হিজলতলা গাঁয়ে একসময়ে ওদের দু’বাড়ির সীমানা ঘেঁষে বয়সের ভারে ন্যুব্জ, ছালবাঁকলা ক্ষয়ে-পড়া, এবড়োথেবড়ো এক দৈত্যাকার গাবগাছ ছিল। খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যেত ওদের- রাতের আঁধারের খোলস ছেড়ে দিবস উঁকি দিতে তখনও ঢের সময়ের বাকি। পুবাকাশে সবে আবছায়া-জাফরান রঙের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। সেসময়ে আধো আলো-অন্ধকার সাঁতরে দু’বন্ধু গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়াত তারারফুলে ছেয়ে থাকা গাবতলার উঠোনে। হাওয়ায় ভেসে বেড়াত নেশাধরা সফেদশুভ্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নক্ষত্রের মতো গাবফুলের গন্ধ। স্পষ্ট মনে আছে ওর, যেন ছায়াছবির মতো চোখের সামনে একে একে সবকিছু ভাসছে সুনীলের আজ এই মুহূর্তে। ভরা বর্ষায় বৃদ্ধগাছটার বাঁকল খসে গাছের গায়ে লেপটে থাকত গাছটা দেখতে অনেকটা গুটিবসন্ত রোগীর শরীরের মতো মনে হত, ওরা গাছের গায়ে হাত বুলাতে ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে পড়ত সেসব ছালবাঁকল। এসময়ে কাঁচাঘাসের মতো ঘ্রাণ বের হয়ে আসত গাছ থেকে, ঠাকুরদা বলতেন-মানুষের মতো গাছেরও নাকি শরীর বেঁয়ে গন্ধ বের হয়। তিনি সত্য বলতেন- আদতে গাছেদের মতো মানুষের শরীরেও স্বতন্ত্র ঘ্রাণ আছে, কাছের মানুষরা টের পায়। এই যেমন, এখন এইমুহূর্তে সবসময়ের মতো মতিনের গায়ের গন্ধে বুঁদ হয়ে ডুবে আছে সুনীল!
তখনও এযুগের পকেটওয়ালা প্যান্ট শার্টের পাইকারি চলন শুরু হয়নি, ছোটদের জন্য তো নয়ই। গজকাপড়ে দর্জিঘরে বানানো হতো গিরুঅবধি নেমে যাওয়া ট্যাটন কাপড়ের রঙিন হাফপ্যান্ট। অবশ্য কালো সুতার তাকি কোমরে বেঁধে পকেটের কাজ কৌশলে পুষিয়ে নেওয়া যেত বলতে গেলে নির্দ্বিধায়। তাকিবাঁধা-কোঁচরে গাবফুল গুঁজে সিঁদুরটিপের মতো বিশাল সূর্যটা দেখতে ছুটে যেত মতিনদের প্রাচীন কুমিরের পিঠের মতো উঁচুনিচু ইটসুরকি বেরিয়ে যাওয়া শ্যাতলা-পড়া শানবাঁধা পুকুরঘাটে। ততক্ষণে গাঢ় কমলারঙের ডিমের কুসুমের মতো দিবাকর তার অস্তিত্ব জানান দিতে উঁকিঝুকি মারছে পূবাকাশে। দু’বন্ধু পুকুরঘাটে পাশাপাশি পা ঝুলিয়ে গুটিসুটি মেরে বিস্ময়ে হা হয়ে দেখত সূর্যোদয়ের সেই অপার্থিব দৃশ্য।
