অনেক ব্যস্ততার মাঝে অবশেষে শিয়ালদা রেল স্টেশনে এসে পৌঁছালাম। সেখান থেকে বিকেল ৪ টা ৪০-এর লালগোলা ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ট্রেনে উঠে বসলাম। গন্তব্য পলাশী।সেখান থেকে মাইল সাতেক দূরে ধীরগতিতে বয়ে চলেছে বৃদ্ধা গঙ্গা নদী। নদীর ওপারে রয়েছে সেহরিল নামক একটি ছোট্ট গ্রাম । সেহরিলেই কেটেছে আমার বাল্যকাল । আমার বাল্যকালের সব থেকে কাছের বন্ধু হল আমার দাদু। সারাদিন দুজনে একসঙ্গে অনেক আড্ডা দিতাম। আর সব থেকে মজার বিষয় হল,আমি দাদুকে দাদু বলে কম ডাকতাম।তার নাম ধরে বেশি ডাকতাম। সেই অভ্যাসটা এখনো ছাড়তে পারিনি । বাড়ির অন্যরা এই বিষয়ে আপত্তি করলেও দাদু বেশ খুশি হতেনই।
দাদুর শরীরটা একটু ভেঙ্গে পড়ায় শহর ছেড়ে গ্রামে আসতে হচ্ছে। অতঃপর উপায় নেই স্যুটকেশ হাতে বেরিয়ে পড়লাম গ্রামের উদ্দেশ্যে।অবশ্য গ্রামের হাওয়া আমার বেশ ভালই লাগে। গ্রামের কথা মনে পড়তেই পুরনো স্মৃতিগুলো বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে ।গ্রামের মাঠঘাট, বাল্যকালের কিছু বন্ধু, কিছু ভুতুড়ে জায়গা, আম বাগান, নদীর তীরে দমকা হাওয়া,সাথে হলুদ সরষে ফুল, মটরশুঁটি, ধনেপাতার গন্ধে ম-ম করা নদীর পাড়ে বসে বন্ধুদের সঙ্গে অনেক আড্ডা।
অবশেষে ট্রেন থেকে নামলাম।ঘড়িতে তখন বাজে ৭ টা ৫৭। সেখান থেকে টোটো গাড়ি করে নদীর পাড়ে পৌঁছালাম। অনেক হাঁক ডাকের পর মাঝি সাহেব নৌকা নিয়ে এলেন । নদী পেরোতে বেশ বেগ পেতে হল। বেশি রাত হলে আবার কোনো বাহন মেলে না।অজ পাড়াগাঁয়ের এই আরেক ভয় । নদীর ঘাট থেকে লাল-মোরামের রাস্তা ধরে মাইল তিনেক যেতে হবে। প্রথম এক মাইল পড়বে কুসুন্দির বাগান।শোনা যায় সেখানে নাকি ছিনতাইবাজ ছাড়াও বিভিন্ন অপদেবতার বাস । যদিও ঘটনার সত্যতা কেউ কখনো যাচাই করেনি।
মাঝিকে ভাড়া মিটিয়ে কিছুদূর হাঁটতেই বিপ্লবদার চায়ের দোকানের টিমটিম করা আলোয় বাল্যকালের বন্ধু নাফিরুলের মুখটা আবিষ্কার করলাম। তার হাতে পাঁচ ব্যাটারির একটা জোরালো টর্চ আর তার বাহন সবুজ সাইকেলটা। চায়ে গলা ভিজিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।গল্প করতে করতে কখন যে বাড়ির গেটের সামনে চলে এসেছি, বুঝতেই পারিনি। আমাকে নামিয়ে নাফিরুল বাড়ি চলে গেল। বাড়ির গেট খুলতেই দাদু হাঁক দিলেন “কে হিরু” ! আমার নাম হীরা।শুধু মাত্র দাদু আমাকে ছোটো থেকেই হিরু বলে ডাকেন। উত্তরে বললাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ দাদু।” তারপর দাদুর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করে দাদুকে ঔষধ খাইয়ে আমি উপরে শোবার ঘরে চলে এলাম।
