বাঙালির প্রাণের ঠাকুর রবি ঠাকুরের সাথে আমাদের সকলেরই সাধারণত প্রথম পরিচয় ঘটে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ১৯১১ সালে লেখা ওই সংগীতটির যে আরও ৪টি স্তবক আছে বা ভারতবিধাতা নামে একটি শিরোনাম আছে তারই বা খোঁজ রাখি ক’জন! সাধারণভাবে আমাদের রবীন্দ্র-পাঠ আবর্তিত হয় যেসমস্ত কবিতাকে কেন্দ্র করে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হল — বঙ্গমাতা, দুই বিঘা জমি, পুরাতন ভৃত্য, সবুজের অভিযান, কৃষ্ণকলি, ধূলামন্দির, ওরা কাজ করে, প্রশ্ন প্রভৃতি। এর বাইরে কেউ কেউ অগ্রসর হন আফ্রিকা, নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, দেবতার গ্রাস, ভারততীর্থ, ঝড়ের খেয়া, সোনার তরী, আহ্বান, ঐকতান এবং রূপ-নারানের কূলে পর্যন্ত। এই সমস্ত রবীন্দ্র-কবিতা পড়া-শোনার বৃত্তে ঘুরপাক খেতে খেতে হঠাৎ একদিন ‘সঞ্চয়িতা’য় চোখ আটকে যায় ছোট্ট একটি কবিতায়। সেটা প্রায় বছর ত্রিশেক আগের কথা। মাত্র ছ’লাইনের সেই কবিতাটি একবার পড়ে আশ মেটে না। বার কয়েক পড়ি এবং পরে আবার পড়ার মানসে পিছনের সাদা পাতায় কবিতার নাম ও পৃষ্ঠা নম্বর লিখে রাখি।
রবি ঠাকুর কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯৩৭ সালে। প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৪৩ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থে। এটি তাঁর কৌতুক কবিতার সংকলন। এই কাব্যগ্রন্থটিকে রসসম্রাট সুকুমার রায়ের অনন্য সৃষ্টি ‘আবোল তাবোল'(১৯২৩)-এর সার্থক উত্তরসূরী বলা যেতেই পারে। বন্ধু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পুত্র সুকুমার রায় (১৮৮৭) ছিলেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের (১৮৮৮) সমবয়সী। কবিকে তিনি গভীর শ্রদ্ধা করতেন। পক্ষান্তরে অসামান্য প্রতিভা সম্পন্ন সুকুমারকে পুত্রসম স্নেহ করতেন রবীন্দ্রনাথ। কালান্তক কালাজ্বরে আক্রান্ত সুকুমার যখন মৃত্যুশয্যায়(১৯২৩), তখন তাঁকে দেখতে গিয়ে বিদায়পথযাত্রীর আব্দারে তাঁর শিয়রে বসে স্বকন্ঠে গান শোনাতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। থাক সেসব কথা।
খাপছাড়া কাব্যগ্রন্থে সংকলিত কবিতাগুলির শিরোনাম ছিল না, ছিল কেবল ক্রমাঙ্ক। প্রথম কবিতাটি ছিল — “খান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির/পাঁচ বোন থাকে কালনায়” ইত্যাদি। দ্বিতীয় কবিতাটি সেই বিখ্যাত দামোদর শেঠ। আমাদের আলোচ্য রাজব্যবস্থা কবিতাটি ছিল ৮২ নম্বরে। বলা বাহুল্য, এটি উপরে উল্লিখিত কবিতাগুলির মত বহুপঠিত নয়। এ নিয়ে কিছু কথা বলার আগে পুরো কবিতাটি নিচে উদ্ধৃত করা যাক —
“মহারাজা ভয়ে থাকে পুলিশের থানাতে,
আইন বানায় যত পারে না তা মানাতে।
চর ফিরে তাকে তাকে,
সাধু যদি ছাড়া থাকে,
খোঁজ পেলে নৃপতিরে হয় তাহা জানাতে —
রক্ষা করিতে তারে রাখে জেলখানাতে।।”
বলাই বাহুল্য, রবি ঠাকুর যখন কবিতাটি লিখেছিলেন তখন এদেশে রাজতন্ত্র ছিল না, যা ছিল তার নাম ব্রিটিশরাজ। সুতরাং ব্রিটিশরাজকেই তিনি সকৌতুকে রূপকার্থে ‘মহারাজা’ বলেছেন। আর ভয় পেয়ে মহারাজার পুলিশের থানাতে আশ্রয় নেওয়ার কথাটিও কিন্তু শ্লেষাত্মক। আসলে এই উক্তির দ্বারা রাজশক্তির পুলিশ-নির্ভরতার কথাই বলা হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করার লক্ষ্যে তৎকালীন ঔপনিবেশিক সরকার একের পর এক দমনমূলক আইন ও অধ্যাদেশ জারি করে। ১৮৭০ সালে প্রণীত হয় রাজদ্রোহ আইন, ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ আটকাতে জারি করা হয় কার্লাইল