মল্লিকা দিদি

জাকিয়া শিমু

আমার সাথে মল্লিকা’দির বন্ধুত্ব, অবুঝবেলা থেকে। আমাদের বাড়ির অদূরে তাদের বাড়ি। আমাদের পূবপাড়াঘেঁষে ডোরাসাপের দেহের মতো মসৃন এবং আঁকাবাঁকা সরু একটা মেটেপথ চলে গিয়ে, মিলেছে উপজেলার লাল-কাঁকরবিছানো নতুন সড়কের সাথে। সেই মেটেপথ ধরে অল্পদূর পায়েহেঁটে এগুতে, চোখে পড়ে শিকড়বাঁকরে আবৃত বহুকালের পুরনো প্রাচীন এক বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষের উত্তরপাশের পাড়াটাই মল্লিকা’দিদের পালপাড়া। আদি-নাম পালপাড়া হলেও সে- নাম সরকারিলোক কেটেছেঁটে আজিকার কাগুজে নাম দিয়েছে – উত্তরপাড়া। যদিও লোকমুখে এখনো পালপাড়া নামটাই বেশি উচ্চারিত হয়। একসময় এপাড়ায় হিন্দু সম্পদায়ের একচেটিয়া বাস থাকলেও এখন দু’চারঘর হিন্দুপরিবার অবশিষ্ট আছে বাদবাকিরা জন্মভিটা বেঁচে দিয়ে নিজদেশ ছেড়ে ওপারে গিয়ে বসত গেঁড়েছে।

আমি আর মল্লিকা দি’ স্কুল ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই রেডিওতে অনুরোধের আসরে গান শুনি। স্কুলে যাওয়ার নাম ধরে বইপত্র নিয়ে সাতসকালে মল্লিকাদি’র বাড়ি চলে আসি। আমাদের বাড়ির সাথে তাদের বাড়ির সম্পর্ক বহুবছরের পুরনো! আমার পূর্বপুরুষদের ভিটেমাটি পদ্মাগর্ভে তলিয়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে তারা এই গাঁয়ে এসে বসত করতে উদ্ধত হলে গাঁয়েলোকেরা তাতে বাধা দেয়। তখন এ-তল্লাটে হিন্দুসম্পদায়ের দাপট ছিল প্রকট এবং একচেটিয়া। কোনো মুসলমান তাদের সাথে একত্রে বসবাস করবে, সেসময়ে এমন সহাবস্থানের চিত্র ছিল অবাস্তব। মল্লিকাদি’র বড়দাদা কিংবা তারও আগের প্রজন্মের কেউ নাকি আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি সদয় হয়েছিলেন। এবং তাঁর উছিলায় তারা এগাঁয়ে কোনোমতে মাথাগোঁজার একটা সুযোগ পেয়ে যায়। সম্বন্ধের শুরুটা সেইথেকে এবং বংশপরম্পরায় আজও পাকাপোক্ত হয়ে পুরনো সংস্রবটা রয়ে গেছে।

মল্লিকা দি’ বয়সে আমার চেয়ে ঢের বড় হবে। আমি প্রাইমারি স্কুলে পাঁচক্লাসে পড়ি, আর মল্লিকা দি- হাইস্কুলের শেষের দিকে। আমাদের বয়সের তফাৎ বন্ধুত্বের সম্পর্ককে ফিকে করতে পারে না। মল্লিকা দি’ দেখতে দেবী দুর্গার মতো।

বৃদ্ধ বটগাছটার ছায়াতলে এপাড়ার হিন্দুদের ঠাকুরঘর। বছরের বিভিন্ন সময়ে পুজোর আগে মাটির কারিগর-কুমোররা এসে নানান ধরনের ঠাকুর তৈরি করে। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে বসে তাদের কাজ দেখি। দেবীদুর্গার মুখশ্রী ঠিক যেন আমার মল্লিকা দি’র মুখের আদলে রূপ দেওয়া ! তার গায়ের রং অবশ্য একটু ময়লা। যদিও এমনটা আমি মানতে নারাজ। এ বিষয়ে আমার মা এবং মল্লিকাদির মায়ের ( আমি তাকে মাসি ডাকি) মধ্যে বেশ ব্যাকুলতা টের পাই। আমি তাদের গল্প শোনে মল্লিকাদির সাথে মিলিয়ে দেখি। তা অবশ্য একটু হবে বইকি কিন্তু আমার কাছে তার কিঞ্চিৎ ময়লা-বরন বেজায় লাগে। বরং আমার কাছে মনে হয় এরূপ দেবীরূপি মানুষটাকে পরিষ্কাররঙে বেজায় বেখাপ্পা লাগত। মল্লিকাদির টিকালো নাকের ঠিক নিচে, বাঁ পাশটায় কালো একটা আঁচিল, ঘাস ফড়িঙের মতো লেজউঁচিয়ে বসে আছে। কী অপরূপ লাগে দেখতে। মল্লিকাদি যখন কথা বলেন, আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি। মিহি-আওয়াজে শব্দ বুনে বুনে গল্পের মতো করে কথা বলে যান। যখন হাসেন তার সমস্তশরীরটা হেলেদুলে একত্রে হেসে ওঠে।

