ভাঙনবেলা

by সৌরভ হোসেন

তবে কি আমার চোখ দেখতে ভুল করেছিল না চিনতে ভুল করেছিল? তা কী করে সম্ভব? এত বছরের মিলমহব্বত। গায়ে-গায়ে মনে-মনে উঠবস। কোলাকুলি গলাগলি। না ছিল এঁটোর ছুঁত ছোঁয়া না ছিল প্রসাদ-সিন্নির ছুঁত অচ্ছুত। বিশুদের বদলে যাওয়াকে কোনোভাবেই মেলাতে পারে না রুস্তুম। সে তার খুঁটল চোখগুলো দিয়ে টিপটিপ করে তাকায় বিশুর মুদির দোকানের দিকে। চোখের মণিগুলো যেন ভাসমান থলথলে ঘোলা কুসুম। সে থির দৃষ্টিতে দুনিয়ার বিস্ময় ভর করে আছে। এ বিস্ময় যেন রুস্তুমের কাছে ‘ইহকাল’এ ‘পরকাল’ দেখা। যে পরকালের কথা বলে তাকে হদ্দিন ভয় দেখিয়ে মসজিদমুখি করতে চায় শফিকউদ্দিন মওলবি। অথবা আসমানের ফিরিশতা জ্বলজ্যান্ত মানুষ হয়ে তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে যাওয়ার থেকেও বিস্ময়। কিম্বা এক ‘ছু মন্তর ছু’এ তার প্রিয় দলের ক্ষমতা দখল! তার খুচখুচে কাঁচাপাকা দাড়ির মুখটা শুকিয়ে আরও চামটা হয়ে গেছে। মসজিদের ইমাম শফিকউদ্দিন এত করে বললেও মুখে দাড়ি রাখেনি রুস্তুম। উল্টে বলেছে, আমার সুন্নত মনে, মুখের দাড়ি আর মাথার টুপিতে নয়। বুকের পাটা আছে রুস্তুমের। হাড়-মাংসে হিম্মতও আছে। তানাহলে সমাজে থেকে সমাজের মোড়লদের ওপরে কথা! কবর দোজখের কত ভয় দেখিয়েছেন ইমাম হুজুর। ভয়ংকর আজাব-গজবের কথা বলেছেন। তবুও কানে আতর গুঁজে মাথায় ফেজ টুপি লাগিয়ে মসজিদমুখো হয়নি রুস্তুম। সে গর্ব করে বলে, আমি ধর্মদাস নই আমি দলদাস।

রুস্তুম পার্টি করে। রুস্তুম যে পার্টি করে সে পার্টি আবার দেশের কোথাও ক্ষমতায় নেই। তবে ‘জনতায়’ আছে। কথাটা রুস্তুমই বলে। রুস্তুম আরও বলে, তারাই নাকি প্রকৃত বামপন্থী। তাতে কোন ভেকও নেই ভেজালও নেই। শাসকদলের গফুর যেই বলেছিল, দুনিয়া উল্টে গেলেও তোমরা ক্ষমতায় আসবে না। সেদিন দল তৈরি করে আজ আমরা ক্ষমতায় আর তোমরা সেই ইংরেজ আমলে দল তৈরি করেও ক্ষমতা তো দূরের কথা একটা এমপি এমএলএও বানাতে পারলে না! রুস্তুম তখন বলেছিল, তোমাদের এই ক্ষমতা লালসার প্রতিহিংসার। এতে ক্ষমতার লাঠি আর টাকা ভোগ করা যায় কিন্তু সমাজ থেকে ভেক ও বিভেদ দূর করা যায় না। যে ক্ষমতা ধর্মকে তলোয়ার বানায় সে ক্ষমতা বুলেটের হতে পারে ব্যালটের নয়। এই ক্ষমতাই দেশটাকে একদিন শেষ করে দেবে। রুস্তুমের আজ সেই কথাটাই বার বার মনে পড়ছে। বিশু তো তাও কালেভদ্রে এক-আধদিন পুজোটুজো দেয় কিন্তু অনন্ত? ও তো কোনোদিন ‘রাম’ বলেও মন্দিরের ছায়া মাড়ায়নি। সেই অনন্তও আজ এসব কথাবার্তা বলছে! তলে তলে নাড়ছে কলকাঠি! ছড়াচ্ছে বিষ! যে বিষ ঘৃণার! বিদ্বেষের! বিশুর দোকানের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পার্টি অফিসটার দিকে তাকাল রুস্তুম। পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথুনির ওপরে টালির ছাউনি। দু খোপের কুঁড়োঘর। প্লাস্টারহীন এবড়োখেবড়ো দেওয়ালগুলোর গায়ে সবুজ রঙের ছিদল। ভিতরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে ডাপে খুঁটিতে উই কাটার কটকট শব্দ শোনা যায়। আবার রাতের বেলায় আকাশে শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠলে তার রুপোলী আলো ছাউনির ফাঁক গলে ভেতরের শিবদাস ঘোষের ছবিতে পড়ে। তখন শিবদাস ঘোষের তেজদিপ্ত মুখটা যেন জ্বলজ্বল করে। সে জ্বলজ্বল করা মুখ বেশ কয়েকবার দেখেছে রুস্তুম। সে মুখ দেখে তার ভিতরের নাড়ি-ভুঁড়িতে হাড়-মজ্জায় ঠেসে লেগে থাকা চিন্তা দর্শন খিলখিল করে ওঠে। সারা দেহে একটা অদ্ভুত স্পন্দন খেলে যায়। দলের কাজে তাকে মাঝেমধ্যে পার্টি অফিসে রাত কাটাতে হয়। যেদিন পার্টি অফিসে রাত কাটিয়ে বাড়ি যায় রুস্তুম সেদিন তার মনে একটা স্বর্গীয় উৎফুল্লতা বিরাজ করে। মেজাজ ফুরফুরে থাকে। আর মনের ভেতরে এক বদলের স্বপ্ন গুনগুন করে। সে গুনগুনানি শুনতে পায় নাফিসা। নাফিসা তখন ঠেস মেরে বলে, “বউর কাছে শুলে কি আর বিপ্লব হবে? বউর কাছে তো শিবদাসও নেই মার্কসও নেই। বউর কাছে আছে ভাতের খ্যাচখাচানি আর ক্ষিদের ফ্যাচফ্যাচানি।” তারপর রুস্তুমের পার্টি করাকে বিদ্রূপ করে বলে, “আগে ভাতের হিল্লে করো তারপরে বিপ্লবের হিল্লে করো।” আমরা যে কত সত্যি, আমাদের আদর্শ যে কত সঠিক, সেটা এবার নাফিসাকেও বোঝানো যাবে। মন্দির মসজিদ যে আজ দেশটাকে ফাঁসির শূলীতে চড়াতে চলেছে তা জাত করে বলা যাবে। আঃ নাফিসা বলে কি না, মুসলমানের পেটের ছেলে হয়ে মার্কসবাদ করবে! চোদ্দগোষ্ঠিকে দোযখে নিয়ে যাবে! আমি মোনাফেক লোকের বউ হয়ে মরতে পারব না? আজ সেসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় এসে গেছে। মন দিয়ে মনকে কষল রুস্তুম।