কাছিমের পিঠে ভর করে বয়ে চলা সময়ের মতো ধীরলয়ে একসময় শৈশব থেকে কৌশরে ফিরে যায় ওরা। মতিন এবং সুনীলের বয়সের ফাঁরাক মাত্র চারমাস উনিশ দিনের। হিজলতলা গাঁয়ের প্রাইমারী স্কুল বাড়ি থেকে মাইলখানেকের হাঁটাপথ। দু’জোড়া ক্ষুদ্রপায়ে অতটুকু পথ পেরোতে সূর্যদেব আসমানের মধ্যিখানে চলে আসত। তারপরও সবদিন স্কুলে ঠিকঠাক পৌঁছা হতো তা কিন্তু নয়। মতিন-টা ছোটবেলা থেকেই ছিল বয়সের তুল্যে বেশ আঁটসাঁট গড়নের শক্তসামর্থ্য তবে একটু বেশিই যেন চপল। সুনীল ছিল তার উল্টো- বারোমেসে পীড়িত। নিদিষ্ট সময়ের মাসখানেক আগে জন্ম-নেওয়া সুনীলের, সুতিকাগার থেকেই শরীর-মনের জোর ছিলো স্তিমিত। তবে মতিনের একজোড়া নির্ভরতার-হাত সুনীলের জন্যে সদা আগ বাড়িয়ে থাকত বলেই তার জীবনটা হয়ে ওঠে শরতের নির্মেঘ আকাশের মতো নির্ঝঞ্ঝাট। এত ভালোবাসা ভাইয়ে ভাইয়েও সহজে দেখা মেলা ভার।
স্কুলের মেটেপথের দু’ধারে ছেয়ে থাকত সারি সারি ঢোল কমলি, সেসবের ফাঁকফোকরে কাঁটাল আগাছার আখড়া। সুনীলের ক্লান্তপা এলেদুলে কাঁটা নটে শাকে জড়িয়ে গেলে ব্যথার যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠত, মতিন ছুটে এসে কাঁটা কৌশলে বের করেই ক্ষান্ত থাকত না। কাঁটা-ফুঁড়ে যাওয়া ক্ষতস্থানে দাঁতে চিবিয়ে দূর্বাঘাসের কষ বের করে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে মুহূর্তে ব্যথার নিরাময়ও করে দিত। সুনীল কমজোরী দৌড়ঝাঁপ যেমন পাড়ত না, গাছ গাছড়াও বাইতে জানত না তবে পাখির বাসায় ডিম দেখলে ডিম হাতে পেতে অস্থির হয়ে উঠত। বন্ধুর কোন ইচ্ছায়ই অপূর্ণ রাখত না মতিন। গাছীর মতো ঝানু পায়ে দরদরিয়ে গাছের মগডালে বাঁধা পাখিরবাসা থেকে নীলচে ডিম পেড়ে এনে সুনীলের হাতের মুঠো ভরিয়ে দিত।
ওদের বাড়ির দক্ষিণে যতদূর চোখ যেত দিগন্তছোঁয়া ফসলের মাঠ ধু ধু করত। শীতকালে রবিশস্যে মাঠগুলো কানায় কানায় ভরা থাকত। পৌষের বিকেলে মিহি রোদের ফাঁকে ফাঁকে রেশমি সুতোর মতো পাতলা কুয়াশা জমত সেখানে। ওরা দলবেঁধে ঘুড়ি উড়িয়ে একসময় ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ত মটর-কলুই ক্ষেতের নরম বিছানায় জড়াজড়ি করে।
আহা ! সেসব দিন, চাক্ষুষ চোখের সামনে শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছে এই তো গতকাল অথচ কতোগুলো বছর গেছে কেটে। মাথার উপর অসীম শূন্যলোক। সেদিকে চোখ রেখে কোন অজানা অকূল দূরস্থিত ভাবনায় জড়িয়ে যেত কচি সবমনেরা, কে তার নাগাল পায় ! নেশাখোরের মতো নির্জীব হয়ে ডুবে থাকত ওরা কতক্ষণ, কতোকাল কে তার হিসেব রাখে। ধ্যানস্থ সেই জগত থেকে একসময় বাস্তব জগতে ফেরাত- বেরসিক মাঝেরচরের চাষী মঙ্গল রায়ের পাচনি। পাচনি হাতে বহুদূরে হতে গরু তাড়ানোর আদলে ধর ধর শব্দে তেড়ে আসতে, দলবেঁধে ওরা ছুটে পালাত। অবশ্য ততক্ষণে প্যান্টের