কিছুদিন পর ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা।নিম্নচাপের দিন। সকাল থেকে ভারী বৃষ্টিপাত, তার সঙ্গে জোরালো ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। সারাদিন সূর্যি মামার দেখা মেলেনি। দুপুরে বৃষ্টি একটু থামলেও এখন আকাশে আবার বাদলা করেছে । মনে হয় আবার মুষলধারে বৃষ্টি নামবে। তখনই মেজ কাকার আগমন। আমি কিছুটা আন্দাজ করলাম, তিনি কিছু দেখে ভয় পেয়েছেন বললে ভুল হবে না।অবাকও বলতে পারেন। তার পায়ে কাদা আর হাতে একটা লম্বা কালো ছাতা দেখে বুঝলাম তিনি মাঠে গিয়েছিলেন। গ্রামের মানুষ কাকা।নতুন চাষ জমিতে না গেলে তার যেন ঠিকমতো খাবার হজম হয় না । আমি লক্ষ্য করলাম এই বৃষ্টির ঠান্ডা দিনেও তার কপাল দিয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম ফোঁটা হয়ে কপালের দুপাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ার উপক্রম।
আমি কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই তিনি বললেন – আজ দুপুরে চাষ জমি থেকে কিছু আগাছা তুলে জমির আল উদ্দেশ্য করে ছোঁড়ার সময় একটি বিচিত্র প্রাণীর সম্মুখীন হই। দেখে হিংস্র প্রাণী মনে হল কারণ একটি হিংস্র প্রাণীর যতরকম বৈশিষ্ট্য থাকে সেগুলি সেই অবয়বের মধ্যে বর্তমান। সেটির উচ্চতা প্রায় ৩ ফুট মত হবে। কুকুরের থেকে বড় কিন্তু বাঘের চেয়ে কিছুটা ছোট হবে। সারা গায়ে ছোট ছোট খয়েরি লোম ছাড়া আর কোন রঙের ছিঁটেফোঁটাও নেই। সামনের উপর নিচ দুই পাটিতে দুটো করে চারটি হিংস্র বড় বড় দাঁত, আর লোমহীন লেজ।
কিছুদিন পর পরিবেশ তার স্বরূপে ফিরে আসে। বিষয়টা আমিও প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। একদিন সন্ধ্যাবেলায় চপ আর বেগুনি নিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হায়দার চাচার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তখন মেঘেন্দ্র বলে উঠলো, জানিস কাল রাতে কী হয়েছে ? আমরা সমবেত কন্ঠে বলে উঠলুম,কী হয়েছে? মেঘেন্দ্রের কথা শুনে আমার পুরনো স্মৃতিটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। সে বলে উঠল, কাল রাতে পাশের বাড়ির এক কাকিমা, দরজার সামনে বসে তার ছোট ছেলেকে সোহাগ করছিল। হঠাৎ- ই তার চোখ যায় বাড়ির উঠানের দিকে। সেখানে বসে আছে এক অচেনা প্রাণী।চাঁদের আলোয় প্রাণীটিকে দেখা না গেলেও বোঝা যায় এটি কোনো পূর্ব পরিচিত জীব নয়।আত্মরক্ষার তাগিদে, হাতের কাছে থাকা বোটিটা ছুঁড়ে মারল। তৎক্ষণাৎ বোটিটা প্রাণীটিকে ভেদ করে পিছনের প্রাচীরে গিয়ে লাগলো ।
