ্টী ইত্যাদি লিপি থেকে সৃষ্ট প্রাক-বঙ্গলিপি। অনেকের মতে নিম্নবঙ্গে আরও কিছু লিপি হয়তো প্রচলিত ছিল, কিন্তু সে-সব লিপি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। আর তাই সুন্দরবন অঞ্চলে প্রাপ্ত কয়েকটি সীলমোহরের পাঠোদ্ধার আজও সম্ভব হয়নি। সাগরকূলের গঙ্গারিডইরা ছিল ব্রাহ্মণ্যপ্রভাবমুক্ত স্বাধীন জনগোষ্ঠী। এদের যে বিরাট হস্তীবাহিনী ছিল তা আগেই বলা হয়েছে। এদের প্রতীক ছিল হাতি। কাকদ্বীপে প্রাপ্ত হাতির কঙ্কাল ও দাঁতের জীবাশ্ম থেকে এই বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। এদের সাথে গ্রিক ও রোমানদের যে বানিজ্যিক সম্পর্ক ছিল তা সুন্দরবনে প্রাপ্ত গ্রিক ধাঁচের টেরাকোটার মূর্তি দেখে বোঝা যায়। এদের মধ্যে পোড়ামাটির মূর্তি এবং হাতি, ঘোড়া, ষাঁড় ইত্যাদি টোটেম পূজার প্রচলন ছিল। তবে বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের সম্পদ ক্রমশঃ নিঃশেষিত হয়ে যায়। ফলে তাদের সাথে অন্যান্য দেশের বানিজ্যিক সম্পর্ক ক্রমশঃ কমে যায়। ফলে বিদেশেও গঙ্গারিডি নাম বিস্মৃতিতে বিলীন হয়ে যায়। তারপর এই অঞ্চলে ক্রমান্বয়ে বৌদ্ধ ধর্ম, ব্রাহ্মণ্যধর্ম, ইসলাম ধর্ম ও বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব পড়ে। পরবর্তীকালে ইংরেজদের আগমনের পর খ্রিস্ট ধর্মেরও প্রভাব পড়ে। বর্তমানে গঙ্গারিডই জনজাতির বংশধররা অধিকাংশই পৌন্ড্রক্ষত্রিয়, মুসলমান, বৈষ্ণব এবং সামান্য সংখ্যক বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান।
সুন্দরবন অঞ্চল তথা দুই ২৪ পরগনা হল প্রত্নসম্পদের আঁতুড়ঘর। গঙ্গারিডইরা যে শৌর্যের সাথে শিল্পেও দক্ষতা অর্জন করেছিল তার প্রমাণ দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বোড়াল, আটঘরা (বারুইপুর), হরিনারায়ণপুর (কুলপি), দেউলপোতা (ডায়মন্ড হারবার), পাকুড়তলা (কাকদ্বীপ), মন্দিরতলা (সাগরদ্বীপ), উত্তর ২৪ পরগনার চন্দ্রকেতুগড় (বেড়াচাঁপা, বারাসাত) ইত্যাদি স্থানে প্রাপ্ত নানা পুরাবস্তু থেকে পাওয়া গেছে। কিন্তু যত না আবিষ্কৃত হয়েছে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি অনাবিষ্কৃত। কারণ ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া সুন্দরবনের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার নিয়ে সরকারি উদ্যোগ খুব বেশি গৃহীত হয়নি। আর তাই গঙ্গারিডি রাষ্ট্র নিয়ে আজও অনেক মতামত, অনেক কল্পনা, অনেক সম্ভাবনার কথা উঠে আসে। আগামীদিনে হয়তো আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। হয়তো অনেক প্রশ্নের উত্তর কোনওদিন পাওয়াও যাবে না। কিন্তু তা বলে সুন্দরবন অঞ্চলে গঙ্গারিডি রাষ্ট্রের গৌরবময় ইতিহাস মিথ্যে হয়ে যাবে না।
সহায়ক গ্রন্থ / প্রবন্ধঃ
(১) গঙ্গারিডি – ইতিহাস ও সংস্কৃতির উপকরণ – নরোত্তম হালদার
(২) দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অতীত (প্রথম ও দ্বিতীয় খন্ড) – কালিদাস দত্ত
(৩) যশোহর-খুলনার ইতিহাস – সতীশচন্দ্র মিত্র
(৪) বাঙালির ইতিহাস-আদিপর্ব – নীহার রঞ্জন রায়
(৫)বাংলাদেশের ইতিহাস – রমেশচন্দ্র মজুমদার
(৬) সুন্দরবনঃ উৎসে ফেরা – কমল চৌধুরী (প্রবন্ধ)
(ছবিঃ উইকিপিডিয়া)