নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ও বখতিয়ার খলজি

by আমিনুল ইসলাম

বিহারের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধবংসের জন্য বখতিয়ার খলজির নির্মম আক্রমণকে সাধারণত দায়ী করা হয়। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, এ এল ব্যাসাম, রোমিলা থাপার থেকে শুরু করে ইরফান হাবিবের মত দিকপাল ঐতিহাসিকও নালন্দা ধবংসকারী হিসেবে বখতিয়ার খলজিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। ইরফান হাবিব লিখেছেন, “এই মহাবিহার ১২০০ সালে মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির নালন্দা আক্রমণ ও হত্যালীলা সহ বেশ কিছু রাজনৈতিক ঝড়ঝাপটা সামলে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত টিকেছিল। “৪ জানুয়ারি ২০১১-এ চেন্নাইয়ে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের ৯৮তম অধিবেশনে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বক্তব্য: ১১৯৩ সালে বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে নালন্দা মারাত্মকভাবে ধবংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। (হিন্দু, ৮ জানুয়ারি ২০১১।)

এ তথ্য সর্বাংশে সত্য নয়। তবে এই আলোচনায় প্রবেশের পূর্বে আমরা নালন্দার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরতে পারি। বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদানের ভিত্তি বিশ্লেষণ করে নালন্দার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতাব্দী থেকে। তখন নালন্দা ছিল একটি সমৃদ্ধ শহর। কিন্তু নালন্দার অবস্থান নিয়ে ঐতিহাসিকেরা সহমত হতে পারেননি। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে পার্শ্ববর্তী অনেক স্থানের সঙ্গে নালন্দাকে সনাক্ত করেছেন ঐতিহাসিকেরা। কিন্তু এইসব তথ্য প্রমাণ থেকে নালন্দার সঠিক সনাক্তকরণ সহজসাধ্য নয়। কারণ অনেক তথ্যই পরস্পর বিরোধী। তবে পালি-বৌদ্ধ সাহিত্য ও জৈন উপাদান থেকে নালন্দার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, সে নালন্দা এবং বর্তমান নালন্দা মোটামুটিভাবে একই, যা কিনা বিহার রাজ্যের রাজগীর শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত।

বৌদ্ধ সংঘের সংস্কৃত বা পালি প্রতিশব্দ হল বিহার, যার প্রকৃত অর্থ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আশ্রয়স্থল। এইসব বিহারের অনেকগুলি পরবর্তীকালে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল, তার মধ্যে কয়েকটি আবার বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছিল; যেমন নালন্দা। এই নালন্দার উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে। কারণ ফা-হিয়েন যখন নালন্দাতে আসেন, তখন সেখানে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। গুপ্তযুগে নালন্দা বিহার থেকে মহাবিহারে রূপান্তরিত হয়েছিল মূলত রাজকীয় অনুদানের দ্বারাই। আর কোনো মহাবিহার নালন্দার মত রাজকীয় অনুদান পায়নি। কারণ নালন্দা ছিল বিশ্বমানের শিক্ষাক্ষেত্র। পাল রাজারাও ছিলেন নালন্দার পৃষ্ঠপোষক। পাল শাসনকালেই নালন্দা খ্যাতির চরম শিখরে পৌঁছেছিল। এই পাল রাজারা ছিলেন মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী আর নালন্দা ছিল তাঁদের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র; যার ফলে তাঁরা মুক্তহস্তে নালন্দাতে দান করছিলেন। সেই সময় নালন্দাতে ভারতের বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকেও শিক্ষার্থীরা আসতো, যারা জ্ঞানার্জনের শেষে প্রচুর আর্থিক সাহায্য নালন্দাকে দিয়ে যেত নালন্দার সমৃদ্ধির এটাও একটা অন্যতম প্রধান কারণ বলা যেতে পারে। এখানে প্রায় ১০,০০০ ছাত্র বসবাস করত ও অধ্যয়ন করত। (নালন্দা উৎখননের ফলে যে বাড়িগুলি আবিষ্কৃত হয়েছে তাতে দশ হাজার ছাত্রের থাকার ব্যবস্থাকে সমর্থন করা যায় না। ৬৭০ সালে ইৎ-সিং নামে অপর এক চীনা পরিব্রাজক নালন্দা পরিদর্শন করেন। তাঁর মতে, এখানে তিন হাজার ভিক্ষু থাকত। ইৎ-সিং এর বক্তব্যই বেশি সমর্থনযোগ্য ও যুক্তিসম্মত বলে মনে করেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা)। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ স্বয়ং নালন্দার অধ্যক্ষ শীলভদ্রের কাছে পড়াশুনো করতেন। তাঁর মতে, ভারতে তখন হাজার হাজার শিক্ষাকেন্দ্র ছিল; কিন্তু শিক্ষণীয় বিষয়ের বৈচিত্র্য, শিক্ষা পদ্ধতির উৎকর্ষে ও বিশালত্বে নালন্দার স্থান ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ।

বখতিয়ার খলজি মগধ অঞ্চলে ধবংস-যজ্ঞ চালিয়েছিলেন, এর উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকদের একাংশ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’ তিনিই ধবংস ও অগ্নিকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। উদন্তপুরী মহাবিহার ধ্বংসের দৃষ্টান্ত থেকেও বোধহয় নালন্দা ধবংসের জন্য বখতিয়ারকে দায়ী করা হয়। অনুমান নির্ভরতা ঐতিহাসিক সত্যের প্রমাণ হতে পারে না। প্রচলিত উপকথা ও জনশ্রুতির বিপরীতে এখানে বলে রাখা ভাল যে, নালন্দা মহাবিহার বখতিয়ারের বিহার অভিযানের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। নালন্দার ক্ষয়-ক্ষতিগুলো সবই প্রাক-ইসলামীয় যুগের। আর এক্ষেত্রে কয়েকবার যে অগ্নিকাণ্ড ঘটানো হয় তার প্রমাণ পোড়া চাল ও শীলমোহর ধবংসাবশেষের মধ্যে পাওয়া যায়। অগ্নিকাণ্ডে বা অন্য কোনো কারণে ধ্বংস হলেও তৎকালীন রাজন্যবর্গ, বিত্তশালী লোক ও ভিক্ষুদের সহায়তায় নালন্দা কয়েকবার পুনর্গঠিত হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে সৌধগুলির তিনটি থেকে নয়টি পর্যন্ত পুনর্গঠনের স্তর পাওয়া যায়। দেখা যায়, প্রতিবারই পূর্বের স্থাপত্যকর্মের ধবংসাবশেষের উপরই পুনর্নির্মিত ভবনগুলি গড়ে উঠেছে।

তবে কৌতূহলোদ্দীপক ঐতিহাসিক তথ্য হল এই যে, নালন্দা ধবংসের দায় বখতিয়ারের উপর চাপানো হলেও তিনি কিন্তু নালন্দাতেই যাননি। তাহলে এই অপবাদ কেন? মূল লক্ষ্য হল, ভারতে মুসলিম শাসন কতটা অসুন্দর ছিল তা প্রতিপন্ন করা। প্রচারণা এমনই যে, বখতিয়ার খলজি কতটা বর্বর হলে বিশ্ববিদ্যালয় ধবংসের মতো এমন একটি জঘন্য কাজ করতে পারেন, গ্রন্থরাজিতে আগুন লাগিয়ে দিতে পারেন! একই সঙ্গে এই বক্তব্যে আরও রং চড়িয়ে বলা হয়, যে মুসলিম শাসনের নিপীড়ন-অত্যাচারে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্মের আপাত অবলুপ্তি ঘটে। অথচ এমন বক্তব্য যে মিথ্যা ও প্রতারণাপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বোঝাই যাচ্ছে, উদন্তপুরীকে ভুলে নালন্দা ভেবে ফেলা হয়েছে। বখতিয়ার নালন্দাতে যাননি। তিনি অভিযান চালিয়েছেন উদন্তপুরে, কেননা এটাই ছিল সেসময়ের রাজধানী।

