মুসলমান ‘ভোটব্যাঙ্ক’

বিগত ৬|৪|২১ তারিখ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদিজী উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জনসভায় বার বার ঘোষণা করেছিলেন, “মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক ” মমতা দিদির কাছ থেকে সরে গেছে। তার মানে আজও মুসলমানেরা ভোটব্যাঙ্ক! ব্যাঙ্কে পরম নিশ্চিতে যেমন টাকা রাখা যায় ;তেমনি মুসলমান ভোট রাজনৈতিক দলগুলোর পরম নিশ্চয়ের জায়গা।এবার প্রশ্ন হলো, মুসলমানরা আর কতদিন ভোটব্যাঙ্ক থাকবে??

রাজনীতিতে “ভোটব্যাঙ্ক ” আজ একটি জনপ্রিয় শব্দ।বেঙ্গালুরবাসী এম,এন, শ্রীনিবাসন সমাজবিজ্ঞানের অ্যারিস্টটল নামে অভিহিত; তিনিই ছিলেন এই শব্দটির জনক। অতীত নির্বাচনী রাজনীতি- তে জাত-ধর্ম ভিত্তিক জনভিত্তি থাকলেও তাকে ভোট ব্যাঙ্ক বলা হতো না। কিন্তু এখন এই কট্টর আনুগত্যের নামই ‘ভোটব্যাঙ্ক’।

ভারতবর্ষের রাজনীতিতে অনেক রাজনীতিবিদ মুসলমানদের ‘ভোটব্যাঙ্ক ‘ হিসেবে মনে করে থাকেন । ভোটারকে যদি ব্যক্তি ভোটার হিসেবে না ভেবে  সাম্প্রদায়িক বা যূথবদ্ধ ভোটাররূপে বিবেচনা করা হয়, তবে ভারতবর্ষের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের বিপদ। বিপদ শুধু নয় ; একটি দেশের সম্যক বিকাশের অন্তরায়। বঞ্চনার শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।সুদূর অতীত থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ” আখের গোছানোর ” যন্ত্র হিসেবে ভেবে নিয়েছিলেন। মুসলমানরা সম্প্রদায় হিসেবে যূথবদ্ধভাবে একটি দলকে ভোট দেবে, এ রাজনৈতিক ভাবনার দ্বারা এ দেশের নেতাদের চিন্তা- চেতনা সুসমৃদ্ধ! সেজন্যই প্রাক্ নির্বাচনী প্রচারে নেতারা ভুরি ভুরি প্রতিশ্রুতি দেন। শুকনো মাটিতে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন।সঙ্গে সঙ্গে  বিপরীত প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায় — ‘সংখ্যালঘু তোষণ হচ্ছে।’ সুতরাং, সাম্প্র- দায়িক ভেদাভেদের আগুন গ্রাম শহরের আনাচে- কানাচে  ধূমায়িত  হয়।

দেশভাগ মুসলমান জাতির কাছে ছিল একটা বড়ো ধাক্কা। দেশভাগের ফলে ভারত তথা বাংলার মুসলমানেরা একটা বঞ্চিত সংখ্যালঘু শ্রেণিতে পরিনত হয়। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে হয়ে পড়ে কৃপার পাত্র।ভোটের সময় নেতাদের অধিকার জন্ম নেয় এসব বঞ্চিত মানুষদের ওপর।স্বাধীনতার পর কংগ্রেসই একমাত্র দল হয় সেই অধিকারের দাবীদার।

স্বাধীনতা পরবর্তী কালে, মুসলমানদের ভোট স্বাভাবিক ভাবে কংগ্রেস পেতো।কংগ্রেস সরকার ভাবতো মুসলমানরা তাদেরকেই ভোট দেবে। অন্য কোনো দলের অধিকার নেই মুসলিমদের ভোটে ।এই ভাবনারই অপর নাম ‘ভোটব্যাঙ্ক ‘। কখনো কখনো মুসলিম- জাহানের তথাকথিত ধর্মীয় নেতাদের দিয়ে যেমন দিল্লির জামে মসজিদের ইমাম বা ধর্মীয় নেতাদের কাছে  নিজেদের রাজনৈতিক সত্তাকে বন্ধক দিয়ে নিজেদের অনুকূলে ভোট প্রয়োগের ঘোষণা করিয়ে নেওয়া হতো ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে। তারপরেও যে, সেই দলকে মুসলমানরা ভোট দিয়েছে, এ কথা কি হলফ করে বলা যাবে? আর এটাও তো দেখেছি, মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় মুসলিম লীগ পাশ করতে পারে নি। তখ মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, মুসলমানেরা এক বিশেষ দলের ‘ভোটব্যাঙ্ক’ । তাহলে বলতে হচ্ছে যে , ভারতবর্ষের রাজনীতিতে মুসলমানেরা “ভোট ব্যাঙ্ক” হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে । আজও হচ্ছেন।

