দৃষ্টান্ত

by জয়ন্ত সাহা

তোমরা সোমা’কে চেনো তো! খুব নাম করেছে মেয়েটা। হাওয়ার বেগে ছুটতে পারে। ছুটতে ছুটতে এখন সবাইকে ছাপিয়ে গেছে। নীলগঞ্জের মাঠে সেই সোমাকে দেখতে থইথই করছে ভিড়। এ গ্রামের মুখচোরা রুগ্ন মেয়েটা এসেছে সোনার পদক গলায় ঝুলিয়ে। টিভিতে, খবরের কাগজে নাম উঠেছে সোমার। হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুক সর্বত্রই সোমাকে নিয়ে হই হই রই রই ব্যাপার। সঙ্গে আছে সত্য’দা।মাটি খুঁড়ে রত্ন পেয়েছেন তিনি। তিনটি সোনা। সঙ্গে আবার দু’টি জাতীয় রেকর্ড। সত্যরঞ্জন রায়ের আঠাশ বছরের প্রশিক্ষণ জীবনের সাফল্যের মুকুটে মধুপুরের সোমা পাল একটা লকেট।সেই লকেটের চেকনাই গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। ওদের একচালা টালির ঘরে খুশির হাওয়া। মা অন্নপূর্ণা মানত করেছিল সোমার নামে। বাবাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পেন্নাম ঠুকে বলল, ‘ঠাকুর আমাদের কথা শুনেছে। দেখো, আমাদের একচালা এবার নিশ্চয় পাকা হবে। আরও কত কী হবে দেখো! আমাদের সোমা তিন তিনটি সোনা পেয়েছে। চাট্টিখানি কথা!’

এখনও শহুরে জটিলতা মধুপুরে ডানা মেলেনি।সাদাসিধে মানুষ গুলো অল্পেই সুখী।সাতসকালের লালরঙা সূর্যকে অবাক চোখে দেখে।রোদ বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা পছন্দ করে খুব। আর সন্ধের পর হাতে কাজ না থাকলে তারা ভরা আকাশের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। নুন আনতে পান্তা ফুরানো এ তল্লাটের মানুষ সব সময় থাকে ফুরফুরে মেজাজে।

পঞ্চায়েত থেকেই সোমাকে সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এতোটুকু মেয়ে। বয়স পনেরও গড়ায় নি।অনূর্ধ্ব সতের’র জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দৌড়ে সবাইকে ছাপিয়ে গেছে। একশ, দু’শ আর হার্ডলসে সমস্ত বাধা টপকে আজ ও ভারত সেরা। ওর খবর নিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত। সব রকমের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাঁরা। সোমা এখন সত্যিই সেলিব্রিটি। কঠোর পরিশ্রমের ফল পেয়েছে। কিন্তু এই সংবর্ধনায় ঘোর আপত্তি জানালো সত্যদা। সত্য’দাই ওর ফ্রেন্ড ফিলোসফার গাইড। কী কষ্ট করেই না ওকে গত পাঁচ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে তুলেছে । ‘এখনও তো শিখরে উঠতে অনেক বাকি! ছোট মেয়ে। সংবর্ধনার চোটে মাথা ঘুরে গেলে! এত প্রচার!! সব পরিশ্রমই তখন মাটি হয়ে যাবে।’সত্যদা অনেক বড় স্বপ্ন দেখেন সোমাকে নিয়ে। ও একদিন এশিয়ান গেমসে সোনা পাবে। অলিম্পিকে ভারতের হয়ে দৌড়াবে।অনেক অনেক স্বপ্ন তাঁর ঝুলিতে তোলা আছে। সত্য দা বললেন, ‘এখন বাড়ার বয়স। আমার সোমা বড়ো রেশের ঘোড়া। ও সাফল্যের স্বাদ পেয়েছে। এখন নিজেকে সামলে নিয়ে চলতে হবে। তিনি হতাশ গলায় বললেন, ‘নীলগঞ্জের মাঠে অনুশীলন শেষে সোমাদের ভিজে ছোলা পর্যন্ত দিতে পারিনি। ইট দিয়ে ছেলে মেয়েদের ওয়েট ট্রেনিং করিয়েছি। ওরা যদি আগে থেকে বাড়তি সাহায্য পেত….আরো বড়ো হবার সুযোগ ছিল ওদের সামনে।