ঐতিহাসিক কে কে কানুনগো ‘জার্নাল অফ দ্য এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল’-এ প্রকাশিত শরৎচন্দ্র দাশের ‘অ্যান্টিকুইটি অফ চিটাগাঁও’ প্রবন্ধ থেকে জানাচ্ছেন, যে কাশ্মীরের বৌদ্ধ পণ্ডিত শাক্য শ্রীভদ্র ১২০০ সালে মগধে গিয়ে দেখেছিলেন বিক্রমশীলা ও উদন্তপুরী বিহার ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তুর্কিদের ভয়ে শ্রীভদ্র ও ওই বিহার দুটির ভিক্ষুরা বগুড়া জেলার জগদ্দল বিহারে আশ্রয় নেন। কিন্তু শরৎচন্দ্র দাশ তাঁর উক্ত প্রবন্ধে এমন কথা বলেননি যে, ১২০০ সালে বিক্রমশীলা ও উদন্তপুরী বিহার দুটিকে ধবংস করা হয়েছিল। বরং তিনি তাঁর সম্পাদিত তিববতীয় শাস্ত্র ‘পাগ সাম জন জ্যাং’-এ (১৭৪৭ সালে সমাপ্ত) বলেছেন, বিহার দুটি ধবংস হয়েছিল ১২০২ সালে। ফলে শাক্য শ্রীভদ্র জগদ্দল বিহারে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এই ঘটনা বখতিয়ারের বিহার অভিযানের (১২০৩) পূর্বেকার। আর এই বিহার অভিযানেও বিক্রমশীলা ও উদন্তপুরী মহাবিহার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বিহার দুটি ছিল বৌদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ঐতিহাসিক মিনহাজ সিরাজী বিহার অভিযানের ৩৯ বছর পর লোকমুখে (১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজির বাংলা অভিযানে অংশগ্রহণকারী দুই সৈনিক ছিলেন নিজামউদ্দিন ও সামসামউদ্দিন। এই দু-ভাই বিহার অভিযানেও অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের মুখে বিহার ও বাংলা অভিযানের কথা শুনেছিলেন মিনহাজ) শুনে সেই ঘটনা বর্ণনা করেন তাঁর ‘তাবাকাত-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে। তাঁর বর্ণনা মতে বোঝা যায়, যে বখতিয়ার সেই অপারেশনে ভুল করে উদন্ত পুরী মহাবিহারের উপর আক্রমণ চালান। কেননা মহাবিহারটি বাহির থেকে সামরিক দুর্গের মতো দেখাচ্ছিল। পরে তিনি বুঝতে পারেন আসলে এটি ছিল একটা মহাবিহার তথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই আক্রমণে প্রতিষ্ঠানের অধিবাসী বৌদ্ধ ছাত্র ও বৌদ্ধ ধর্মগুরু সকলে নিহত হয়। তবে কারো মতে, সেই মঠটি ছিল নালন্দা। এও মনে করা হয়, যেহেতু দুটি মহাবিহারই কয়েক মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত ছিল, সেহেতু উভয়ের ক্ষেত্রেই হয়তো একই ঘটনা ঘটেছিল।

তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, ক্ষতিগ্রস্ত বিহারগুলির মধ্যে নালন্দার নাম নেই। মিনহাজ কেন অন্য কোনো সূত্রেও নালন্দা ধবংসের কথা বলা হয়নি। ১২৩৪ সালে অর্থাৎ বখতিয়ারের বিহার জয়ের ৩০ বছর পর তিববতী সাধু ও জ্ঞানসাধক ধর্মস্বামী (১১৯৭-১২৬৪) মগধে আগমন করেন ও সেখানে অবস্থান করেন। শুধু তাই নয়, তিনি বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যেটা কিনা বখতিয়ারের উদন্তপুর অভিযানের সময় ধবংস হয়েছিল, যেমনটা পণ্ডিতগণ অভিযোগ করেন। নালন্দা মঠকেও তিনি তখন চালু অবস্থায় দেখতে পান। সেখানে মঠাধ্যক্ষ রাহুল শ্রীভদ্রের পরিচালনায় ৭০ জন সাধু অধ্যয়নে নিয়োজিত ছিলেন। তাছাড়া ধর্মস্বামী লক্ষ করেন যে, বহু বৌদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তখনও নালন্দা ও তার আশেপাশে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি নালন্দাও ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত যথাযথভাবে তার কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল এই যে, বখতিয়ারের আক্রমণে ১২০৪ সালে নালন্দা সম্পূর্ণ ধবংসপ্রাপ্ত হয় বলে যে প্রচারণা ছিল ধর্মস্বামীর বিবরণে তার উল্লেখ নেই। তবে তিনি বিক্রমশীলা মহাবিহারকে ধবংস অবস্থায় ও উদন্তপুরীকে তুর্কি সামরিক ঘাঁটিরূপে দেখতে পান।

বখতিয়ার কি তাহলে উদন্তপুরীতে কী আছে জানার পরেও নালন্দা ও বিক্রমশীলা আক্রমণে এগিয়ে গিয়েছিলেন পর পর মহাবিহার তথা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান দখল ও ধবংসের কালাপাহাড়ি লক্ষ্য নিয়ে? কিন্তু কোন প্রমাণের ভিত্তিতে আমরা এমন একথা বলব? মিনহাজউদ্দিন সিরাজী তো স্পষ্টই লিখেছেন, বিহার বা সেকালের উদন্তপুরী অধিকারের পর বখতিয়ার দিল্লিতে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবকের দরবারে ফিরে যান। তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় উদন্তপুরী, বিক্রমশীলা এবং নালন্দা পরস্পরের কাছাকাছিই ছিল। উদন্তপুরী নালন্দা থেকে মাত্র ১৩ কিমি হওয়া সত্ত্বেও বখতিয়ার কেন নালন্দায় যাননি তার আর একটা কারণ, মুসলিম অভিযানের পথপরিক্রমা হতে নালন্দার অবস্থান ছিল বহুদুরে। দিল্লি হতে বাংলার পথনির্দেশিকা ছিল ভিন্ন রকম, সেখানে নালন্দার অস্তিত্বই ছিল না। এ প্রসঙ্গে ‘বায়োগ্রাফি অব ধর্মস্বামী’ বইয়ের ভূমিকা-লেখক পাটনার কে পি জয়সোয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এর অধ্যক্ষ Anant Sadashiv Altekar বলেছেন, “Nalanda was not, like Vikramasila, on the highway leading from Delhi to Bengal, and so the work of completing its destruction required a special expedition. “১০ তিনি পরিষ্কার বলেছেন, এরকম আরও কিছু কারণের জন্যই নালন্দা তুর্কি আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।

সাম্প্রতিক গবেষণায় অন্য একটা চিত্র তুলে ধরেছেন ওয়াশিংটনের Kevin Alschuler University-এর রিলিজিয়াস স্টাডিজের প্রফেসর জোহান এলভার্সকগ তাঁর ‘বুদ্ধ ইজম অ্যান্ড ইসলাম অন দ্য সিল্ক রোড’ বইয়ে। বৌদ্ধদের সঙ্গে মুসলিমদের সম্পর্কের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন- “This is problematic for many reasons, not the least being that the story of Nalanda is not true. For example, not only did local Buddhist rulers make deals with the new Muslim overlords and thus stay in power, but Nalanda also continued as a functioning institution of buddhist education well into the thirteenth century. One Indian master, for example, was trained and ordained at Nalanda before he travelled to the court of Khubilai Khan. We also know that Chinease monks continued to travel to India and obtain Buddhist texts in the late four- teenth century.”১১ অর্থাৎ বখতিয়ার খলজির অভিযানের প্রায় ১০০ বছর পরও নালন্দা সচল ছিল। তাহলে নালন্দা ধবংস হল কিভাবে? এটা হিন্দু ও বৌদ্ধ সংঘাতের ফলশ্রুতি নয় তো? এর জমাটি উত্তর দিয়েছেন ঐতিহাসিক ডি এন ঝা। তিনি বলেছেন যে, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বৌদ্ধদের মধ্যকার চলতে থাকা ঘাত-প্রতিঘাতেই নালন্দা ধবংস হয়। এই ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ঝা অনেকগুলো তিববতি রেফারেন্সও দিয়েছেন।১২

এখানে আর একটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, বখতিয়ার খলজি কেন ভুলে উদন্তপুর বিহার আক্রমণ করলেন। তিববতী কুলাচার্য জ্ঞানানশ্রী তাঁর ‘ভাদ্রকল্পদ্রুম’-এ বলেন যে, সেসময় বৌদ্ধদের নিজেদের মধ্যেও ভিন্ন ভিন্ন মত ও ধারা প্রচলিত ছিল। সেদিন বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতগণের মধ্যে কলহ-বিবাদ এতই উত্তেজনার শিখরে ওঠে যে তাদের একপক্ষ রাজা লক্ষ্মণ সেনের সময়ে তুর্কির মুসলিম আক্রমণকারীদেরকে তাদের ওখানে আক্রমণ চালাতে প্রতিনিধি পাঠায়। লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে এই প্রেরিত প্রতিনিধিত্ব লক্ষ্মণ সেনেরই ইচ্ছার প্রকাশ ঘটায়। তিনি চেয়েছিলেন, বৌদ্ধদের ক্ষমতা সেখানে ভেঙে পড়ুক। এই উদ্দেশ্যে তিনি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে বিবাদের সূত্র লালন করেন ও দুই বিবাদীর একপক্ষকে বিদেশিদের সাহায্য নিতে উৎসাহ দান করেন। এতে তিনি তাঁদের দুর্বল করে ফায়দা নিতে চেয়েছিলেন। ফলাফল যেটা হল, বখতিয়ারকে যেভাবে গাইড করা হয়েছে সম্ভবত সেভাবেই তিনি অভিযান পরিচালনা করেন। বিহার আক্রমণ প্রতিহত করতে যাঁরাই বাধা দিয়েছে তুর্কি সৈন্যরা তাদেরকে হত্যা করেছে। মিনহাজের বিবরণে স্পষ্ট হয়, বখতিয়ার জানতেন না যে, উদন্তপুর ছিল বৌদ্ধদের একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সেখানে সারি সারি পুস্তক দেখে অনুসন্ধান করে জানেন যে, সেটা কোনো সেনাদুর্গ ছিল না।১৩ এই বক্তব্য প্রায় সমস্ত সোর্সই নিশ্চিত করেছে।

