সামসুল হালসানা
সালটা ১৯২৩। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বরাজ দলের নেতৃত্বে কলকাতা কর্পোরেশনের শাসন পরিচালনা করার দায়িত্ব পেল দেশবাসী। ৩২ টি ওয়ার্ডে দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মনোনীত প্রার্থীরা কাউন্সিলর নির্বাচিত হলেন। কলকাতা কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। সুভাষচন্দ্র বসু হলেন চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার। ডেপুটি মেয়র হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মাত্র ২৬ বছর বয়সে এমন একটি গুরুদায়িত্ব পদে আসিন হলেন প্রথম বাঙালি। এই পদে মাইনে ছিল মাসিক ৩০০০ টাকা। কিন্তু বড় আশ্চর্যের কথা, এই বয়সে সুভাষ তাঁর সমস্ত খরচ বাবদ নিতেন মাত্র ১৫০০ টাকা। এই উদাহরণ থেকেই বোঝা যায় নিজের জন্য খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য যা দরকার তার বেশি অর্থ নেওয়ার তিনি চিন্তাভাবনা কখনোই করেননি। এটাই তো প্রকৃত দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়কের চিন্তা-ভাবনা যা তাঁর ওই তরুণ বয়সেই লক্ষ্য করা গেছিল। তিনি ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক ও দেশের অগণিত দরিদ্র মানুষের স্বপ্ন পূরণের এক চিন্তাশীল প্রহরী। দায়িত্বভার নেওয়ার পর পৌর প্রতিষ্ঠান থেকে খোলা হল শিক্ষা বিভাগ যাতে গরিবরা বিনামূল্যে শিক্ষা লাভ করতে পারে। বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হলো। কলকাতার চেহারায় গেল বদলে। এসবকিছুর নেপথ্যে ছিল সুভাষের দান।হয়ত সুস্থ শরীরে ফিরে আসলে দেশের চেহারাই পাল্টে দিতে পারতেন তিনি।সত্যিকারের নীতি–আদর্শ, ধর্মনিরেক্ষ চর্চা ও এর অনুশীলনই ছিল তাঁর জীবনসংগ্রামের ইতিহাস ৷ আজকে দেশের এই সংকটকালে তার জীবন সংগ্রাম এবং ধর্মনিরেক্ষ আদর্শকে পাথেয় করতে পারলে হয়তো সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে কলুষিত ও দূষিত দেশের আকাশে বাতাসে মানবিকতার বিশুদ্ধ বাতাস আসতেও পারে।
কেমন ভারত চেয়েছিলেন মহান এই দেশনায়ক । এতে বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই প্রকৃত সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। কারণ তিনি তাঁর গভীর বোধ এবং দূরদৃষ্টি দিয়ে অনুভব করেছিলেন “নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান” এর এই বিশাল দেশে বিবিধের মাঝে মহান মিলন দেখতে হলে কেবল মাত্র ধর্মনিরপেক্ষতার অদৃশ্য সুতো দিয়ে সকল ভারতবাসীকে সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বাঁধা যেতে পারে ।আধুনিক ইউরোপীয় সেকুলার রাষ্ট্রভাবনার ধ্যান ধারণায় পুষ্ট হয়ে তিনি এমন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন যেখানে রাষ্ট্রীয় সমস্ত পরিকাঠামো থেকে ধর্ম অনেক দূরে থাকবে l তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্ম হবে মানুষের ব্যক্তিগত বিষয়। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোনো যোগসূত্র থাকবে না।তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন নিষ্ঠাবান মাকালীর ভক্ত। কিন্তু তাঁর এই ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ কখনোই সমষ্টিগত সামাজিক কাজে বা রাজনৈতিক কাজে প্রতিফলিত হয়নি। তাই স্বাধীনতা আন্দোলনের ময়দানে দাঁড়িয়ে তিনি দৃপ্ত কন্ঠে বলেছিলেন, ‘‘গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গত খণ্ড চিন্তা নয়, সমগ্র জাতিকে জড়িয়েই চিন্তা করতে ও অনুভব করতে আমাদের শিখতে হবে৷ সামাজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রের যে সত্যটি সম্বন্ধে আমাদের নিরক্ষর দেশবাসীর চোখ আমাদেরই খুলে দিতে হবে, তা হল, ধর্ম, জাত ও ভাষার পার্থক্য থাকলেও আর্থিক সমস্যা ও অভিযোগগুলি আমাদের সকলেরই এক৷ … দারিদ্র ও বেকারি, অশিক্ষা ও রোগগ্রস্ততা, কর ও ঋণের বোঝা সব সমস্যাই হিন্দু ও মুসলমান সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের জনগণকে একইভাবে আঘাত করে এবং এগুলির সমাধানও সর্বাগ্রে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের উপর নির্ভর করে৷’’