তাকি-পকেট ভর্তি হয়েছে মটরের শিমে। ভগ্ন শরীরে দৌড়ে কুলাতে পারত না সুনীল। অল্পতেই দাঁড়িয়ে হাঁপাতে শুরু করত। ডরভয় বড্ড জাঁকিয়ে ধরত ওকে। আতঙ্কে বুকেরখাঁচা কামারের ফুটু হাপারের মতো দুলতে থাকত। বাকিরা দৌড়ে নিরাপদে চলে গেলেও মতিন সুনীলকে টেনে হেঁচড়ে সাথে নিয়ে এগুতে যেয়ে মঙ্গল রায়ের পাচনির কবলে পড়ে যেত। শেষে উপায়ন্ত না দেখে সুনীলের দেহ আগলে দু’হাত পাকা আসামীর মতো উঁচিয়ে উঠিয়ে সারেন্ডার করলেও দু’ চারটা পাচনির বারী যে পড়ত না তা কিন্তু নয় তারপরও বন্ধুকে ছেড়ে পালাত না।
তাদের বাড়িরধারে ইছামতী নামে এক নদী ছিল, যদিও এখন তা স্তিমিত। একসময় সে-নদী নাকি প্রমত্তা ছিল, গাঁয়ের বৃদ্ধরা ছোটদের কাছে রূপকথার গল্পের মতো সেই নদীর গল্প চাউর করে বলে বেড়াত ! শীতকালে নদীর পানি শুকিয়ে তলায় নামত। অল্পপানিতে মাছ প্যাঁককাদায় লাফঝাপ করলেও ধরা ততটা সহজ ছিল না। বর্ষাকালে হিজল তেতুলের ডালপালা কেটে ঝাঁটা ফেলা হত, মাছেরা ঝাঁটায় বাসা বেঁধে মনের আনন্দে নদীতে লাফিয়ে বেড়ালেও একসময় পানি শুকিয়ে গেলে ঝাঁটায় যেয়ে আশ্রয় নিত। শীতকালে মতিনরা ঝাঁটার ফাঁদে কায়দা করে মাছ আটকে দিত। এরপর গাঁয়ের প্রায় সকলে একদিন দলবেঁধে মাছ ধরতে নদীতে নামত। এমন চিত্র প্রায় বছর হয়েছে- সবাই হল্লা করে মাছ তাড়িয়ে ফাঁদে ফেলে যেই মাছ ধরতে যাবে ঠিক সেসময়ে সুনীল পা চেপে ধরে যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠছে। পায়ে তার জিয়ল মাছের কাঁটা ফুঁটেছে। মতিনের মাছ ধরা ভেস্তে যেত। মাছের খালুই উল্টে ফেলে সুনীলকে নিয়ে চটজলদি নদীপাড়ে উঠে আসত সে। শুধু তাই নয়! সে বয়সে অনেকটা বিজ্ঞজনের মতো বিশেষ গাম্ভীর্য মুখে এঁটে মাছের কাঁটার-মন্ত্র, তেতিয়ে-ওঠা সূর্যের দিকে মুখ ফিরিয়ে সুনীলকে পাঠ করাতো। মন্ত্রপাঠে তো নয় বন্ধুর ভালোবাসার স্পর্শে সুনীলের ব্যথার যন্ত্রণা সত্যি সত্যি কোথায় উড়ে পালাত ! নানান রকমের মাছ ভর্তি কালুই নিয়ে সকলে বাড়ি ফিরলেও সুনীল বন্ধুর কাঁধে ভর দিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে বাড়ির পথ ধরত। সবকাজে সুনীলের কারণে মতিন পিছিয়ে পড়ত ঠিক তাই বলে মতিনকে কখনো কোন অভিযোগ কিংবা আক্ষেপ করতে দেখা যেত না।
এভাবে হেলায়খেলায় পাখির ডানায় ভর করে দিনগুলো বেশ ভালোয় ভালোয় কাটছিল। তখন কতো তাদের বয়স হবে, প্রাইমারী ছেড়ে হাইস্কুলের তিনক্লাসে সবে উঠল সেবছর। একদিন ভোরসকালে হুট করে নীরোগ সুনীলের মুদিদোকানী-বাপ সন্যাসরোগে চিতেয় উঠলেন !
