বালাপোশঃ মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্যের অতীত ও বর্তমান

by তুহিনা খাতুন

বাংলার অন্যতম ইতিহাস সমৃদ্ধ ঐতিহ্যমন্ডিত জেলা মুর্শিদাবাদ। একসময় বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী ‌ হিসাবে চিহ্নিত মুর্শিদাবাদ খ্যাতির চরম শিখরে পৌঁছেছিল। পলাশীর যুদ্ধের পর শুরু হয় ভাগ্য বিপর্যয়। পরবর্তীতে নানা ঘটনার ঘনঘটায় ভাগীরথীর জল গড়িয়েছে অনেক দূর। হারিয়ে গেছে তার অতীত গৌরব ও জৌলুস। অতি প্রাচীন কাল থেকেই মুর্শিদাবাদের ভূমি ইতিহাস ও ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ। পথে-ঘাটে, অলিতে-গলিতে, নির্জন প্রান্তরে, আঁকে বাঁকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কত না অজানা ইতিহাস। প্রতিটি ধূলিকণাতে মিশে রয়েছে রাজা, মহারাজা , ঞ্জানী-গুনী বিদ্বজনদের পদচিহ্ন। বাতাস যেন আজও বয়ে নিয়ে চলেছে সেই পুরনো গন্ধ। যুগ যুগ ধরে প্রাচীন স্থাপত্য ও ভাস্কর্য শিল্প নিদর্শন গুলো আজও বহু উত্থান পতনের সাক্ষী হয়ে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আবার কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে কত না অমূল্য সম্পদ। বিলীন হয়ে গেছে চরম উদাসীনতার কারণে। সমস্ত কিছুর সাক্ষী হয়ে নীরবে আজও বয়ে চলেছে ভাগীরথী। যাইহোক, আমাদের অতীত ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করতে হবে। বাঁচিয়ে রাখতে হবে সেই ঐতিহ্য আগামী প্রজন্মের জন্য।

আঠারো শতকে সমৃদ্ধির চরম শিখরে মুর্শিদাবাদ, বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী।সিংহাসনে মুর্শিদকুলি খাঁ ও পরবর্তী নবাবেরা। সেই নবাবী ঘরানার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে এক অসামান্য শিল্প সৃষ্টি, এক অবিস্মরণীয় নাম ‘বালাপোশ’। তাইতো বালাপোশ নামেই কেমন নবাবী গন্ধ পাওয়া যায়। আজও নবাবী ঐতিহ্যকে নীরবে বহন করে চলেছে এই বালাপোশ। যদিও তার আভিজাত্য কিছুটা ফিকে হয়েছে। উদাসীনতার কারণে কদর কমেছে অনেকটা। তবুও অস্তিত্ব সংকটের মধ্য দিয়েও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে অতীতের সেই গৌরবময় ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন বহরমপুর খাগড়ার বড় মসজিদ এলাকার বাসিন্দা বালাপোশ শিল্পী সাখাওয়াত হোসেন খানের বংশধররা।

শিল্প বাণিজ্যের দিক থেকে মুর্শিদাবাদ তখন সমৃদ্ধশালী। এখানকার রেশম শিল্প, সিল্ক, কাঁসা শিল্প, হাতির দাঁতের কাজ ইত্যাদি বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে সারা ভারতে ব্যাপক চাহিদা এমনকি বিশ্বেও সমাদৃত। এমনই এক শিল্প বালাপোশ যার খ্যাতি দেশের গণ্ডি অতিক্রম করে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বালাপোশ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার কৌতূহল সামলাতে না পেরে একদিন হাজির হই খাগড়ার বড় মসজিদের পাশে বালাপোশ শিল্পী সাখাওয়াত হোসেন খানের বাড়িতে। সমৃদ্ধ হয়েছিলাম ওনার স্ত্রী, ছেলে ও মেয়ের কাছ থেকে ইতিহাসের নানান অনালোকিত ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে কিছুটা লেখার চেষ্টা—