ভিন্নক্লাস হলেও আমাদের স্কুল একই সময়ে শুরু হয়। আমি সাতসকালে বইখাতা কাঁখে নিয়ে মেটেপথে হেঁটে পৌঁছে যাই মল্লিকা’দির বাড়ি। সপ্তাহে দু’দিন ঠিক স্কুল বসার সময়টাতে রেডিওতে অনুরোধের আসর’ বসে। মল্লিকাদি’ প্রায়ই সেসময়ে মাসির চোখ ফাঁকি দিয়ে স্কুল কামাই করেন। আমিও তার সাথে রেডিওতে গান শুনতে বসে যাই। এসময়ে মাসি বাগানের কাজে ব্যস্ত থাকেন। আমি আর দিদি লুকিয়ে পুকুরঘাটে রেডিও নিয়ে গানের আসরে বসে পড়ি। আমি গানের আগা-মাথা তেমন কিছুই বুঝি না। শুখু মল্লিকাদি’ যখন রেডিওর খাঁজকাটা নবটা উপর দিকে খানিক ঘুরিয়ে দিয়ে সাহাদাত আঙ্গুলটা তার সরুচিকন ঠোঁটজোড়ায় চেপে ধরে আমাকে চুপ থাকার ইশারা করেন, তখন বুঝতে পারি এ মুহূর্তে আমার গলায় আটকে যাওয়া শেষশব্দটাও চেপে ধরে বসে থাকার সময় হয়েছে। আমি কথা বলতে পছন্দ করি, কারণে-অকারণে সত্যমিথ্যায় মালা গেঁথে গল্প করতে পছন্দ করি। তারপরও রেডিও-র গান শুরু হলে নীরব নিথর হয়ে বসে থাকি। মল্লিকাদি’ গানের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। আবেগে চোখ বুজে থাকেন, নিলীমিত চোখজোড়ার ওপরের কপালটাতে তিরতির কাঁপন ধরে, গানের তাল-লয়-সুরের সাথে তার হাতদু’খানা সমুদ্রতরঙ্গের মতো উঁচু-নিচু ঢেউ খেলে যায়। আমি তার দিকে বিহ্বলচোখে তাকিয়ে রই।

মাঝেমধ্যে অবশ্য মাসি এসময়ে আমাদের বাড়ি, আমার মায়ের সাথে সুখদুঃখের গল্প পাড়তে যায়। তখন নির্ভয়ে আমাদের গানের আসর বসে মল্লিকাদি’র দক্ষিণমুখি শোবার-ঘরটাতে। তার পড়ার টেবিলঘেঁষা জানালার বাইরের দিকটায় বনজঙ্গল-ঝোপঝাড়ে ভরা। হিজল, মহুয়ার ডাল নুয়ে পড়ে ফুলের ভারে। মল্লিকাদি’ এসময় আমার কাছে অচেনামানুষ হয়ে উঠেন, উদাসচোখে তাকিয়ে থাকেন। গানের সুর-লয়ের সাথে কোথায়, কোন অচিনরাজ্যে হারিয়ে যান, আমি তার নাগাল পাই না। টলমলে-স্বচ্ছ জলেভরা ডোবার মতো চোখজোড়ায় তার রাজ্যের ভাবনারা খেলা করে। এরপর আলগোছে কবিতার মতো সুন্দর চোখদুখানা ঘুমের মতো নিশ্চলতায় বুজে আসে। খানিকবাদে দু’গাল বেঁয়ে জলেরধারা ঝরতে থাকে। সম্পূর্ণ ভিন্নমানুষ বনে যান মল্লিকাদি। সেদিন আর আমার সাথে গল্প জমে না তার। হাতের ইশারায় আমাকে ছুটি দিয়ে দেন। আমি একা বিষণ্ণমনে স্কুলের পথে একপা দু’পা করে এগিয়ে যাই।