তাহলে কি তুর্কি সেনাবাহিনীকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল পথে পরিচালিত করা হয়েছে? এটা ব্রাহ্মণ্যবাদের অতি পুরাতন ও বহুল ব্যবহৃত কুটনীতি ও কৌশল যে, তাঁরা স্থানীয় শক্তির মধ্যকার অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কাজে লাগিয়ে শত্রুর শত্রুকে দিয়ে নিজের শত্রুকে শায়েস্তা করেন। এ দৃষ্টিতে কুলাচার্য জ্ঞানানশ্রীর বর্ণনাকে অগ্রাহ্য করা যায় না। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায় আবদুল মোমেন চৌধুরীর ‘দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অফ বুদ্ধিজম ইন সাউথ এশিয়া ‘গ্রন্থ” থেকে। তাছাড়া অধ্যাপক যোহান এলভার্সকগ তাঁর পূর্বোক্ত গ্রন্থে ভারতে বৌদ্ধ-মুসলিম সম্পর্ক নিয়ে প্রচলিত ধারাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। বৌদ্ধদের উপর মুসলিম সেনাপতি ও শাসকগণ অত্যাচার করেছেন এই ধারণাকে তিনি নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, বৌদ্ধদের সঙ্গে মুসলিমদের শত্রুতার প্রচলিত ধারণা পশ্চিমা জগতে তৈরি হয় এবং এটা আরও প্রতিষ্ঠিত হয় আফগানিস্থানের তালিবান কর্তৃক ২০০১ সালে বিশাল বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংসের মাধ্যমে।১৫

পাল যুগের সমন্বিত মানবিক সমাজ সেন যুগে এসে শ্রেণি বৈষম্যে এবং বর্ণ বৈষম্যে একেবারেই ভেঙে পড়ে। ধর্ম পালনের অধিকার, সংস্কৃত এবং নিজ কথ্যভাষায় শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার অধিকার এবং সামাজিক মর্যাদা হারিয়ে এসময়ে অনেক বৌদ্ধ, নাথ, সহযান প্রভৃতি উদারপন্থীরা প্রাণ-মান বাঁচাতে হিন্দুধর্মে ফিরে যায়। অনেকে তাঁদের জ্ঞান তথা সাহিত্য, দর্শনের পাণ্ডুলিপি নিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। উল্লেখ্য যে, পালযুগে ব্রাহ্মণরা ভূ-সম্পত্তি দান হিসেবে লাভ করলেও সেন যুগে কোনো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তি বা পুরোহিতের ভূমি লাভের কোনো প্রমাণাদি আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। পূজা-অর্চনার ক্ষেত্রেও মেলেনি কোনো বৌদ্ধ বা সাধনবাদী দেব-দেবীর অস্তিত্ব। কৌম জীবন থেকে রাজ শাসনের আওতায় প্রবেশ পর্যন্ত দীর্ঘ হাজার বছরের মধ্যে বাংলা এরূপ সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে সংঘাতময় জীবন প্রত্যক্ষ করেনি বলেই জানা যায়। বস্তুত সেন যুগেই বাংলার রাষ্ট্র ও সমাজ সাম্প্রদায়িক সংঘাতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সমাজের সর্বত্র দেখা দেয় অতিমাত্রায় ভেদ বৈষম্য, ব্যক্তিগত ও শ্রেণিগত বৈষম্য এবং সাম্প্রদায়িক সংঘাত। যার অনিবার্য পরিণতি হল শিল্প-সাহিত্য, অর্থনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান তথা সমাজের সর্বত্র অধোগতি।

লামা তারানাথ এবং মিনহাজউদ্দিন সিরাজীর বর্ণনা থেকে জানা যায়, যে সামাজিক এই অধোগতি থেকে মুক্তি পেতে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ গোপনে বখতিয়ার খলজির সাথে যোগাযোগ করেছেন তথা গুপ্তচরের কাজ করেছেন। একই সাথে বাংলায় প্রবেশের ক্ষেত্রে বখতিয়ার খলজির পথ প্রদর্শকের কাজ করেছেন। লামা তারানাথ আরও বলেছেন যে, বখতিয়ার সংবাদবাহী ভিক্ষুদের মধ্যস্থতায় বাংলা ও তার পার্শ্ববর্তী অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলের রাজাদের নিজ দলভুক্ত করে অনেক বৌদ্ধ আচার্যকে হত্যা করেন এবং উদন্তপুরী ও বিক্রমশীলা বিহার দখল করেন। ফলে এইসব বিহারের বেঁচে যাওয়া পণ্ডিতগণ বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন এবং এই কারণে মগধে বৌদ্ধ ধর্ম বিলুপ্ত হয়ে যায়। তারানাথের এই কথা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের কারণ থেকে যায়। কারণ যে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ছিলেন মুসলমান শাসকদের গুপ্তচর এবং বাংলায় প্রবেশের পথ প্রদর্শক তাদেরকে মুসলমানরা হত্যা করেছিলেন এবং সেই মুসলমানরাই বৌদ্ধধর্ম বিলুপ্তির কারণ একথা যথেষ্ট যুক্তিসংগত নয়। বরং ধারণা করা যায় যে, যেহেতু বৌদ্ধ ভিক্ষুরা গোপনে সেন শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য মুসলিম শাসকদের সাথে যোগাযোগ করেছেন এবং গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেছেন, সে কারণে সম্ভবত ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন শাসকরাই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকবেন, যা অধিক যুক্তিসংগত মনে হয়। যাই হোক, সেন শাসনের সামাজিক নির্যাতন এমন অবস্থায় পৌঁছেছিল যে, বল্লাল সেনের সময়ে আরোপিত সামাজিক বিধি আজও বাংলায় ‘বল্পলী বালাই’ নামে পরিচিত। এরূপ সামাজিক অসংগতি থেকে বাঁচার জন্য এবং যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য বাংলার সাধারণ মুক্তিকামী মানুষ অধীর অপেক্ষা করছিল। একদিকে ব্রাহ্মণ্য শাসনের ভীতি, অন্যদিকে বৌদ্ধ নেতৃত্ব-শূন্যতা সম্ভবত বাংলায় মুসলিম রাজশাসন আগমনের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।

বখতিয়ার খলজির আক্রমণে যদি নালন্দা না ধধ্বংস হয়ে থাকে, তাহলে ধবংস হল কীভাবে এবং গ্রন্থাগার পোড়ানোর গল্পটাই বা কোথা থেকে এল? প্রাচীন যুগে হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে যে ভয়ংকর সংঘাত চলেছিল কয়েক শতাব্দী ধরে, তার কি কোনো আঁচ লাগেনি নালন্দার গায়ে? কিংবদন্তিতেও অনেক ঐতিহাসিক সত্য লুকিয়ে থাকে। তিববর্তী শাস্ত্র ‘পাগ সাম জন জ্যাং’ নামক গ্রন্থে এমনই একটি তিববতী কিংবদন্তির কথা জানা যায়। এই কিংবদন্তি অনুসারে, মুদিত ভদ্র নামে এক বৌদ্ধ সাধু নালন্দার চৈত্য ও বিহারগুলি মেরামত করেন এবং তৎকালীন রাজার এক মন্ত্রী কুকুটসিদ্ধ সেখানে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। আরেকটি গল্প অনুসারে, ভবনটির যখন উদ্বোধন করা হচ্ছিল, তখন দুইজন ক্রুদ্ধ তীর্থিক ভিক্ষু (ব্রাহ্মণ) সেখানে উপস্থিত হন। কয়েকজন তরুণ শিক্ষানবিশ ভিক্ষু তাঁদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন ও তাঁদের গায়ে কাপড় কাচার জল ছিটিয়ে দেন। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য সেই ভিক্ষুরা সূর্যকে প্রসন্ন করার জন্য ১২ বছর তপস্যা করেন ও তপস্যার শেষে একটি যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন। যজ্ঞকুণ্ডের ‘জাগ্রত ভষ্ম’ তাঁরা বৌদ্ধ মন্দিরগুলির উপর ছিঁটিয়ে দেন। এতে নালন্দার গ্রন্থাগারে আগুন লেগে যায়। বুদ্ধগয়া, নালন্দা ও রাজগীরে বিখ্যাত তীর্থস্থান অথবা ধবংসাবশেষের উপরে লিখিত একটি পরিচিতি পুস্তিকায়ও এর কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে। যদিও সে বর্ণনায় কিছুটা অলৌকিকত্বের তত্ত্ব ঢোকানো হয়েছে। বখতিয়ার খলজির আক্রমণ তত্ত্বের সাথে কোনো ভণিতা না করে পুস্তিকাটিতে এ তথ্য সংযোজিত হয়েছে : “…একদিন ঐ মন্দিরে যখন শাস্ত্রচর্চা চলছিল তখন দুজন কোমল স্বভাবের ব্রাহ্মণ সেখানে উপস্থিত হন। কয়েকটি অল্প বয়স্ক ভিক্ষু তাঁহাদের উপর পরিহাসোচ্ছলে জল ছিটিয়ে দেন। এতে তাঁদের ক্রোধ বেড়ে যায়। বারো বৎসরব্যাপী সূর্যের তপস্যা করে তাঁরা যজ্ঞাগ্নি নিয়ে নালন্দার প্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারে এবং বৌদ্ধ বিহারগুলিতে অগ্নিসংযোগ করেন। ফলে নালন্দা অগ্নিসাৎ হয়ে যায়।”১৬