প্রচন্ড ঠান্ডায় নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ দিশেহারা। কিছুতেই কাবু করতে পারছেন না শীতকে। এদিকে মোটা মোটা লেপ কম্বল টেনে টেনে রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। রুচি হারিয়েছেন এসবে। নবাব বলে কথা। এমন কিছু কি পাওয়া সম্ভব যেটা ওজনে হবে ভীষণ হালকা, আবার এতটাই গরম যে শীত তার কাছে আত্মসমর্পণ করবে। আর গায়ে পরলে অনুভূতি হবে এমন যেন মায়ের কোলের মধ্যে আছেন অর্থাৎ মাতৃ ক্রোড়ের উষ্ণতা পাওয়া যাবে। বিস্তর চিন্তাভাবনার পর উপায় বার করলেন তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন। খুঁজে পেলেন যেন আলাদিনের আশ্চর্য চিরাগ যা সব অসম্ভবকে সম্ভব করবে। সুজাউদ্দিনের নির্দেশে এই দায়িত্ব তুলে নিলেন শিল্পী আতর হোসেন খান। আতর হোসেন খানের ভরসা তাঁর দক্ষ কারিগর রমজান খলিফা। যার হাতের কাজে জুড়ি মেলা ভার। হাতের কাজ ছিল যেমন নিখুঁত তেমন প্রশংসনীয়। খলিফা রমজান শেখ সমস্ত চাহিদার কথা মাথায় রেখে তার শিল্প নৈপুণ্যে শেষ পর্যন্ত নিখুঁতভাবে গড়ে তুললেন এক অবিস্মরণীয় বালাপোশ।

বালাপোশ তৈরীর কৌশল সযত্নে সঞ্চিত রইল আতর হোসেন খানের হৃদয়ে। বংশ পরম্পরায় তা প্রবাহিত হতে লাগল।আতর হোসেন খান, আমির হোসেন খান, সাখাওয়াত হোসেন খান, স্ত্রী – চাঁদ বিবি (বেওয়া), ছেলে -সারাফাৎ হোসেন খান‌‌‍, মেয়ে-ববি বেওয়া, রুমি খাতুন, সাবিনা বেগম।


নবাবী আমলের খাঁটি বালাপোশ তৈরী হতে লাগলো মুর্শিদাবাদে, সারা ভারত তথা বিশ্বে কোথাও এই খাঁটি বালাপোশ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আতর হোসেন খান ছিলেন সাখাওয়াত হোসেন খানের দাদু। আর আমির হোসেন খান সাখাওয়াত হোসেন খানের বাবা। আমির হোসেন খান বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। বালাপোশ ছাড়াও একাধিক হস্তশিল্পে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। তিনি কসমেটিক্স দ্রব্য তৈরীর নানান ফর্মুলাও জানতেন। সাখাওয়াত হোসেন খান উওরাধিকার সূত্রে এই গুন পেয়েছিলেন। সাখাওয়াত হোসেন খান‌ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সুনিপুণ কৌশলে একের পর এক বালাপোশ বুনে যেতেন। ছেলে মেয়েরা পাশে বসে মুগ্ধ হয়ে বাবার কাজ দেখতেন। এভাবেই কৌশল রপ্ত করতেন। শিল্পী সাখাওয়াত হোসেন খানের মৃত্যুর পর বালাপোশ ক্রমশ তার কৌলিন্য হারাতে থাকে। তবুও উনার স্ত্রী, ছেলে ও দুই মেয়ে এই ঐতিহ্যবাহী মৃতপ্রায় হস্তশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে সুদিন ফেরার আশায়।

বালাপোশ তৈরী করার কাজটা কিন্তু মোটেই সহজ সাধ্য নয়। এর সাথে জড়িয়ে থাকে কারিগরের অসীম ধৈর্য্য, প্রচুর পরিশ্রম ও সর্বোপরি ভালোবাসা। বালাপোশ তৈরী করতে প্রয়োজন হয় উৎকৃষ্ট মানের দীর্ঘ আঁশওয়ালা কার্পাস তুলোর। প্রথমে তুলো থেকে বীজ ছাড়িয়ে নেয়ার পর লাল রঙে চুবিয়ে তারপর খুব ভালো করে রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। রোদে শুকাতেই লেগে যায় বেশ কয়েকদিন। তারপর শুরু হয় তুলোধোনার কাজ ‌। তুলো ধুনাইয়ের উপর নির্ভর করে বালাপোশের গুণগতমান, তাই দক্ষ ধুনুরির প্রয়োজন। তুলো ধোনাই এর জন্য দরকার বিশেষ ধরনের যন্ত্র। এই যন্ত্র দিয়ে বারবার তুলো ধুনতে হয় (কমপক্ষে প্রায় ১৫-২০বার)। যত ধুনাই করা হবে , তুলো তত ওজনে হালকা হতে থাকবে। সম্পূর্ণ বদ্ধঘরের মধ্যে নিজেকে আটকে রেখে কারিগর এই কাজ করে থাকেন। এক টুকরো সিল্কের কাপড় মেলে ধরে তার পাশে তুলো নিয়ে ধুনতে হয়। তুলোর পাতলা আঁশ রেনুর মতো বাতাসে উড়ে এবং ধীরে ধীরে সিল্কের কাপড়ের উপর পড়ে। এই ভাবেই তুলো ধুনে ধুনে দিনের পর দিন কাপড়ের উপর তুলোর আস্তরণ ফেলতে হয়। আস্তরণ কোথাও মোটা আবার কোথাও পাতলা হলে চলবে না। সমানভাবে কাপড়ে পড়া চায়।। এমনই শিল্পীর শিল্প নৈপুণ্য।

