জল শব্দটা দুই অক্ষরের হলেও জল আমাদের জীবজগতের বেঁচে থাকার রসদ। এজন্যই আমরা বলি জলই জীবন। আমরা জানি পৃথিবীর আয়তনের প্রায় ৭১% জলভাগ এই মোট জলের আবার ৯৭.৫ শতাংশ সাগর মহাসাগরের সঞ্চিত ১.৯% হিমবাহ এবং তুষারাবৃত অঞ্চলে বরফ হিসেবে থাকে। বাকি 0.৬ শতাংশ জল ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত প্রাণী ও উদ্ভিদের জীবনধারণের জন্য নির্দিষ্ট।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি ব্যবহারযোগ্য জলের পরিমাণ অত্যাধিক কম। কিন্তু বিভিন্ন কারণে জল অপচয়ের জন্য আজ বিশুদ্ধ জলের মাত্রা অত্যাধিক হারে হ্রাস পাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি শিল্প আর্থসামাজিক উন্নয়নের অজুহাতে ভূগর্ভস্থ জল অত্যাধিক হারে উত্তোলন করা হচ্ছে। এর ফলে তীব্র জল সংকট দেখা দিচ্ছে। শিল্প ও নগর উন্নয়নের নামে বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ জল পাম্পের সাহায্যে মাটি থেকে বের করে আনা হচ্ছে।
দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ এখনো দূষিত জল পান করতে বাধ্য হয়। এর ফলে প্রায় কয়েক লক্ষ মানুষ জল বাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় যাদের সিংহভাগই গরীব খেটে খাওয়া মানুষ । এছাড়া মোট রোগের ৭২ %রোগ দূষিত পানীয় জলের কারণে হচ্ছে আর এর ফলে ওষুধ ব্যবসায়ীরা লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা মুনাফ অর্জন করছে। পানীয় জলের গুণগত মানের বিচারে বিশ্বের ১২২টি দেশের মধ্যে ১২০ নম্বরে আমাদের দেশ।
জল সংকটের কারণগুলি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় প্রধান কারণ গুলি হচ্ছে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ জল নির্বিচারে উত্তোলন, পরিবেশ দূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন, জীব বৈচিত্র এবং বৃক্ষ ছেদন, ট্রেন লাইন বা শিল্প কলকারখানা বা নগর সম্প্রসারণের জন্য প্রচুর বনাঞ্চল ধ্বংস করা। আবার সরকারি উদ্যোগে বা জমি মাফিয়া বেশীর ভাগ জলাশয় গুলো ভরাট করে ফেলছে। আসলে জলাশয়গুলি হল প্রকৃতির বৃক্ক ।
বর্তমানে খরা কবলিত দক্ষিণ ও মধ্য ভারতের জলের ট্যাংক বলা হতো পশ্চিমঘাট পর্বতমালাকে। ঘন অরণ্যে ঢাকা দক্ষিণ ভারতের সমস্ত নদী ঝরনার উৎস ছিল এই পর্বতমালা। সারা বছর প্রচুর বৃষ্টিপাতের জলকে ধরে রাখতে পাহাড়ের মাথায় ছোট ছোট হ্রদ কিন্তু অবৈধভাবে খনি,পর্যটন শিল্প, ও অপরিকল্পিত নগর উন্নয়নের কারণে হ্রদ গুলি বা জলাশয় গুলো ভরাট করে ফেলেছে ।সেখান থেকে জমি মাফিয়ারা লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা মুনাফা অর্জন করছে।
যেমন এই বছর মার্চ ২০২৪-এ সিলিকন ভ্যালি নামে খ্যাত বেঙ্গালুরুতে তীব্র জল কষ্ট দেখা দিয়েছে ।পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এক বালতি জল কিনে আনতে হচ্ছে হাজার দু হাজার টাকার বিনিময়ে। কিন্তু মজার বিষয় বেঙ্গালুরু একসময় পরিচিত ছিল ‘সিটি অফ লেকস’ নামে। একসময় এই শহরে প্রায় প্রায় ২৮৫টি হ্রদ ছিল এবং অনেকগুলো জলাধার ছিল কিন্তু উন্নয়নের জোয়ারে সেই সব হ্রদ ও জলাশয় গুলো ভরাট করে দিয়ে গড়ে উঠেছে বহুতল আবাসন,পর্যটন কেন্দ্র, রাস্তা ইত্যাদি।ফলে জলস্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। যতদিন যাবে জলের হাহাকার আরো বৃদ্ধি পাবে।
আরও লক্ষণীয়ভাবে আমরা দেখছি শহরগুলো বিউটিফিকেশনের নামে কংক্রিটে রূপান্তরিত হয়েছে. কোথাও এতটুকু উন্মুক্ত জায়গা নেই যেখান দিয়ে জল শোষণ হতে পারে। আমাদের অতি পরিচিত বহরমপুর শহর সহ ভারতবর্ষের প্রায় বেশীর ভাগ শহরে এর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়. সেখানেও জলাশয় গুলো ভরাট করে জমি মাফিয়ারা বহুতলা আবাসন গড়ে তুলেছে এবং সেগুলো চড়া দামে বিক্রি করছে তাতে একশ্রেণীর সরকারি আধিকারিক ও নেতাদের হয়তো মদত রয়েছে। কারণ তারাও এসব গুলো চোখে দেখেও না দেখার ভান করে থাকে বা অভিযোগ করলেও কোন পদক্ষেপ নেন না।
২০১৪ সালে সরকার গ্রামাঞ্চলে মাথাপিছু চল্লিশ লিটার জল দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা কিন্তু বাস্তবে হয়নি। কিন্তু, প্রশ্ন হলো ভারতের মতো নদীমাতৃক দেশে জল সংকট কেন? ১৯০ কোটি ঘনমিটার ক্ষমতা সম্পন্ন নদ নদীর মাত্র ৭০ হাজার ঘন মিটার জল আমরা ব্যবহার করি বাকিটা কিন্তু সমুদ্রে চলে যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতবর্ষে জলের প্রয়োজন তিন হাজার বিলিয়ন ঘন মিটার আর প্রতিবছর বৃষ্টির মাধ্যমে ভারতের জল পাওয়া যায় চার হাজার বিলিয়ন ঘন মিটার। প্রায় ৬৫ শতাংশ জল কিন্তু সমুদ্রে চলে যায়। সেগুলো কাজে লাগাতে পারিনা আমরা।
সুতরাং দেখতে পাচ্ছি জলের মাত্র ২৮ শতাংশ ব্যবহার করা হয়। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও কেন জল ব্যবহারে সুষ্ঠু পরিকল্পনা সরকারের নেই ?কেনই বা সরকার এ ব্যাপারে এত উদাসীন?