মল্লিকাদির বাড়িটি আমার খুব পছন্দের জায়গা। বাড়িটি বহু পুরনোকালের এবং বাড়ির চতুরপাশ ঘিরে বিরল-সব গাছ গাছালীতে ঠাঁসা। গাঁয়ের অন্যকোনো বাড়িতে এতসব রকমারি গাছ গাছড়া চোখে পড়ে না। এবাড়ির মূল বসতঘরের দেয়ালের পলেস্তেরা ক্ষয়ে-খসে পড়েছে সেই কতকাল আগে। ভারি এবং মোটা দেয়ালের বেখাপ্পা সাইজের লাল ইটগুলোতে ফোস্কার মতো সবুজ শ্যাওলার মোটাকাটা-স্তর জমে আছে; এসব চিহ্ন এঘরের বয়েসকালের দিকে ইঙ্গিত দেয়। দেয়ালের ভেতর থেকে গজে উঠেছে নানানপদের বনলতার আগাছা।

বাড়ির দক্ষিণদিকে প্রায় মাটিরনিচে বসে যাওয়া ভগ্নস্তূপের একটি বহুপ্রাচীন দ্বিতল ভবনের অস্তিত্ব সগর্বে জানান দেয়, এবাড়ির পূর্বপুরুষদের ঐশ্বর্য এবং আভিজাত্য।ভবনটি ঘিরে আমার ছোট্টমনে শত সহস্র প্রশ্নের জন্ম নেয়। মূলবাড়ি থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন এবং জঙ্গল-ঝোপঝাড়ে ঘেরা সেইঘরে বহুকাল কারো পায়েরচিহ্ন পড়েনি। আমরা চুপিসারে মাঝেমধ্যে ভবনটিতে যাই। ঝোপঝাড় লতাগুল্ম পেড়িয়ে মল্লিকাদি খুব সাবধানীপায়ে আমার হাত শক্ত করে ধরে টেনেহেঁচড়ে ভাঙ্গাচূড়া পিচ্ছিল অজগরের পিঠের মত সিঁড়ি বেঁয়ে শেষ সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়ে পড়েন। ঘরে প্রবেশের কোনো পথ নেই। ঘরের দরজা-জানালার কপাট ক্ষয়ে পড়েছে সেই কবে। আমরা ক্ষয়েযাওয়া চৌকাঠে পা রেখে ভেতরে চোখ রাখি। সিঁড়িঘরের জানালার শ্যাওলাপড়া লোহারফ্রেমের ভেতর দিয়ে মাঝেমধ্যে কাঠের পাটাতনের মেঝের উপর একচিলতে রোদ এসে বিছানা গাড়ে। ভাঙ্গাচোরা ঘরটার যৎসামান্য অস্তিত্ব আমাকে বহুবছর পেছনে টেনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়।

মল্লিকাদির কাছে সেসব দিনের বহুগল্প শুনেছি। পূজাপার্বণে এবাড়িতে কলিকাতা থেকে বিখ্যাত বাইজীরা আসত। তখন এঅঞ্চলের জমিদার এবং উচ্চবর্ণের বিত্তশালী হিন্দুদের সামাজিক কার্যক্রমের-অংশ ধরা হতো এসব নাচ-গানের জলসাকে। কলিকাতার নামকরা বাইজীদের ভাড়া করে এনে রঙতামাশায় মজে থাকতেন তারা। এসব বাড়িতে বৈঠকখানা কিংবা বাংলাঘরের মতো সমান প্রয়োজনীয় ছিল, বাইজীঘর। বছরজুড়ে পূজাপার্বণে এবং বিভিন্ন উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ এবং অনুষঙ্গ ছিল এসব বাইজীরা। তাদের নাচগান- রঙঢঙ্গ কাছ থেকে দেখার সুযোগ সর্বসাধারনের জন্যে উন্মুক্ত ছিলনা এমনকি তাদের নিজেদের ঘরের বউ ঝিরাও এসব বিনোদন থেকে বঞ্চিত ছিল। জমিদারের পছন্দের ঘনিষ্ঠজনেরা বাইজীঘরে নাচ-গান এবং পানাহারের বিশেষ ব্যবস্থায় উপস্থিত থাকত। কিন্তু কাঠের পাটাতনের মেঝের সাথে বাইজীদের পায়ের ঘুঙুরের মিশ্র আওয়াজ বহুদূর থেকে শুনা যেত। হতভাগা সেসব মানুষ সে আওয়াজেই বিভোর হত। এভবনের সামনে এলে আমি খুব ব্যথিত হই। বাইজিদের রঙচঙমাখা মেকি চেহারার ভেতরের আসল রূপটা স্পষ্টতই চোখের সামনে ভেসে উঠে, কান পাতলে বিরহঘুঙুরের আওয়াজ পাই।

