আশিস ত্রিপাঠী
রবীন্দ্র রচনাবলির পাতা উল্টাছিলাম, চতুর্থ খণ্ড, গানের সংগ্রহ (প.ব. সরকার, ১ম প্রকাশ ১৩৯৪, ইং ১৯৮৭)। ভারতের জাতীয় সঙ্গীত ‘জনগণমন’ গানের দ্বিতীয় পংক্তিতে নজর পড়তেই মালুম হল, এতোদিন ধরে দুটো শব্দের, বলা ভালো দুটো প্রদেশের নাম ভুল উচ্চারণ করে এসেছি। ‘পঞ্জাব’-এর স্থানে ‘পাঞ্জাব’ এবং ‘মরাঠা’-র স্থানে মারাঠা বলতাম। এরপর খাপছাড়াভাবে সমীক্ষা করতে শুরু করলাম।
অধিকাংশই আমারই মতো অজ্ঞানতার দোষে দোষী। জাতীয় সঙ্গীতে ভুল উচ্চারণ করার অর্থ দেশের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানো। ১৯১১ সালে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে গানটি প্রথম গাওয়া হয়। পরে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বাংলা ১৩১৮-র (ইং ১৯১২) মাঘ মাসের সংখ্যায় ‘ভারতবিধাতা’ শিরোনামে গানটি প্রকাশিত। ১৯১৯ সালে দক্ষিণ ভারতে মদনাপল্লীতে বেড়াতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং গানটির ইংরেজিতে অনুবাদ ক’রে তার শিরোনাম দেন “The Morning Song of India”। গানটির প্রথম দুই পংক্তি – “Thou Art the ruler of minds of all people / Thou Dispenser of India’s destiny”। স্বাধীন ভারতে গানটি ‘জাতীয় সঙ্গীত’ হিসেবে গৃহীত হয়। গানটির দ্বিতীয় পংক্তিতে উল্লেখিত প্রদেশগুলির নাম ভারতের ভৌগোলিক বিন্যাস অনুযায়ী পশ্চিম দিক থেকে দক্ষিণ হয়ে পরে পূর্বদিক ধরে উত্তর দিক থেকে এগিয়েছে। একমাত্র সিন্ধু প্রদেশ বা তার কোন অংশ স্বাধীন ভারতে অন্তর্ভুক্ত নয়। সিন্ধ্রি জনগণ দেশ ভাগের পর গুজরাটে, রাজস্থানে, মহারাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ অভিমত দিয়েছেন ‘সিন্ধু’র বদলে জাতীয় সঙ্গীতে উল্লেখহীন প্রদেশের নাম সংযোজিত হোক। এতে রাজ্যগুলির ক্রমবিন্যাসের শৃঙ্খলাভঙ্গ হবে, আবার অখণ্ড ভারতের স্মৃতিটাও হবে বিলীন। সিন্ধুপ্রদেশ তথা সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্য ভারতের ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। রবীন্দ্রনাথের দৌহিত্রী নন্দিতার (ছোট মেয়ে মীরা দেবীর কন্যা) সঙ্গে সিন্ধ্রি লেখক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী কৃষ্ণ কৃপালিনী পরিণয়ের সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এদিক দিয়েও ‘সিন্ধু’র যৌক্তিকতা স্মর্তব্য।
ফিরে আসা যাক পঞ্জাব এবং ‘মরাঠা’-র আলোচনায়। পঞ্জাব শব্দটির উৎস – পঞ্চ + অপ্ (জল); অর্থাৎ শতদ্রু প্রভৃতি পাঁচটি নদীবেষ্টিত দেশ। ‘মরাঠা’ শব্দটি সংস্কৃত ‘মহারাষ্ট্র’ থেকে আগত। বিকল্পে মারাঠাও চলে। ‘শিবাজি উৎসব’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন – ‘মারাঠার কোন শৈলে অরণ্যের অন্ধকারে বসে/ হে রাজা শিবাজি’। একইরকমভাবে ‘জনগণমন’ গানে ‘তব শুভ আশিস মাগে’ লিখলেও ১৯৩৩ সালের ১২ মার্চে আনন্দবাজার পত্রিকার শুরুতে প্রেরিত আশীর্বাণীর একটি পংক্তি “নবীন আশার বাহন তোদের ‘আশীষ’ করে। দেখা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন স্থানে একই শব্দের বিভিন্ন বানান করেছেন। সাহিত্য অকাদেমী দ্বারা প্রকাশিত ‘দুশ বছরের বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে’ রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধের নাম ‘মারাঠী ও বাংলা’। আবার সেই সাহিত্য অকাদেমী কর্তৃক দেবেশ রায় সম্পাদিত ‘দলিত’ বইতে ‘মারাঠা’ শব্দের বদলে ‘মরাঠা’ লেখা হয়েছে। তথাপি রবীন্দ্রনাথ উক্তগানে যেহেতু ‘মরাঠা’ লিখেছেন তাই ‘মরাঠা’ই মান্য হওয়া উচিত। অথচ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রার্থনায় অভ্যাসবশত ভুল উচ্চারণ করা হয়। সর্বোচ্চস্তরের রাজনীতিবিদরাও ভুল উচ্চারণ করেও লজ্জিত হন না। ত্রুটিযুক্ত উচ্চারণে তাঁরা রবীন্দ্রনাথ তথা দেশকে অবরেণ্য করার ধৃষ্টতা দেখান।
