জলকথা

একটা সরাল ডেকে গেল। তারপর ও কোন দিকে যে উড়ে গেল। বন চাঁদ ঘাড় ঘোরাবার আগেই ও পালাল। বিশি মাঝি আসবার আগেই ও চলে এসেছে বিলে। এখনো ছোপ ছোপ আঁধার। বেশি দূর চোখের দৃষ্টি যায় না। বন চাঁদের আজ তাড়া আছে। ছেলেটিকে শহরে নিয়ে যেতে হবে। বিশু ডাক্তার আর পারলো না। হাল ছেড়ে দিয়েছে। ওর ওষুধ এ আর কাজ হচ্ছে না। বন চাঁদ বেশ চিন্তায় আছে। ওর বউও যাবে সঙ্গে। বিনিও চিন্তায় আছে। রাতে শোবার আগে বলে, হা –গো কি হবি মিলুর? ও যে দিনকে দিন কেমনটা হয়ি যাচ্ছি।
চিন্তা করিসনা বিনি। মিলু ঠিক হয়ি যাবি। ও পাড়ার মসজিদ থেকে একটু জল পরা নিয়ে আসিস। কিসে কি আছে কে বলতি পারি? ওপর ওয়ালার সব দান।

বন চাঁদ কথা বলতে বলতে কেমন অন্য মনস্ক হয়ে যায়। গাভিন চাঁদের আলো ওদের মাটির দাওয়ায় এসে পড়েছে। উঠোনে গাঁদা গাছের পাতাটা চকচক করছে চাঁদের আলোতে। ওদের একপাশে ছোট্ট মিলু ঘুমিয়ে। বিনি বন চাঁদের পাশ ঘেঁষে আসে। বন চাঁদ ওর শরীরের উষ্ণতা অনুভব করে। আজকাল বিনি কেমন শুকিয়ে গেছে। আগের মতো ও রসালো নয়। ওর গায়ে হাত দিলেই বন চাঁদের শরীরটা কেমন ঝিনঝিন করে উঠতো। গোটা শরীরে যেন আগুন লেগে গেছে। ওর আর মন মানতো না। বিনির গোটা শরীরময় ও আদিম খেলাটা শুরু করে দিত। বিনিও সাড়া দিত। বিলের মাছের মতোই ও পিছলে যেত। তারপর এক সময় ওরা দুধি জোছনাতে ভিজতে ভিজতে ঘুমিয়ে পড়ে। তারপর ভোরবেলা উঠে বন চাঁদ চলে যায় ডুমনি বিলে। যেদিন ভালো মাছ পড়ে জালে সেদিন ওর মুখে হাসি ফোটে। বিনিকে সে দুপুরে আবার আদর করে। ওর জলে ভেজা হাত কেমন যেন ফ্যাকাসে। বিনিকে সে ঠান্ডা হাত দিয়ে জাপ্টে ধরে।

ওঃ, তুমি এটি কি করছো? লোকে দেখলে খিটকাল হবি।

হোক। এখন করবো না- তো কখন করবো? তু একটু চুপ মারবি? ছেনালের মতো করছিস।

কি — বললা? আমি ছেনাল?

বিনি কপট রাগ দেখায়।

বন চাঁদ ওর রাগ মেটায়।

সে সব কত সুখের দিন ছিল ওদের। ডুমনি ওদের সুখে রেখে ছিল। কিন্তু এখন যে কি হল! ওদের সুখে থাবা বসালো গ্রাম্য রাজনীতি। সব সুখ একটু একটু করে চলে গেল। তা আর ফিরে এলো না। ডুমনি বিল এখন সমিতির হাতে। মাছ ধরতে গেলে একটা অংশ সমিতিকে দিতে হয়। যে ডুমনিতে তার বাপ দাদা মাছ ধরে জীবন কাটিয়েছে। কাউকে কোনো দিনই হিসেব দিতে হয়নি। খাল বিলে তারা অবাদে মাছ ধরেছে। গরীব দুখো মানুষ। সামান্য আয়। কোনো রকমে তারা জীবন ধারন করে। সেটা আর তাদের হল না। বিল দখল হয়ে গেল। দখল করে নিল রাজনৈতিক নেতারা। তারাই সমিতির সব কিছু। যা বলবে তা গরীব জেলেদের মেনে নিতে হবে। এখন আর ইচ্ছে মতো ডিঙি নিয়ে থাকা যায় না জলে। তারও হিসাব দিতে হয়। গগেন মাঝি তাহলে ডেকে বলবে, বন চাঁদ, এতক্ষণ জলে থেকি একটাও মাছ পাসনি? শালা মিথ্যুক কোথাকার। বিলে সবাই মাছ পাচ্ছি আর তু পাচ্ছিস না? এটি আমি বিশ্বাস করবো। মাছে গজগজ করছে বিলে। আর তুর জালে মাছ উঠেনি। শালা!

