বাথান থেকে দড়ি খুলে যখন গরুটাকে গোয়ালঘরে বাঁধতে গেল, তখনই চোখে পড়ল ছোট বউয়ের। গর্ভারস ঝরছে চুইয়ে চুইয়ে। বর্ষার শুরুতে গরুটা পাল খেল, আর এই ফাল্গুনেই ভরা গোব্বিন। শ্বশুর তোমরেজ মল্লিক আঁজির তলায় বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে। দুই ছেলের বিয়ে দিয়ে সংসারের দায়-দায়িত্ব সব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছে বুড়ো। লজ্জ্বায় শ্বশুরের কাছে কিছু বলল না ছোট বউ। চুলোশালে বসে তরকারি জ্বাল দিচ্ছে শাশুড়ি। জয়গন বিবির মুখটা আগুনের আঁচে একবার রাঙা হচ্ছে, একবার আবছা হচ্ছে। ঘামছে মানুষটা। সেখানে গিয়ে বাঁশের খুঁটি ধরে দাঁড়াল ছোট বউ। জয়গন মুখ ঘুরিয়ে দেখল।বলল, গোরুটাকে ছানি দিলি?

ছোট বউ মাথা নেড়ে জানাল, ছানি দিয়েছে।

জয়গন চুলোয় পোয়াল ঠেলতে ঠেলতে বলল, উনুন নিভলে গরম পাশ বের করে ঘুঁটে দিয়ে সাঁজাল দিয়ে দিবি। নাহলে সারারাত অবলা পশুটাকে মশাতে ছিঁড়ে খাবেক।

খুশির সংবাদটি এবার শাশুড়িকে শোনাল ছোট বউ,—গরুটা আজ রাতে বিয়োবেক মনে হচ্ছে মা।

—তাই নাকি! কই বিকালে বাথানে বাঁধা ছিল, কিছুই খেয়াল করিনি তো।

ছোট বউ বলতে পারল না গর্ভারস ঝরার কথা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। শাশুড়ি তার তরকারি গরম করছে। সেই বারোটাই রাঁধাখাওয়া।আবার খাওয়া হবে রাতে। সাঁঝেরবেলা জ্বাল দিয়ে গরম না করলে টকে যাবে। ছোট বউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জয়গন জানাল, রাতে উঠে মাঝেমাঝে দেখতে হবেক মা। নাহলে বাছুর মরে পড়ে থাকবেক।

সারারাত ঘুম এল না ছোট বউয়ের চোখে। এবাড়ির ছোটছেলে কোমরেজ  যখন তাকে বিয়ে করে এনেছিল,তখন থেকেই বড় বউ নিজের ছেলেপুলে নিয়ে আলাদা সংসারে। বাপ মরা মেয়ে ছোট বউ জ্যোৎস্না মামার ঘরে মানুষ। অল্প বয়সে নাড় হল মা-টা।শালি নদীর গাবায় বনপারুল গাঁ। আগের পক্ষের ছেলেপুলে নিয়ে মায়ের নতুন সংসার, নতুন মানুষের সঙ্গে ঘরবাঁধা।পরের ঘরই এখন আপন হল ছোট বউয়ের। সংসারকে নিজের মতো বাগিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে সে। এখানেই যখন থাকতে হবে। তবে মামা কম করেনি তার জন্য। বিয়ের যাবতীয় খরচখরচা,বরপন, দেনাপাওনা থেকে শুরু করে কনে বিদায়ের সমস্ত আয়োজন নিজের বাপের মতোই করেছে। গতবছর খোকা হল। নাতির  দুধ খাওয়ার জন্য গোয়াল থেকে সাদা বকনাটা বের করে জামাইয়ের হাতে তুলে দিল মামা। সেই গরু এখন বাচ্চা বিয়োবে।

টর্চ নিয়ে রাতে দু’- দু’বার বার উঠেছে জ্যোৎস্না। মরদটা সারাদিন মাঠেঘাটে খেটে সাঁঝ রাতেই খেয়েদেয়ে বিছানায় মরা কাঠ। ঠ্যাংম্যাং উলটে সেই যে শুয়েছে আর দিশে হুস নেই। ওদিকে শাশুড়ি জয়গন বিবিরও চোখে ঘুম নেই। জ্যোৎস্না দ্বিতীয় বারে গোয়ালঘরে গিয়ে দেখল, ছানির বস্তায় ঠেস দিয়ে বসে বসে হায় তুলছে শাশুড়ি। ছোট বউকে আসতে দেখে জয়গন বলল, ঘুমাসনি মা? এখনও তো কিছুই বুঝা যাচ্ছেনি গো। চল শুই গা। ভোররাতে আবার উঠতে হবেক।