তিনি সাম্প্রদায়িকতার ভয়ংকরতা বিচক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তৎকালীন সাম্প্রদায়িকতার আঁতুড়ঘর হিন্দু মহাসভা ও মুসলিম লীগ থেকে কংগ্রেসকে সমদূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন।তাই, জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালীন সুভাষ সর্বসম্মতিক্রমে হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগের মতো সংগঠনগুলির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে রেজুলেশন পাশ করান। ১৯৪০ সালে ফরোয়ার্ড ব্লক উইকলির একটি সম্পাদকীয়তে সুভাষ লিখেছিলেন, “দীর্ঘ দিন যাবৎ কংগ্রেসের কিছু বিশিষ্ট নেতা হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগের মতো সাম্প্রদায়িক সংগঠনে যোগ দিতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। এই সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি আগের থেকে আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। যে কারণে কংগ্রেস নিজের গঠনতন্ত্রে নতুন একটি বিধান অন্তর্ভুক্ত করেছে। যার ভিত্তিতে হিন্দু মহাসভা অথবা মুসলিম লিগের কোনো সদস্য কংগ্রেসের সদস্যপদ পাবেন না”।ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় কলকাতায় হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক প্রচারসভাকে একাধিকবার বিক্ষোভ দেখিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল সুভাষচন্দ্রের যুব বাহিনী। শেষে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নিজেই ময়দানে নামলে তাঁকেও সেই বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। স্বয়ং শ্যামাপ্রসাদই তাঁর ডায়েরিতে লিখে গিয়েছেন, “সুভাষ তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং হুঁশিয়ার দিয়ে বলেন যে ‘হিন্দু মহাসভা’ রাজনীতি করতে এলে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে তিনি তা আটকাবেন”। শুধু ভাবনাতেই নয় তিনি অনুশীলনেও অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষতার অসংখ্য প্রমাণ রেখে গেছেন।
তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে, সামন্ততন্ত্র এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াইয়ে সমগ্র জনগণকে যুক্ত করে এমন একটি স্বাধীন সার্বভৌম ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই ভারত সমস্ত ধর্ম–বর্ণ–প্রাদেশিকতার ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে এক অখণ্ড জাতি হিসাবে গড়ে উঠতে পারবে৷ যেখানে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টির উপাদানগুলিই লুপ্ত হয়ে যাবে৷তিনি ভারতীয় সমাজ ধারার বিকাশকে ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তিনি মনে করতেন বহু ধর্ম, বহু ভাষা, বহু জনজাতির এই দেশে ধর্মের অতীন্দ্রিয় আবেগ দ্বারা রাজনীতি পরিচালিত হওয়া উচিত নয়,তা পরিচালিত হওয়া উচিত শুধুমাত্র অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক বিচার বুদ্ধি দিয়ে৷ কিন্তু বড় আক্ষেপের বিষয় ভারতের জাতীয় রাজনীতি সব সময় পরিচালিত হয়েছে জাত–পাত, ধর্ম–বর্ণের সাথে আপস করে ৷ উপরন্তু ধর্মকে জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ প্রচারের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে , কখনো নরম ভাবে বা কখনো প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তির দ্বারা গরম ভাবে। ফলে সাংবিধানিকভাবে ভারত রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলেও তার কাঠামো উপকাঠামোতে বড় ছোঁয়াচে ধর্মের আবেগ লেগেইছিল, যার পরিণতি আজ ভয়ঙ্কর আকারে দেখা দিয়েছে। নেতাজির ভাবাদর্শ এবং ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাভাবনা যদি বাস্তবে রূপায়িত হত তাহলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প হয়তো রাষ্ট্রের শিরা-উপশিরা থেকে মুছে গেলেও যেতে পারত।
