সকালবেলা।বারান্দায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলাম।আমার শিশু পুত্র সফদর এসে আমার পাশে বসলো। কাগজের প্রথম পৃষ্ঠাতে ছিল একটি ছবি।উজান আসামের গোলাঘাট, মাজুলী কিম্বা শিবসাগরের। কয়েকজন হতদরিদ্র লোককে চার-পাচজন বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট যুবকের মারার দৃশ্য।
সফদর আমাকে প্রশ্ন করলো, “আব্বা, এই হতদরিদ্র লোকগুলোকে মারছে কেন?”
“মানুষ গুলো ঐ দাদাদের চোখে বাংলাদেশী ,তাই-” আমার উত্তর।
“কে প্রমাণ করেছে ওরা বাংলাদেশী? আর ঐদিনতো তুমি আমাকে বলেছিলে-লুংগী পরা, দাড়ি থাকা লোক, যারা ভাল করে অসমীয়া বলতে পারে না, নিম্ন আসামের সেইসব লোকদের দেখলেই উজান আসামের অধিকাংশ লোক তাদের বাংলাদেশী বলে গণ্য করে…
অল্পসময় সে কিছু ভাবলো, তারপর আবার বললো, “ওরা যদি সত্যিই বাংলাদেশীও হয়, তবু তাদের কেন মারবে? ওরা কি মানুষ না?”
“নারে, বাবা।ওরা বরপেটা জেলার এক পশ্চাৎপদ গ্রামের গরীব মানুষ।এই কাগজেই লিখেছে।”
“তাহলে এই দুষ্ট দাদাদের পুলিশ এরেস্ট করেনি কেন? ডাকাত হয়েছে না, মানুষ মানুষকে কখনো এরকমভাবে মারতে পারে?” সফদরের কচি মুখ রাগে লাল।
“এই দাদারা আসলে কিছু লোকের হাতের পুতুল মাত্র…”
“পুতুল? কার হাতের পুতুল,আব্বা?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সে।
“কিছু লোক আছে, দেশের রাজা মন্ত্রী হয়ে থাকতে চায়, ওরা মানুষের মাঝে বিভাজন আনতে চায়, হিন্দু-মুসলমান, অসমীয়া-বাঙালি …তাছাড়া দেশে তো অন্য অনেক সমস্যাও আছে, তাইনা?”
“কি সমস্যা?”
“যেমন ধরো, এই যে যুবকেরা যারা মারপিট করছে, তারা লেখা-পড়া শেষ করে কোনো একটা কাজ পাওয়াটা জরুরী ছিল, নতুবা বেপার-বাণিজ্য কিছু একটা করে দুপয়সা উপার্জন করাটা তাদের জন্যে প্রয়োজনীয় ছিল, কিন্তু এদেশের রাজা-মন্ত্রীরাতো এদের জন্যে এসব কিচ্ছু করে দিতে পারেনি বা দেয়নি।তাই বিপথগামী এই যুবকদের মাথায় একাংশ রাজনীতিবিদ ঢুকিয়ে দিচ্ছে-নিম্ন আসাম থেকে উজান আসামে কাজের সন্ধানে যাওয়া, নদী-ভাঙনের শিকার শ্রমিকরা তাদের কাজ কেড়ে নিচ্ছে,তাই অসমীয়া যুবকেরা কাজ পাচ্ছে না।আসামের আর্থিক দুরাবস্থার জন্যে এরাই দায়ী।তাই এই শ্রমিকদের ওরা তাড়িয়ে দিতে চায় আসাম থেকে, তাদেরকে বাংলাদেশী হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চায়।”
“তাদের কাজ তারা নিজেরা করেনা কেন? কাজ করা লোকগুলো তাহলেতো তাদের জায়গাগুলোতে যাবেইনা।আচ্ছা আব্বা, ওরা সবাই আলসে লোক নাকি?”
সফদর প্রশ্ন করে।
“সবাই নয়।কিছুসংখ্যক কিন্তু সত্যিই আলসে।” আমার সংক্ষিপ্ত উত্তর।
সফদর আমার পাশ থেকে উঠে ভেতরে চলে যায়।কিছুক্ষণ পর সে আবার এসে আমার পাশে দাঁড়ায়।খবরের কাগজটি থেকে মাথা তোলে তার দিকে তাকিয়ে
আমি প্রশ্ন করি, “কিছু বলবে সফদর?”
“তুমি যে বললে-এই গরিব লোকেরা ঠিকমত অসমীয়া বলতে পারে না-তাই এই দাদারা তাদের মারপিট করিতেছে।আমাদের ক্লাসের রজনীতো বোড়ো সম্প্রদায়ের, ট্রাইবাল ছেলে।আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড।সেতো অসমীয়া নয়।অসমীয়া বলতেও পারেনা, লেখতেও জানেনা।আর ছন্দামিতা দিদি, আমাদের ইংরেজির ম্যাম, সেতো নেপালী।আমার বন্ধু-মনোজ।ওরাতো বিহারী।হিন্দী বলে।ঐ দাদারা এদের সব্বাইকে মারপিট করবে?”
“করবে না।ওরা শুধু গরিবেদেরকেই অত্যাচার করে, দাঙ্গায় হত্যা করে, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।ধনী লোকদের, বড় কারবারীদের ওরা কিচ্ছু করেনা।করতে পারেনা।পূজা-বিহুতে তারা মোটা টাকার চাদা আদায় করে এদের কাছ থেকে।তাছাড়া ধনীদের সরকার নিরাপত্তা দেয়।তাই এরা ধনীদের ক্ষতি করার সাহস পায়না।”
আমার উত্তর শুনে সফদর সন্তষ্ট হলো কি না আমি বুঝতে পারলাম না।
আবার নি:শব্দে ঘরের ভেতর ঢুকে গেল সে।
অসমীয়া কাগজটি পড়া শেষ করে আমি দ্যা হিন্দু কাগজটি হাতে নিলাম।
সফদর আবার আসল।আমার পাশ থেকে অসমীয়া কাগজটি নিয়ে পাকাতে বিছিয়ে দিল।
আমি ভাবলাম-সে হয়তো ছবিগুলো দেখবে নতুবা অক্ষর জুটিয়ে জুটিয়ে তার প্রিয় ক’লাম খেলার জগতের খবরগুলো পড়বে।কয়েক মূহুর্ত্তের পর তার দিকে
তাকালাম-সর্বনাশ।ওর হাতে নতুন ব্লেড একটা।
আমি চিৎকার করে বললাম, “সফদর, ব্লেড দিয়ে কি করছো?”
“আমি এই বদমাশ দাদাদের হাতগুলো কেটে দিচ্ছি।ভবিষ্যতে এই দুষ্ট লোকেরা আর কোনো গরিব মানুষদের অত্যাচার করতে পারবেনা।”