ঘুমজড়ানো চোখে ছোট  বউ জ্যোৎস্না গোয়াল থেকে বেরিয়ে এসে এগনেতে দাঁড়ায়। ডাকু মোরগটা দরমায় ঢুকেনি। আঁজির গাছের ডালে বসে ডানা ঝাঁপটে সকালকে আহ্বান জানাচ্ছে। জয়গন বিবি গালি দেয় মোরগের উদ্দেশ্যে,মরারটাকে খটাশেও ধরে না গো!

শেষ রাতে চোখ লেগে এসেছিল জ্যোৎস্নার। ভোরের বেলা জয়গন বিবির ডাকে ঘুম ভাঙল,—ও বউ,টপ টপ উঠে আয়।গাইটা বিয়োচ্ছে।

শাড়ির আচল-ফাচল বিছানায় লুটাচ্ছিল। খোকা মাঝে শোয়। খোকাকে একপাশে কখন সরিয়ে দিয়ে কোমরেজ ওম নিচ্ছিল বউয়ের।ঠ্যাংম্যাং সরিয়ে দিয়ে উঠে এল জ্যোৎস্না। কপাট খুলে দেখল, এখনও ঘোর অন্ধকার। মানুষের গলা পেয়ে সকাল হয়ে গেছে ভেবে, দরমার ভেতর হাঁস-মুরগিগুলো কলবল কলবল করে ডেকে উঠল। কুড়ো ভিজে আর বাসি ভাত ম্যাট করে গুলে দিলে গলা উটারে খেয়ে হেলতে দুলতে পুকুরে নামবে সব।

তোমরেজ মল্লিক ফজরের নামাজ পড়তে উঠেছে। চুলোশালের চালে বাঁশের খোপে গুঁজে রাখা নীম দাঁতন পেড়ে কলতলার দিকে চলে গেল। জয়গন বিবি ডাকল,কই গো শুনছ? গরুটার ছানা হচ্ছে। একবার ধরবে এসো। তারপর ওজু করবে।

বুড়ো তোমরেজের কোনো গ্রাহ্য নেই। সংসারে দুটি খেতে পেলেই যেন হল। পুরো গা ভাসিয়ে দিয়েছে। বলল, আমি নামাজ পড়তে যাচ্ছি।ছোট খোকাকে উঠো গা। পড়ে পড়ে ঘুমচ্ছে।

—ভীমরতি ধরেছে! বলে মুখ ভ্যাংচাল জয়গন। জ্যোৎস্নাকে আসতে দেখে হেঁকে বলল, কোমরেজকে উঠিয়ে দে তো মা। পুরুষ মানুষ না ধরলে আমরা দু’জনে বাগাতে পারি!

জ্যোৎস্না আড়চোখে তাকাল শ্বশুরের দিকে। তারপর আবার ঘরমুখো।

প্রথম বিয়োনি গাই হলেও বাচ্চা প্রসব করতে তেমন অসুবিধা হল না। যন্ত্রণায় দু-একবার ওঠবস করল। বারকতক খুটির চারপাশে পাক খেল। খানিক পরই ভালোয় ভালোয় ভূমিষ্ট হল বাছুর।

সুতলির বস্তা ছেড়া দিয়ে বাছুরের গা পরিস্কার করতে গিয়ে জয়গনের হাত গেল থেমে,—ও মা! পিঠে এটা কী গো! লম্বা পারা!