এবাড়ি ঘিরে অনেকগুলো বসতঘর ছিল, ঘরগুলো ভরা থাকত নানান বয়সের মানুষজনে এবং সেই মানুষদের প্রত্যেকের জীবনের আলাদা আলাদা গল্পও ছিল। সেসব এখন ধুলোজমা ইতিহাস। চিহ্ন বলতে দু’চারটে ইট-কাঠ-সুরকির ভগ্নাংশ, মাটির গভীরে লুকিয়ে আছে। মাটি খুঁঁড়লে হঠাৎ হঠাৎ বেরিয়ে এসে অতীত দিনেরকথা মনে করিয়ে দেয়। সেসব মানুষেরগল্প আমার করোটিতে কল্পনা-পাখায় ভর করে উড়ে এসে গেঁড়ে বসে। আমি এবাড়ির চারপাশের বাতাসে সেসব গল্প ভেসে বেড়ানো ঝনঝনানি শব্দ শুনতে পাই, চোখ বুজঁলে ছায়াছবির মতো সেসব গল্পের মানুষগুলোর ছুটোছুটি স্পষ্টতই যেন দেখতে পাই। মল্লিকাদি’ নিজেও নাকি রাতদুপুরে তাদের হেঁটেচলার শব্দ পান। কান বিছালে ফিসফিসানি গল্পকথার আওয়াজ শুনতে পান।

বাড়ির পুবদিকের পুরনো দিঘিটা কাকচক্ষুর মতো পরিষ্কার ঠাণ্ডাজলে ভরে থাকে বারোমাস। দিঘির চারিপাশে হিজল-কদম-মহুয়ার সারিবদ্ধ গাছের শাখাপ্রশাখার ছায়া দিঘিটাকে ছায়া-আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখেছে। বাড়ির মূল অংশ থেকে সাপের দেহের মতো ন্যাতিয়ে পেঁচিয়ে লাল ইট-সুরকির সিঁড়িটা নেমে এসে সখ্যতায় মিলেছে দিঘিরজলের সাথে। সিঁড়ির অস্তিত্বও মুছে যাওয়া এবাড়ির ইতিহাসের মতোই ক্ষয়ে গেছে। উপরে প্রলেপের চিহ্নমাত্রা নেই। গুটিকয় ইট-সুরকি শতায়ু বৃদ্ধের দাঁতের মতো ধারালো অথচ ঠুনকো- নড়বড়ে হয়ে কোনোমতে টিকে আছে।

দিঘিরপাড়ের গাছের ডালে জানা অজানা পাখিদের আড্ডাখানা।মল্লিকাদি আমার কাছে পাখি বিশারদ। বিকেলবেলায় আমরা ঘুরে বেড়াই। মল্লিকাদি আমাকে ইষ্টিকুটুম পাখি চেনান। যে পাখি ডাকলে বাড়িতে কুটুম আসে। আমাদের পায়েরতলায় পিষে যাওয়া শুকনোপাতার মচরম্যাচর আওয়াজে পাখি ছুটে পালায় দূরে কোথাও। আমরা পাখির পেছন ছুটতে ছুটতে দিঘির সীমানা ছেড়ে, খানদের অন্দমহলে অনেকটা বেখেয়ালে ঢুকে পড়ি। অবশ্য দিঘিটা এখন আর মল্লিকাদিদের নিজেদের দখলে নেই, ঠিক যেমন নাই-তাদের বসতবাড়ির বারোআনি।

মল্লিকাদির বড়দাদা তার দাদাকে রেখে অন্যসব ছেলেমেয়ে নিয়ে ওপার বাংলায় ঘর বেঁধেছেন সেই সাতচল্লিশে, দেশ ভাগের পরপর। দাদাকে অবশ্য বহু চেষ্টা তদবির করেও সাথে নেওয়া যায়নি। এরপর দাদার ভাইরাও বারকয়েক কলিকাতা থেকে এসেছেন তাঁকে ফিরিয়ে নিতে কিন্তু তিনি দেশ ছেড়ে যাননি। মল্লিকাদির বাবাও ঠিক তার দাদার মতো। একাত্তর-এর পর তার বড় জ্যাঠামশাই তাঁকে ফিরিয়ে নিতে কম চেষ্টা করেননি কিন্তু তাঁর একই কথা। দেশ ছেড়ে উদবাস্তু হওয়ার বাসনা তাঁর নেই। তাঁর কাছে ব্রিটিশ ভারত-পাকিস্থান-বাংলাদেশ বলে কোনো বিভাজন নেই, নেই কোনো সীমারেখা। সাতপুরুষের নাড়িপোঁতা ভিটেটাই আসল, বাকিসব মানুষের তৈরি বিভাজন এবং তিনি তা মানতে নারাজ।