মেঘেন্দ্র আরো বলে, গত দু দিন আগের রাতে। মাঠ থেকে ভেসে আসছিল এক অপরিচিত প্রাণীর প্রবল আর্তনাদ। যেন প্রাণীটা কিছু বলতে চায়। আর্তনাদ শুনে ঘুম আসছিল না। তাই পাশের ঘরে থাকা কাজল ও বিজলের কাছে চলে যাই। তারা বলল, কী হয়েছে? আমি বললাম, তোরা চিৎকার শুনিস নি ! তারা বলল, কোন চিৎকার। আমি বললাম, কিছু শুনিস নি, চল এবার শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়েছে।
কাজল ও বিজল আমার মাসির ছেলে । আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। একজন ক্লাস এইটে পড়ে আর একজন ক্লাস ইলেভেনে।
পরদিন সকালে সবার মুখে মুখে গত রাতের হাড় হিম করা চিৎকারের কথা । অনেক দূর পর্যন্ত শোনা গেছে চিৎকারটা।
প্রায় কয়েক মাস কেটে গেল। পরিপক্ক ফসল কেটে চৈতালি ফসল লাগানোর তোড়জোড় শুরু করেছে চাষিরা । দেখতে দেখতে চৈতালি যেন সারা মাঠ দখল করে নিয়েছে। সারা মাঠ জুড়ে হলুদ সরষে ফুল, মোটর শুটির নীল-সাদা ফুল, ধনে ক্ষেতের মন মাতানো গন্ধ, তরতাজা পালং শাক, পেঁয়াজের কচি কলি, গাজর , মুলো, লাল আলু আরো কত কী। সব মিলিয়ে এক মায়াবী পরিবেশ। তখনই চরের মাঠে আগমন অপূর্ব সুন্দর একটি শ্বেতাঙ্গ হরিণের। সেটিকে নাকি গ্রামের প্রায় মানুষই দেখেছে কিছুক্ষণের জন্য। তার লাফ নাকি সাংঘাতিক! চোখের পলকে এক লাফে যেন সে উধাও হয়ে যায়। যথারীতি গ্রামে শোরগোল পড়ে গেল শ্বেতাঙ্গ হরিণ দর্শনের। কিন্তু সবাই হরিণটির দর্শন পায় না।
আজ গ্রামের একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা মারা যান। তার জানাজা সেরে ফেরার পথে কিছু মানুষের সঙ্গে হরিণটির সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তাদের কথা শুনে এখন আমার মনে হচ্ছে, হরিণটি সত্যিই অনেক দ্রুতগামী। কারণ দুইজন ব্যক্তি একই সময়ে হরিণটিকে দেখেছে মাঠের দুটি আলাদা আলাদা জায়গায়। জায়গা দুটির দূরত্ব প্রায় সাড়ে চার মাইল।কিন্তু সময়ের ব্যবধান এক মিনিটও নয়। বনদপ্তরে খবর দেওয়া হয়েছে।
কিছুদিন পর গ্রামে নেমে এলো শোকের ছায়া। গ্রামের ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা নাকি হরিণ দেখতে গিয়ে আর ঘরে ফেরেনি । এই চার দিনে নয় জন বাচ্চা উধাও। প্রশাসন এবং গ্রামের মানুষ সারা মাঠে চিরুনি তল্লাশি চালিয়েও কোন ফল পাইনি। প্রতিদিন প্রায় কেউ না কেউ উধাও হচ্ছে। দিন দিন পরিস্থিতি আরো জটিল হচ্ছে। গ্রামের শান্তি ভঙ্গ হয়েছে। সিভিক ভলেন্টিয়ার এবং বনদপ্তরের লোকে মাঠটিকে চার দিক থেকে ঘিরে কড়া পাহারা দিচ্ছে। গ্রামে মাইকে করে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে কেউ যেন মাঠের দিকে না যায়। জায়গায় জায়গায় সাইনবোর্ড বসানো হয়েছে। এবার চাষীদের মাথায় হাত । মাঠে না গেলে, চাষ না করলে, তারা সমেত তাদের বউ বাচ্চারা যে না খেতে পেয়ে অনাহারে মরবে!