বিশিষ্ট তাত্ত্বিক লেখক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত নালন্দা মহাবিহার ধবংসের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আক্রমণকে মান্যতা দিয়েছেন।” তিববতী ঐতিহাসিক লামা তারানাথও ব্রাহ্মণ্যবাদীদের আক্রমণকে মান্যতা দিয়েছেন। ঐতিহাসিক বি এন এস যাদবও ‘উগ্র হিন্দুদের’ (‘Hindu fanatics’) হাতে নালন্দার গ্রন্থাগার পোড়ানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।১৯ এই মতের দীর্ঘ আলোচনা করেছেন আর এস শর্মা এবং কে এম শ্রীমালি।২০ ডি আর পাতিল অবশ্য তাঁর পূর্বোক্ত গবেষণাপত্রে (বিহার সরকার কর্তৃক প্রকাশিত) খুব পরিষ্কার করে বলেছেন যে, নালন্দা ধবংস করেছিল শৈবরা। তিনি এও লিখেছেন যে, “…the Brahmins deliberately set fire to the famous library (at Nalanda called Ratnodadhi).”২১ বখতিয়ার খলজির আক্রমণের পূর্বেই যে নালন্দা ধবংস হয়েছিল সে সম্পর্কে ডি আর পাতিল লিখেছেন, “…All these circumstances would indicate that, quite before Bakhtiar Khilji’s invasion, Nalanda had perhaps fallen to decay or ruins already; but how and when actually this happened is still a mystery to be unravelled.”” ডি আর পাতিলের পূর্বোক্ত গবেষণা আরও প্রমাণ করে যে, ‘There is, therefore, reason to believe that Nalanda had met its final end some time in the 11th century i.e.more than hundred years before Bakhtiyar Khilji invaded Bihar in 1197 A.D.২৪

লামা তারানাথ বর্ণনা করেছেন যে, রাজা তুরস্ক যিনি দীর্ঘকাল কাশ্মীরে রাজত্ব করেছিলেন, ঐতিহাসিকেরা যাঁকে মিহিরকুল (৫০২-৫৪২) নামে অভিহিত করেছেন, শৈব ধর্মের অনুসারী বৌদ্ধ নিপীড়ক এই রাজার নেতৃত্বে মধ্য এশিয়ার যুদ্ধবাজ হুনদের দ্বারা নালন্দা প্রথম আক্রান্ত হয়। ‘মুর্তিবিনাশী’ মিহিরকুল বৌদ্ধদের সহ্য করতে পারতেন না। আমৃত্যু অভিযান চালিয়ে তিনি অসংখ্য বৌদ্ধ উপাসক ও বৌদ্ধদের হত্য করেন। কিপিনের বৌদ্ধ সংঘ উৎখাত করে বুদ্ধের পবিত্র ভিক্ষাপাত্র তিনি ধবংস করেন। তাঁর নিষ্ঠুরতা এতটাই ভয়ংকর ছিল যে, কাশ্মীরের ঐতিহাসিক কলহন তাঁর ‘রাজতরঙ্গিনী’তে তাঁকে মৃত্যুদেবতা ‘যম’-এর সাথে তুলনা করেছেন (১.২৮৯)। কলহন বলেছেন যে, এই নামটি উচ্চারণ করলে অপবিত্র হতে হয় (১.৩০৪)। হিউয়েন সাঙ মিহিরকুল সম্বন্ধে যে কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তা এই: “…পঞ্চনদ প্রদেশের অন্তর্গত সাকল নামক রাজধানীতে মহারাজ মিহিরকুল সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন। ভারতের সুবিস্তৃত অংশে তাঁহার আধিপত্য বদ্ধ মূল হইয়াছিল। ইনি অবসর মত বৌদ্ধশাস্ত্রের আলোচনা করিতে সমুৎসুক হইয়া একজন শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধাচার্য্যকে তৎসমীপে প্রেরণ করিবার জন্য আদেশ করিয়াছিলেন। বৌদ্ধাচার্য্যগণের অর্থাদিতে স্পৃহা ছিল না, খ্যাতিলাভেও তাঁহারা উদাসীন ছিলেন। সুপণ্ডিত এবং খ্যাতনামা বৌদ্ধাচার্য্যগণ রাজানুগ্রহকে ঘৃণার চক্ষেই অবলোকন করিতেন। এজন্যই তাঁহারা মহারাজ মিহিরকুলের আদেশ প্রতিপালন করিতে অনিচ্ছুক হইলেন। একজন পুরাতন রাজ-অনুচর বহুকালাবধি ধর্ম-পরিচ্ছদ ধারণ করিয়াছিলেন, তিনি তর্কে প্রাজ্ঞ এবং সুবক্তা ছিলেন। বৌদ্ধাচার্য্যগণ রাজসমীপে তাঁহার নাম প্রস্তাব করিলেন। ইহাতে মিহিরকুল নিতান্ত অসন্তুষ্ট হইয়া পঞ্চনদ ভূমি হইতে বৌদ্ধধর্ম নিষ্কাশন এবং বৌদ্ধাচার্য্যগণকে বিনাশ করিবার জন্য আদেশ প্রচার করিয়াছিলেন।”২৫ মিহিরকুলের ভীষণ অত্যাচারে গুপ্ত সাম্রাজ্য জর্জরিত ও ধবংসমুখে পতিত হয়েছিল।২৩ বহু বৌদ্ধ বিহার তাঁর হাতে বিধবস্ত হয়।” মিহিরকুল যখন পাটলিপুত্র আক্রমণ করেন তখন নালন্দা মহাবিহার ধবংসপ্রাপ্ত হয়। বহু বৌদ্ধ ছাত্র ও বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এই আক্রমণে। রেভারেন্ড এইচ হিরাস এ বিষয়ে লিখেছেন: ‘Nalanda University was not far from the capital, Pataliputra and its fame had also reached Mihirakula’s ears. The buildings of Nalanda were then probably destroyed for the first time, and its priests and students dispersed and perhaps killed.’২৮ স্কন্দগুপ্ত (৪৫৫-৪৬৮) ও তাঁর পরবর্তী বংশধরেরা একে পুনর্গঠন করেন। তাছাড়া সাত শতকের মাঝামাঝি সময়ে মগধে অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়েছে এবং সেগুলোরও শিকার হতে পারে নালন্দা। নালন্দায় এইসব উপর্যুপরি আক্রমণের তথ্য ‘জার্নাল অব দ্য বিহার অ্যান্ড ওড়িশা রিসার্চ সোসাইটি’ থেকে পাওয়া যায়।২৯ 

স্কন্দগুপ্তের প্রায় দেড় শতাব্দী পরে বাংলার কর্ণসুবর্ণের রাজা নরেন্দ্র গুপ্ত তথা শশাঙ্ক (খ্রিঃ ৬১৯-৬৩২) এবং শাসক নরেন্দ্র গুপ্ত তথা শশাঙ্কের দ্বারাও নালন্দা আবার ধবংসের মুখে  পড়ে। রাজা হর্ষবর্ধনের (৬০৬-৪৭) সঙ্গে তাঁর বিরোধ ও ধর্মবিশ্বাস এই ধবংসযজ্ঞে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। রাজা হর্ষবর্ধন প্রথম দিকে শৈব ধর্মের অনুসারী হলেও পরে বৌদ্ধধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হন। অন্যদিকে রাজা শশাঙ্ক ছিলেন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের একান্ত অনুরাগী। ফলে উভয়ের মধ্যে সবসময় শত্রুতা লেগেই থাকত ও উভয়ের মধ্যে একটি বড়ো যুদ্ধও সংঘটিত হয়েছিল। শৈব নরপতি শশাঙ্ক বৌদ্ধদের ধর্মীয় স্থান ছাড়াও বুদ্ধগয়াকে সম্পূর্ণভাবে ধবংস করেন। সপ্তম শতকের একেবারে প্রথম দিকে কান্যকুব্জ আক্রমণের সময় বৌদ্ধ ধর্মের বিরুদ্ধে প্রবল আক্রোশে তিনি বোধিবৃক্ষ আমূল উপড়ে ফেলেছিলেন। রাজা শশাঙ্কের বৌদ্ধনীতি সম্পর্কে রামাই পণ্ডিতের ‘শূন্যপুরাণ’ থেকে ধারণা পাওয়া যায়। শশাঙ্কের আদেশ ছিল সেতুবন্ধ হতে হিমগিরি পর্যন্ত যত বৌদ্ধ আছে-বালক-বৃদ্ধ নির্বিশেষে তাদের হত্যা করতে হবে; এটা যে না করতে চাইবে তারও মৃত্যুদণ্ড হবে। রাজা শশাঙ্ক বৌদ্ধ ধর্মের মূলোৎপাটনের জন্য এমন কোনো প্রচেষ্টা ছিল না যা করেননি। বুদ্ধের যাবতীয় নিদর্শন লোপ করার উদ্দেশ্যে শশাঙ্কের তাণ্ডব লক্ষ করে রাজা পূর্ণবর্মণ আক্ষেপ করেছিলেন: “জ্ঞানের সূর্য অস্তমিত; বুদ্ধের কিছুই অবশিষ্ট নেই বৃক্ষটুকু ছাড়া এবং সেটিও ধবংস করল তারা।” পূর্ণবর্মণ নালন্দা পুননির্মাণ করেন। সম্রাট হর্ষবর্ধন পরে রাজা শশাঙ্কের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেন ও শেষপর্যন্ত বাংলার কিছু অংশ করায়ত্ত করেন। তিনিও নালন্দার পুনর্গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। উল্লেখ্য, বৌদ্ধ ও শৈব ব্রাহ্মণদের মধ্যে এই রাজনৈতিক সংঘাত তথা ক্ষমতার লড়াই এবং এর ফলাফল হচ্ছে উত্তর ভারত হতে বৌদ্ধ দের গণবিতাড়ন ও গণহত্যা। এ সময়ে হর্ষবর্ধন একবার হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে গেলেও পরবর্তীতে এক ব্রাহ্মণ গুপ্ত ঘাতকের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়।