মল্লিকাদির বড়দাদা খানদের সাথে বাড়ি অদল বদল করে দেশ ছেড়েছেন। খানরাও একসময় দাপুটে ছিল ওপার বাংলায়। সাতচল্লিশের পর তারা সেখানে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন। সিরল র‍্যাডক্লিফের পেন্সিলের আঁচড়ে ব্রিটিশ ভারত কেটেছিঁড়ে রক্তাক্ত হয়। হাজার হাজার বছরে গড়ে-ওঠা বিভিন্ন ধর্মবর্ণের মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য, পারস্পারিক সহাবস্থান, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এসব কিছুকেই মুহূর্তে ধূলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয় দেশভাগ নামের ঘৃণ্যকর্মের মাধ্যমে। মানুষ হন্যে হয়ে দিকবিদিক ছুটতে থাকে। তাদের অতি কাছের জন, চিরপরিচিত পথঘাট সহসাই অচেনা হয়ে ওঠে। সেসময় খানরা নিজেদের ভিটেমাটি বদল করে এপার বাংলায় মল্লিকাদিদের প্রাচীন এই বাড়িতে উঠে আসে।

নোমান আলী খান, বয়সে মল্লিকাদির চেয়ে বছর চার পাঁচেকের বড় হবে হয়তো, খানদের বংশের ছোটছেলে। মাথাভর্তি পাটলরঙের কোঁকড়া ঝাঁকড়া একগোছা চুল। গায়েররঙ পরিষ্কার দুধে আলতা, লম্বা- চওড়া মেদহীন সুঠামদেহী- দিঘিরপাড়ে হাওয়া বাতাস খেতে বিকেলে হেঁটে বেড়ান। আমি মল্লিকাদির চোখের ইশারায় প্রতিদিনের মতো তার কাছে ছুটে যাই। সে খুব গোপনে হাসিমুখে দোয়াতকলমের আঁচড়ে লেখা একগুচ্ছ স্বপ্ন আমার হাতে তুলে দেন। আমি স্বপ্ন নিয়ে ভোঁ দৌড়ে দিঘির এপারে অপেক্ষায় থাকা মল্লিকাদির কাছে ফিরি। মল্লিকাদি সঙ্গোপনে কাগজগুলো লুকিয়ে রাখেন। পরেরদিন বিকেলে মল্লিকাদির স্বপ্নগুলো নোমান আলী খানের কাছে ডাকহরকরার মতো পৌঁছে দেই।

স্বপ্নগুলোর রং কেমন! যেমন জানি না, জানতেও চাইনা। কিন্তু বিশ্বাস করি আমার মল্লিকাদির চাওয়া অসুন্দর হতে পারে না। নোমান আলী খান শহরে পড়াশুনা করেন। ছুটিছাঁটায় বাড়ি চলে আসেন। ছুটি পার হলেও তাকে লম্বাসময় ধরে বাড়িতে দেখা যায়। বিকেলে সময় করে তাদের স্বপ্ন বদল হয়। একসময় নোমান আলী খান শহরে ফিরে যান। তখন দুজনের মাঝের স্বপ্নগুলো সকাল- সন্ধ্যায় মল্লিকাদি হিজলফুলের মালায় গেঁথে রাখেন, মহুয়ার বনে উতলা হয়ে গুনগুনিয়ে গান গান।

মল্লিকাদির বাবা, আমি তাকে জ্যাঠা ডাকি, এমনিতে বেশ আমুদে মানুষ। তিনি চমৎকার গান করেন এবং গানবাজনার সমঝদার। বছরখানেক আগেও তাকে সকালবেলা মল্লিকাদির সাথে হারমোনিয়াম নিয়ে গলা ছেড়ে গান গাইতে দেখা যেত। স্থানীয়বাজারে সোনার দোকান আছে। আমার জন্মের পর তিনি নিজহাতে আমাকে একজোড়া সোনার কানের সাদা পাথরের দুল তৈরি করে উপহার দেন। দূর থেকে সাদা পাথর হিরকখণ্ডের মতো জ্বলজ্বল করে। আমার যখন দু’বছর তখন কান ফুঁটা করে হিরক খণ্ড আমার কানের লতিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এবং আজও তা জ্যাঠার ভালোবাসা-আশীর্বাদের আলোজ্বেলে কানের পরে ঝুলে আছে।