নদীর দিকে তাকাল রুস্তুম। চামটা পেটে শুকান দিচ্ছে এলেবেলে ভৈরব। পার্টি অফিসটা ভৈরবের তীরে ঝুলে আছে। অফিসের জায়গাটা খাস। এই ঢাল সহ পশ্চিমের তামাম মাঠ যোগেন্দ্র নারায়ন রায়ের জমিদারি ছিল। পরে সেসব ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যায়। বর্গা পাট্টা হয়। কিছু জমি খাসও হয়ে যায়। সেরকম এক খাস জমি দখল করে পার্টি অফিসটা গড়া হয়েছিল। রুস্তুম তখন লুঙ্গি পরতেই শুরু করেনি। সেটাও নেই নেই করে তিরিশ চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। সে খাস জমি দখলের আন্দোলনে না থাকতে পারার আফসোসটা মাঝেমধ্যেই করে রুস্তুম। সেটা নাকি তার কাছে এক বিপ্লব ছিল। শেষ চৈত্রের মরা নদী চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। বুকের ওপর যেটুকু জল আছে তাতে জলের ওপর কাদা না কাদার ওপর জল বলা মুশকিল। সেই কাদাজলে অস্তগামী সূর্যের সিঁদুর রঙ পড়ে নদীটাকে লাল করে তুলছে। নদীর এমন রূপ দেখে রুস্তুমের মনটা খুশিতে ভরে গেল। লাল তার প্রিয় রঙ। সে বিশ্বাস করে, এ রঙ দুনিয়ার সব খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের রঙ। এ রঙ মুক্তির। এ রঙ বিপ্লবের। রুস্তুমের মন বলছে নদীর বুকে গিয়ে দাঁড়াই। দাঁড়িয়ে প্রিয় লাল রঙটা গায়ে মাখি। তারপর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে জোরে একবার বিপ্লবের স্লোগান দিই। লাল রঙ গায়ে না মাখলেও পায়ে কাদা মেখে নীচে নামল রুস্তুম। শুকিয়ে যাওয়া নদী হেঁটে ওপারে যাবে। ওপারের মাঠে পাট বপনের জন্যে জমি বাতাল করছে ছলিম। আজ নতুন কী ঘুসুরমুসুর হয়েছে, নতুন কী কথা ছড়াছড়ি হচ্ছে, ছলিমের কাছে না গেলে যে সেসব জানা যাবে না? ছলিমই যে তার সংবাদদাতা। রেডিও টিভি। রুস্তুম ঠাট্টা করে বলে, আল্লাহর সংবাদদাতা হল ফিরিশতা আর আমার সংবাদদাতা হল ছলিম। কথাটা বলেই তার পুকরে দাঁতগুলো বের করে খিখি করে হাসে রুস্তুম। ছলিম তখন তাকে সাবধান করে, দুনিয়ার বামবাদ রামবাদ নিয়ে যাইই করো আল্লাহর আলাম-কালাম নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করো না রুস্তুম, মোড়লদের কানে গেলে কিন্তু তোমার গদ্দন আর ধড়ে থাকবে না! সেসব ভয় কবেই হারাম করেছে রুস্তুম। তানাহলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া মুমিন মুসল্লি আব্দুল্লা সেখের বেটা কখনও নাস্তিক দল করে? না ‘পরকালকে’ ‘বোগাস’ বলে? ছলিমই তাকে ক-দিন ধরে শিবু অনন্তদের ভেতরের খবরগুলো দিচ্ছিল। সেসব দেখেই তো আকাশ থেকে পড়েছিল রুস্তুম। কোনোভাবেই তার কানকে চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিল না। সেদিন অনন্তকেও নিষ্পলক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ দেখেছিল রুস্তুম। সে তাকানো দেখে অনন্ত আবার তাকে বলেছিল, ‘অমন করে কী দেখছ গ রুস্তুমদা! আমাকে নতুন করে চিনছ নাকি?’ হ্যাঁ, নতুন করে চিনছি তোমাকে। এতদিন সত্যিই চিনতে পারিনি। অথবা চেনায় ভুল ছিল। ইদ পরবে সিমাই-পায়েস আর কুরবানিতে খাসির মাংস আতপ চালের রুটি এক থালায় এক পাতে বসে খাওয়া তোমাকে সত্যিই চিনতে পারিনি। একটা মানুষের ভিতরে কত রকমের যে মানুষ লুকিয়ে থাকে তা আজ তোমাকে না দেখলে জানতে পারতাম না অনন্ত। এই চেনাটা অনেক আগেই চেনা উচিত ছিল। মনে মনে বলেছিল রুস্তুম।