আজ তিনজন সিভিক ভলেন্টিয়ার নাকি নিখোঁজ ।তাদের মধ্যে একজন আমাদের গ্রামের নবারুণ চাষীর ছোট ছেলে।
গ্রামের মানুষ অসহায় হয়ে যে যার ইষ্ট দেবতার কাছে প্রার্থনা করছে,যাতে এই অভিশাপ দূর হয়ে যায়। চলছে বিভিন্ন প্রকার জাগ-যজ্ঞ, তন্ত্র-মন্ত্র, পূজা-অর্চনা। অন্যদিকে মুসলিম পাড়া গুলিতে জলসা, দোয়ার মজলিস, আরো চলছে নানান জিন পরীর কার্যকলাপ। কিছুতেই কিছু হয় না।
গোটা গ্রাম যখন নিকষ কালো অন্ধকারে। তখনই গ্রামবাসীদের আলোর দিশা হয়ে এগিয়ে এলো হায়দার চাচা। যার নাম আপনারা আগেই শুনেছেন ।তিনার আছে এক অলৌকিক অদৃশ্য ক্ষমতা। যার জন্য তিনি সকলের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। খুবই শান্ত স্বভাবের মানুষ তিনি। সাদামাটা লোক।দেখে সেরকম বিশেষ কিছু বলে মনে হয় না। তিনি বললেন, আমি এই বিপদের কারণ সম্পর্কে অল্প বিস্তর জানি। কিন্তু এই অভিশাপের ব্যাপারে বিশদে জানতে আমাকে একটি বিশেষ ধরনের সাধনা করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন ১১ টি সাদা বিড়ালের লোম, বাঘের দাঁত, শুসুকের লেজের পাখনা, দুই মাসের বাচ্চার চোখের জল, জায়নামাজ আর গঙ্গাজল। সাধনাটি হবে গঙ্গা নদীর তীরে বিকেল ৪ টা ২৫ ।
যথারীতি সমস্ত আয়োজন হল। নদীর পাড়ে মানুষে ছেয়ে গেছে। যেন এক বিরাট মেলা বসেছে। হায়দার চাচা সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, এই পাত্রে রাখা গঙ্গাজল আমি পড়ে দিয়েছি। এই জল দিয়ে তোমরা তোমাদের চারদিকে একটি গণ্ডি কাটো। খবরদার কেউ গণ্ডি ছেড়ে বের হবে না।
সাধনা শুরু হয়ে গেছে। গ্রাম বাসীরা দূরের একটি উঁচু টিলা থেকে হায়দার চাচার সাধনা দেখছে। কিছুক্ষণ ধরে বিড়বিড় করে, থলে থেকে কি যেন একটা বের করে নদীতে ছুঁড়ে মারল। কিছুক্ষণ পর নদীর বিশেষ একটি জায়গায় জলের বড় বড় বুদবুদ সৃষ্টি হল। তারপর যা ঘটল তার জন্য আমরা কেউই মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। নদী থেকে উঠে এলো এক অতিকায় বিশাল হাতির মতো চেহারার বীভৎস প্রাণী । তার মাথাটা কুমিরের মত, করাতের মত ধারালো বড় বড় দাঁত, পায়ের বদলে বড় বড় পাখনা, লেজটা মাছের মত। এইসব দেখে পাড়ার প্রধান পুরোহিত মশাই হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে জয়ধ্বনির সুরে বলে উঠলো, মকর। মকর হল মা গঙ্গার বাহন। যুগ যুগ ধরে নিরবে গঙ্গাকে রক্ষা করে চলেছে মকর। যখন গঙ্গাকে অপবিত্র বা ক্ষতি করার চেষ্টা করা হয়েছে, তখনই মকরের অবতার হয়েছে।
মকর জল থেকে উঠে এক পা, এক পা করে সামনে আসতে লাগলো। তখনই যেন কোন মায়াবী বাঁধনে জড়িয়ে গেল তার পাখনা গুলো। হায়দার চাচা তার থেকে কুড়ি হাত দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তিনি মকরের চোখের দিকে তাকিয়ে কোন এক অদৃশ্য ভাষায় নিঃশব্দে কথা বলে চলেছে। গ্রাম বাসিরা বিস্ফারিত চোখে তাদের দূর থেকে দেখছে । মকরকে দেখে মনে হচ্ছে সে এই কথোপথনে মোটেই খুশি নয়। সে জোরে জোরে লেজ ও পাখনা নেড়ে মায়াবী বাঁধন থেকে মুক্তির চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা প্রকান্ড আওয়াজ করে মায়াবী বাঁধন কেটে যায়। তারপর হায়দার চাচার দিকে এক পা, এক পা করে এগোতে থাকে মকর। মকর যখন প্রায় হায়দার চাচাকে ছুঁই ছুঁই,তখনই হায়দার চাচা তার পিছনের ডান হাতে রাখা। সাদা বালিতে জোরে জোরে পবিত্র কোরআন শরীফের একটি সূরা পড়ে, বালিতে তিনবার ফুঁ দিয়ে সেই বালি নিক্ষেপ করল মকরের দিকে। সেই বালির ছোঁয়ায় সঙ্গে সঙ্গে মকর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর মুখটা রাগান্বিত করে চাচার উদ্যেশ্যে অজানা ভাষায় কী যেন বলতে থাকে।বলা শেষ হলে কারো কোনো ক্ষতি না করে সে আবার গঙ্গার জলে নেমে যায়।