সোমার বেড়ে ওঠা সে এক আশ্চর্য কাহিনী।ছেলেদের সঙ্গে চুটিয়ে ফুটবল খেলত গ্রামের মাঠে। খুব জোরে বল নিয়ে দৌড়াতে পারত।সেই জন্য ওর নামই হয়ে যায় ‘ছুট্টি’।ছেলেরাও ওর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারত না। কি করে যেন চোখে পড়ে যায় সত্য দা’র।সোমার দৌড়ানোর গতি দেখে চমকে যান তিনি। সত্যদা’র জহুরীর চোখ হীরে চিনতে অসুবিধা হয় নি। একদিন সটান হাজির হন সোমাদের বাড়ি।ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলে ভবিষ্যতই বা কি! অ্যাথলিট হবার সমস্ত উপকরণ ওর মধ্যে মজুত আছে।একটু অনুশীলনেই ধারাল হয়ে উঠবে। একসময় তিনি বলেই ফেললেন, ‘সোমা আপনাদের সোনার মেয়ে।একদিন দেখবেন,এমেয়ে আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করবে।আপনাদের সুখের দিন ফিরে আসবে।অনেক অনুরোধে রাজি করান ওর বাবা মা’কে।তারা খেলাধুলোরএসবের কিছু বোঝেই না।সোমার কাছেও বিষয়টা ছিল আকাশ কুসুম কল্পনা।কিন্তু সত্য’দার আন্তরিকতার কাছে হার মানতে বাধ্য ওর বাবা মা।

সত্যদা সকাল বিকেল খাটিয়ে মারত মেয়েটাকে।বেলা,চাঁপা,অমিত,তপন,অমিতাভদের সঙ্গে নীলগঞ্জের মাঠে অনুশীলন করত। ভালো ভালো খাবারের লোভ দেখিয়ে আসলটা তুলে আনতেন তিনি। সত্যি খুব কষ্টের দিন গেছে সোমার। বাবা মাধব পাল পেশায় রাজমিস্ত্রি।ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলায় না।দুই বেলা ভরপেট খাবারও জোটে না।কিন্তু উৎসাহ প্রেরণা সবই সত্য দার কাছ থেকে। দুবেলা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি আর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে করতে একটা জেদ সোমাকে পেয়ে বসেছিল। মধুপুরের কতকিছুই তো নেই। সেই নেই রাজ্যের বাসিন্দা হয়ে একনম্বরে পৌঁছাতে হবে। পৌঁছাতেই হবে। সত্যদা রোজ ঘড়ি ধরে সময় মাপেন সোমার। নামী অ্যাথলিটদের কাহিনী শুনিয়ে উৎসাহ দেন।

অনুশীলন করার সময় নিজের বাড়ির, নিজের স্থানীয় অঞ্চলের কঠিন সমস্যা গুলো কেমন যেন চোখের সামনে ভেসে উঠত সোমার। সে সংকল্প করে ছিল মাঠ থেকেই তাকে হিরো হতে হবে।হতেই হবে। সত্যদা তিলে তিলে গড়ে তুলেছে তাকে। যেমন করে গড়ে তুলেছিল আরও অন্যদের। একসময় তার মনে হতো কিভাবে সে বড় হবে! তার তো সামনে পেছনে কেউ নেই! কিন্তু সত্যদা আছে!সত্যদা তার মাথায় বড় একটা ছাতা ধরেছিল।ভরসার ছাতা। যে ছাতার নিচে সোমা পেয়েছিল একদণ্ড বিশ্রাম। পরিশ্রমের মধ্যে কষ্ট থাকে আবার আনন্দ থাকে। সেটা ও এই চোদ্দ পনেরো বছরের জীবনে বুঝতে পেরেছে। একবেলার খাবার দুবেলা ভাগ করে খেয়ে অনুশীলন? এভাবে কতদিন চলবে নিজেই জানত না।

সত্যদা সাহস দিয়ে বলতেন, ‘ভয় কি আমিতো আছি!’ মোটা ফ্রেমের চশমার সত্যদা মাথায় হাত বুলিয়ে ভরসা দিত সোমাকে। নিজে সামান্য একটা চাকরি করলেও খুব বড় মনের মানুষ তিনি। দেবদত্ত, জয়া, পিনাকী জয়ন্ত পুতুলের মতন কৃতী অ্যাথলিট তাঁর অলংকার। নীলগঞ্জের মাঠে এদের নিয়েই সত্যদার ঘর-সংসার।

জলন্ধর এর জাতীয় গেমসে সোমার যাওয়াটাও ছিল অতি আশ্চর্যের। শেষ মুহূর্তে শিকে ছেঁড়ে মেয়েটার। দুদিন আগেও সত্যদা জানতেন পঁচিশ সদস্যের বাংলা দলে ঠাঁই হয় নি সোমার। রাজ্য গেমসে ভালো পারফর্মেন্স করলেও কর্মকর্তারা বাতিল করে দিয়েছিল তাকে। সত্যদার প্রতিবাদ ধোপে টেঁকে নি। এই নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি।কী আশ্চর্য! কুমকুম বয়সের ছাড়পত্র না মেলায় সোমা চলে আসে পঁচিশের দলে।সোমা জিদ ধরে ছিল সত্যদার সাথেই থাকবে। স্যারের পরামর্শ ছাড়া এক পা এগোবে না। সত্যদা’ই শেষ মুহূর্তে রাজি করান তার প্রিয় ছাত্রী সোমাকে।