গগেন মাঝির মুখে কিছু আটকায় না। এখন সে সমিতির সব কিছু। ওকেই দায়িত্ব দিয়েছে হরেন দাস। হরেন দাস হল এ গ্রামের প্রধান। তার অনেক সাঙ্গোপাঙ্গ। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত। লেগেই আছে হম্বি তম্বি। বন চাঁদ এ সব মাতব্বরি নিতে পারছে না। ওর ইচ্ছে করে না ডিঙি নিয়ে বিলে মাছ ধরতে। কিন্তু তার কোনো উপায় নেই। মিলুটার অসুখ। তার চিকিৎসার পয়সা। সংসার চালানোর জন্য যে টাকা রোজ লাগে। তা ও মাছ ধরে রোজগার করতে পারে না। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সংসারের হাল সে ঠিক মতো সামলাতে পারে না। বিনি কি ভাবে যে আঁকড়ে ধরে আছে তা ওই- ই জানে। আগের মতো আর বিলের বুকে মাছ নেই। বৃষ্টি যে বছর ভালো হয় সে বছর মাছ হয়। বৃষ্টি কম হলে সে বছর মাছ কমে যায়।

সারা বিল খুঁজে খুঁজে মাছদের ধরতে হয়। ফাঁসে মাছ পড়ে না। বন চাঁদ বিড়ি ধরিয়ে চুপ করে ডিঙিতে বসে থাকে। আর ভাবে সকালে চাল ডালটা কি ভাবে আসবে? মাছ তাদের সংসারের সুখ। সেই সুখটুকুও যেন জানালা গলিয়ে পালিয়ে যাবে। বন চাঁদ কোথাও মন বসাতে পারছে না। ডিঙিটা ঢেউ লেগে দুলছে। বার বার তার ছেলের মুখটা মনে পড়ছে। ডুমনিমা সহায় হলে তবেই বাঁচোয়া। তা না হলে ওর সব শেষ হয়ে যাবে। ও বিড়িতে টান দিতে ভুলে যায়। পুবে আজ মেঘ লেগেছে। যে কোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টিতে ভিজেই ও মাছ ধরে।মেঘটা কেটে গিয়ে পুবের আকাশে একটু একটু করে ফরসা হচ্ছে। বিশি মাঝি এখনো আসেনি। ফাঁসের জাল গুলো বন চাঁদ তুলছে জল থেকে। আজ মাছ সে রকম পড়েনি জালে। ডুমনিমা কি ওদের খালি হাতেই ফিরাবে? মাছ না পেলে ওদের চলবে কি করে? বন চাঁদের মনটা কেমন এক অজানা আশঙ্কায় খারাপ হয়ে যায়। টলটলে জলের দিকে ও তাকিয়ে থাকে। পুবের আকাশে সূর্যের লালি দেখা যাচ্ছে। এমন সময় বিশি মাঝি এলো ডিঙি নিয়ে। এসেই হাঁক দিল, কিরে বনো, মাছ কি আজ পড়িছি জালে?

তুমার এত দেরি কেনে?

আর বুলিসনি বনো। শালা বউটাকে নিয়ে হয়েছে যত জ্বালা! রাতে পেটের অসুখ। সারারাত ঘুম হারাম।

এখুন কি ঠিক আছি?

ওই তো করিম ভাই ঔষধ দিয়েছে। দেখি কি করার লাগে।

বিশি মাঝি কথা বলতে বলতে কেমন অন্য মনস্ক হয়ে যায়। ডিঙি ঠেলে ঠেলে জাল তুলতে থাকে। বন চাঁদ আর কথা বাড়ায় না। ও কাজে মন দেয়। ডুমনির জলে কেমন এক ঢেউ উঠেছে। ডিঙি দুলছে। বন চাঁদ পোক্ত হাতে জাল তুলছে। ফাঁস জালের ফাঁকে ফাঁকে তার সংসার সুখ।সে দুহাত দিয়ে সুখ খুঁজছে।