বালাপোশের একপিঠে সিল্ক ও অন্য পিঠে মখমলের কাপড় দিয়ে প্রথমে সর্গজেবন্ধ ও পরে আসাদ সেলাই দিয়ে চার স্তরে তৈরী হয় বালাপোশ।নবাবী আমলে ঢাকায় মসলিন দিয়ে বালাপোশ তৈরী হত। আভিজাত্যপূর্ণ এই বালাপোশের ওজন হত এক থেকে দেড় পোয়া। বালাপোশের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এই বালাপোশের সারা গায়ে থাকে না কোন সেলাই এর দাগ শুধু চারিপাশের প্রান্তিক সেলাই ধরে রাখে তুলোকে। এই সেলাইকে বলা হয় আসাদ সেলাই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল বালাপোশ যতই নাড়াচাড়া করা হোক বা টানা হেঁচড়া করা হোক না কেন তুলো কিন্তু বিনা সেলাইয়ে এদিক ওদিক সরে যায় না বা গুটিয়ে জড়ো হয়ে যায় না। এখানেই শিল্পীর সার্থকতা।

উন্নতমানের কার্পাস, ঢাকাই মসলিন, নবাবী আমলের দামী আতর আর তেমন পাওয়া যায় না। তার সাথে দোষর দক্ষ কারিগরের অভাব। তাই প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে একসময়ের নবাবী মেজাজের সুপ্রসিদ্ধ বালাপোশ। এখন বালাপোশের দুদিকেই সিল্ক বা একদিকে সিল্ক আর অন্যদিকে রেশম খাদি বা সুতির কাপড় ব্যবহার করা হয়। আবার ক্রেতার চাহিদার দিকেও লক্ষ্য রাখা হয়। এক্ষেত্রে দামটাও একটা বড় বিষয়। গুনগত মান বজায় রাখলে বতর্মানে একটা সিঙ্গল বালাপোশের দাম প্রায় ১২-১৩ হাজার টাকা আর ডাবল বালাপোশের দাম প্রায় ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা।

এই বালাপোশের নামকরণ করেছিলেন রমজান খলিফা। তিনি উত্তর প্রদেশ থেকে এসে মুর্শিদাবাদে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন। তিনি নাকি আতর হোসেন খানের অধীনে একজন কারিগর ছিলেন। তখন ৪০ জনেরও বেশি কারিগর আতর হোসেন খানের অধীনে কাজ করতেন। নবাবের চাহিদার কথা মাথায় রেখে রমজান খলিফার তৈরি বালাপোশ পেয়ে নবাব তো বেজায় খুশি হয়েছিলেন। নবাব খুশি হয়ে বেশ কিছু জমি বকসিস দিয়েছিলেন শিল্পীকে।কিন্তু সমস্যা হল শীত তো কদিনের অতিথি। বছরের বেশিরভাগ সময় বালাপোশ আলমারি বন্দী হয়ে পড়ে থাকতো। ফলে এতে সোঁদা গন্ধ হত। নবাবের যা মোটেই পছন্দের নয়। উপায় বের হল। তুলোতে মেশানো হলো দামী আতর। বিভিন্ন দেশ থেকে দামী দামী সুগন্ধি আতর আনা হতো বালাপোশে ব্যবহারের জন্য। আতরের মোহময়ী গন্ধে ভরে উঠতো ঘর, যেন বসন্ত বিরাজ করত। গায়ে জড়ালেই মনে হতো যেন প্রিয়তমার আলিঙ্গন। যত্ন করে ব্যবহার করলে এই আতরের সুগন্ধ থাকতো প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ বছর। এমনই ছিল বালাপোশের অতীতঐতিহ্য। ভাবখানা তখন এমন যে বালপোশ একটা গায়ে না জড়াতে পারলে বনেদিয়ানা আর বুঝি রক্ষা হয় না। খ্যাতির সরণী বেয়ে এই বালাপোশের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের মাটিতেও।