এরপর বাংলার সিংহাসন দখল করেন বিহারের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত তীরহুতের জনৈক রাজা অর্জুন, যিনি চিনা সোর্সে ‘A-lo-na-shun’ (তাঁকে অনূদিত গ্রন্থে ‘Arunasva’ or ‘Arunasa’ নামেও দেখা যায়) নামে পরিচিত। তিনি হর্ষবর্ধনের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন, Hans Bakker তাঁকে হর্ষবর্ধনের অধীনস্থ বলে উল্লেখ করেছেন।°° অর্জুন সিংহাসনে বসার পর একদল ব্রাহ্মণ দুর্বৃত্তের নেতৃত্বে নালন্দা আক্রান্ত হয় ও সেটা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।

এটাই হচ্ছে নালন্দা ধবংসের মূল কারণ। তবে এটি সেসময় পুরোপুরি ধবংস হয়ে যায়নি। এ সময় চিনা প্রতিনিধি ওয়াং হিউয়েন রাজা অজুর্ন কর্তৃক আক্রান্ত হলে তিনি নেপালে আশ্রয় নেন। নেপালের রাজা এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে রাজা অর্জুনকে আক্রমণ ও গ্রেপ্তার করে প্রতিশোধ স্বরূপ চিনে পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীতে নেপালের রাজার সহযোগিতায় নালন্দা মেরামতির কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। তাছাড়া হর্ষবর্ধনের সময়ে কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার নালন্দা মহাবিহার ধূলায় গুড়িয়ে দেওয়ার হুঙ্কারও বিশেষ তাৎপর্যবাহী বলা যেতে পারে। এছাড়াও পাল যুগে কোনো কারণে নালন্দা ভষ্মীভূত হলে মহীপাল (৯৮১-১০২৯) আগুনে বিনষ্ট নালন্দা মহাবিহারের সংস্কার করেছিলেন এবং পরবর্তীতে এই সংস্কার কাজ চলতে থাকে। মহীপালের রাজ্যের একাদশ সংবৎসরে উৎকীর্ণ দুটি শিলালিপিতে আগুনে বিনষ্ট নালন্দার সংস্কারের উল্লেখ আছে।

৫ 

তাহলে কিভাবে চালু থাকা নালন্দা ধবংস হয়ে গেল? এর জমাটি উত্তর অধ্যাপক ডি এন ঝা পূর্বেই দিয়েছেন যে, ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধদের বিরামহীন সংঘাত এক্ষেত্রে প্রধানত দায়ী। ঐতিহাসিক এস এন সদাশিবন অবশ্য নালন্দা ধবংসের জন্য মুসলমান ও ব্রাহ্মণ উভয়কেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন।** তিনি লিখেছেন, “The enormous manuscript library of the Nalanda university was set on fire by the Tirthikas (all sects of Brahmins) with the support of Jainas due to the mounting Jealousy they nurtured against the great centre of learning. The Mohammedan militarists continously harassed the Buddhist monks of the university and occasionally tortured them.” সদাশিবনের প্রথম অভিযোগটির সমর্থন আছে বুদ্ধ প্রকাশের গ্রন্থে। নালন্দায় অগ্নি সংযোগের জন্য তিনি হিন্দুদেরই দায়ী করে লিখেছেন, “…they (Hindus) performed a Yajna, a fire sacrifice and threw living embers and ashes from the sacrifice into the Buddhist temples. This produced a great conflagration which consumed Ratnabodhi, the nine- storeyed library of the Nalanda University.” বুদ্ধ প্রকাশের বই (১৯৬৫) সদাশিবনের বইয়ের (২০০০) চেয়ে অনেক পুরোনো। এর চেয়েও পুরোনো বই হংসমুখ ধীরাজ সাঙ্কালিয়ার ‘দ্য ইউনিভার্সিটি অব নালন্দা’ (১৯৩৪)।৩৭ সাঙ্কালিয়াও যেনতেন প্রকারে প্রমাণ করতে সচেষ্ট যে নালন্দা ধবংস করেছিলেন বখতিয়ার খলজি। তাঁর ধারণা, মিনহাজ যে জায়গার বর্ণনা দিয়েছেন সেটা উদন্তপুরী নয়, নালন্দা। কেন? এ সম্পর্কে কোনো নির্দিষ্ট প্রমাণ নেই সাঙ্কালিয়ার কাছে এবং তিনি সেটা মেনেও নিয়েছেন, “It would thus appear that there is no direct evidence to prove that Nalanda was destroyed by the Mohammedans in the year A.D.1199.”* সালটা গুলিয়ে ফেলেছেন তিনি। কেননা একটু পরেই তিনি আবার লিখেছেন, “Hence Nalanda was destroyed by the Mohammedans in or about 1205 A.D.”* প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও সাঙ্কালিয়ার অনুমান, “The Moslem invasion therefore appears to be the immediate cause of the destruction of Nalanda.” অবশ্য তিনিও বলেছেন, “according to another tradition, the buildings were razed to the ground by a stupid act of two mendicants. Ridiculed by the young monks, they are said to have propitiated the sun for twelve years, performed a sacrifice and alleged to have thrown embers on the stately structures which reduced them to ashes.” আর সেটা ঘটেছিল বখতিয়ার খলজি আসার অনেক পরে।

কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, যজ্ঞের আগুনেই যে নালন্দা পুড়েছিল তার প্রমাণ কি? ফরাসি লেখক Lucien X. Polastron তাঁর বিখ্যাত বই ‘বুকস অন ফায়ার’-এ যজ্ঞের অঙ্গার ছুঁড়ে ফেলার দীর্ঘ বিবরণ দেওয়ার পরও বলেছেন, গল্পটা এখনও চালু আছে এবং এটা প্রচার করেছিলেন তিববতী লামা ধর্মস্বামী, আর তিনি মোটেই সুবিধার লোক ছিলেন না। তিনি যে ‘সুবিধার লোক ছিলেন না’, Polastron একথা জানলেন বা বুঝলেন কী করে? সে সম্পর্কে তাঁর কোনো বক্তব্য নেই। বরং কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই সম্পূর্ণ অনুমানের ভিত্তিতে Polastron ধর্মস্বামী থেকে বন্দুক ঘুরিয়ে দিয়েছেন বখতিয়ার খলজির দিকে। ঐতিহাসিক এ এল ব্যাসাম নালন্দা ধবংসের জন্য সরাসরি বখতিয়ারকে দায়ী না করলেও তিনি অবশ্য এটা ধবংসের জন্য মুসলিম আক্রমণকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। কোনো প্রমাণ ছাড়াই তিনি লিখেছেন, “গঙ্গার তীরে তীরে মুসলিম অভিযানের তরঙ্গাভিঘাতেই নালন্দা ও বিহারের অন্যান্য বৌদ্ধ মঠ লুণ্ঠিত ও ধবংসপ্রাপ্ত হয়। গ্রন্থাগারগুলি হয় ভস্মীভূত এবং দলে দলে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় আক্রমণকারীদের হাতে।৪২ ধীরাজ সাঙ্কালিয়া অবশ্য নালন্দায় আগুন লাগানোর ঘটনার সমর্থনে লিখিত সূত্র উল্লেখ করে লিখেছেন, “The tradition cited from Pag-sam-jon zang ahout the final annihilation of Nalanda by fire may be true, for while excavating the Nalanda-site, heaps of ashes and coals are un- earthed, even on the topmost levels after the re- moval of layers of earth which cover up various sites.” কিন্তু এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, একদিকে সাঙ্কালিয়া বলছেন, নালন্দা ধবংস করেছিলেন বখতিয়ার খলজি, আবার পরে হিন্দুদের দ্বারা নালন্দায় অগ্নি সংযোগের ঘটনাও সত্যি বলছেন। তাহলে এমন পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের উদ্দেশ্যই বা কি? তিনি কি নালন্দা ধবংসের বা নালন্দার লাইব্রেরি পোড়ানোর আসল কারণ আড়াল করতে চাইছেন?