কোমরেজকেও উঠিয়ে এনেছে জ্যোৎস্না। জয়গনের ‘ও মা!’ চিৎকার শুনে মেয়ে-মরদ দু-জনেই ভালো করে ঝুঁকে দেখল বাছুরটা। এতক্ষণ খেয়াল করেনি। পিঠের বাঁ-পাশে বাড়তি একটা লেজ।হাত দিয়েও দেখল, লেজই তো।

একটা গরুর দুটো লেজ! খোদার একি খেলা গো! জয়গন হায় হায় করে উঠল। যখন ছোট বউয়ের বাচ্চা হল, নাতির বা-পায়ে ছ’টা আঙুল দেখে এমনই হায় হায় করে উঠেছিল।

গোয়ালে হৈ-হল্লা শুনে তোমরেজ মল্লিক বদনার পানি মুখে ভরেই কুলকুচি করতে করতে ছুটে এল।

—হা দ্যাখো গো। কী তাজ্জব ব্যাপার দ্যাখো! বাছুরটার দুটো লেজ।

তোমরেজ দোর গোড়ায় দাঁড়িয়ে দেখল। দেখে বলল,যানগরু জন্মেছে!হায় আল্লা! এ গরু তো বড় হলেও কুনু কাজে আসবেনি গো! হাটেও বিকোবেকনি, মানুষেও খাবেকনি।শেষে জন্ম খুঁতো গরু হল!

গরুটার ভবিষ্যৎবানী শুনে জয়গন বিবি আরও হাউমাউ করে উঠল। এতদিন গরুর জন্যে কত শখই না করেছে সে। একসময় এই সংসারে গোয়ালভরা গরু-ছাগল ছিল। বুড়ো বেচে বেচে সংসারের লাগ মিটিয়েছে। গোয়ালঘরটা অনেকদিন ফাঁকাই পড়েছিল। ছোট খোকার মামাশ্বশুর গরুটা দিতে জয়গনের মনের খায়েশ অনেকটাই মিটেছে। দুটো ঘুঁটের জন্যে কারও বাড়িতে চাইতে যেতে হয় না। আবার লাল চা জয়গনের মুখে একদম রোচে না। নাতি তো আর পুরো দুধটা খেতে পারবে না।

তোমরেজ ধমকে উঠল,তুই চুপ করবি! ভেক দেখো! যেন ছেলে মরেছে !

ছোট বউ জ্যোৎস্না মাথায় ঘোমটা টেনে সরে গেল এক পাশে।

গোয়ালঘরের ঝাপটা ফেলে দিল তোমরেজ। পাটের বস্তা জুড়ে জুড়ে ঝাপ বানিয়েছে তোমরেজ। ওটাই গোয়ালের কপাটের কাজ করে।বলল, চুপ কর সবাই। চেঁচামেচি করে পাড়াপড়শি সবাইকে জড়ো করবি নাকি! ঠান্ডা মাথায় যা হোক একটা ব্যবস্থা করতে হবেক। নাহলে এই গরু নিয়ে অনেক ভোগান্তি আছে।

ছোট বউ জ্যোৎস্না ভীত হরিণীর মতো চেয়ে থাকে। শ্বশুর কী ব্যবস্থা করার কথা বলছে! বুক দুরুদুরু করে।

—তাহলে কী হবেক গো! বড় হলে লেজটা খসে পড়বেকনি? জয়গন আশার আলো দেখতে ছাড়ে না।

তোমরেজ এবার পাঞ্জাবির হাতাটা গুটিয়ে নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করে দেখল। লেজের গোড়াটা সরু পিঙপিঙে। আসল লেজটার মতো পুরুষ্ট নয়। লেজের ডগা চন্দ্রবোড়া সাপের লেজের মতো মোড়া। গোড়ায় চুল বেঁধে রেখে দিলেও ধীরে ধীরে খশে যেতে পারে। তবে সবাই জেনে যাবে। ব্যাপারটা আর পাঁচজন মানুষের কাছে খুব অমানবিক।যানগরু বলে কথা! এ লেজ তো আল্লার দান। তোমরেজ সাতপাঁচ ভাবতে থাকে। সকাল হবার আগে উপায় একটা বের করতেই হবে। যা করতে হবে সবই চুপিচুপি।