সার্কুলার, ১৯১০ সালে পাস হয় ইন্ডিয়ান প্রেস অ্যাক্ট। ১৯১৫ এবং ১৯১৯ সালে পাস করানো হয় যথাক্রমে দ্য ডিফেন্স অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট এবং রাওলাট অ্যাক্ট। কোনও আইন দিয়েই ভারতবাসীর স্বাধীনতা লাভের স্পৃহাকে অবদমন করা সম্ভব হয়নি সেদিন। তাই কাব্যচ্ছলে কবি বলেছেন — “আইন বানায় যত পারে না তা মানাতে।” রাওলাট আইনের বিরোধিতা করার জন্যই পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে সমবেত হয়েছিলেন হাজার হাজার জনতা। সেই নিরীহ-নিরস্ত্র জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে কয়েকশো মানুষকে হত্যা করা হয়। আহত হন কমবেশি দেড় হাজার মানুষ। ওই গণহত্যার প্রতিবাদেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশের দেওয়া নাইটহুড খেতাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
আগেকার দিনে রাজাদের নানারকম মন্ত্রী থাকত। এখনকার মন্ত্রীরাই রাজা-মহারাজা! কবিতার ‘মহারাজা’ ভয়ে ‘পুলিশের থানাতে’ থাকত, কিন্তু এখনকার মহারাজা-মহারানিদের সদাসর্বদা ঘিরে রাখে থানার চেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী বিশেষ নিরাপত্তা বলয়। এই মুহূর্তে দেশের সর্বোচ্চ রাজার নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে স্পেশাল প্রটেকশন গ্রুপ সংক্ষেপে এসপিজি। এই এসপিজির জন্য ভারতীয় প্রজাদের কষ্টার্জিত যে অর্থ এক বছরে খরচ হয় তার পরিমাণ অন্তত ৫৯২ কোটি টাকা। অর্থাৎ দৈনিক খরচ ১ কোটি ৬২ লাখ টাকা — মানে প্রতি ঘন্টায় পৌনে সাত লাখ মাত্র! দিল্লি থেকে এবার আসুন বাংলায়। এখানে যিনি রাজকার্য পরিচালনা করেন তিনি জেড প্লাস ক্যাটিগরির নিরাপত্তা পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ ত্রিস্তরীয় বিশেষ নিরাপত্তা বলয়ে থাকেন সর্বক্ষণ। তাঁর বসতবাটির পাহারায় সর্বক্ষণ থাকেন অন্তত ১০ জন কমান্ডো সহ ৩০ থেকে ৩৬ জন আধিকারিক। দিন-রাত মিলিয়ে প্রতিদিন শিফটিং ডিউটি করেন শতাধিক আধিকারিক। তাতেও রক্ষে নেই! এবছরের গোড়ার দিকে তাঁর বাড়ির চারপাশে বসানো হয়েছে ৩০ টি অত্যাধুনিক ক্যামেরা। প্রায় ৫৬ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত কঠোরতর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যন্ত্রই জানান দেবে নজরদারির যাবতীয় তথ্য। তিনি বাড়ির বাইরে পা দিলেই সঙ্গে থাকে ১৮ গাড়ির কনভয়। তাহলে আধুনিক রাজা-রানিদের নিরাপত্তার বহর দেখেই বোঝা যায়, তাঁরা কেউই নির্ভয়ে নেই।
কবিতার মহারাজা(নৃপতি) চরের অর্থাৎ গুপ্তচরের মাধ্যমে জেনে নিতেন কোন কোন বিপজ্জনক ব্যক্তি (‘সাধু’) এখনো ছাড়া রয়েছেন। খোঁজ পেলেই ‘রক্ষা করিতে তারে’ রাখতেন জেলখানাতে। আধুনিক রাজা-রানিরাও কবি ভারভারা রাও, সমাজকর্মী সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখা, স্ট্যান্ স্বামী,ডাক্তার কাফিল খান, সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান, মোঃ জুবায়ের, ছত্রধর মাহাতোদের ‘রক্ষা’ করতে জেলখানাতেই রাখেন! এই কাজে তাদের সহায়ক হয় ১৮৭০ সালের রাজদ্রোহ আইন, ১৯১৯ সালের রাওলাট আইনের কার্বনকপি ইউএপিএ এবং ইউএপিএ – ২, আফস্পা ইত্যাদি। এমনকি রবি ঠাকুরের রাজ্যেও এখন বিদ্বেষবাদীদের অভিযোগক্রমে সুপরিচিত সম্প্রীতি-সাধকের ‘নিরাপত্তার জন্যই’ রাতভর থানায় আটক রেখে পরের দিন জামিন অযোগ্য ধারায় কোর্টে তোলা হচ্ছে! সেই পুলিশ-কেস কবে শেষ হবে তা কেউই জানেন না!
তাহলে ১৯৩৭ সালের ‘রাজব্যবস্থা’ ২০২৩ সালেও বেশ বহালতবিয়তেই রয়েছে, বলুন ?