এরপর থেকে সুনীলের সুখগুলো ঝড়ে ছাই-উড়ে যাওয়ার মতো করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। পড়াশুনা চালিয়ে নেওয়ার পথ রইল না। বইখাতা সেরদরে বেচে দিয়ে বাবার মুদিদোকানে কাজে লেগে পড়তে হলো তাকে। সুনীলের গায়েগতরে জোর কম। মতিন স্কুলশেষে সুনীলের দোকানের ভারি কাজগুলো সেরে দিয়ে আসে। আবার বেশ রাত করে বাজার ভাঙ্গতে দোকানের ঝাঁপিটানার সময় হয়, সুনীলকে সাহায্যে করতে সে ঠিক সময়মতো দোকানে যায়। বাজার থেকে আঁধাররাতে জুনিপোকার আলোতে বাড়ি ফিরতে ফিরতে যতটুকু সময় মেলে দু’বন্ধু সারাদিনে জমিয়ে রাখা কথার ঝুড়ি খোলে ধরে। কতো স্বপ্ন তাদের। সেই শৈশব থেকে মুঠো মুঠো করে জমিয়ে রাখা স্বপ্নগুলো যদিও হঠাৎ হঠাৎ আকাশের নক্ষত্র ক্ষয়ে পড়ার মতো করে ঝরে যায় তারপরও আবার নতুন স্বপ্ন এসে তা ভরাট করে দেয়। দু’জনের পথ মাঝপথে এসে হুঁচট খেয়ে বাঁক ঘুরে গেছে সেই সুনীলের বাপ চলে যাওয়ার দিন থেকে। তারপরও মতিন সুনীলের চোখে বুনে দেয় আসমান ছুঁয়া স্বপ্নবৃক্ষের চারা। সুনীলের জীবনের ধুনুচি হয়ে তাকে আগলে রাখে সে সবসময়। মিইয়ে-পড়া সুনীল- বুকে বল পায়, অকূলে তটের দেখা পায় বন্ধু মতিনের পরামর্শে, উৎসাহে।
সময় বয়ে যায়,অনেককিছু বদলে দিয়ে। মতিন স্কুল ফাইনাল পাশ করে। কলেজে ভর্তি হতে শহরে যাওয়ার বন্দোবস্ত চলছে। সেবছর মতিনের বাবা কঠিন রোগে পড়লেন। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মস্তবড় অফিসার বানানোর স্বপ্নটা মাঝপথে এসে তাকে থামাতে হল। মতিন সংসারের জোয়াল ধরতে শহরে চাকুরির খুঁজে চলে যায়। এবং একসময় বাবার পরিচিত একলোক ধরে পিয়নের একটা কাজও জুটিয়ে ফেলে।
সুনীল সারাক্ষণ জোড়াভাঙ্গা ছানার মতো ছটফট করে,বন্ধুর পথ চেয়ে বসে থাকে। মতিনকে ছাড়া একদম চলে না। ওদিকে বন্ধুরও দম ফেলার ফুসরত নেই। কাজের ব্যস্ততার মাঝেও সারাক্ষণ বন্ধু সুনীলের কথা পড়ে, মনের গহীনে খোঁচাতে থাকে। পিয়নের কাজে ছুটি পাওয়া বড় মুশকিল। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও অফিসের স্যারের ফুট-ফরমাশ খেটে দিন পার হয়। মাসে একবার বড়োজোর দু’বার গাঁয়ে ফিরতে পারলেও ছুটি মাত্র একদিনের।