জয়গন বিবির মাথায় দুশ্চিন্তার কালো মেঘ। কত শখের গাই গরু। সেই গাইয়ের ছানা হল জন্মগত খুঁতো। সারাজীবন বাছুটার পিঠে বাড়তি একটা লেজ ঝুলবে!ভাবতে পারল না। যানগরু তো জয়গনও দেখেছে কতবার।ঘন্টির ঠুন ঠুন শব্দ তুলে গাঁয়ে যানগরু এলেই ছোটবেলায় জয়গন পাড়ার ছেলেপুলেদের সঙ্গে পিছু পিছু ছুটে যেত। মাঠ থেকে আমন ধান চাষিদের ঘরে উঠলেই পৌষ মাসে কাহা কাহা মুল্লুক থেকে অনেক ফকির যানগরু নিয়ে চাল-ধান আদায় করতে আসে। ফকিরের গায়ে থাকে ঢোলা আলখাল্লা,মাথায় টুপি। কেউ কেউ পাগড়ি বাঁধে।এক হাতে ঝাড়নকাঠি।অন্য হাতে যানগরুর দড়ি ধরে থাকে। গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি ঘুরে উঠোনে দাঁড়িয়ে ফকির হাঁক পাড়ে, যান গরুর সেবায় লাগে। পাপের ভাগ নিতে রাজি,চাল-ডাল,আলু-পেঁয়াজ দাও গো মাইজি।

গরুটির যাহোক একটি বাড়তি অঙ্গ থাকবেই। লাল সালুর পোশাক পরিয়ে, কড়ি ও পুঁথির মালা দিয়ে খুব সুন্দর করে সাঁজিয়ে আনে গরুটিকে। সারা গায়ে একরকম আতরের গন্ধ উঠে। গলায় ঘন্টি, পায়ে বাঁধা ঘুঙুর। গরুর পিঠের দু’-ধারে ধান-চালের বস্তা ঝোলানো। গৃহিণী বাড়ি থেকে চাল-ধান এনে বস্তায় ভরে দিলেই ফকির তখন হাতের ঝাড়নকাঠিটি দিয়ে দোয়া পড়তে পড়তে  মাথা ঝেড়ে দেয়।তাতেই নাকি সব পাপ ওই কাঠির ডগায় বাঁধা চুলে আটকে যায়। ফকির তারপর ঝাড়নকাঠিটি গরুর পিঠে ঠেকায়। গরুটি পাপগুলো গ্রহণ করে নেয়। তিন চোখের গরু, তিন কানের গরু, পাঁচ পায়ের গরু কতরকম যানগরুই না দেখা যায় শীতকালে। এখন অবশ্য খুব একটা আসে না।জয়গন বিবি ভাবল, এই গরু যদি দুটো লেজ নিয়ে বড় হয়, তাহলে তো খুব মুশকিল ! শেষে ফকিরের মতো গাঁয়ে গাঁয়ে ভিখ মেগে বেড়াবে নাকি তারা! খাইয়ে দাইয়ে বড় করে অন্যজনকে দানখয়রাত করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

বুদ্ধিটা দিল কোমরেজ। বলল,ডাক্তার এনে লেজটা কাটিয়ে দিলে হয় না?

ছোট বউ জ্যোৎস্না চমকে উঠল স্বামীর কথা শুনে। এ কী চিন্তা মরদটার! গরুর লেজ কাটবে মানে! আর চুপ থাকতে পারল না সে। বলল, কী পাষাণ জান গো তুমার! মাসুম বাচ্চাটা এই সবে জন্মাল, আর তার লেজ কাটবে!

তোমরেজ মল্লিক বলল,যুক্তিটা ফেলার নয় বউমা, ভবিষ্যতের কথাটা ভেবে দেখো।

জোৎস্নার বুক কেঁপে উঠল। শেষমেশ শ্বশুরও! শ্বশুর তাকে কথাটা এমন ভাবে বলল কেন! এ কীসের ইঙ্গিত!নাকি তার মামা গরুটা দিয়েছে বলে, গরুর মালিক তাকেই ভাবছে সবাই। সম্মতি চাইছে তার কাছে? জ্যোৎস্না শ্বশুরের কথা শুনে মুখ নামিয়ে নিল।

তোমরেজ ছেলেকে বলল, এই ভোরে ডাক্তার কোথায় পাবি! সকাল আটটার কমে তো কল দিলেও পাবিনি। সকালে ডাক্তার এলে লোক জানাজানি হয়ে যাবে।হাসাহাসি করবে সবাই।

ঘর থেকে খোকার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। উঠে পড়েছে ছেলেটা। জয়গন বলল, তুই ঘরে যা বউ। ছেলেটাকে কোলে নিগে।আমরা দেখছি কী করা যায়।