ভটভট শব্দটা জমির আল বাতালের মাটি ছুঁয়ে বাতাসের কাঁধে চেপে নদীর বুকে ঝিরঝির করে নামছে। তারপর সে শব্দ হাত-পা ছুঁড়ে মিশে যাচ্ছে নদীর পাড়ে পগারে। স্যালো মেশিন থেকে সেচ দিচ্ছে ছলিম। জমির দোম নেই। দিন দশেক হল এই জমি থেকে পিঁয়াজ তুলেছে ছলিম। এবার পাট বুনবে। ছলিম তার বউকে ঠাট্টা করে বলে, আমাদের এই জমিটা তোমার মতো ফলনদায়িনী গো। তুমি যেমন বছর বছর সন্তান প্রসব করো আমাদের এই জমিটাও সেরকম মরসুমে মরসুমে ফসল প্রসব করে। কোদালের কোপ দিয়ে জলের বাঁধা সরিয়ে দিচ্ছে ছলিম। ঢেলা মাটিতে চু চু করে জল ঢুকছে। ভুড়ভুড় করে গলে যাচ্ছে মাটি। সে জলের হিম ছোঁয়া পেয়ে তিড়িং বিড়িং করে লাফ মারছে ঘূঁঘরে চটপটে পোকা। সেসব শিকার করার জন্যে ছো মেরে দাঁড়িয়ে আছে এক ঝাঁক বক। ছলিম আর মদনের সদাইয়ের আলে দাঁড়িয়ে রুস্তুম জিজ্ঞেস করল, “আজ নতুন কিছু খবর?”

“আছে। শুনলে এই ভুঁইয়েই মাথা ঘুরে পড়ে যাবা। দাঙ্গাও লেগে যাতে পারে!” ঘুত করে কোদালের কোপ দিয়ে কুঁত পেরে বলল ছলিম। কপাল থেকে দরদর করে ঘামও ঝরল জমিতে। ছলিম শরীরের এই ঘামকে চাষের জমিতে মেশা নিয়ে গর্ব করে। বলে, ‘এ ঘাম নুন-পানির নয়, এ হল চাষির হাড়-গোশ্ত পানি করা যাকাত। এ যাকাত পায় বলেই তো জমি গতর ভরে ফসল দেয়? এ ফসলে কণা মাত্র হারাম নেই। যখন গাছে শিষ ধরে তখন স্বয়ং ফিরিশতারা আসমান থেকে নেমে এসে আল্লাহর বরকত পৌছে দিয়ে যান।’

ছলিমের কথা শুনে রুস্তুম ফাঁকা মাঠটাকে আরও ফাঁকা দেখে। আর সে ফাঁকা মাঠে হাজির হন তাদের সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ। নদীর ভাঙা পাড় চষা জমির ঘ্রাণ আলের ঘাস গমের খড়ি পোড়া ছাই আর শেষ বিকেলের সিঁদুররঙা চিকন রোদে দেখতে পাচ্ছে তার প্রিয় নেতার কথাগুলো। শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন, ‘যেহেতু ভারতবর্ষ একটি পুঁজিবাদী দেশ এবং যেহেতু পুঁজিবাদ সম্প্রদায়গত, জাতিগত ও বর্ণগত প্রভৃতি জনবিরোধী চিন্তা ও ভাবনাধারনার জন্ম দেয় ও লালন-পালন করে এবং ইহা সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবিদ্বেষপ্রসূত দাঙ্গার মূল কারণকে জিইয়ে রাখে, সেহেতু কিছুদিন অন্তর অন্তর আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অবধারিত রূপে ঘটিবেই।’ কথাগুলো রুস্তুমকে ধারালো করে তুলল। রুস্তুম বলল, “তাহলে আর জমি বাতাল করে কী করবে? অস্ত্র বাতাল করো। বোম গুলি বানাও। সময় এসে গেছে।”