সুনীলের দাঁড়িগোঁফ এখনো ঠিকঠাক গজে উঠেনি, ঠোঁটের উপরিভাগে কালোরেখার দাগে কিঞ্চিৎ লোমের আঁচর সবে পড়তে শুরু করেছে। নরম বয়স। তাছাড়া শরীর মন উভয়ই তার বয়সের চেয়ে বেশ পিছিয়ে আছে। বাপমরা ছেলেকে নিয়ে মায়ের উৎকণ্ঠার শেষ নেই। ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সমস্ত দুঃখের অবসান ঘটাতে মায়ের তোড়জোড় শুরু হয়। সুনীল প্রথম প্রথম বেঁকে বসলেও পরে অবশ্য মায়ের কথার অবাধ্য হতে পারে না, বাবা চলে যেতে যুবতী মায়ের শরীরে বৃদ্ধের ছায়া পড়েছে, সারাক্ষণ ধরণী ছেড়ে যাই যাই করে। মায়ের দূরসম্পর্কের আত্নীয়ের সাথে সুনীল সাতপাকে বাঁধা পড়ে।
মতিন কাজের ব্যস্ততায় শহুরে ইটকাঠের খপ্পরে পড়ে একসময় ফাঁপরজীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। শহুরে মেয়ের সাথে ভাব-ভালোবাসা বিনিময়ে বিয়ে করে সংসারও পাতে। ছ’মাসে কিংবা বছরে একবার তাও অল্পসময়ের জন্যে গাঁয়ে ফিরতে পারে। সুনীলের বন্ধুর জন্যে খুব মন পুড়ে। যদিও দু’বন্ধুর প্রায়মাসে চিঠিপত্রে যোগাযোগ হয়। কিন্তু তাতে সুনীলের মন ভরে না। এরপর মাঝেমধ্যে অবশ্য সুনীল পরিবারসহ বন্ধুর সাথে দেখা করতে শহরে যায়। আচমকা সময়ে অসময়ে সুনীলকে দেখে বন্ধু মতিনের সেকি আনন্দ ! কতো কথা জমা হয়ে থাকে দু’জনের মনের কোটরে। দু’বন্ধু বহুদিন পর পর হলেও সেই আগের মতো দিলখোলে গল্প করে। গল্পে গল্পে কখন রাত শেষে ভোর হয় খেয়ালে থাকে না !
এক আষাঢ়ে ডলকের ভর-সন্ধাবেলায় মতিন বসে আছে তার দো-কামরা ঘরের ঝুলবারান্দায়। সন্ধ্যা নামতে মাঝরাতের আঁধারে জেঁকে বসেছে শহরটাতে। বাইরে উথালপাথাল বৃষ্টির ঢল। সামান্য ক’হাত দূরের কিছু দৃশ্যমান হচ্ছে না। আকাশে মেঘের গম গম আওয়াজ। এমন দুঃসময়ে কাঁকভেজা হয়ে পোষ্টমাষ্টার ঝুলবারান্দার ফাঁক দিয়ে তাকে একখানা হলুদখামের চিঠি ধরিয়ে দিয়ে যায়। খামের উপর সুনীলের ঠিকানা, কিন্তু চিঠির ওজন পাখির পালকের মতো হালকা, যা সচরাচর হয় না ! মতিনের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে,সে উৎসুক হয়ে আধভেজা খামটা খুলে ফেলে। একখানা চিরকুট।