জ্যোৎস্না গোয়াল থেকে নিমেষেই বেরিয়ে গেল।

অনেক ভাবনাচিন্তার পর জয়গন বিবি একটা উপায় বাতলে দিল। কোমরেজকে বলল, এক কাজ কর তো খোকা। নামোপাড়ার বতুলা চাচির বাড়ি যা। চুপিচুপি ডেকে আনবি। বলবি, মা ডেকেছে।

*********

টালির চালে বতুলা বুড়ি একলা রাঁধে বাড়ে। বুড়ো মরেছে গেল বছর জৈষ্টতে। ছেলেপুলে পেটে না ধরলেও, এই গাঁয়ের অনেক ছেলেই জন্মাল বতুলার হাতে। ধাইমা ডাক শুনে, নিঃসন্তান বতুলার জান জুড়ায়। এক দু’জনের মা তো নয়, সে সবার মা।

কোমরেজ পাড়ার ভেতর দিয়ে না গিয়ে পুকুরপাড় ধরে, ধানখেতের আল ডিঙিয়ে বতুলার বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ভোরের ঝুঁঝকি আলো ফুটছে, এবার সকাল হবে। দরজায় নাড়া দিতেই বুড়ি ভেতর থেকে হাঁক পাড়ে,—কে?

—কপাটটা খুলো দাদি। আমি মল্লিক পাড়ার তোমরেজের ছোটছেলে।

বুড়ি কষ্টেসৃষ্টে উঠে আসে। কাঁকালে ব্যথা। কপাট খুলে দাঁড়াতেই কোমরেজের মুখোমুখি। ফোকলা দাঁতে হেসে বলল, বউ আবার খালাশ হবে বুঝি! বছর ঘুরলনি, আবার…

লজ্জা পেল কোমরেজ,—কী যে বল না দাদি! এত তাড়াতাড়ি আবার ছেলে…! অন্য কেস আছে গো। একটু বিপদে পড়েছি। টপটপ চলো।মা ডাকছে তুমাকে।

কপাট ঠেঁসিয়ে এক কাপড়েই বতুলা বুড়ি বেরিয়ে আসে। শিশির ভেজা পথ। আগে হাঁটে কোমরেজ। পিছে হাঁটে বতুলা।

যেতে যেতে মনের ভেতর নানান প্রশ্ন জাগে বতুলার। কী এমন কাজ, যা তাকে এখন বলা যাবে না? নাকি জয়গন তলে তলে পোয়াতি ছিল!ও মা গো! ঘরে দু-দুটো ছেলের বউ। শাশুড়ি আবার ছেলে বিয়োবে! নিজের মনেই হাসল বতুলা। এই গাঁয়ে কার ছেলের বিয়ে হল। কার ক’মাস চলছে সব খবর রাখে সে। এই বয়সেও স্মৃতি শক্তি প্রখর। তবে এখন অধিকাংশ বউ খালাশ হয় হাসপাতালে। সামান্য ব্যথা উঠলেই হ্যালো করে দিলে ঘরের সামনে সাদা রঙের গাড়ি এসে থামে। তবুও বতুলা ফেলনা নয়। তার ডাক পড়ে আঁতুড়ঘরে ছেলের সেবা করার জন্যে। তেল দিয়ে গা-হাত-পা নুচে দেয়। খাঁদা নাক সোজা করে। বাচ্চা ছেলে তো মাটির তাল। গড়েপিঠে নিতে হয়। ধাই বিদায়ের সময় নতুন শাড়ি পায় বতুলা।পায়, সরসের তেল, মাথার ঠান্ডা তেল, চাল, ডাল, আলু-পেঁয়াজ। আর নগদ দু-পাঁচশো টাকা।এ ইভাবে পাঁচঘরে খেয়েপরেই দিন চলে যায়।

বতুলা বুড়ি তোমরেজের বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকতেই জয়গন বিবি ডেকে নিল,—এসো চাচি, গোয়ালঘরে এসো।

বুড়ি বলল, কে খালাস হবেক লো জয়গুনি?