“তাই তো করতে হবে। ধর্মকে হেফাজত করতে সেরকমই ফরমান আছে হাদিস-কোরানে।” কোদালের ডামাট(হাতল)টাকে শক্ত করে ধরল ছলিম। দাঁতগুলোকে এমন চিবোল যেন তার মুখের কথাগুলোও কোদাল হয়ে উঠল। তা দেখে রুস্তুম, ‘ফিক’ করে হাসল। হাসিটায় ঠাট্টা মশকরা মেশানো। আসলে রুস্তুম ‘ছলিমের ধর্ম হেফাজতের’ জন্যে অস্ত্র, বোম গুলি বানানোর কথা বলতে চায়নি। রুস্তুম বলতে চেয়েছে, তাদের সেই ‘কাঙ্ক্ষিত বিপ্লবের’ কথা। যে বিপ্লব এ দেশে বয়ে নিয়ে আসবে সাধের সমাজতন্ত্র। চিরতরে বিনাশ হবে পুঁজিবাদ। যে সমাজতন্ত্র না কায়েম হলে গরিবের, খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের মুক্তি নেই। সে বিপ্লবই উদয় ঘটাবে মেহনতি মানুষের মুক্তি সূর্যের। সে দিন চলে এসেছে। এবার শান দিতে হবে বিপ্লবের অস্ত্রে। এখন ফসল আবাদ নয়, এখন বিপ্লবের আবাদে জোর দিতে হবে। মানুষকে বলতে হবে, ওঠো, জাগো, অস্ত্র হাতে নাও, বিপ্লবের সময় এসে গেছে, ওই তো দুয়ারে দাঁড়িয়ে রয়েছে সমাজতন্ত্র। পার্টির কোনও এক সভায় কে যেন বলেছিলেন, যখন দেখবেন লড়ি-খড়িকে তলোয়ার মনে হচ্ছে, ধানের শীষকে তির-বল্লম আর মাটির ঢেলাকে মনে হচ্ছে বোম, পথের ধুলোকে বারুদ আর ক্ষয়াটে চাঁদকে মনে হচ্ছে কাস্তে, তখন ধরে নেবেন বিপ্লবের সময় এসে গেছে। সেসবই যেন মনে হচ্ছে এখন রুস্তুমের। ভাবনাগুলো তার রগ-রক্তকে ফুটিয়ে তুলছে। সেটা বুঝতে পারল ছলিম তার চোখের দিকে তাকিয়ে। ছলিম জিজ্ঞেস করল, “কী গ চোখ অত্ত লাল ক্যানে! কাহুর সাথে মারামারি করে এলা নাকি?”

“করিনি। তবে এবার করতে হবে।” ঘোরের মধ্যে কথাটা বলল রুস্তুম। রুস্তুমের কথার মধ্যে উত্তাপের আঁচ পেয়ে ছলিম বলল, “একেই বুলে জ্বেহাদ। এ জ্বেহাদে শহীদ হলে জান্নাত নসিব পাক্কা।”

ছলিমের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল রুস্তুম। তারপর বলল, “হ্যাঁ জান্নাতই বটে। তবে এ জান্নাত আসমানের নয়, জমিনের।”

“মানে!” ভ্রূ টান করল ছলিম। রুস্তুম বলল, “মানে, বিপ্লব।” এবার ছলিম মুখ ভেংচে হাসল। তারপর বলল, “ওহ, তুমাদের সেই সমাজতন্ত্র না কি য্যানে বুলে অই?” তারপর মনে মনে ছলিম বলল, বেটা রুস্তুমের কমরেডগিরি ব্যামুটা আবার উস্কেছে দেখছি। এ ভূত যে কোনোমতেই ছাড়ার কথা বলছে না। নাস্তিক দল করাটা না ছাড়াতে পারলে যে বেটা রুস্তুম দোজখের আগুনে পুড়বে! একজন কাছের মানুষকে এভাবে দোযখে যেতে দেখে কিছু না করতে পারলে যে আমিও মরে শান্তি পাব না। আমিও যে পাপের ভাগিদারি হয়ে যাব। পরকালে আল্লাহকেই বা কী কৈফিয়ত দেব? জোরে একটা শ্বাস ফেলল ছলিম। রুস্তম ‘ছাড়ো ওসব কথা’ বলে বলল, “নতুন খবরটা বলো।”

লছিম কোদালটা আলে খাড়া করে রাখল। তারপর বলল, “বিপ্লবের থেকে জ্বেহাদ অনেক বড় নেক কাজ রুস্তুম। এখুন বিপ্লবের নয়, এখুন জ্বেহাদের সুমা। এ জ্বেহাদে না জিততে পারলে জ্ঞাতি গোত্র ধ্বংস হয়ে যাবে!”

“জ্বেহাদ কোনও একটা ধর্মের জন্যে নয় কোনও একটা জাতির জন্যে নয়, জ্বেহাদ হোক ভাতের জন্যে রুটির জন্যে, তাহলে দ্বিনও বাঁচবে দুনিয়াও বাঁচবে।” বলল রুস্তুম। ছলিম লুঙ্গির গিঁটে আটকানো মোবাইলটা বের করতে করতে বলল, “যা শুরু করেছে, দ্বিন তো দূরের কথা দুনিয়াই বাঁচবে কি না দ্যাখো!” ছলিমের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল রুস্তুম। হাসির মধ্যেই বলল, “ক্যানে, তোমরাই তো বলো, আল্লাহর দ্বিন আল্লাহ ঠিকই রক্ষা করবেন। দুনিয়ার মানুষের ক্ষমতা নেই সে দ্বিনকে দুর্বল করতে পারে।”

“সে তো ঠিক কথাই।”

“তাহলে আবার ওসব নিয়ে চিন্তা কীসের?”

“চিন্তা তুমার হচ্ছে না?”

“হ্যাঁ, হচ্ছে, তবে আমার চিন্তা আসমানের জান্নাত-বেহেশত নিয়ে নয়, আমার চিন্তা খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের ভাত-রুটির।”