কবিগুরু যথার্থই বলেছেন “যে দেশে প্রধানত ধর্মের মিলেই মানুষকে মেলায়, অন্য কোনো বাঁধনে তাকে বাঁধতে পারে না, সে দেশ হতভাগ্য।“ সুভাষ চন্দ্রের ভাবনাও ছিল একই। তিনি ধর্ম দিয়ে নয় ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ (যেমন অর্থনৈতিক সমস্যা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ,দারিদ্র, বিজ্ঞানমনস্কতা, সামাজিক সচেতনতা প্রভৃতি) দিয়ে ভারতবাসীকে এক নতুন চিন্তাভাবনার আলোকে বাঁধতে চেয়েছিলেন। স্বভাবতই সেকুলার গণতন্ত্রের যে ধারণা সুভাষচন্দ্র এ দেশে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তৎকালীন জাতির পিতা গান্ধীজি সহ বাকি কংগ্রেস নেতারা তার চর্চা করলেন না । ফলে ধর্ম-বর্ণ-জাতি প্রভৃতি বিভেদকামী উপাদানের সঙ্গে আপোষ করে ভারত স্বাধীন হয়েছিল এবং অখন্ড ভারত আর থাকেনি তা দু টুকরো হয়ে ভারত ও পাকিস্তান হয়ে গেছিল। ফলে স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রকৃত সেক্যুলারিজমের চর্চা হয়নি।একদিকে হিন্দু মহাসভা অন্যদিকে মুসলিম লীগ এই দুই প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রভাবে দেশ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল এবং সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের জীবনের এবং সম্পত্তির ক্ষতি হলো।সাম্প্রদায়িক হানাহানি শোষিত মানুষের ঐক্য ধ্বংস করে। এই ধ্বংসের বীজ ভারতীয় রাষ্ট্রের কাঠামো থেকে বিনষ্ট করা হয়নি। তৎকালীন আপসকামী ও বুর্জোয়া মানসিকতার রাষ্ট্রীয় নেতারা ধর্মকে জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ প্রচারের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করলেন৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামের কর্মসূচির মধ্যে সামাজিক বিপ্লব ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কর্মসূচিকে মেলাতে সক্ষম হলেন না৷ এর ফলে তাঁরা মানবতাবাদী আদর্শের ভিত্তিতে এক ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে দেশবাসীকে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলেন৷ ফলে দেশের জনসাধারণ বিচ্ছিন্ন ও আলাদা আলাদা কমিউনিটি হিসাবেই থেকে গেল৷ ফলে নেতাজির ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তৈরীর ভাবধারা অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে গেল, বলা ভালো নষ্ট করা হলো।
আজ সেই প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক বুর্জোয়া শক্তি কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার পুষ্টিতে পুষ্ট হয়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসীন। স্বাভাবিকভাবেই তারা যে সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শে দীক্ষিত হয়েছে সেই দর্শনই তারা প্রচার করবে, সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি দিয়ে মানুষের ঐক্যকে বিনষ্ট করে ভারতবর্ষের চিরাচরিত সম্প্রীতি ও সহবাস্থানের ধারাকে ভেঙে চুরমার করে দেবে এটাই স্বাভাবিক। নেতাজির জন্মদিন আবার সুযোগ সন্ধানী সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট স্বার্থপর কতিপয় রাজনীতির কারবারিরা নেতাজিকে তাদের দলে টানার চেষ্টা করবেন। তারা দেখাবেন তারা নেতাজিকে কত শ্রদ্ধা করেন। সত্যিই শ্রদ্ধা করেন, নেতাজির স্বপ্নকে এবং তার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে।
তবুও সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি নেতাজির নামের সঙ্গে একটা জাদু লুকিয়ে আছে যা আজও আসমুদ্রহিমাচল থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত প্রত্যেকটি ভারতবাসীর মনে শিহরন জাগায় , প্রকৃত দেশপ্রেমের শিহরন ।নেতাজির আদর্শের গান, দেশ প্রেমের বাণী এবং ধর্মনিরপেক্ষতার সুর ধ্বনিত হোক প্রত্যেক ভারতবাসীর অন্তক। তাহলেই আজকের পিয়াজি দ্বেষপ্রেমিকদের হাত থেকে আমাদের এই জন্মভূমিকে বাঁচানো যাবে এবং সবার এই দেশ আবারো মানবতার সাগরতীরে পরিণত হবে।
তাঁর ১২৫ তম জন্মদিনে দেশবাসী তোমার মানবতাবাদী এবং ধর্ম নিরপেক্ষ চিন্তাধারায় প্রভাবিত হোক। তোমাকে জানাই দেশপ্রেমীয় শ্রদ্ধা।