—খালাস তো ভোররাতে হয়ে গেছে চাচি। মানুষ নয়, আমাদের সাদা গাইটা। জয়গনের ঠোঁটের ডগায় সামান্য হাসি,—গোয়াল ঘরে ঢুকে দেখবে চলো। একটা কাজ তুমাকে গোপনে করে দিতেই হবেক।

বতুলা বুড়ির মনের ভেতর হাজার প্রশ্ন ধানফুলি মাছের মতো বুড়বুড়ি কাটছে। গাইগরুর ছানা হলে ধাইবুড়ির কী দরকার! তাছাড়া ছানা তো হয়ে গেছে। বুড়ি গোয়ালের ঝাপ সরিয়ে ভেতরে ঢুকল। অন্ধকার মেঝেতে একটা চার্জার লাইট জ্বলছে। হ্যারিকেনের মতো দেখতে। সেই হ্যারিকেনের সাদা আলোয় বুড়ির চোখ পিট পিট  করে। চোখের কোনায় পিচুটি এখনও কাটেনি।

ধাইবুড়িকে গোয়ালঘরে ঢুকতে দেখে কোলে ছেলে নিয়েই তড়িঘড়ি ছুটে আসে জ্যোৎস্না। ভেতরে ঢুকতে সাহস হয় না তার। ঝাপের এপাশে দাঁড়িয়ে ছেলেটাকে মাই দেয়। খোকা চুক চুক করে দুধ টানে। দুধ খাচ্ছে বাছুরটাও। কোমরেজ বসেছিল গোয়ালের দোরগোড়ায়।ঝাপের এধারে মুখ বের করে গলা নামিয়ে বউকে বলল, অ্যায়! তুমি এখান থেকে যাও। যা পারছে করুক। কিছু বলতে যেও না।

জ্যোৎস্না বলল, কেনে! তুমি বারণ করতে পারছনি!

কোমরেজ ভেতরে মুখ ঢুকিয়ে নিল।

জয়গন বাছুরটাকে টেনে ধরে দ্বিতীয় লেজটা বতুলাকে ভালো করে দেখাল। নিজের চোখে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারে না বুড়ি। খানিক ঝুঁকে হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। জয়গন বলল, তুমি তো অনেক ছেলের নাড়ি কেটেছ চাচি। পারবে না লেজটা কেটে দিতে?

জয়গনের কথা শুনে চমকে উঠল বতুলা। ছিঁটকে সরে গেল হাত। যেন ইলেক্ট্রিক শক খেল। তারপর সঙ্গে সঙ্গে বাছুরটিকে ছুঁয়ে বুকে কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল। প্রণাম সেরেই গোয়ালের ঝাপ তুলে বেরতে গেল, ওমনি হাতটা চেপে ধরল জয়গন,—কি হল চাচি? মুখে কিছু বললে না যে! বুঝতেই তো পারছ এই খুঁতো গরু নিয়ে কপালে কী দুর্ভোগ আছে।

ছোট বউ জ্যোৎস্না ঝাপের আড়ালে দাঁড়িয়ে থরথর কাঁপছে। ছেলেটাও বুঝি কিছু বুঝতে পেরে কোঁকিয়ে উঠল।

বতুলা হাতটা ঝিনে ছাড়িয়ে নিল,—ছাড় আমাকে। যানগরুর লেজ কাটাবি! ও লো— শুন লো, এই হাত দিয়ে অনেক মায়ের পেট থেকে বাচ্চা নামিয়েছি। নাড়ি কেটেছি। কত ছেলেকে গড়েপিঠে তুলেছি। সেগুলো পূণ্যির কাজ। সেই একই হাত দিয়ে এতবড় পাপ করব! ভাবলি কী করে!

জয়গন ছানির বস্তাটা এগিয়ে দিল,—বসো চাচি, বসো। এত উতলা হও না। পাপ বলতে? বাচ্চাবেলায় সাফ করে দিলে তো, সারাজীবন গরুটাকে আর খুঁতো বদনাম নিয়ে থাকতে হবে না।

—দাগ কখনও মেলায় জয়গন!

বতুলা ছানির বস্তার ওপর বসল। খানিক পরে রাগ কমলে শান্ত গলায় বলল,—কপালে সাতপুরুষের ভাগ্য নিয়ে এসেছিস বলে তুদের ঘরে এমন গরু জন্ম নিয়েছে। যে সে গরু,যে তুরা এত চিন্তা করছিস!ও লো যানগরু জন্মেছে! খুশি হয়ে ঘরে ঘরে মিষ্টি বিলি করা উচিত।

জয়গন বলল, সবই বুঝলাম চাচি, কিন্তু এই গরুকে বড় করে কী উপকারে আসবে! আমাদের কথাটাও একটু ভেবে দেখো।

তোমরেজ মল্লিক মসজিদে নামাজ পড়তে গেছে। ভেতরে ছোট ছেলে কোমরেজ, বাইরে ছোট বউ জোৎস্না, চুপচাপ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বুড়ির কথা শুনছে।

বতুলা বলল,যানগরু না হয় দেখেছিস, গাঁয়েঘরে চাল-ধান আদায় করতে নিয়ে আসে ফকিরে। কেউ কেউ তাবিজ-কবচ,আংটি, মালাও বিক্রি করে যায়। কিন্তু যানগরুর আসল কিসসাটা শুনেছিস?