শুধু নালন্দাই নয়, ময়নামতী মহাবিহারও (অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত) ধবংস হয় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে। নালন্দার মতো এক্ষেত্রেও দায়ী করা হত মূলত মুসলিম আক্রমণকারীদের। একাদশ শতকের শেষভাগে বৌদ্ধ চন্দ্রবংশ উৎখাত করে অবিভক্ত দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্মণ রাজবংশ। এই বংশেরই অন্যতম শাসক ছিলেন জাতবর্মা। রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহারের প্রতি। তিনি অচিরেই বৌদ্ধ বিহারটি অবরুদ্ধ এবং লুণ্ঠন করেন। অবশেষে অগ্নি সংযোগে মহাবিহারটি ধবংস করেন। ওই বিহারের মঠাধ্যক্ষ সুপণ্ডিত করুণাশ্রী মিত্রকেও তিনি অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করেন। ভোজবর্মার বেলাবলিপি থেকেও জানা যায়, পরম বিষ্ণুভক্ত জাতবর্মা সোমপুরের মহাবিহার ধবংস করেছিলেন। বৌদ্ধ নিপীড়নের কিছু নমুনা প্রসঙ্গে বিখ্যাত সোমপুর মহাবিহার ধবংসের কথা নীহাররঞ্জন রায় এভাবে উল্লেখ করেছেন: “..ভারতীয় কোনও রাজা বা রাজবংশের পক্ষে পরধর্মবিরোধী হওয়া অস্বাভাবিক, এ যুক্তি অত্যন্ত আদর্শবাদী যুক্তি, বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি তো নয়ই। অন্যকাল এবং ভারতবর্ষের অন্য প্রান্তের বা দেশখণ্ডের দৃষ্টান্ত আলোচনা করিয়া লাভ নাই; প্রাচীনকালের বাঙলাদেশের কথাই বলি। বঙ্গাল-দেশের সৈন্য-সামন্তরা কি সোমপুর মহাবিহারে আগুন লাগায় নাই? বর্মণ রাজবংশের জনৈক প্রধান রাজকর্মচারী ভট্ট-ভবদেব কি বৌদ্ধ পাষন্ড বৈতালিকদের উপর জাতক্রোধী ছিলেন না? সেন-রাজ বল্লাল সেন কি ‘নাস্তিকদের (বৌদ্ধ) পদচ্ছেদের জন্যই কলিযুগে জন্মলাভ’ করেন নাই?”৪৬

দেখা যাচ্ছে যে, পঞ্চম শতকে গুপ্ত সম্রাটদের বদান্যতায় নালন্দার প্রকৃত গোড়াপত্তন হলে এই প্রতিষ্ঠান এদেশে উচ্চশিক্ষা ও মননশীলতার ক্ষেত্রে যে গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করেছিল ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত দীর্ঘ আটশো বছর তা অব্যাহত ছিল। সপ্তম শতকে চিনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ ও ইৎ-সিং নালন্দার সংগঠন, কর্মপদ্ধতি লক্ষ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁরা নালন্দা মহাবিহারের যে বিশদ বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য ও গবেষণার দ্বারা তার যথার্থতা প্রতিপন্ন হয়েছে। আটটি কলেজ, কয়েকটি সুবৃহৎ আগার, গ্রন্থাগার, মানমন্দির, শ্রমণ, অধ্যাপক ও ছাত্রদের বাসস্থানের উপযোগী বহু বিচিত্র সৌধমালার অপূর্ব সমাবেশে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত হয়েছিল। সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা বেষ্টন করে ছিল একটি দীর্ঘ প্রাচীর। ইৎ সিং-এর বর্ণনায় জানা যায়, প্রায় ৩০০০ শ্রমণ ও বিদ্যার্থী অবস্থান করবার মত ব্যবস্থা নালন্দায় ছিল। হিউয়েন সাঙ-এর জীবনীকার হুই-লি এই সংখ্যাকে ১০,০০০ বলে উল্লেখ করেছেন। এ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরাটত্বের আভাস পাওয়া যায়।

এটাও বোঝা যাচ্ছে যে, বখতিয়ার খলজি কর্তৃর্ক নালন্দা ধবংসের বিষয়টি খুবই বিতর্কিত-এ নিয়ে কোনো সহজ সিদ্ধান্তে আসা যায় না। বখতিয়ার তৎকালীন বিহারের রাজধানী হিসেবে ১২০৩ সালে আক্রমণ চালিয়েছিলেন উদন্তপুরীতে। কিন্তু তা ধবংস করেছেন বলা অতিরঞ্জিত। তিনি ভুলে সামরিক দূর্গ ভেবেই উদন্তপুরীতে হামলা করেছেন। এ প্রসঙ্গে গ্রন্থাগার পোড়ানোর বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও তা রটনা মাত্র। অন্যদিকে হামলা তো দূরের কথা, বখতিয়ার নালন্দাতেই যাননি। মিনহাজ নালন্দা ধবংস নিয়ে কোনো কথা বলেননি। এরপরেও অবশ্য কিছু পণ্ডিত নালন্দা ধবংসের জন্য বখতিয়ারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান। উল্লেখ্য যে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবলুপ্তির সঙ্গে ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্মের অন্তর্ধানের একটি সম্পর্ক রয়েছে। সপ্তম শতকে ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনের সময় হিউয়েন সাঙ লক্ষ করেছিলেন, যে এককালের সক্রিয় বৌদ্ধধর্ম ধীরে ধীরে পতনের দিকে এগিয়ে চলেছে। শুধু তাই নয়, তিনি নালন্দার পরিসমাপ্তির দুঃখজনক পূর্বাভাষও পেয়েছিলেন। সেই সময় বৌদ্ধধর্ম দ্রুততার সঙ্গে তার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিল। কেবলমাত্র অধুনা বিহার ও বাংলা অঞ্চলের রাজারাই এই ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন। পাল শাসনকালে বৌদ্ধ ধর্মের প্রথাগত মহাযান ও হীনযান সম্প্রদায়ে গোপন আচার অনুষ্ঠান ও যাদুবিদ্যা সংক্রান্ত তান্ত্রিক কার্যকলাপ অন্তর্ভুক্ত হয়। পাশাপাশি এই ধর্মমতে সহজযান, বজ্রযান প্রভৃতি নানা গোষ্ঠীও তৈরি হয় এবং এই গোষ্ঠীগুলির অন্তর্কলহে বৌদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা ধীরে ধীরে ক্ষয় পেতে শুরু করে। তাছাড়া সংঘে নারীদের প্রবেশের অনুমতি দেওয়ায় এবং ভিক্ষুনীদের সংখ্যা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়াও সংঘগুলিতে অনাচার ও অনৈতিকতা প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা মদেও আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল।

ফলে জনমানসে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সম্পর্কে একটা বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হতে লাগল।** সেইসঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশে বৈষ্ণব ও শৈব দার্শনিক- যেমন উদ্যোতকর, কুমারিল ভট্ট, শংকরাচার্য, উদয়নাচার্য, বাচস্পতি মিশ্র প্রমুখের আগ্রাসন, ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকদের চরম বৌদ্ধদ্বেষ নীতি এবং একাদশ শতকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজবংশের পতনের ঘটনা থেকেই বোঝা যায় যে, সে সময়ে বৌদ্ধধর্মের উপর রাজনৈতিক-দার্শনিক-নৈতিক দিক হতে চরম আঘাত নেমে এসেছিল। এ সত্বেও ত্রয়োদশ শতকের প্রারম্ভে বখতিয়ার খলজির বিহার আক্রমণই ভারতে বৌদ্ধধর্মের ওপর শেষ আঘাত হেনেছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যে যাদের গোপন সাহায্যে বখতিয়ার তথা মুসলিমরা বিহার ও বাংলা জয় করলেন তাদের উপর বা তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপর মুসলমানরা চরম আঘাত হানবেন এমনটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। আসল কথা হল, নালন্দা ধবংস হয়েছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুদের হাতেই। নালন্দা মহাবিহার ধধ্বংসে অর্থনীতির বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা, আমরা যখন বলি রাজনীতি সর্বদাই অর্থনীতিকে অনুসরণ করে তখন ভিন্ন প্রেক্ষাপটের দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। সমাজে তখন প্রচলিত ছিল বিদ্যা শিক্ষাদানের জমজমাট ব্যবসা। এক- একজন ব্রাহ্মণ পরিবারে কম করে হলেও চার-পাঁচশ ছাত্র থাকত। এরা গুরুর কাছে শুধু বিদ্যাশিক্ষাই করত না, গুরুগৃহের যাবতীয় কাজকর্ম ভাগ করে নিত। যার ফলে আরাম-আয়েশের দিক দিয়ে একেকজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এক-একজন সামন্তের মতো দিন যাপন করতেন। আচার্যের গ্রাম একটি ছোট্ট সামন্ত রাজের গ্রামের মতোই প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ছিল, যদিও এই আচার্য ছিলেন রাজ-পুরোহিত। আর এখানেই আঘাত হানে বৌদ্ধ ধর্মীদের বিহার সমূহ। বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র ছিল বিহারগুলি। শত শত আবাসিক বিহার গড়ে ওঠে সারা ভারতভূমিতে। বিদ্যাশিক্ষার জন্য দলে দলে বিদ্যার্থীরা নাম লেখাতে থাকে নানা বিহারে। তাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের সংখ্যাও কম নয়। ইতিমধ্যে তাদের পরিবার বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়ে নেয়। তাছাড়া বিদ্যাদানের ব্যাপারে বিহারগুলিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, চণ্ডাল-এসবের কোনো বৈষম্য ছিল না। সব শ্রেণির মানুষের জন্য বিহারের দরজা ছিল উন্মুক্ত। ফলে টোলের ব্রাহ্মণদের বিদ্যাদানের ভাটার টান ধরে, একদমই মহাভাটা। অতএব, নালন্দা বিহার ধবংস করা অর্থনৈতিক কারণেও তাদের জন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে।