সুনীলের চিঠিগুলো সাধারণত চারপাঁচ পৃষ্ঠার বেশি হয়। প্রায় সপ্তাহে তার চিঠি আসে, মতিন যত্ন করে বসার ঘরে টেবিলের উপর তা রেখে দেয়। সাধারণত ছুটিরদিনে ঘটা করে বিশেষ অভিনিবেশে সে-চিঠি খোলে এবং আদ্যেপ্রান্ত পড়ে। যদিও শহুরেব্যস্ততায় তার ঘনঘন উত্তরপত্র লেখা হয়ে ওঠে না, কিন্তু বন্ধু তাতে ক্ষান্ত হয় না। তার চিঠিতে হিজলতলা গাঁয়ের খুঁটিনাটি বিষয়ও বিস্তারিত লেখা থাকে, কোন ঘটনাই বাদ থাকে না যেমন-
গাঁয়ের কার সংসারে সুখের নহর বইছে কার আকাল চলছে, কে কুশলে আছে, কার সাথে কার কী ঘটছে- এমনতর হাঁড়িরখবর কিংবা ইছামতীর নদীর স্রোতে বাঁশের সাঁকো খুলে গেল, নাকি ঝুলে পড়ল! কার ঘরে আগুন লাগল, অতি বর্ষায় ফসল জলে ডুবল না ভাসল- এরকম কতো কী ! চিঠি শেষ হয়েও যেন বাকি থেকে যায়। রোল করা পৃষ্ঠার বাইরের অংশে পুনশ্চ দিয়ে ভুলে যাওয়া সংবাদে ভরাট করা হয়। সেখানে মাত্র দু’লাইনের চিরকুট দেখে মতিনের টানটান কপালে রেশমিসুতার মতো মিহিভাঁজ স্থায়ী হয়। ব্যালকনিতে অন্ধকার, সে চিরকুট নিয়ে বসার ঘরে ফিরে। পড়তে শুরু করলে দু’লাইনী চিঠির ভারে মুহূর্তে চূড়া-ভাঙ্গা পাহাড়ের মতো ধপাস করে বসে পড়ে।সুনীলের দু’কিডনি অচল, নিথর।
সুনীল মুদি-দোকানি। জমি-জিরাত বলতে দাদার-কালানের এককানি জমি। এরইমধ্যে সংসারে যোগ হয়েছে দু’কন্যা সন্তান। সেই জমির উপর ভর করে চলছে চারজনের সংসার। দোকানটা বিক্রি করতে হয়েছে, সামান্য চিকিৎসা যদিও হয়েছে তাতে আরোগ্য হওয়ার আশা অবান্তর তা অবশ্য সুনীল কেনো তার অবুঝ সন্তানেরাও বুঝে উঠবার কথা। তাকে রাজরোগে ধরেছে, চিতায় তুলে তবেই তা ক্ষান্ত হবে। চোখে-মুখে অমানিশার কালো আঁধার এঁটে রাতদিন বাড়ির পুবকোণের বাঁশেরচাঙ্গে বিবশ হয়ে বসে থাকে। সন্মূখের ভাবনায় জমাটবাঁধা অন্ধকারে ডুবে থাকে তার মন, পাঁজরফাটা দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে উঠে তার চারপাশ। দু’চোখের জমানো স্বপ্নগুলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে শূন্যে ঠেকেছে সেই কবে। মেয়ে দুটো সারাক্ষণ চোখের সামনে হাঁটিহাঁটি পায়ে হেঁটে বেড়ায়। বউটা কান্না সামলে উঠতে মুখে শাড়ির আঁচলের খুঁট গুঁজে আবডালে লুকায়। সুনীলের অসহায় দু’চোখ বেঁয়ে নীরবে বয়ে চলা অশ্রুধারা শুকিয়ে গিয়েছে সেই কবে তবে অবিরত মনের-শরীরের দহন নিভে কোন দাওয়ায় ! হাত-পা ফুলে ঢোল হয়ে আছে। শরীরটাতে অসহনীয় কষ্ট, সে নিজেও এখন দিনরাত্র মৃত্যুদূতের আগমন কামনা করে!