পরিবেশ হালকা বুঝে জ্যোৎস্না ঝাপ সরিয়ে কোলে ছেলে নিয়েই ভেতরে প্রবেশ করল। বাছুরটা নড়বড় করে দাঁড়িয়েছে। এখনও তিরতির করে কাঁপছে। ওদিকে গাইটাকে দেখো, বাচ্চা বিয়োনোর পর কেমন ফোসফোস করে নিশ্বাস ছাড়ছে। অবলা পশুরা তো আগে থেকেই অনেক কিছু বুঝতে পারে। কিছু কি টের পেয়েছে? এখনই হয়তো ধাইবুড়ির মন ঘুরে গেলেই লেজটা কেটে দেওয়া হবে। গল গল করে রক্ত ঝরবে। আর বেশিকিছু ভাবতে পারল না জ্যোৎস্না। নিজের ছেলেটাকে শক্ত করে টিপে ধরল।

জয়গন বলল,না শুনিনি চাচি। কী বৃত্তান্ত বলোদিনি।

বুড়ি বতুলাকে ঘিরে তিনটি মানুষ। অন্ধকার আলো-আঁধারি মেঝে। বাইরে একটা দিনের শুরু। আদ্যিকালের বুড়ি ঠাকুমার মতো বতুলা বলল, সে অনেককাল আগের কথা। এক গরীব চাষার ঘরে নাকি একটি খুঁতো গোরু জন্মেছিল। সেই গরুর মাথায় তৃতীয় চোখ। চাষা পড়ল বড়ই চিন্তায়। তিনচোখো গোরু নিয়ে কী করবেক সে! তো একদিন ভোরের খোয়াবে চাষাকে দেখা দিলেক একজন কালো আলখাল্লা পরা, মাথায় পাগড়ি বাঁধা বুজুর্গ মানুষ। পীর-মুরশিদের মতো তাঁর চেহারা। আর কী তাঁর জৌলুশ! চাষাকে বললেক, আরে পাগল, খুঁতো গরুর জন্যি মনখারাপ করিস! তুর হালচাল দেখে স্বয়ং আল্লাতালা তুর ঘরে এমন গরু পাঠিয়েছে রে! এই গরু বড় হলে দেখবি ঘরের সব বালা মশিবত দূর করি দিবেক। হেলাফেলা করিস না, এই গরু হল একটি যান।মানুষের পাপকে পিঠে চাপিয়ে আল্লার দরবারে নিয়ে যাবেক।আল্লাকে কেঁদে কেঁদে বলবেক,হে আমার মালিক, বেঁচে থাকতে সারাজেবন আমাকে দেখে মানুষ হাসাহাসি করেছে। আবার কেউ ভক্তিভরে দু’মুঠো চাল, ধান, টাকা পয়সাও দান করেছে। একজন ফকিরের সংসারের খোরাকও যোগাড় হয়েছে আমার দ্বারা। তুমার কাছে আমি একটি আর্জি নিয়ে এসেছি মালিক।

আল্লা বলবেক, বল তুর কীসের আর্জি?

গরুটা তখন পিঠটা উপুর করে সব পাপ ঢেলে দিবেক। আল্লাকে বলবেক, এই পাপগুলো আমি সারাজেবন ধরে পিঠে চাপিয়ে বহন করছি মালিক, আর ভার বইতে পারছিনি। তুমি সব পাপ মাপ করি দাও।

বুড়ি বতুলা খানিক থামল। সবাই হা হয়ে শুনছে তার কথা। জয়গন বলল, তারপর কী হলেক চাচি?