সরকার স্বীকৃত দেশপ্রেমের গানই জাতীয় সঙ্গীত, যেখানে দেশের গরিমা, ইতিহাস, আশাবাদের বাণী – সুরের ধ্বনিতে ধরা থাকে। স্পেন, সানমেরিনো, কসোভো এবং বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা – এই চার দেশের জাতীয় সঙ্গীতে কথা নেই, অধিকাংশ দেশে আছে। কথা থাকলে বিতর্ক জন্ম নেয়। কয়েকদিন আগে নজরে এল, উত্তরপ্রদেশে কৌশাম্বিতে পঞ্চম শ্রেণীর টেক্সটবুকে ছাপা জাতীয় সঙ্গীতে ‘উৎকল’ ও ‘বঙ্গ’ বাদ পড়েছে (‘এই সময়’ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২)।
অবশ্য জনগণমন গানটি নিয়ে বিতর্ক অনেকদিনের। ১৯১১ সালে ব্রিটেনের রাজা পঞ্চম জর্জ ভারতে আসেন। সমসময়ে গানটি রচিত হওয়ায় কেউ কেউ মনে করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ পঞ্চম জর্জকে জনগণমনের অধিনায়ক আখ্যা দিয়েছেন। অনেক পরে রবীন্দ্রনাথ নিজেই পুলিনবিহারী সেনকে ব্যাখ্যা দেন “আমি ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয় ঘোষণা করেছি – সেই যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনও জর্জই হতে পারেন না সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন।”
গানটি পাঁচ স্তবকে বিন্যস্ত। প্রথম স্তবকটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত, ৫২ সেকেন্ডের মধ্যে গাওয়াই বিধি। ভালোভাবে পাঠ করলে বোঝা যায় সংস্কৃত ঘেঁষা তৎসম শব্দে গানটি রচিত, দু-একটি পংক্তি ব্যতীত। ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষেরা সহজেই বুঝতে পারেন। গানের প্রথম স্তবকে ভূগোল, দ্বিতীয় স্তবকে ইতিহাস, তৃতীয় ও চতুর্থ স্তবকে অতীতের ইঙ্গিত দিয়ে ভারতের পতন-অভ্যুদয়ের কালের উল্লেখ করা হয়েছে। পঞ্চম স্তবকে প্রভাতের সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রভৃতিতে নবজীবনের তথা আশাবাদের জয় ধ্বনিত হয়েছে। ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী লিখেছেন “জয় হে জয় হে”-র ধুয়া বা কোরাস বিলিতি গানের পরোক্ষ প্রভাব বলা যেতে পারে। গানের দ্বিতীয় স্তবকে ভারতে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, বিভিন্ন ধর্ম, প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সমন্বয়ে ‘প্রেমহারের’ কথা উল্লেখ করেছেন কবি।
একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকেও ধর্মীয়, ভাষিক, সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধ জাতীয়তাবাদের ভ্রান্তিবিলাসে তৈরি হচ্ছে না মিলন ঐতিহ্যের ভারতবোধ – পীড়িত হচ্ছে কবির স্বপ্ন। তাই আমার প্রস্তাব – সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গানটির পুরো পাঁচ স্তবক লেখার নির্দেশ দেওয়া হোক, এবং ‘পঞ্জাব’ ও ‘মরাঠা’ যথাযথ উচ্চরিত হোক; আমরা যেন কবির শ্রদ্ধাভাজন হই।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)