নীলগঞ্জের সংবর্ধনা সভায় সোমাকে নিয়ে সবাই মেতে উঠেছে। মেতে ওঠারই তো কথা। গোটা ভারতের মানুষ তার নাম জেনে গেছে। সেইসঙ্গে জেনে গেছে অখ্যাত মধুপুরের নাম। এই মধু পুরের নীলগঞ্জ মাঠে আজ অনেক গুণী মানুষ আসবে তাকে সংবর্ধনা দিতে। আজকের এই সব পেয়েছির দেশে সোমাকে অনেক কিছু বলতে হবে।সে আজ যা চাইবে তাই হয়তো পেয়ে যাবে। স্বপ্নের কথা স্বপ্নের ভাবনাকে সেকি পারবে বিকশিত করতে! কি বলবে ভেবে পাচ্ছেনা! একবার কি জিজ্ঞাসা করে নেবে সত্যদাকে। অনেক কষ্ট অনেক যন্ত্রনা তাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল, তোমাকে আরো এগোতে হবে। জলন্ধরের মাঠেও তাকে কম হেনস্তার শিকার হতে হয়নি দেখতে ভালো নয় বাবার আর্থিক অবস্থা খারাপ সব মিলিয়ে তাকে নিয়ে হাসি মশকরা ঠাট্টা সবই চলেছে।সোমা সব কিছুর জবাব দিয়েছে মাঠে।

জেলাশাসক ,জেলা সভাধিপতি সহ গণ্যমান্য অনেক মানুষ এসেছেন সংবর্ধনা সভায়।নীলগঞ্জের মাঠে আজ তিল ধারণের জায়গা নেই। ছোট্ট সোমাকে ঘিরে বিরাট আয়োজন ।সত্যদাও আছেন। তবে অন্তরালে। তিনি এগিয়ে দিয়েছেন সোমাকেই ।’ কী চাই তোমার বলো!সরকার চেষ্টা করবে তোমার সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে।জানি তুমি আমাদের কাছ থেকে তেমন কিছুই পাওনি। চেষ্টা আর পরিশ্রমের ফসল ঘরে তুলেছে। আর পেয়েছো সত্যরঞ্জন রায়ের মতন সৎ প্রশিক্ষককে।বল তোমার কি চাই! তুমি আমাদের সকলের মুখ উজ্জ্বল করেছ। আরো এমন কিছু করো যা পেলে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে!

জেলা শাসকের কথায় সবাই চুপ করে আছে। সবার চোখ সোমার দিকে। সবাই সোনার মেয়ের কথা শুনতে।’স্যার আমাদের গ্রাম খুব গরীব। একটাও পাকা রাস্তা নেই।বর্ষা কালে কেউ হাঁটতেই পারেনা। চব্বিশ ঘন্টার পানীয় জল চাই আমরা।আর চাই প্রাইমারি স্কুলের ছাদ পাকা করতে। সবার ঘরে আলো।হাসপাতালে অবস্থাও খুব খারাপ। একটা উন্নত হাসপাতাল চাই আমরা।জানি সরকার আমাদের জন্য অনেক কিছুই চেষ্টা করে কিন্তু আর অপেক্ষা করতে আমরা রাজি নই। প্লিজ একটা ব্যবস্থা আপনাকে করে দিতেই হবে স্যার। তাহলে আমি জেলার কাছে আমার রাজ্যের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমার স্যার সত্যদা আছে। তিনি আমাকে পথ দেখবেন।দেখবেন স্যার নিজেকে উজাড় করে দেব আমার দেশের জন্য। সোমা নিজের কথা বলতে ভুলেই গেল। নিজের গ্রামের জন্য অদ্ভুত আবেগ কাজ করল তার মধ্যে।

জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সোনার পদক বদলে দিয়েছে দিন আনা দিন খাওয়া হতশ্রী গ্রামের চেহারার।সরকার বাহাদুর কথা রেখেছে সোমার। সূর্য ডোবার পর আলো ঝলমলে মধু পুর গ্রামীণ উৎসব মেতে থাকে। গ্রামের সমস্ত জায়গায় পৌঁছে গেছে পানীয় জল।এমনকি হাসপাতাল স্কুল সমস্ত কিছুই ঢেলে সাজানো হয়েছে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সোনার মেয়ের হতদরিদ্র গ্রামে পৌঁছে যায় বিদ্যুৎ।অন্ধকারকে ভয় পাওয়া ভীতু গ্রামবাসীরা এখন রাত ভোর আনন্দে মেতে থাকে।মধুপুর গ্রামের প্রতিটি পরিবারে গ্যাসে রান্না করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে সরকার। নীলগঞ্জের মাঠে এখন সূর্যের আলোকে জাল করে ফ্লাড লাইটের কেরামতি।সোমাদের জন্য এসেছে অনুশীলনের কত রকমের পশরা। সত্য’দাকেও নিয়ে বড়ো বড়ো ক্লাবের বিচিত্র অফার।

সত্য’দা সেই আগের মতই। অমিত, তুহিন, গোপাদের নিয়েই বেঁচে থাকতে চান। অখ্যাত এই গ্রামটি সোনার মেয়ের সাফল্যে অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে আছে।সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ পায় আলোর ঝিলিকে। এ তল্লাটের যত আলো এখন সোমাকে ঘিরে। স্বার্থপরের মতো বেঁচে না থেকে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করল সোমা।

You may also like