একসময়ে এতল্লাটের জমিদারের সাথে বিষয়সম্পদে জ্যাঠার পূর্বপুরুষদের নাকি তুলনা হত। কিন্তু কালক্রমে সেসব সম্পদ-সম্মান হারিয়ে কোনমতে আজ তারা টিকে আছেন। আপনজনেরাও ওপার বাংলায়। তিনি অবশ্য শুরু থেকেই নিজদেশ ত্যাগে রাজি ছিলেন না। নিজের দেশ, মায়ের মতো। পূর্বপুরুষের পদচিহ্নমাখা ভিটেমাটি ও-তো দেশ নয়, যেন সাক্ষাত স্বর্গ। মাকে বিসর্জন দিয়ে অন্যদেশে পালিয়ে-বাঁচা জীবন নয়, তার থেকে চিতায় ওঠা শ্রেয়। সাধারণত সারাদিন ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু ইদানীং তাকে কেমন যেন বিপর্যস্ত দেখায়। উদভ্রান্তের মতো আনমনা হয়ে ঘুরে বেড়ান। সকাল-বিকাল আমার বাবার কাছে গোপন কি-সব বিষয় নিয়ে আলাপ করেন। আমি আমার স্বভাব মতো কান পেতে রাখি। কিন্তু দুর্ভেদ্য সে বিষয় বুঝতে না পারলেও বিষয়সম্পত্তির বেচাবিক্রি নিয়ে কথা হয় তা অবশ্য আন্দাজ করতে পারি।

মল্লিকাদির মা, আমার মাসি। মাটিরমানুষ। চায়-চেহারা মল্লিকাদির সাথে শতভাগ মিলে গেলেও গায়েররঙ কিন্তু তার মতো নয়, টকটকে লাল জবার মতো। কণ্ঠস্বর মাঘমাসের দিঘিরজলের মতো শীতল। আমি এপর্যন্ত তার চড়াগলার কথা শুনতে পাইনি। কোমলকণ্ঠে এবং ধীরগতিতে যখন কথা বলেন মনেহয়ে যেন কলেরপুতুল, ব্যাটারি চেপে কথা বেরিয়ে আসে। যখন কথা বলেন, শুনতে হলে বাড়তি মনোযোগ লাগে। তিনি যখন কথা বলেন আমি বাড়তি মনোযোগে কান বিছিয়ে শুনি। বাবারবাড়ি পার্শ্ববর্তী জেলায়। সেসব আপনজন অবশ্য বহুকাল আগেই দেশছেড়ে ওপার বাংলায় চলে গেছেন।

সকাল – সন্ধ্যা পূজাআর্চনা করেন। গাছগাছালির যত্নআত্তিতেও বেশ পারদর্শী। তার রান্নাঘরের চালেরওপর বারোমাস চালকুমড়ো ঝুলে থাকে। মাসির হাতের চাল কুমড়োর মুরব্বা আমার কাছে অমৃত লাগে। মল্লিকাদি যখন পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকেন আমার সময়টা তার সাথে গাছগাছড়ার পরিচর্যায় মন্দ কাটে না। সেই মাটির মানুষটাকেও আজকাল দিশেহারা হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখি। আমার মায়ের সাথে তার খুব ভাব। মাকে জড়িয়ে ধরে গোপনে কাঁদেন।
,
আমাদের গাঁ থেকে পাশেরগাঁয়ের দূরত্ব হাঁটাপথ বড়োজোর কয়েক কদম কিন্তু দুগাঁয়ের সীমানা ঘেঁষে এক চিলতে বাঁশেরফাঁলির মতো একখানা মরানদী জলকাঁদায় মাখামাখি অবস্থায় সীমানাখুঁটি হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। নদীর এপার আমাদের গ্রাম ওপারের গাঁয়ে মল্লিকাদির বন্ধুর বাড়ি। আমরা সাঁকো পেরিয়ে তার বন্ধুর বাড়ি যাই।