বালাপোশের বৈদেশিক খ্যাতি অর্জনে একসময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের সিল্ক ব্যবসায়ী সুধাংশু শেখর বাগচী। তাঁর অদম্য ইচ্ছায় ও ঐকান্তিক উৎসাহে ১৯০০ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশ্বমেলায় মুর্শিদাবাদের শিল্পকে তুলে ধরা হয়েছিল। যেমন-রেশম বস্ত্র, বালুচরী শাড়ি, বালাপোশ ইত্যাদি। তিনি ডিপ্লোমা অফ অনার ও স্বর্ণপদক লাভ করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯১১ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত বিশ্ব মেলাতে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন।

বঙ্গভঙ্গ রদের সময় দিল্লীর দরবারে মহারাজা মনিন্দ্রচন্দ্র নন্দী ও সুধাংশু শেখর বাগচী আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। মহারাজা মনিন্দ্রচন্দ্র নন্দী বাগচী মহাশয়কে চিন্তিত হয়ে বললেন দিল্লির দরবারে নেমন্তন্ন বলে কথা তো আমরা গায়ে দিয়ে যাব কি? সেখানে তো সারা ভারতের সম্মানীয় গুণীজন ব্যক্তিরা উপস্থিত হবেন। সুধাংশু শেখর বাগচী বললেন -এমন জিনিস বানাচ্ছি যা দেখে সকলের হুঁশ উড়ে যাবে! তিনি তখন বালাপোশ শিল্পী আমির হোসেন খানকে দিয়ে বানিয়ে নিলেন উন্নতমানের বালাপোশ। আবরোয়াতে দেওয়া হল ঢাকাই মসলিন। তুলোতে মেশানো হলো গোলাপের আতর। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য মসলিনের উপর অভ্রের গুঁড়ো ছিটিয়ে দেওয়া হল যেন আলো পড়লেই চিকচিক করে। বালাপোশ পরে দরবারে প্রবেশ মাত্রই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল গোলাপের আতরের সুগন্ধ। দিল্লির দরবারে হাজির সকলেই মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে রইলেন। মোহিত হয়ে গেলেন। সেদিন সারা ভারতবর্ষের হিরে জহরতকে টেক্কা দিয়ে বাংলার বালাপোশ পেয়েছিল শ্রেষ্ঠ আসন। আমির হোসেন খান মহারাজা মনিন্দ্রচন্দ্র নন্দীর কাজ থেকে প্রচুর সম্মান ও উপঢৌকন পেয়েছিলেন।

নবাবী ঐতিহ্য বহনকারী বালাপোশের সৌরভ সেসময় দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। নবাব বাদশা রাজা-মহারাজা থেকে শুরু করে স্বাধীন ভারতের নেতা-মন্ত্রী ও সরকারী আমলা সকলের গায়ে শোভা পেত এই বালাপোশ। মুর্শিদাবাদের খ্যাতি সম্পন্ন এই বালাপোশ উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছিল লেডি রানু মুখার্জি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী, জ্যোতি বসু সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। এছাড়া ও জগদীশ সিনথা, দেবযানী সিনথা, জিমি কার্টার, ডি .এম সঞ্জীব চোপড়া, অনুকুল ঠাকুর, সারগাছি আশ্রম, সাইবাবা, স্পীকার সোমেন চ্যাটার্জি, আজিমগঞ্জ রাজবাড়ি, কাশিমবাজার রাজবাড়ি, সেনবাড়ি ইত্যাদি আরও অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের স্পর্শে ধন্য হয়েছে বালাপোশ। স্বার্থক হয়েছে শিল্পীর জীবন। দিল্লি, মুম্বাই সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অর্ডার আসতো।