স্বাধীনতার পর থেকেই দেখা যায়, মুসলমানরা ছিল কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক। তারপর মুসল- মান সমাজ ধীরে ধীরে বামপন্থী রাজনীতিতে আকৃষ্ট  হয়ে পড়ে। এর মূল কারণ ছিলো দরিদ্র খেটে-খাওয়া ভূমিহীন মুসলমানদের হতাশা আর নানা জায়গায় ঘটে যাওয়া দাঙ্গা আর  দাঙ্গাতঙ্ক। এছাড়া,  নতুন প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষাসচেতনতা বৃদ্ধি । এরাই ভোট দিয়ে পঃ বঙ্গে ৩৪ বছর বামফ্রন্টকে টিকিয়ে রেখেছিল। বামফ্রন্টও মুসলমানদের  ‘ভোটব্যাঙ্ক’ হিসেবে ভেবে নিয়েছিল। একটা প্রগতিশীল সরকার, যারা ৩৪ বছর ধরে রাজ্য শাসন  করেছে। মুসলমানদের উন্নয়ন ঘটবে, এমনটাই ভেবেছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। কিন্তু ২০০৬ সালে, নভেম্বর মাসে সার্চার কমিটির রিপোর্ট থেকে জানা যায় , পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের অবস্থা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় করুণ, বেদনাদায়ক । ধর্মীয় শেণিবিভাগ সম্পর্কে তাদের আদর্শগত অনীহা সত্ত্বেও বামফ্রন্ট নড়েচড়ে বসে। কিন্তু ২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত মুসলমানদের যে সামান্য উন্নতি হয়েছিল ,তার মূল কারণ হলো সম্প্রদায়টিকে ও বি সি তে অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু আইনটি পাশ করানোর আগেই সরকারের পতন হয় । তবে, বামফ্রন্টের  আমলে ছাড়পত্র পাওয়া সংখ্যা -লঘু শ্রেণির জন্য পুনর্গঠিত আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় তৃণমূল সরকারের আর্থিক সাহায্যে মুসলমান শ্রেণির মধ্যে এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাবের সূচক হয়ে উঠল। বর্তমানে  বহু শিক্ষক, অধ্যাপক  ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র মুসলমানদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে।  তারপর, তৃণমূল সরকার মুসলিমদের  নানা ধরনের ভাতা দানের মধ্য দিয়ে মুসলমান দরদি হয়ে ওঠে।ফলে, মমতার সরকারকে মুসলমান তোষণকারীর অপবাদে ভূষিত হতে হয়েছে।কিন্তু চরম  সত্য হলো মুসলমান সমাজের কোনো উন্নতি হয়নি। সাধারণ মানুষের কাজের সংস্থান, শিক্ষিত বেকারের চাকুরি তো হয় নি; বরং ,খুণ  ,ধর্ষণ, ঘুষ নানা গুণাবলীতে রাজ্য খ্যাতি  অর্জন করেছে।

গত পঞ্চাশ বছরে সরকারি চাকুরি ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থা তথৈবচ। তাঁরা প্রদীপের নিচে জমাট অন্ধকারে আছে। এই অভিযোগ  নির্দিষ্ট কোনো সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়। কম বেশি সব সরকারই দায়িত্ব এড়াতে পারে না “তোষণ” শব্দটি মুসলমানদের ক্ষেত্রে সবৈব মিথ্যে। অথচ, তোষণ  আজ বিভাজনের রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। তবে ,তোষণ যদি সত্যি কোনো সরকার করত তবে মুসলমানদের উন্নতি হতো।আসলে ওসব কাগুজে বক্তৃতা। তাছাড়া, সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রতি বাজেটে  সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়, সেই বরাদ্দকৃত অর্থ কোনদিনই খরচ তো হয় না ,বরং দুর্নীতিবাজদের পকেটস্থ করার ব্যবস্থা হয় ।এই “তোষণের” অপপ্রচারের দ্বারা সংখ্যাগুরু ভোটকে বিপরীত মেরুতে একত্রিত করা হচ্ছে। তাই কোনো তোষণ নয়, প্রকৃত উন্নয়নই হবে মুসলমানদের প্রতিষেধক।  সত্যি কথা, মুসলমানেরা সবসময় যেকোনো ক্ষমতাসীন সরকারের “ভোটব্যাঙ্ক”।শুধু তাই নয়; মুসলমানরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির শিকার। ফলে, ভারতবর্ষের মুসলমানেরা বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি বিরোধী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।সুতরাং,এই মেরু- করণের রাজনীতি ভারতের গণতন্ত্রকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে।