মল্লিকাদি গল্প করেন আমরা চুপচাপ গল্প শুনি। মল্লিকা’দি বার-কয়েক কলিকাতা ঘুরে এসেছেন। সেসব গল্প আমার কাছে যেমন আকর্ষণীয় তার বন্ধুর কাছেও। আমরা আমাদের বাড়ির সীমানার বাইরে তেমন কোথাও যাওয়ার সুযোগ পাইনি, বড়জোর পাশের জেলায় নানার বাড়ি অব্দি গিয়েছি। মল্লিকাদি কলিকাতার ভাষাও রপ্ত করেছেন। কলিকাতার শাড়ি পরে নিজেকে ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে আমার সামনে যখন দাঁড়ান, আমি হা হয়ে অচেনা এক মল্লিকাদির দিকে তাকিয়ে থাকি।
সেদিন তাদের পুরনো প্রাচীন লোহাকাঠের কচ্ছপের পিঠের মতো অমসৃন আলমারিটা খুলে কলিকাতা থেকে আনা আকাশরঙা সিল্কের শাড়িটা আমাকে বের করে দেখান। বলেন, বিশেষ একদিন এই শাড়িটা পরে নোমান আলীর সাথে ঘুরতে যাবেন। মল্লিকাদি বাসায় সবসময় চওড়া পাড়ের ঢাকাই তাঁতের শাড়ি পরেন। শাড়ির রঙে মিলিয়ে সবসময় কুমকুমের একটা গোলাকৃতি টিপ পরেন, দু’চোখের মাঝ বরাবর কেমন রহস্য নিয়ে সে-টিপ দাঁড়িয়ে থাকে। আমার কাছে মনে হয় যেন বিশাল আকাশের গাঁয়ে লাল টুকটুকে সূর্যটা ভেসে আছে। আজ সে কলাপাতা রঙের জমির উপর নীল-কমলা ছোট ছোট বনফুল বসানো চওড়া লাল পাড়ের তাঁতের শাড়ি পরে বন্ধুর বাড়ির উত্তরপাশের দিঘিরজলে পা ডুবিয়ে বসে আছেন-চোখেমুখে তার অতল চিন্তার ভাঁজ। নোমান আলি কীসব বলছেন, মল্লিকাদি মনদিয়ে শুনছেন।

নোমান আলীর বাপ-চাচারা অত্রঅঞ্চলে বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেছেন বিশেষ করে বাংলাদেশ পাকিস্থান পৃথক হওয়ার পর থেকে। শিক্ষিত এবং মার্জিত এই বৃহদাকার পরিবারটি ৪৭-এর বিভাজনের পর যখন এদেশে আসে, অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। ধীরে ধীরে অবশ্য অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। একসময়ে বাড়ির ছেলেরা শহরমুখি হয়। চাকুরিবাকুরির ব্যবস্থা হয় মানুষজনের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয় এবং সে অবস্থান থেকে দ্রুত বেরিয়েও আসে। মুক্তিযুদ্ধের সময় খানরা বাংলাদেশের পক্ষ হয়ে কাজ করেছে। সেসময় মল্লিকাদিদের তারা আপনজনের মতো আগলে রাখেন, না- হলে মল্লিকাদি’দের এদেশে টিকে থাকা মুশকিল ছিল। সেসময়ে বহু হিন্দুপরিবার ওপারে পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছিল।

নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে আসার কষ্ট খান’রা জানেন। তাইতো বাড়ির এককোণে পড়ে থাকা মল্লিকা’দিদের নির্ঝঞ্ঝাট পরিবারটিকে এরা বাস্তুহারা করেনি। বাড়ি যখন অদল-বদল হয় তখন পুরোবাড়ির মালিকানাই তাদের কাছে আসে।

খানরা প্রাসাদসম বাড়ি ফেলে এসেছে কলিকাতায়, সেই বাড়ি এখন মল্লিকাদির চাচা জ্যাঠারা বাস করছেন। তখনকার অবস্থায় কোনোমতে প্রাণে বেঁচে পালিয়ে আসাটাই মুখ্য ছিল। দাঙ্গারকালে খানদের পরিবারের বেশকজনকে হারাতে হয়েছে। ভয়ঙ্কর এবং মর্মান্তিক ঘটনার ভেতর দিয়ে যায় তখন খান- পরিবারটি। একমাত্র ধর্মের কারণে কাছের বন্ধুকে ঠাণ্ডামাথায় এবং অবলীলায় হত্যা করার নজির বোধহয় ভারতবর্ষে দাঙ্গার আগে কেউ দেখেনি। খান-পরিবারের প্রধানকে প্রায় চারযুগ একসাথে সুখদুঃখ ভাগ করে চলা বন্ধু, চিত্তরঞ্জন, হাসিমুখে শির নামিয়ে দেয়। সেরাত্রে খান-পরিবার লুকিয়ে দেশছেড়ে এপাড়ে এসে আশ্রয় নেয়। এবং মল্লিকাদি’দের সাথে তাদের বাড়ি বদল করে।

মল্লিকা’দির বাড়ি এবং আমাদের বাড়ির পরিবেশ বেশ ক’দিন হয়, যেন একবিন্দুতে থেমে আছে। কেমন যেন অসারতা নীরবতায় ঢেকে আছে যা হরহামেশা থাকে না। জ্যাঠাকে দেখি সারাক্ষণ বাড়ির সামনের তুলসীতলের ধারঘেঁষে পুরনো ক্ষয়ে যাওয়া ইমারতখণ্ডের ওপর চুপচাপ বসে থাকেন। চোখের দৃষ্টি পাথরের মতো ঠাণ্ডা এবং স্থির। শুনলাম তাদের জাত ব্যবসা, সোনার-দোকানটাও বিক্রি করে দিয়েছেন। মল্লিকাদির মা আগাগোড়া চুপচাপ স্বভাবের। তাকেও দেখা যায় সকাল-বিকাল আমার মায়ের নিকট দিকভ্রান্তের মতো ছুটে আসতে। খুব সাবধানী গলায় ফিসফিসিয়ে কথা বলেন।