ভারতের ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করে ইংল্যান্ড, আমেরিকার সহ বিভিন্ন দেশেও এক সময় পৌঁছে যেত বালাপোশ। আমেরিকার রেনিস প্রদেশ থেকে একবার এক মহিলা এসে হাজির হয়েছিলেন সাখাওয়াত হোসেন এর বাড়িতে। সাখাওয়াত হোসেন খানকে আমেরিকাতে নিয়ে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এমন লোভনীয় প্রস্তাব ভারতের বিভিন্ন জায়গা ছাড়াও বিদেশ থেকেও এসেছিল। কিন্তু তিনি সব প্রস্তাব প্রত্যাখান করে নিজের ভিটে আঁকড়ে ধরে থেকেছেন আজীবন।

সাখাওয়াত হোসেন খান যতদিন বেঁচে ছিলেন বালাপোশ শিল্পের অতীত ঐতিহ্য ও গৌরব বজায় ছিল। সাখাওয়াত হোসেন খান অল্প বয়স থেকেই বাপ ঠাকুরদার আমলের বংশ পরস্পরায় চলে আসা ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কাজের দক্ষতার জন্য জাতীয়, রাজ্য, জেলা স্তরের প্রচুর পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৮ সালে তিনি কেন্দ্রীয় টেক্সটাইল বিভাগ থেকে পুরস্কার পান ‌। ২০০৮ সালে ‘অ্যাওয়ার্ড অফ এক্সেসেলেন্স সাউথ এশিয়া’ পান। সব পুরষ্কার এখন প্লাস্টিক প্যাকেটে মুড়ে বাক্স বন্দি অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আছে ঢাকাই মসলিন কাপড় ও প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর বোনের লেখা চিঠি। সব অমূল্য সম্পদ কিন্তু করুণ দশা।

সাখাওয়াত হোসেন খান ষাট বছর বয়স থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে পেনশন পেয়েছিলেন দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে। ২০১৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে পেনসন বন্ধ হয়ে যায়। তখন ও তিনি বেঁচে ছিলেন। তারপর আর চালু হয় নি। ২০১৮ সালে ৮৭ বছর বয়সে শেষ দক্ষ শিল্পী সাখাওয়াত হোসেন খান পরলোক গমন করেন। শেষ হয় বালাপোশের গৌরবময় অধ্যায়ের ।উনার স্ত্রী চাঁদ বেওয়া এখন ও বেঁচে আছেন স্বামীর স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরে। স্মৃতি চারণায় চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বাড়িটার দিকে একবার তাকালেই আর্থিক দৈন্যদশার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরিবারের সদস্য সংখ্যা নেহাত কম নয়। যৌথ পরিবার,সকলের একসাথে বাস। অভাব আছে কিন্তু অভাববোধ নেই।তবুও দুচোখ স্বপ্ন দেখে, আশায় বুক বাঁধে হয়তো সুদিন ফিরে আসবে।

২০১৭সালে গান্ধীনগরে অনুষ্ঠিত বস্ত্রশিল্পের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্মেলন “টেক্সটাইল ইন্ডিয়া-২০১৭”য় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বালাপোশ দেখে মোহিত হয়েছিলেন। হাতে নিয়ে পরখ করেছিলেন। বিশ্ব বাংলার তরফ থেকে এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও এর ভবিষ্যৎ সেই তিমিরেই।

এখন মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়েছে। নেই সেই আগের রাজা মহারাজা,আর নেই তাঁদের সেই মেজাজী বালাপোশ। অত্যাধুনিক নানান সৌখিন জিনিসের ভীড়ে নবাবী বালাপোশ এখন প্রায় কোনঠাসা –বিলুপ্তির পথে। সাখাওয়াত হোসেন খান আক্ষেপ করে বলেছিলেন -বালোপোশের অতীত আছে কিন্তু কোন ভবিষ্যৎ নেই। তবে একেবারে বিলুপ্ত হবে না এই শিল্প। তাঁর ছেলে, মেয়েরা ধরে রাখবেন এই শিল্পকে। তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাঁদের পক্ষে এই শিল্পের গৌরব ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। সরকারি সহযোগিতা পাওয়া গেলে এই শিল্প হয়তো স্বমহিমায় ফিরতে পারে!

You may also like