ঐতিহাসিক ডি আর পাতিল তাঁর ‘অ্যান্টিকোয়ারিয়ান রিমেইন্স অফ বিহার’ গ্রন্থে (বিহার সরকার কর্তৃক প্রকাশিত, এটা নালন্দা ধবংসের উপর লিখিত একমাত্র গবেষণাপত্র) বলেছেন যে, শৈবরাই নালন্দা ধবংস করেছিল। তিনি এও লিখেছেন যে, নালন্দা ধবংস হয়েছিল বখতিয়ারের বিহার আক্রমণের পূর্বেই। স্কন্দগুপ্তের সময়ে (৪৫৫-৪৬৮) নালন্দা প্রথম আক্রান্ত ও ধবংস হয় শৈবরাজা মিহিরকুলের দ্বারা। প্রায় দেড় শতাব্দী পরে গৌড়রাজ শশাঙ্কের সময়ে (৬০৬- ৬৪৭) নালন্দা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়। এটা ছিল রাজা শশাঙ্ক ও কনৌজের রাজা হর্ষবর্ধনের সংঘর্ষের ফলশ্রুতি। এরপর উত্তর বিহারের তিরহূতের রাজা অর্জুনের সময় একদল ব্রাহ্মণ দুর্বৃত্তের হাতে নালন্দা আক্রান্ত হয় ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও পালযুগে মহীপালের সময়ে (৯৮১-১০২৯) নালন্দা আগুনে বিনষ্ট হয়। বার বার ধবংসপ্রাপ্ত নালন্দার সংস্কারও হয়েছিল সময়ে সময়ে। তবে তা সত্ত্বেও শেষরক্ষা হয়নি।

৭ 

সুতরাং স্পষ্টতই বলা যায় যে, বখতিয়ার বিহার ও পরবর্তীতে বাংলায় অভিযান চালিয়েছেন সত্য এবং সেটা তিনি করেছেন বৌদ্ধদের আহবানে। সেটা করতে গিয়ে তাঁর বাহিনীর হাতে উদন্তপুরী ও বিক্রমশীলা মহাবিহার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং সেই সঙ্গে বহু মানুষও মারা গিয়েছিল। কিন্তু বখতিয়ার ঐতিহাসিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধবংসের সংগে কোনোভাবেই জড়িত ছিলেন না। বরং বখতিয়ারের সময় ও পরবর্তী মুসলিম শাসনে নালন্দা সহ অনেক বৌদ্ধ বিহারে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্বের মতোই জ্ঞানচর্চা চলেছিল। কিন্তু দেশীয় ও বিদেশীয় রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা সত্ত্বেও মূলত অষ্টম শতকের শেষভাগ থেকে নালন্দার গৌরব-সূর্য ধীরে ধীরে অস্তমিত হতে থাকে, বিশেষ করে ৮১০ সালে বিক্রমশীলা মহাবিহার প্রতিষ্ঠার পরই। পাল রাজাদের সময়ে বিক্রমশীলার পরিচালকবৃন্দই নালন্দা পরিচালনা করতেন। তার ওপর তখনকার নানা গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ ও আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে দীর্ণ নালন্দা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। অথচ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে সমূলে ধবংস করা ও বৌদ্ধ ধর্মকে তার উৎসস্থল হতে নির্মূল করার জন্য বখতিয়ারের উপর দোষারোপ করা হয়-এটা ঐতিহাসিক সততার চরম ও কদর্য বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। পক্ষপাতদুষ্ট ঐতিহাসিকগণের এই প্রচেষ্টা তাঁদের বস্তুনিষ্ঠ ঐতিহাসিক জ্ঞানের চরম দীনতা প্রকাশ করে।

তথ্যসূত্র

১। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, নালন্দার পরিচিতি ছিল কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে, অথচ এরকম মহাবিহার (বিশ্ববিদ্যালয়) তখন আরও ছিল। যেমন সৌরাষ্ট্রের বলভী বিশ্ববিদ্যালয়। এটাও নালন্দার মতোই ২০০ গ্রাম থেকে রাজস্ব পেত। (ডি এন ঝা, আর্লি ইন্ডিয়া: এ কনসাইজ হিস্ট্রি, বাংলা সং- আদি ভারত: একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৮, পৃ. ১৮০)।

২। ডি এন ঝা, হাউ হিস্টরি ওয়াজ আনমেড অ্যাট নালন্দা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস: ৯ জুলাই, ২০১৪।

৩। ডি এন ঝা, হাউ হিস্টরি ওয়াজ আনমেড অ্যাট নালন্দা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস: ৯ জুলাই, ২০১৪।

৪। যদুনাথ সরকার সম্পাদিত, হিস্টরি অফ বেঙ্গল, খণ্ড-২, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, ১৯৭২, পৃ. ৩২-৩৩।

৫। ‘পাগ সাম জন জাং’ আঠারো শতকের এক তিববর্তী পণ্ডিতের লেখা বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস। শরৎচন্দ্র দাস ১৯০৮ সালে ইংরেজি সূচিপত্র ও টীকাসহ এর একটি সম্পাদিত সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন। পাগ সাম জন জ্যাং: হিস্টরি অফ দ্য রাইজ, প্রোগ্রেস অ্যান্ড ডাউনফল অফ বৌদ্ধ ইজম ইন ইন্ডিয়া, এডিটেড বাই শরৎচন্দ্র দাস, প্রেসিডেন্সি জেল প্রেস, কলকাতা, ১৯০৮। এই বইটির এখনও কদর আছে।

৬। এইচ ধীরাজ সাংকালিয়া, ইউনিভার্সিটি অফ নালন্দা, বি জি পাল অ্যান্ড কোম্পানি, মাদ্রাজ, ১৯৩৪, পৃ. ২১২।

৭। জর্জ রোয়েরিখ সম্পাদিত, বায়োগ্রাফি অফ ধর্মস্বামী, কে পি জয়সওয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, পাটনা, ১৯৫৯, ইনট্রোডাকশন, পূ. XX.

৮। জর্জ রোয়েরিখ সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, ইনট্রোডাকশন, পৃ. xix. 

৯। জর্জ রোয়েরিখ সম্পাদিত, ইনট্রোডাকশন, ভূমিকা, পৃ. xix. পণ্ডিত সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ এই মত পোষণ করেন যে, মুসলমান আক্রমণের পরও সেখানে বহু মন্দির ও বিহার নির্মিত হয়েছিল।

(রমেশচন্দ্র মিত্র, ডেকলাইন অফ বুদ্ধ ইজম ইন ইন্ডিয়া, শান্তিনিকেতন, ১৯৪৯, পৃ. ৪৬)। লামা তারানাথও তাঁর বর্ণনায় গুজরাট, রাজপুতানায় মুসলমান বিজয়ের পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্মের পুনরুজ্জীবনের কথা বলেছেন। এ প্রসঙ্গে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘বুদ্ধ চরিত’ (১৯১১) নামে একটি পদ্য রচনার কথা বলা যায়, যেখানে বুদ্ধ কে বিদ্র অবতার বলা হয়েছে। সুতরাং বৌদ্ধ ধর্মের প্রায়-অবলুপ্তির কোনো নির্দিষ্ট তারিখ বা প্রকৃতির সঠিক বর্ণনা করা দুরুহ ব্যাপার।

১০। জর্জ রোয়েরিখ সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, ইনট্রোডাকশন, পৃ. xx. ১১। যোহান এলভার্সকগ, বুদ্ধ ইজম অ্যান্ড ইসলাম অন দ্য সিল্ক রোড, ফিলাডেলফিয়া ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভেনিয়া প্রেস, ২০১০, ইনট্রোডাকশন, পৃ. ২। ১২। ডি এন ঝা, হাউ হিস্টরি ওয়াজ আনমেড অ্যাট নালন্দা, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস: ৯ জুলাই, ২০১৪।

১৩.। জার্নাল অফ বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি, রাজশাহী, ১৯৪০। ১৪। আবদুল মোমেন চৌধুরী, দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অফ বুদ্ধিজম ইন সাউথ এশিয়া, ইনস্টিটিউট অফ সাউথ এশিয়া, লন্ডন, ২০০৮।