—তারপর চাষা খোয়াবের মধ্যিই ওই বুজুর্গ মানুষটিকে শুধিয়েছিল, তার কী করনীয়। তখন নাকি বিধান দিয়েছিল, গরুটিকে খাইয়ে-দাইয়ে বড় করে, গায়ে লাল সালু চাপিয়ে,কড়ির মালা দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে চাষা যেন কোনো ফকিরের হাতে তুলে দেয়। ফকির ওই গরু নিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরবেক। ফকির যত বস্তা বস্তা চাল পাবেক, ধান পাবেক ততো চাষার জন্যি, চাষার পরিবারের জন্যি আল্লার দরবারে দু-হাত তুলে দোয়া করবেক। তাতে,আল্লা খুশি হয়ে খেত ভরা ফসল দিবেক, চাষার ঘরের আয়-বরকত সব বেড়ে যাবেক। খাওয়া-পরার কুনুদিন অভাব হবেকনি। আর একটা হজ করার সমান পূণ্যি হবেক। সেই থেকি খুঁতো গরু জম্ম নিলেই যানগরু বানিয়ে অনেকেই ফকিরের হাতে তুলে দেয়। গরু নিয়ে ফকির গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে, যে চাল-ধান দান করে, তাদের পাপের বোঝা যানগরু নিজের পিঠে নিয়ে নেয়। আর তুরা ভাবিস লেজ কাটার কথা! ওসব চিন্তা মনে আনাও পাপ। তওবা তওবা কর। গরুটা বড় হোক, কোনো ফকিরকে দিয়ে দিবি।

জ্যোৎস্নার বুক ঠেলে বেরিয়ে এল স্বস্তির নিশ্বাস। যাক বাঁচা গেল! বাছুরটা তো জানে আরাম পেল। একেই খুতো বাছুর, আবার তার লেজ কেটে দ্বিতীয়বার খুতো হোক, সেটা মন থেকে চায় না জ্যোৎস্না। তার খোকাও তো খুতো। পায়ে ছ-টা আঙুল। মানুষ বলে আঙুলটা কেটে দেওয়ার কথা কেউ কখনও তো ভাবেনি! আর অবলা গরু বলে তার লেজ কেটে দেবে!

বতুলার কিসসা শেষ হলেও তার ঘোর এখনও কাটেনি।নিস্পন্দ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল জয়গন। মুখে কোনো কথা সরল না। ধাইবুড়ি তাকে এ কী কিসসা শোনাল গো! সব যদি সত্যি হয়, তাহলে? মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল জয়গনের। কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়িয়ে থাকার পর শ্লথ গতিতে গোয়ালের ঝাপটা গুটিয়ে নিল। আঁধার কেটে ফুটফুটে  সকাল হয়ে গেছে। বুড়ি বতুলা গুট গুট হেঁটে নিজের বাড়ি চলে গেল।

জ্যোৎস্না কোমরেজকে বলল, খোকাকে একবার নাও তো, বাসি থালাবাসনগুলো ধুতে হবেক।

জয়গন বলল, তুই গোয়ালেই থাক বউ। আমি থালাবাসনগুলো বের করে পুকুরঘাটে নিয়ে যাচ্ছি। গর্ভফুলটা পড়লে ভালো করে পুঁতে দিয়ে আসবি। বাছুরটা আর পাঁচটা গরুর মতোই বড় হোক। পরের কথা পরে ভাবা যাবেক।

গাঁ-গ্রামের মানুষদের বিশ্বাস গর্ভফুল যদি শেয়াল-কুকুরে খেয়ে নেয়, তাহলে বাছুর নাকি অকালে মারা যায়। গরু-ছাগলের গর্ভফুল তাই কেউ ফেলে দেয় না। মাটি খুঁড়ে পুঁতে দেওয়া হয়।

জ্যোৎস্নার কোল থেকে খোকাকে নিয়ে কোমরেজ আদর করছে। বাছুরটাও যেন ফাড়া কেটে গেছে বুঝতে পেরে দুধ খেতে খেতে আনন্দে লেজ দোলাচ্ছে। মা-টা জিভ দিয়ে গা চেটে দিচ্ছে বাছুরের। কিছুক্ষণ পরেই গাইগরুর জন্মদ্বার ভেদ করে গর্ভফুলটা নেমে এল। মাটিতে ভূমিষ্ট হবার আগেই ঝুড়ি পেতে কুড়িয়ে নিল জ্যোৎস্না।

You may also like