একদিন ভোরের আদুরে আলোয় ভর করে সুনীলের জীবনের ঘোর আঁধার কেটে আচম্বিত সুখ ফিরে আসে। সুদখ হয়ে বরাবরের মতো বন্ধু মতিন। মতিনের সাথে সুনীলের কিডনি মিলে যায়। রোগের শুরুতে মতিন ঠিক এই চেষ্টাটা করেছিল তখন অবশ্য ভুল রিপোর্ট আসায় তাদের চেষ্টা বিফলে যায়। এ রোগের চিকিৎসায় অঢেল টাকার প্রয়োজন ছিল, যা দু’বন্ধুর কারো নেই। তারপরও মতিন হাতগুঁটিয়ে বসে থাকেনি। কিন্তু পরিপূর্ণ চিকিৎসা সম্ভব হয়ে উঠেনি। এরপর সে গতমাসে আবার নতুন করে টেস্ট করালে দেখা যায়- উভয়ের রক্তের গ্রুপ ও’ নেগেটিভ। কিন্তু আরও জটিল সব টেস্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এবং গতকাল ডাঃ তাকে নিশ্চিত করে তার স্বপ্ন আশার আলো দেখছে। তবে মতিনের বহুমুত্ররোগের কারণে জীবনের ঝুঁকি বিষয়ে চিকিৎসকদের কপালেও উদ্বেগের মিহি-চিরল ভাঁজ দেখা যায়। কিন্তু বন্ধু মতিনের বুকভরা সাহস এবং বন্ধুর প্রতি বিশুদ্ধ ভালোবাসার কাছে সমস্ত দুর্ভাবনা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। দেশে সেসময়ে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট মোটেও সহজতর ছিল না। কিন্তু দেশের বাইরে চিকিৎসা নেওয়ার অর্থনৈতিক অবস্থায় দু’বন্ধুর কেউই ছিলেন না, কিন্তু তাদের হাতে বিকল্পপথও যে নেই। অবশেষে দেশের সরকারি হসপিটালে অপারেশন হয় এবং বলা যায় খুব নির্ভারে সুনীল সুস্থ হয়ে হিজলতলা গাঁয়ে ফিরে আসে।
মাঝে চল্লিশ বছর পার হল।
মতিনের হাতে লালরঙের একটা ফাইল, সে ডাক্তারের চেম্বারে মাথা গুঁটিয়ে বসে আছে। বয়সের কারণে কিনা নাকি রোগের কারণে- মাথা সোজা করে রাখতে তার সমস্যা হয়। অল্প বয়সী ডাঃ সবে হয়তো প্র্যাকটিশ শুরু করেছেন, তিনি রিপোর্ট পড়ে- মতিনের নিচু হওয়া মুখের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তার কপালে চিড়ল ভাঁজ দেখা গেল। সমূখে রাখা শীতলপানির বোতল থেকে একটু শব্দ করেই কয়েক ঢুক পানি গলায় ঢেলে নিজের মধ্যে যেন দম ফেরালেন। মতিন, আচমকা ডা-এর মুখে এমন কথা শুনে চল্লিশ বছর আগের সেই ঘোর বর্ষা-সন্ধ্যায় ফিরে গেল, মাথায় আস্ত আকাশটা যেন ঝুরঝুর করে ভেঙ্গে পড়ল ! বয়সের ভারে কোঠরে লুকানো ধূসর চোখেজোড়ায় মুমূর্ষু মানুষের মতো নিরুপায়-দৃষ্টি মেলে সে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকে। মতিনের কিডনি বিকল’ রোগ ধরা পড়েছে!