১৫.। যোহান এলভার্সকগ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪।

১৬। বুদ্ধগয়া গয়া-দর্শন রাজগীর নালন্দা পাওয়াপুরী: পর্যটক সহায়ক পুস্তিকা, নালন্দা, পৃ. ১৬-১৭; দ্রঃ-আমীর হোসেন, বাঙালীর বিভাজন, অনুষ্টুপ, বিশেষ শীতকালীন সংখ্যা ১৪০৮, কলকাতা।

১৭। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৬। দেখুন-পাগ সাম জন জ্যাং, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯২। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ শ্যামাপ্রসাদ চট্টরাজ লিখেছেন, “দু’জন তান্ত্রিক সন্ন্যাসী নালন্দায় আসেন এবং কোনো কারণে নালন্দায় শিক্ষার্থীদের দ্বারা অপমানিত হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আগুন লাগিয়ে এই বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়টি ধবংস করে দেয়।” (শ্যামাপ্রসাদ চট্টরাজ, ভারতের শিক্ষার ইতিহাস, প্রথম প্রকাশ, সাহিত্যশ্রী, কলকাতা, ২০১৬, পৃ. ৮৭)।

১৮ । Lama Taranatha, History of Buddhism in India, English translated from Tibetan by Lama Chimpa & Alka Chattopadhyaya, Edited by Debiprasad Chattopadhyaya, Motilal Banarsidass Publishers Private Ltd, Delhi, reprint, 1990, P. 141-142.

১৯। বি এন এস যাদব, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার ইন নর্দার্ন ইন্ডিয়া ইন টুয়েলভথ সেঞ্চুরি, রাকা প্রকাশন, এলাহাবাদ, ২০১২, পৃ. ৩৪৬।

২০। আর এস শর্মা ও কে এম শ্রীমালি, এ কমপ্রিহেন্সিভ হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, খণ্ড-৪, ভাগ-২, অধ্যায় ২৫-খ: বৌদ্ধ ধর্ম, মনোহর পাবলিশার্স, নিউদিল্লি, ২০০৮, পাদটীকা, পৃ. ৭৯-৮২।

২১। ডি আর পাতিল, অ্যান্টিকোয়ারিয়ান রিমেইন্স অফ বিহার, কে পি জয়সওয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউট, পাটনা, ১৯৬৩, পৃ. ৩২৭।

২২। ডি আর পাতিল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২৫। 

২৩। ডি আর পাতিল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩০৪।

২৪। ডি আর পাতিল, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২৫।

২৫। দেখুন- যতীন্দ্রমোহন রায়, ঢাকার ইতিহাস, খণ্ড-২, প্রথম দিব্যপ্রকাশ সংস্করণ, ঢাকা, ২০১৭, পৃ. ৫৯। স্যামুয়েল বিল (ট্রান্সলেটেড), সি ইউ কি বুদ্ধিস্ট রেকর্ডস অফ দ্য ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড, খণ্ড-১, কিগান পল ট্রেঞ্চ টুবনার অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড, লন্ডন, ১৯০৬, পৃ. ১৬৭-৭।১ কলহন, রাজতরঙ্গিনী (এম এ স্টেন, ক্রনিকলস অফ দ্য কিং অফ কাশ্মীর, ওয়েস্টমিনিস্টার, ১৯০০, পুনর্মুদ্রণ, ১৯৬১), খণ্ড-১, পৃ. ৮২৫। আরও দেখুন-রমেশচন্দ্র মিত্র, ডেকলাইন অফ বুদ্ধ ইজম ইন ইন্ডিয়া, শান্তিনিকেতন, ১৯৪৯, পৃ. ১২০।

২৬। দেখুন-যতীন্দ্রমোহন রায়, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩।

২৭। এ এল ব্যাসাম, দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া, বাংলা সংস্করণ- অতীতের উজ্জ্বল ভারত, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০১৮, পৃ. ৩৬১। ঐতিহাসিক মোরল্যান্ড ও চ্যাটার্জির যৌথ প্রচেষ্টায় লিখিত ‘A short History of India’ গ্রন্থের ৯৮ পৃষ্ঠায়ও এ তথ্য রয়েছে। হিউয়েন সাঙ জানিয়েছেন, মিহিরকুল ১৬০০ বৌদ্ধস্তূপ ও মন্দির ধবংস করেন এবং হাজার হাজার বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে হত্যা করেন। তাঁর বিবরণকে সমর্থন করেছেন একাদশ শতকের ঐতিহাসিক কলহন; যিনি কাশ্মীরের রাজা হর্ষ কর্তৃক বৌদ্ধদের নিগ্রহের উল্লেখ করেছেন। (ডি এন ঝা, এক হিন্দু আত্মপরিচয়ের খোঁজে, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ২৫)।

২৮। রেভারেন্ড এইচ হিরাস, দ্য রয়েল পেট্রনস্ অফ দ্য ইউনিভার্সিটি অফ নালন্দা, দেখুন- জার্নাল অফ দ্য বিহার অ্যান্ড উড়িষ্যা রিসার্চ সোসাইটি, পার্ট-১, খণ্ড-১৪, ১৯২৮, পৃ. ৮-৯।

২৯। জার্নাল অফ দ্য বিহার অ্যান্ড উড়িষ্যা রিসার্চ সোসাইটি, প্রাগুক্ত।

৩০। হান্স বেকার, দ্য ওয়ার্ল্ড অফ দ্য স্কন্দপুরাণ: নর্দার্ন ইন্ডিয়া ইন দ্য সিক্সথ অ্যান্ড সেভেন্থ সেঞ্চু রিজ (সাপ্লিমেন্ট টু গ্রোনিনজেন ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ), ব্রিল অ্যাকাডেমিক পাবলিশার্স, লিডেন, নেদারল্যান্ডস, ২০১৪, পৃ. ১২৮-২৯।

৩১। ডি ডি কোসাম্বী, দ্য কালচার অ্যান্ড সিভিলাইজেশন অফ এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়া ইন হিস্টরিক্যাল আউটলাইন, লাহোর, ১৯৯১, পৃ.১৮০।

৩২। শৈলেন্দ্রনাথ সেন, অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়ান হিস্টরি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন, নিউ এজ ইন্টারন্যাশনাল, নিউদিল্লি, ১৯৯৯, পৃ. ২৬।

৩৩। দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, ভারত ইতিহাসের সন্ধানে, আদিপর্ব: দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্যলোক, কলকাতা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ২০১৭, পৃ. ১৫৮।

৩৪। Amalananda Ghosh, A Guide to Nalanda, Publisher : Director General of Archaeology in India, 5th edition, Archaeological Survey of India, New Delhi, 1965, P. 13. ৩৫। এস এন সদাশিবন, এ সোস্যাল হিস্টরি অফ ইন্ডিয়া, এ পি এইচ পাবলিশিং, নিউদিল্লি, ২০০০, পৃ. ২০৯।

৩৬। বুদ্ধ প্রকাশ, অ্যাস্পেক্টস অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি অ্যান্ড সিভিলাইজেশন, শিবলাল আগরওয়াল, আগ্রা, ১৯৬৫।

৩৭। এইচ ধিরাজ সাংকালিয়া, ইউনিভার্সিটি অফ নালন্দা, বি জি পাল অ্যান্ড কোম্পানি, মাদ্রাজ, ১৯৩৪।

৩৮। এইচ ধিরাজ সাংকালিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১২।

৩৯। এইচ ধিরাজ সাংকালিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৪।

৪০। এইচ ধিরাজ সাংকালিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৮।

৪১। লুসিয়েন পোলাওঁ, বুকস অন ফায়ার দ্য ডেস্ট্রাকশন অফ লাইব্রেরিজ ঘুআউট হিস্টরি, ইনার ট্রাডিশন্স পাবলিকেশন, রোচেস্টার, ইউনাইটেড স্টেটস্, ২০০৭।

৪২। এ এল ব্যাসাম, অতীতের উজ্জ্বল ভারত, বাংলা সংস্করণ, প্রগ্রেসিভ পাবলিশার্স, পুনর্মুদ্রণ, ২০১৮, পৃ. ৩৬২ ও পৃ. ২২৫, ৩৬০।

৪৩। এইচ ধিরাজ সাংকালিয়া, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৪।

৪৪। এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, খণ্ড-২১, বিপুলশ্রী মিত্রের নালন্দা তাম্রশাসন, পৃ. ৯৭। আরও দেখুন- শামসুন নাহার, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের আলোকে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ধারাবাহিক ইতিহাস, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৬, পৃ. ১৮৯।

৪৫। এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা, প্রাগুক্ত, দ্বিতীয় পংক্তি দ্রষ্টব্য।

৪৬। নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালির ইতিহাস, আদিপর্ব, দে’জ পাবলিশিং হাউস, সপ্তম সংস্করণ, কলকাতা, ১৪১৬, পৃ. ৫০৬ ও পৃ. ৪১৯, ৩০২।

৪৭। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রচনা সংগ্রহ, খণ্ড-৩, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ, কলকাতা, ১৯৮৪, পৃ. ৩৮।

( প্রবন্ধটি ‘উজ্জীবন’ এ, এপ্রিল ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত)।

You may also like