মল্লিকাদির কপালের টিপের কুমকুমের সাতরঙা কৌটটার প্রতি আমার বড়ো লোভ। আর তার ঝুমকো পায়েলজোড়ায়। কতোরাত ঘুমোতে পারিনি এরূপ একজোড়া পায়েল পরে ঝুমঝুম শব্দে ঘুরে বেড়াব পুরোতল্লাটে এমন স্বপ্নের জ্বালায় ! মল্লিকা’দি তা জানেন।

এরই মধ্যে একদিন, তিনি কুমকুম আর ঝুমকো পায়েলজোড়া আমার হাতের মুঠে শক্ত করে ধরিয়ে দেন। আমি মাথা নিচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। তিনি মুখে কিছুই বলেন না তবে তার বুজে-আসা কণ্ঠস্বরের কষ্টের সমস্তটা আঁচ করতে পারি। বর্ষার থৈথৈ জলেভরা দিঘির মতো চোখজোড়া অশ্রুজলে টলমল করে উঠে।
তারা দেশ ছাড়ছেন, তেমনটা ঠাহর করতে পারি বেশ। যদিও সরাসরি কেউ আমাকে কিছুই বলে না। কষ্টে আমার ছোট্টবুকটা ফেটে যায়। আমি রাতজেগে বসে থাকি। কেঁদেকেটে সিথান ভিজাই।

এক বিকেলে নিঃশব্দে দুজনে সাঁকো পেরিয়ে নদীর ওপারে মল্লিকাদির বন্ধুর বাড়ি যাই। পথে আমাদের একবাক্য কথারও চালাচালি হয় না যেমনটা সবসময় হয়। নোমান আলী খানের সাথে সেই দিঘির শাণবাঁধানো-ঘাটে মল্লিকা’দির শেষআলাপ হয়। এবং বিকেল নেমে এলে নিঃশব্দে বাড়িরপথে ফিরতে পা বাড়াই।
সাঁকোর মাঝপথে দাঁড়িয়ে পশ্চিমদিকে দৃষ্টি ফেরালে লাল-টকটকে বিদায়ী সূর্যটায় চোখ আটকে যায়। “সূর্যাস্তে বিষাদের সুর থাকে ঠিক যেমন সূর্যোদয়ে থাকে সুখস্বপ্ন”-মল্লিকাদির কথা। তিনি এমনতরো কতো কথা আমাকে প্রায়ই বলতেন। আমরা প্রায়ই সূর্যাস্ত দেখতে বাঁশের সাঁকোর মধ্যিখানে নীরবে দাঁড়িয়ে যেতাম আজও স্বভাব মতো থমকে দাঁড়াই। পশ্চিম আকাশ, আজকে একটু বাড়াবাড়ি রকমের বিষাদের লাল আভায় মুড়ে আছে। মল্লিকা’দির কান্নাভেজা চোখজোড়ায় বিষাদের রঙের বড়বেশি মাখামাখি টের পাই। আমি আমার বাড়িরপথে পা বাড়াতে উদ্ধত হলে, মল্লিকাদি আমার হাতজোড়া তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখে। দিঘিরজলের মতো টলমল অশ্রুফোঁটা আমার হাতে গড়িয়ে পড়ে। আমি আলতোভাবে হাত ছাড়িয়ে বাড়ির পথ ধরি।

এরপর দিন-মাস-বছর ক্ষয়ে গেছে বহুবার, দু’যুগেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। মল্লিকাদি ওপার বাংলায় চলে যাওয়ার পর আমার সাথে আর তার দেখা হয় নাই। কিন্তু বহুবছরে অযত্নে ধুলোর আস্তরণ ঢেকে থাকা পুরনো আমলের কাঠের আসবাব থেকে জমাটবাঁধা ধুলো সরালে যেমন ঝকঝকে তকতকে হয়ে উঠে সেরূপে আমার মজ্জায় জমে থাকা সেসব স্পষ্ট স্মৃতিরা বর্তমানকে পাশ কাটিয়ে অতীতদিনের ঝালট খোলে আমাকে মল্লিকাদির পাশে নিয়ে প্রায়ই দাঁড় করিয়ে দেয়।

You may also like