ছলিম মনে মনে ভাবল, রুস্তুম মনে হয় পার্টি অফিস থেকে আসছে। ওই নাস্তিক পার্টি অফিসটা কত লোকের যে সর্বনাশ করল! কত লোক যে ওসব দলের ইস্তেহার মতাদর্শ বই-কাগজ পড়ে কাফের বনে গেল! এখন মনে হচ্ছে, জ্ঞাতি-গোত্রের জন্যে জ্বেহাদ করার আগে ওই পার্টি অফিসটাকে ভাঙি। ভেঙে গুড়িয়ে দিই। আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিই। তাও তো পরকালে গিয়ে আল্লাহকে বলতে পারব, তোমার দুনিয়াতে কাফের বানানোর একটা আখড়া ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন নিজেদের মধ্যে লড়ার সময় নয়। এখন নিজেদের এক হওয়ার সময়। এক হতে না পারলে বিপদ আরও ভয়ংকর হবে! এখন খড়কুটোকেও আপন করে নিতে হবে। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ছলিম আলের ওপর দ হয়ে বসল। তারপর রুস্তুমকে কাছে ডেকে আঙুলের স্পর্শে মোবাইলে কি একটা বের করে বলল, “এই দ্যাখো, হারামিদের কাজ।” রুস্তুম চোখ গোল্লা পাকিয়ে দেখল সে ছবি। সে চোখ গামলা হয়ে উঠল। ছবিটা একটা ইটের। হালফিলের ভাটার ইট। সে পাকা ইটের উপরের দিকে লেখা ‘জয় শ্রীরাম’। আর নীচে লেখা ‘দাতা, অনন্ত ঘোষ’। “অনন্ত তলে তলে এত কম্যুনিয়াল!” মুখ ফুটে কথাটা বেরিয়ে এল রুস্তুমের। ছলিম বলল, “শুধু কি অনন্ত, এই দ্যাখো শিবুকে।” রুস্তুম দেখল, বাবরি মসজিদের ভাঙ্গাকালিন একটা ছবি। যে ছবিতে দেখা যাচ্ছে, উন্মত্ত রামসেনারা বাবরি মসজিদের গম্বুজে উঠে বিজয় উল্লাস করছে। এ ছবি পোস্ট করে শিবু আফসোস করেছে, ‘এদের মধ্যে আমিও যদি থাকতাম কী পুণ্যটাই না হত!’ “শিবু এত দূর!” রুস্তুমের এবার মনে হচ্ছে মাটি ফেটে ঢুকে যায়। “তবে কি সাধে বুলছি, এখুন ভাত-রুটির লড়ার সুমা না, এখুন ধর্মের জন্যে জ্বেহাদ করার সুমা।” সুযোগটা পেয়ে তার মনের কথাটা আবারও ঝালিয়ে নিল ছলিম। রুস্তুম কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকল। তার লাল চোখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে তার এত বছরের হিসেব। শিবু অনন্ত নারান সব্বাই! অনন্ত না হদ্দিন তিন বেলা তাদের মুসলিম পাড়া থেকে দুধ দুহিয়ে রোজগার করে? মুসলমানদের সঙ্গে কত হাসি-খুশির সম্পর্ক। তাদের সঙ্গে করা ঠাট্টা-মশকরাই হল তার সারাদিনের ধকলের টনিক। সেই অনন্ত অয্যোধ্যায় রামমন্দির বানানোর জন্যে ইট পাঠিয়েছে! এ ইটের একটা অংশ যে আমার মাথায় পড়ে আমার মাথাটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। ও কি জানে না, এ ইট কোনও মন্দিরের দেওয়ালের গাঁথুনি নয়, এ ইট দেশের একটা জাতির মুখে ঘা?