মার্কিন সফটড্রিংকস কোম্পানি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের গ্রাম অঞ্চলে অবাধে মাটির ভিতর থেকে জল নিচ্ছে কিন্তু আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়াসহ বিভিন্ন প্রদেশে এই কোম্পানিগুলোকে মাটি থেকে জল নিতে দেওয়া হয় না। সাধারণ মানুষ যে পয়সা দিয়ে জল কিনে তার থেকে অনেক কম দামে সরকার জল ব্যবসায়ীদের দিচ্ছে। সাধারণত ১ লিটার জল আমরা কিনি কুড়ি টাকায়। কোম্পানিগুলো পায় প্রতি লিটার ২০ থেকে ২৫ পয়সায়। শুধুমাত্র কোকাকোলা কোম্পানির একটি কারখানায় দৈনিক পাঁচ লক্ষ লিটার জল লাগে। দেশের এই কোম্পানির ৫৮ টি কারখানার সঙ্গে অন্যান্য কোলড্রিংকসের কোম্পানি কে নিয়ে হিসাব করলে যা জল নষ্ট করে তা ভাবলে চোখ কপালে উঠে যাওয়ার জোগাড় হয়। এবং এই বহুজাতিক সংস্থাগুলো যে সমস্ত প্লাস্টিক দূষণ করে তা প্রতিটি কারখানা তিন কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে সমস্ত জলকে দূষিত করে। শুধু সফটড্রিংকস নয় এর সঙ্গে যুক্ত বোতলবন্দী জলের রমরমা ব্যবসা যার পরিমাণ সফট ড্রিংকস ব্যবসার দ্বিগুণ।
জল সংকট বাড়ছে। পাশাপাশি বোতলবন্দী জলের ব্যবসা প্রতিবছর হু হু করে বাড়ছে। ভারতের প্রায় অনেক লাইসেন্স প্রাপ্ত জলের ব্যান্ড রয়েছে। শুধু দিল্লী-গুরগাতে লাইসেন্সবিহীন তিন হাজার পানীয় জলের কোম্পানি আছে।তাহলে সমগ্র দেশে এই সংখ্যাটা কত দাঁড়াবে সেটা ভাবলে অবাক হতে হয়। যেখানে সর্বত্র জলের হাহাকার সেখানে দেশের জল সম্পদ থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে কোম্পানিগুলি মুনাফার পাহাড় গড়ছে। কিন্তু পাচ্ছে কি করে?
সুতরাং আগামী দিন গরিব মানুষের কাছে ভয়ংকর হয়ে আসছে। আমাদের চোখের আড়ালে ভারতে তৈরি হয়েছে নতুন এক অর্থনীতি যা জল নিয়ে। মাটি থেকে সবজল দিনে দুপুরে ডাকাতি হয়ে যাচ্ছে আর সরকার চোখ মুখ বন্ধ করে বসে আছে। কৃষক চাষের জল পাচ্ছে না গ্রামের মানুষ জল খেতে পাচ্ছে না অথচ সে জল কর্পোরেট হায়নাদের দখলে।
সুতরাং দেখতে পাচ্ছি শীঘ্রই আসতে চলেছে জল দুর্ভিক্ষ। আগামী দিনে পর্যাপ্ত জল পাবে শুধু ধনীরা। আর গরিব খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষকে তার বেঁচে থাকার প্রয়োজনে জল পেতে গেলে করতে হবে প্রতিরোধ এবং পরিবেশ ধ্বংসকারী উন্নয়নের এই মডেলের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন।
আর তা না হলে আগামী দিনে পরিস্থিতি খুবই ভয়ঙ্কর হবে। জলের অভাবে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হবে।
তথ্য সূত্রঃ
১। আনন্দবাজার পত্রিকা
২। উইকিপিডিয়া
৩। গণদাবী