শীতলকুচিতে ১০|৪|২১ তারিখ সেন্ট্রাল ফোর্সের (সিআইএসএফ) গুলিতে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে চারজনই মুসলমান। গুলিচালনার যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ সেন্ট্রাল ফোর্স দেখাতে পারে নি। সংবাদ পত্র গুলিতে পরিষ্কার লিখেছে যে বিজেপিকে ভোট না দেওয়ার জন্যে চারজন মুসলিম যুবকের বুকে গুলি মারা হয়েছে।এই যুবকেরা কোনো অন্যায় করেছে,এমন  কোনো ভিডিও ফুটেজ দেখাতে পারে নি। মোদী,অমিত সাহ, দিলীপ ঘোষ এবং সায়ন্তন প্রমুখদের রাজনীতি সুলভ সৌজন্যের অভাব ভীষণ- ভাবে আঘাত হানছে রাজনৈতিক পরম্পরাকে। অমিত সাহ বলছেন, “ভোটব্যাঙ্ক বলে চার সংখ্যালঘুর মৃত্যুতে মমতা শোকগ্রস্ত, কিন্তু বর্মণের জন্য নয়।” এরকম মিথ্যা ভাষণ করে চলেছেন দিলীপ ঘোষেরা। প্রতিটি আচরণে ও কথায় ঔদ্ধত্য-গা-জোরামি ।সব থেকে লজ্জাজনক বিষয়, মুসলিম মৃত্যু নিয়ে চলছে ভোটব্যাঙ্কের খেলা। হায়!মুসলমান!

কিন্তু,বর্তমান রাজ্য রাজনীতিতে এক নতুন মেরুকরণের সূচনা ঘটেছে। রাজ্যের এক চতুর্থাংশ মুসলমানকে এতদিন রাজনৈতিক দলগুলো অন্তত ভোটব্যাঙ্কের সম্মানটুকু দিয়ে এসেছে। কিন্তু বিজেপি একমাত্র দল, যারা মুসলমানদের ভোটব্যাঙ্ক মনে করে না। কারণ,তাদের রাজনীতি বিভেদের রাজনীতি—মেরুকরণের রাজনীতি ।এই  মেরুকরণের রাজনীতিতে বিজেপির সাফল্য ও সিদ্ধি । সেজন্য মুসল মানদের কাছে বিষয়টি আদৌ শ্লাঘার বিষয় নয়।বরং অবজ্ঞা নিহিত আছে এ জাতীয় মনোভাবে।অন্যদিকে ‘”সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক” কথাটির মধ্যে একটা অসম্মান আত্মগোপন করে আছে। একটা নিরপেক্ষহীনতা —- একটা পক্ষপাতিত্ব — সুবিধাভোগী সম্প্রদায়। যদিও পক্ষপাতিত্ব একটা কাগুজে প্রতিশ্রুতি। বাস্তবে, কিন্তু উন্নয়নের ছিঁটেফোঁটা হয় না, তা নানা পরিসংখ্যান থেকে প্রমাণিত। সুতরাং, আর কতদিন মুসলমানেরা ভোটব্যাঙ্ক হয়ে থাকবে ? অথচ, পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১২০-১৩০ টি বিধানসভার কেন্দ্রে মুসলমানরাই নির্ণায়ক শক্তি। সুতরাং, আর “ভোটব্যাঙ্ক” না থেকে এবার  নিজেদের অধিকার বুঝে নেবার সময় হয়েছে।ভিক্ষা দিয়ে ক্ষুন্নি নিবৃতি হতে পারে, কিন্তু পেট ভরে না।তাই,কোনো কৃপা প্রদর্শন নয়। এটা সরকারেরও  দায়িত্ব। অতএব, বিচ্ছিন্ন করে না রেখে মূলস্রোতের সঙ্গে মুসলমানদের  সংযুক্তিকরণ করার ব্যবস্থা  সরকারকেই গ্রহণ করতে হবে এবং সেটা উন্নয়নের পথ ধরেই করতে হবে । ‘মুসলমানরাও ধীরে ধীরে মূলোস্রাতের অংশ হয়ে উঠবে ‘ — এই প্রত্যাশা খুব স্বাভাবিক ।

সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন।পঞ্চায়েত ভোটের সঙ্গে বিধানসভা বা লোকসভা ভোটের মূলগত তফাত আছে। স্থানীয় প্রভাব এই ভোটে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চায়েতে শাসক দলকে বিরোধীতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। মুসলমান সমাজ খানিকটা হলেও দূরে সরেছে। এখন প্রয়োজন একটা ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক দল।ফলে, অসাম্প্রদায়িক বিজেপি বিরোধী ভোটার একটা নিশ্চিত জায়গা পেতে পারে।নিজেদের গা না বাঁচিয়ে শিক্ষিত মুসলমান সমাজের এ সুযোগকে কাজে লাগানো উচিত। এঁরা ভোটব্যাঙ্কের ছাপটাকে নিজেদের শরীর থেকে চিরকালের মতো মুছে দিতে পারেন।
                

You may also like