শিবুর মুদির দোকান তো বলতে গেলে মুসলমানরাই চালায়। তেল-নুন আনাচপাতি কি না বেচে শিবু। শিবুর ধুপ-ধুনো দেওয়া চাল-আটা আবুল-কাদের-ছলিমদের রোজার সেহরি হয়। ইদের পায়েস হয়। আর এভাবেই ধর্মের চেয়ে দেশ বড় হয়ে বেঁচে থাকে। এ চাতালে একটাই মিস্টির দোকান। সেটা নারান সরকারের। নারানদাও এভাবে তলে তলে হিংসার ঘৃণার সলতে পাকাচ্ছে! ও কি জানে না, মুসলমান খদ্দেররা ওর দোকানে না গেলে ও পেটে মারা পড়বে? প্রশ্নগুলো দমকা হাওয়ার মতো আউরিবাউরি খেতে লাগল রুস্তুমের মনে। একটা মোবাইলের মধ্যে যদি এত ঘুচুরমুচুর এত লটঘট হয় তাহলে বাস্তবে তো আরও ভয়ংকর চক্রান্ত পাকাচ্ছে ওরা! ভয়টা মাথায় খেলতেই সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল রুস্তুমের। একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ। নাম, ‘শ্রী শ্রী রাম’। এই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মেম্বার শিবু অনন্ত নারান। শুধু তাই নয়, শিবু আর অনন্ত আবার এই গ্রুপের ‘অ্যাডমিন’! এই গ্রুপের কাজ হল কট্টর সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা ছড়ানো। মোদ্দা কথা ‘মুসলিম বিদ্বেষ’ ছড়িয়ে হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলে হিন্দুদেরকে এক করা। রুস্তুম এতদিনে ঠাহর করছে, শিবু অনন্তদের আদর করে ডাকা ‘রুস্তুমভাই’, ‘রুস্তুমদা’ আসলে মুখোস, আসল মুখ হল ‘শ্রী শ্রী রাম’ গ্রুপে গালি দিয়ে বলা ‘লুঙ্গি পরা রুস্তুমে’ ‘কাটা রুস্তুম’। কিন্তু মানুষগুলো তো এমন ছিল না! হঠাৎ কী খারাপ হাওয়া যে এল এতদিনের মিলমিশ সম্পর্ক সব ওলটপালট হয়ে গেল! কী বিষ যে ওদের মধ্যে ঢুকল, এত যুগ ধরে একসাথে গায়ে গা লাগিয়ে বসবাস করা মানুষগুলোকে ওরা দুষমন ভাবছে! জনম জনমের শত্রু ভাবছে! তবে কি আবারও সেই ধর্মযুদ্ধ আসন্ন? আর সে যুদ্ধ হলে তো দুই জাতিই ধ্বংস হয়ে যাবে! ধ্বংসের কথাটা মাথায় খেলতেই ভেতরে একটা আশার আলোও দেখল রুস্তুম। এই ধ্বংসটা ঘটলেই তো তাদের সেই কাঙ্ক্ষিত ‘বিপ্লব’ সংগঠিত হবে। ধ্বংসের ভেতরেই তো লুকিয়ে থাকে নতুনের সম্ভাবনা? সে নতুনই তো হল এত দিন এত বছর মনে পুষে রাখা ‘বিপ্লব’। সর্বহারা মেহনতি মানুষের মুক্তি। আরও একটা বিষয় মাথায় খেলতেই তার মন এমন করে ‘ধেই’ করে উঠল যেন কোনও যুদ্ধে জিতে গেছে রুস্তুম। আর সেটা হল, তথাকথিত কম্যুনিস্ট দল যারা মাঝেমধ্যে ক্ষমতায় থেকেছে, তাদের পতন। রুস্তুমদের দল বলে, তারাই প্রকৃত কম্যুনিস্ট। তথাকথিত সেই কম্যুনিস্ট পার্টিতে নাকি বিস্তর গলদ আছে। ওরা হল মেকি বাম। এ নিয়ে সেই তথাকথিত কম্যুনিস্ট পার্টির লোকাল কমিটির মেম্বার আফতাবউদ্দিনের সঙ্গে তার কম তর্ক হয়নি। আফতাবউদ্দিন যেই বলেছিল, ‘মানুষ তো আমাদেরকেই চাই, তাই তো আমরা ভোটে জিতি।’ অমনি রুস্তুম বলেছিল, ‘মানুষ তো হিটলারকেও চেয়েছিল, তাই বলে কি হিটলার ঠিক?’ রুস্তুম সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তাত্ত্বিক কথাও বলেছিল, ‘তোমরা সমাজের ওপর তলা থেকে সমাজতন্ত্র আনার চেষ্টা করছ, সেটা ভুল পথ, সঠিক হল শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সমাজতন্ত্র আসবে। আর সেটা ঘটবে সমাজের নিচু তলা থেকে, খেটে খাওয়া মেহনতি শ্রমিক কৃষকদের কাছ থেকে।’ আফতাবউদ্দিন সে গুঢ়তত্ব কথা শুনে উল্টে রুস্তুমদের দলকে হেয় করে বলেছিল, ‘তোমরা এতই যদি ঠিক আর আমরা এতই যদি ভুল তো এত বছর ধরে একটা রাজ্যেও কেন ক্ষমতায় আসতে পারনি?’ আরও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে আফতাব বলেছিল, ‘তোমরা তো নির্দলের থেকেও ছোট গ! নির্দল প্রার্থীও মাঝে মধ্যে জেতে। আর তোমরা? সেই আশি নব্বই বছর ধরে একটা মন্ত্রীও হতে পারনি ছ্যাঃ ছ্যাঃ!’ রুস্তম আফতাবের কথায় রাগেনি। রেগে হাতে বাঁশও তুলে নেয়নি। শুধু মুখের ওপর বলেছিল, ‘সময় এলে ঠিক বুঝতে পারবে, কারা ভুল আর কারা ঠিক।’ সে সময় যেন তার চোখের কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কানের কাছে এসে বাজাচ্ছে সাইরেন। চোখের সামনে থেকে মোবাইলটা সরিয়ে নিল ছলিম। বন্ধ করে ছলিম বলল, “এ তো দেখলা ছবির কিত্তিকলাপ। নেটঘেঁটের ফন্দিফেউর। এবার তুমাকে আসল ছবি দেখাব। দেখলেই তুমি বুলবা, শালোধেরকে এক্ষুনি জবাই করি।”

“আসল ছবি! সেটা আবার কী!” রুস্তুমের চোখে সাত জাহানের বিস্ময়। ছলিম ফিসফিস করে বলল, “আজ রাতে জোড়তলায় আসো। দেখতা পাবা।”

                                                                                      দুই

খিলখিলে দাঁত বের করা দেওয়ালের একটা গোল ফুটোতে চোখ রাখল রুস্তুম। ফুটোটাকে কেউ বলে ‘হরিয়াল পাখির খুঁটল’ কেউ বলে ‘ঘুলঘুলির কোটর’ আবার কেউ কেউ ‘বায়োস্কোপের ফুটো’ও বলে। পিঠ কুঁজো করে দেওয়ালের যেখানে চোখ রাখল রুস্তুম সেখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার জোড়া বটগাছটার ডালপালা ছুঁয়ে নেমে আসছে। একটা বটগাছের সঙ্গে আরেকটা বটগাছ আংরিফাংরি বেঁধে জোড় লাগা। এজন্যেই লোকে জায়গাটাকে ‘জোড়তলা’ বলে। বয়স্ক গাছটার ঝুরি যেখানে ঝুটি বেঁধে নেমেছে সেখানেই মন্দিরটা। বটতলা মন্দির বা জোড়তলা মন্দির। দেবগৃহের গা লাগা উন্মুক্ত চাতাল। চাতালের পুস্তে ছুঁয়ে এই ঘুপসি ক্লাবঘরটা। ঘরের ছাদ-বারান্দা পাখির বিষ্ঠায় চুন হয়ে আছে।

“শুনছ?” টেসে গলায় জিজ্ঞেস করল ছলিম। খুঁটলের ভেতরে রাখা রুস্তুমের চোখগুলো তখন থির হয়ে গেঁথে গেছে। তার চোখে তখন দুনিয়ার বিস্ময়! যে দুনিয়ার কথা সে শুনেছে মাওলানাদের মুখ থেকে। সে দুনিয়া দোজখ-জাহান্নামের দুনিয়া। আজাব-গজবের দুনিয়া। বাপের জন্মেও ভাবেনি রুস্তুম তাকে এ দুনিয়া একদিন দেখতে হবে। খুঁটলে চোখ রেখেই রুস্তুম ফিসফিস করে বলল, “এ তো ভয়ংকর চক্রান্ত!”