দুই

আবার গ্রাম পঞ্চায়েত ভোটে হরেন দাস দাঁড়াচ্ছে। ওর লোকজন নেমে গেছে প্রচারে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজনকে বোঝাচ্ছে। হরেনের লোকজন কে এমনিতেই সাধারণ মানুষ ভয় পায়। অনেক এড়িয়ে চলে। শান্ত গ্রামটা আজ অশান্তির ঢেরা। বন চাঁদ যায় না এ সবে। এমনিতেই তার ছেলে অসুস্থ। ওর মন ভালো নেই। আর ঠিক একটু আগে খবরটা এলো লোক মারফৎ। ওদের আজ ডেকেছে হরেন দাস। না গেলে সে কৈফিয়ত দিতে হবে। যারা মাছ ধরে তাদের যেতেই হবে। বন চাঁদ কেমন গুটিয়ে যায় খবরটা পাওয়ার পর। বিশি মাঝির খোঁজ নিয়ে জানলো তাকেও বলে গেছে। তাকেও যেতে বলেছে। আজ রাতে ওদের নিয়ে বসবে হরেন দাস। কি বলবে কে জানে। এমন সময় তুলসীতলে সন্ধ্যাবাতি দিয়ে বিনি এসে ওর সামনে দাঁড়ায়।


হ্যাঁ— গো কেনে ডাকলি হরেন প্রেধান? যাবা নাকি?

যেতি হবি। না হলি মাছ ধরতি দেবে না বিলে।

ওর কি বাপের বিল? যে মাছ ধরতি দেবে না! লোখুকুর বেটা কোথাকার।

আঃ! চুপ করবি। না হলি কেউ শুনে ফেললি বেপদ হবি। তখন কে সামলাবে?

তুমি ওই ভয়েই থাকো। মুরদ তোমার জানা আছে।


বন চাঁদ এ কথার কোনো উত্তর করে না। ওদের পাড়া জুড়ে অন্ধকার নামছে। কেমন একটা শীত শীত ভাব। ওর মনেও আজ বড্ড শীত। না গেলেই নয়। ওকে যেতেই হবে। মিলুর কথাটা ভেবেই ওকে হরেনের বাড়ি যেতে হবে। ওর কাজ বন্ধ হয়ে গেলে তার সংসার চলবে না। বন চাঁদ বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। বিনি আর কথা না বলে ও চলে যায়। বন চাঁদ পা বাড়ায় রাস্তায়। কেমন একটা অন্ধকার নামছে ওদের পাড়া জুড়ে। একটু রাস্তার বাঁক নিতেই নিতাই এর চায়ের দোকান। বেশ কিছু লোকজন বসে। জটলা থেকে শোনা গেল খলিলের নাম। এবার নাকি সেই- ই জিতবে। মানুষও তাকে চায়ছে। লোকটা খুব কাজের। বন চাঁদ চেনে লোকটাকে।মাঠপাড়ার দিকে বাড়ি। খুব ভালো মানুষ। কিন্তু তা কি হরেন প্রধান হতে দেবে? তার লোকবল অনেক বেশি। তার টাকার জোর আছে। সে যা চায়বে তা-ই হবে।
বন চাঁদ আর দাঁড়ায় না। বিশি মাঝির বাড়ির সামনে এসে হাঁক দেয় বন চাঁদ। বিশি বলে, ও বনো এসেছিস? তা এখনি যাবি?

যেতি তো হবে। না গেলি তো বেপদ।

চল। দেখি কি বলে?

ওর যখন হরেন প্রধানের বাড়ির সামনে তখন রাত নেমেছে। বাড়ির ভেতরে কাদের কথা শোনা যাচ্ছে। আজ নাকি এটা গোপন মিটিং। একটু খাওয়া দাওয়া হবে। আজকের মিটিং এ সকলকে দায়িত্ব ভাগ করে দেবে। ভোটও এগিয়ে এসেছে। বন চাঁদ বাড়ির সামনে একটু থামে। ওর বুকটা কেমন ঢিপঢিপ করছে। বিশি ওকে বলে, চল না। দেখা যাক কি বলে?

ওরা ভেতরে গেল। দেখছে বিলের দায়িত্বে যারা আছে তারাও এসেছে। ওরা যেতেই কয়েকজন ওদের দিকে চেয়ে দেখলো। বন চাঁদ ওদের সবাইকে চেনে। ওদেের মধ্যে সমিতির গগেন মাঝিও আছে। বিড়িতে বসে টান দিচ্ছে। খুক খুক করে কাসছে। আর কি সব বলছে। বাঘ আর শিয়াল তাহলে আজ সব এক ঘাটে! বন চাঁদ একটু ওদের কাছ থেকে একটু দূরেই বসলো। বিশিও বসলো। খলিল এবার নাকি জিতবেই। তাই তো হরেনের মনে ভয় ধরেছে। এই ভোট মুখো সময়ে তাই ওদের ডেকেছে।