বেশ কদিন ধরে শরীরটা ভারি হয়ে আসছিল। শরীরের জোর কমছিল খুব দ্রুত। একটুতেই হাঁপিয়ে উঠে। ঘুম হয় না, মুখে রুচি নেই। শেষবয়সে এসেও শরীরটা বলতে গেলে এতদিন বেশ ভালোই চলছিল শুধু ওই যে বহুমূত্ররোগটা যা একটু ভোগায়। ডা-কবিরাজ এড়িয়ে চলা মতিন, শরীরের এমন বেহাল দশায় একসময়ে ডাক্তারের কাছে যেতে বাধ্য হয়। শেষমেশ কিনা সেই চল্লিশ বছর আগেকার প্রতিধ্বনি নিজের সায়ংকালে শুনতে হল ! তার একটি মাত্র কিডনি, যারও কিনা শরীরকে চালিয়ে নেয়ার ক্ষমতা প্রায় নিঃশেষ। কিডনিটা নিজে মরার আগেই মরে গেল ! তাও ভালো, বন্ধুর দেহে নিজের কিডনিটা ঠিকঠাক তো চলছে ! প্রকৃতির কী খেয়াল ! বাঁচতে হলে প্রতিসপ্তাহে তাকে ডায়ালিসিস করতে হবে।
প্রতিসপ্তাহের বুধবার সকাল দশটায় মতিনের সময়বাঁধা ডায়ালিসিস। আষাঢ়ে-ডলক কিংবা জিরজিরে হাড় কাঁপানো শীতের প্রকোপ ঠেলে হিজলতলা গাঁ থেকে সুনীল প্রতি বুধবার ভোরের আবেশ না কাটতে বন্ধুর বাসায় উপস্থিত হয়। দু’হাত ভরে নিয়ে আসে বন্ধুর প্রিয় হরেকরকম খাবার।
এদিনে মতিনের খাবারে কড়াকড়ি একটু কম থাকে। এসুযোগে বন্ধুর প্রিয়খাবার বয়ে নিয়ে সেই আঁধারভোরে বাসে চেপে বসে সে। মতিনের ইদানীং সেই কবেকার খাবারের কথা খুব মনে পড়ে। মুখে সেই আগের স্বাদ নেই, তারপরও মন চায় চেখে দেখার। সেই শৈশব-কৌশরে জিভে-লেগে থাকা স্বাদের খোঁজে মায়েরহাতের কতো খাবারের কথা মনেপড়ে মতিনের। কখনো চুলার ছাইয়ে পোড়া জিয়লমাছের ডিমের হাতে-ডলা ভর্তা , লাউপাতায় চ্যাপাশুঁটকি, অনিলের দোকানের রসগোল্লা কিংবা নিখিলের দোকানের নিমকিকাটা চানাচুর।
দু’বন্ধু বুধবারে রাজ্যের গল্প করে। ডায়ালিসিসের পুরোটা সময় সুনীল মতিনের সুঁচে-ফুটা হাতটা ধরে বসে থাকে। ও-হাতে মায়াভরা নিজের হাতটা ছুঁয়ে দিলে যেন বন্ধুর কষ্টটা একটু হলেও লাঘব হয়। দূষিতরক্তের ধারা হাতে জড়ানো পাইপের ভেতর দিয়ে মেশিনে শুদ্ধ হতে বেগে চলে, এসময়ে মতিনের চিরচনা হাসিমাখা মুখটা কেমন বিষণ্ণ অচেনা হয়ে উঠে। সুনীল এসময়ে বড়ো উদগ্রীব থাকে। বন্ধুর মন ফেরাতে ইনিয়ে-বিনিয়ে গল্প জুড়ে দেয়। কতো কথা বলার আছে বন্ধুকে ! সময় মিলেনি সেসব বলার। এসুযোগে আবার সেই শৈশব-কৌশরবেলার মতো অঢেল সময় মিলে যায় তাদের। ফেলে আসা সেইসব দুর্দান্ত দিনের স্মৃতি হাতড়ে ডায়ালিসিসের বিরক্তিকর সময় আলগোছে কখন কেটে যায় টেরই পাওয়া যায় না।
বছরখানেক এমন রুটিনে ভালোয় ভালোয় চলছিল তাদের সময়। কিন্তু এবছরের গোড়ার দিকে মতিনের শরীর ভাঙ্গতে শুরু করে। ডায়ালিসিস সপ্তাহে একদিনের পরিবর্তে দু’দিন এরপর তিনদিন বেঁধে দেওয়া হয়। রক্ত দিতে হয় নিয়মিত। দুষ্কর শ্রেণির রক্ত হলেও সুনীলের মেয়ের সাথে রক্তের মিল থাকায় শেষসময়ে বন্ধুরঋণ কিছুটা হলেও যেন শোধরাবার সুযোগ পায় সে। তার মেয়েটাকেও যে নিজের মেয়ের মতো লেখাপড়ায় সাহায্য করে সমাজে দাঁড় করিয়েছে বন্ধু মতিন। মেয়েটা মতিনকে নিজ পিতার মতো দেখভাল করে।