“সাধে কি আর বুলছি, সব ছেড়েছুড়ে এখুন জ্বেহাদে নামতে হবে।” বলল ছলিম। কথাটায় কন্ঠটা কিছুটা ঝাঁঝিয়েই উঠল তার। সঙ্গে পায়ের নীচের শুকনো বটপাতা সড়সড় করল। ফলে একটা নিস্তব্ধ ভাঙা আওয়াজ অন্ধকার কামড়ে উঠল। বেগতিক দেখে রুস্তুম চোখ পাকিয়ে বলল, “আস্তে, ছলিম, আমাদের দেখতে পেলে সব খিল্লি হয়ে যাবে! জান নিয়ে আর বাড়ি ফিরতে পারব না।” চুপ মেরে গেল ছলিম। অন্ধকারে তখন পিন পতনের নিস্তব্ধতা। শুধু দু একটা পেঁচা ডাকছে গাছে। আর শুকনো বটপাতার মধ্যে খড়মড় করছে পোকামাকড়। অথচ একটা সময় ছিল যখন রুস্তুমরা এই ফুটো দিয়ে লুকিয়ে চুপিয়ে বিশু অনন্তদের চুরি করে বিড়ি ফুঁকা বা মদ খাওয়া দেখত। তখন চুরি করে দেখাটা ধরা পড়ে গেলে দারুন মস্তি হত। হিহি খিখি করে হাসির রোল উঠত। যে যাকে পারত রাগাত ক্ষেপাত চটাত। কিন্তু সে দিনকাল যে আজ বদলে গেছে, সেটা ঠাহর করল রুস্তুম। রুস্তুম তার পিটপিটে চোখ ফেড়ে দেখল, বিশু অনন্তরা পরিকল্পনা করছে, কীভাবে মুসলমানদেরকে শায়েস্তা করা যায়! অনন্ত বলছে, ‘এতদিন সুযোগ ছিল না, এখন সুযোগ এসেছে, তাহলে আমরা কেন সে সুযোগ নেব না?’ বিশু নিখিলকে বলছে, ‘ছলিমের ভুইটা আমি দখল নেব। তুই কাদেরেরটা নিস। ওটাও পয়া।’ নারান ময়রা বলছে, ‘মইদুল মাস্টারের বাড়িটা আমি নেব। ছেলেপিলেকে বলে রেখেছি।’ রস্তুম তাজ্জব হয়ে ভাবছে। রুস্তুম ভাবছে, বাংলায় এসব জিনিস ছিল না। এসব গো-বলয়ে ছিল। এখন বাংলায়ও আমদানি হল! একটা গুড়ির আড়ালে দাঁড়াল রুস্তুম আর ছলিম। এখানে অন্ধকার আরও ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যভাবে বললে, গাছ গাছের গুড়ি ডালপালা ও ঝুরি লতিকে আলিঙ্গন করে আছে। ছলিম বলল, “আর সুমায় নাই। অস্ত্র এবার হাতে তুলে নিতেই হবে। লড়াই আসন্ন।”

রুস্তুম কীসব ভাবতে ভাবতে ‘ফিক’ করে একবার হাসল। এতক্ষণ সে তার দলের কথা ভাবছিল। যেখানে বলা আছে, এরকম একটা সময়ই হল বিপ্লবের প্রাক মুহূর্ত। তারমানে এখন বিপ্লব প্রস্তুত হচ্ছে। সন্তান প্রসব হওয়ার আগে যেমন মায়ের যন্ত্রণা ওঠে, ছটফটানি হয়, বিপ্লবের ক্ষেত্রেও তাই। এই দুঃসময়ে রুস্তুমকে হাসতে দেখে রাগে লাল হয়ে উঠল লছিম। দাঁত খিটমিট করে বলল, “এত বিপদের সুমায় তুমার হাসি পাচ্ছে!” রুস্তুম রাগল না। কন্ঠটাকে কেমন খেয়ালি করে বলল, “ধর্মের বিরুদ্ধে যদি ধর্ম অস্ত্র হয়, জাতির বিরুদ্ধে যদি জাতি অস্ত্র হয়, তাহলে সে লড়াইয়ে না টিকবে ধর্ম না টিকবে জাতি। দুইয়েরই পতন নিশ্চিত। মনে রেখ, ধর্ম পুঁজিবাদের অস্ত্র হতে পারে কিন্তু মানুষের মুক্তির অস্ত্র হতে পারে না।”

“ওহঃ এবার বুঝেছি, তুমার ওই কমরেডগিরি ব্যামুটা আবার উস্কেছে। ওই ভূতটা কবে যে তুমার মাথা থেকে বিদেয় হবে!” মুখ ভেংচাল ছলিম। দাঁত কটমট করে বলল, “তুমি কি কুনু একটা বিপদ আপদ ঘটলেই তার মধ্যে ওই বিপ্লবের বিছন দেখতে পাও?” রুস্তুম শান্ত গলায় বলল, “বিপ্লব সহজ পথ দিয়ে আসে না, ছলিম।” ছলিমের এবার মাথা গরম হয়ে উঠল। গলা কাঁপিয়ে বলল, “ওসব ভুষি কথা বাদ দিয়ে হক কথাডা শুনে ল্যাও, যদি নিজের জ্ঞাতি গুষ্ঠিকে এ দুনিয়ায় দেখতে চাও, তাইলে আগামী হপ্তায় জুম্মাবার রাত আটটা সুমায় কারবালাতে আসো। আমাদের একটা জরুরি মিটিং তলব করা আছে।”