রাতে বেশ মুরগীর ঝোল ভাত। সঙ্গে এটা সেটা। কিন্তু বন চাঁদ ঠিক মতো খেতে পারলো না। ওর রুচি হচ্ছিল না। গগেনের লোকজন মদ খাচ্ছে। তার কটু গন্ধ ও নিতে পারছিল না। তার থেকেও হরেনের কথার কটু গন্ধটা তীব্র ছিল। যা বন চাঁদ মেনে নিতে পারেনি। মানুষটা পশুতে পরিণত হয়েছে। জেতার জন্য সে যা কিছু করতে পারে। সে এখন মরিয়া।

ওরা যখন হরেনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো তখন ডুমনির মাথায় একটা বড় চাঁদ উঠেছে। বন চাঁদ পা চালিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো।

তিন

গগেনই এসেছিল বন চাঁদের বাড়ি। তখন সবে মাত্র সন্ধে নেমেছে। মিলুটার শরীর আরও খারাপ। ওকে শহরে না নিয়ে গেলে বাঁচানো যাবে না। বেশ কদিন ও ডুমনিতে মাছ ধরতে যেতে পারেনি। ওরও শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। টাকা জোগাড় করতে না পেরে তার আরও চিন্তা বেড়েছে। ও কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ছেলেটা সারাদিন বিছানায় শুয়ে থাকে। বন চাঁদের বুকটা ছেলেটার জন্য হু হু করে ওঠে। বিলের মাছও কমে এসেছে দিনকে দিন। আগের মতো আর তেমন মাছ পড়ে না জালে। ডুমনি এখন একটা মরা গাঙ। তার বুকের টলটলে জল এখন কমে আসছে। তার বুকের মীন সন্তান গুলো হারিয়ে যাচ্ছে। বন চাঁদের মতো অনেক জেলে আজ বিপদে। এই মাছই তাদের সুখ। জীবন।

গগেন মাঝি হঠাৎই আসে ওর কাছে। বিড়ি টানছে একটু একটু করে। মাটির দাওয়ায় চুপ করে বসে বন চাঁদ। বিনি আসেপাশেই ছিল।
কিরে বন? হরেনদা পাঠালো তুর কাছে। তুকে একটা কাজ করতি হবে। আর সেটা তুই- ই করবি। বাবুর হুকুম। বুঝলি?

কি কাজ?

বন চাঁদ জিজ্ঞেস করে।

তা তেমন কাজ নয়। তু শুধু খলিলের গোপন খবর গুলো জোগাড় করি এনে দিবি। না হলি বুঝছিস তো সব! আর শোন এর জন্যি বাবু তুকে কিছু নগদ দিয়েছে। ধর টাকাটা।

বলেই বন চাঁদের হাতে এক গুচ্ছ একশো টাকার নোট গুঁজে দেয় গগেন।

যাবার আগে ওকে কাজের কথাটা স্মরণ করে দেয়। বন চাঁদ কি করবে ভেবে পায়না। ওর দুহাতের মুঠোয় এখন সুখ। মিলুটা সেরে উঠবে।

এমন সময় বিনি এসে দাঁড়ায় ওর সামনে।

তুমি মানুষের ক্ষতি করবা? এ টাকা কেনে নিলা?

বন চাঁদ নিথর হয়ে বসে থাকে। মিলুটার মুখটা চেয়ে চেয়ে দেখে। ওর বুকের ভেতরটা কেমন যেন করতে থাকে। রাত নেমে আসে ওদের বাড়ির উঠোন জুড়ে। দূরে কোথায় একটা পেঁচা ডেকে উঠলো। বন চাঁদ উঠে পড়ে। তারপর ও গগেন মাঝির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।

গগেনদা, ও গগেনদা।

কে?

বন চাঁদ।

বার দরজা খুলে দাঁড়ায় গগেন মাঝি।

কি হল বনো?

আমি কোনো কাজ করতি পারবনি। তুমি এই নাও টাকা।

বন চাঁদ বলেই টাকা গুলো গগেন মাঝির হাতে গুঁজে দেয়।

গগেন মাঝি কেমন অবাক হয়ে যায়।

তু কি ভেবে করছিস কাজটা?

হুম।

বিলে তাহলে যাবি না? তুর সব বন্ধ করে দেব।

বন চাঁদ এ কথা শুনে ফুঁসে ওঠে।

আমার বাব দাদার বিল। আমি যাবো। পারলে —।

বন চাঁদ আর দাঁড়ায় না। হনহনিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। তার মুঠোর ভেতর এখন নতুন সুখের রোদ।

You may also like