                                                                                        তিন

এই কদিন ছলিমকে এড়িয়ে চলতে লাগল রুস্তুম। উল্টে পার্টি অফিসে যাওয়া-আসা বাড়তে লাগল। ব্যাপারটা নাফিসাও লক্ষ্য করল। কিন্তু আজ তো ওর মজলিশে যাওয়া কথা? সন্ধ্যা হতে চলল তবু যাওয়ার তো কোনও হেলদোল দেখছি নে! তবে কি ও যাবে না? পেটে আর রাগ ধরে রাখতে না পেরে নাফিসা বলেই ফেলল, “কী গ, গ্যালা না? পাড়ার সব্বাই তো গেল।” তারপর ঝেঝিয়ে উঠল, “এ লড়ায় দুনিয়ায় টিকে থাকার লড়াই। ধর্মের লড়াই। আল্লাহর দ্বিনকে হেফাজত করার লড়াই। এ লড়াইয়ে সামিল না হলে যে পরকালে জাহান্নামে যাতে হবে!” এবার রুস্তুমের ‘বিপ্লব’টাকে বাঁশ দিয়ে বলল, “তুমার ওই বিপ্লব টিপ্লব এখুন মাথা থেকে ঝেরে ফ্যালো। অ আমি খাব না মাথায় দিব? না আমার ছেলেপিলের প্যাট ভরাবে? এ দুনিয়ায় ব্যাটা বিটির মুখ যদি দেখতএ চাও তাইলে এক্ষুনি দৌড় লাগাও।” ক-দিন ধরেই খিচখিচ করছে নাফিসা। স্বামী-স্ত্রীতে সবসময় ঠুকমুক লেগেই থাকছে। রুস্তুম ঠারে ঠারে বুঝতে পারছে, দেশে বিপ্লব আনার আগে নিজের বাড়িতে আগে বিপ্লব আনতে হবে। সে বউর সমস্ত রাগ অভিমানের ওপর জল ঢেলে দিয়ে বলল, “যাচ্ছি।”

“যাচ্ছ!” যেন আকাশ থেকে পড়ল নাফিসা। মুখে আল্লাহর নাম নিল। তার কোনোমতেই বিশ্বাস হচ্ছে না কথাটা। শেষমেশ তাহলে তার ইস্পাত দঢ় স্বামীও বাঁকল! এতদিনে আল্লাহ ওকে রহম করলেন! আল্লাহ কখন কাকে রহম করেন আল্লাহ নিজেই জানেন। ঠোঁটের ফাঁকে একটা চিরিক হাসি খেলে উঠল নাফিসার। রুস্তুম বেরিয়ে গেলে খুশিতে দু রাকাত নফল নামাজও পড়ল নাফিসা। দু হাত তুলে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করল, “আল্লাহ তুমি আমাদের হেদায়েত করো।”

মজলিশ টগবগ করে ফুটছে। গাঁয়ের সব মুসলমান পুরুষ ঝেটিয়ে জড়ো হয়েছে। ছোট্ট কারবালা চত্বরটা যেন বদরের যুদ্ধাঙ্গন! মজলিশের ঢোকার আগে নিম গাছটার আড়াল থেকে কিছুক্ষণ মজলিশটা দেখছিল রুস্তুম। কান পেতে শুনছিল মোড়ল মোল্লাদের কথাবার্তা। মজলিশ তো নয় এও এক দুনিয়া। যেভাবে সেদিন জোড়তলায় খুঁটলে চোখ রেখে দেখেছিল ক্লাবের ভেতরের দুনিয়াটাকে। এও ঠিক সেরকম এক দুনিয়া। রুস্তুম ঠাহর করল, দুই দুনিয়ার ভেতরে ফারাক খুব একটা নেই। সবার উদ্দেশ্যই এক, ধর্ম দিয়ে ধর্মকে খুন। রুস্তুমকে আসতে দেখে উপস্থিত সবাই খুশিতে হুল্লোর করে উঠল। সাইফুদ্দি মুড়ল বলল, ‘তুমি আলা ভালো কল্লা বাপ, ল্যাখাপড়া জানা শিক্ষিতু লোক। বুদ্ধি খাটাতে পারবা।” সঙ্গে আলতো করে একটা খোঁচাও দিল, “আল্লাহ তওবাকারীকে হেদায়েত করে। আল্লাহ যে রহমানের রহিম। তুমি যে তুমার ভুল বুঝতে পেরেছ, সেডাই বড় কথা। কুফরি দল কেউ করে গ বাপ?” সবার মুখকে হাঁ করে দিয়ে রুস্তুম বলল, “আমি তোমাদের ধর্ম যুদ্ধে সামিল হতে আসিনি। আমি একটা হক কথা বলতে এসেছি, আমিও যুদ্ধে নামতে চলেছি, তবে সে যুদ্ধ কোনও একটা ধর্মের জন্যে নয়, কোনও একটা জাতির জন্যে নয়, আমার যুদ্ধ ভাতের জন্যে রুটির জন্যে।” উপস্থিত সবার হাঁ মুখ আরও হাঁ হয়ে গেল! মহরমের তাজিয়াটার পাশে বসে ছলিম মনে মনে বলল, “বেটা রুস্তুমের কমরেডগিরি ব্যামুটা দেখছি আবার উস্কেছে!”

You may also like