গ্রামবাসীরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে অবাক দৃষ্টিতে হায়দার চাচাকে দেখছে। তখনই মোড়ল মশাই হায়দার চাচাকে প্রশ্ন করল। আমরা তো গঙ্গাকে অপবিত্র করিনি বা তার কোনো ক্ষতি করিনি । তাহলে মকর কেন এলো ? একটি কাঠের গুঁড়ির উপর হায়দার চাচা বসলো এবং উচ্চঃস্বরে বলল, শোনো তবে – এই সব কিছুর জন্য দায়ী তোমরা নিজেরাই। তোমরা সব কিছু জেনে, না জেনে, সেই ভুল এখনো করে চলেছ। তোমাদের বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছে প্রকৃতি মা গঙ্গার কাছে। তোমরা খেয়াল করেছো, যখন ফসল বপন করা হয়, তার কয়েক মাসের মধ্যে কোনো না কোনো অদ্ভুত কান্ড ঘটেছে। যার কোন নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা হয় না। ফসল নালিশ করেছে, তার স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতার থেকে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে কয়েকগুণ বেশি ফসল উৎপাদন করানো হচ্ছে। এতে তার ব্যথা লাগে, কষ্ট হয়, তার বিশুদ্ধতা হারায়, স্বাদও পুষ্টিচ্যুত হয়।
ভিড়ের ভেতর থেকে একজন বলে উঠলো, ভুল তো আমরা করেছি কিন্তু তার শাস্তি আমাদের ছেলে মেয়েদের কেন দেওয়া হল ? হায়দার চাচা মুচকি হেসে বলল-“সে জানে কোথায় আঘাত করলে বেশি ব্যথা লাগে”। তোমাদের মোবাইল টাওয়ার থেকে উৎপন্ন রেডিয়েশনের কারণে যেভাবে ছোট ছোট পাখির ঝাঁক দিকভ্রষ্ট হয় । নিজের বাসা হারায় এবং শিকারিদের কবলে পড়ে। ঠিক তেমনি তোমাদের বাচ্চারা পথভ্রষ্ট হয়েছে, ওই ছোট্ট পাখিগুলোর মত।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আপনজনদের হারানোর কতটা জ্বালা। কিন্তু চিন্তার কোন কারণ নেই, তিনি ক্ষমাশীল। যেভাবে তিনি ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছিলেন। তেমনি ছয় দিনে তোমাদের পথভ্রষ্ট হওয়া পৃথিবী ফিরিয়ে দেবেন। হায়দার চাচা এবার গম্ভীর ভাবে বলে উঠলো, একটা কথা মনে রেখো। তিনার অভিশাপ এখনো রয়ে গেছে । তোমরা যদি আবার, নির্দ্বিধায় ওইসব অপকর্ম করে চলো। তাহলে এর ফল ভোগ করবে তোমাদের পরবর্তী প্রজন্ম। তারা মানসিক এবং শারীরিকভাবে অনেক দুর্বল হবে। তাদেরকে মোকাবেলা করতে হবে অপরিচিত রোগব্যাধীর সঙ্গে এবং বিভিন্ন প্রকার ভয়ঙ্কর প্রকৃতির তাণ্ডবের সঙ্গে, যেগুলির জন্য তারা মোটেই প্রস্তুত থাকবেনা।
আজ সন্ধ্যায় আবার চপ মুড়ি আর বেগুনি সাথে নিয়ে আড্ডা হচ্ছিল । তখন আমি বললাম, আচ্ছা হায়দার চাচা, সেই দিন রাতের অদ্ভুত প্রাণীটার আওয়াজ সারা পাড়ার লোকে শুনলেও মেঘেন্দ্রের মাসির ছেলেরা, মানে কাজল ও বিজল শুনতে পায়নি কেন? আর তুমি বা কী করে বুঝলে যে প্রাণীটা কোন সাধারণ প্রাণী নয়?
হায়দার চাচা বলল, এটা খুব সাধারন ব্যাপার। প্রথমতঃ ছেলে দুটো গ্রামের না। আর ওই অপকর্মের তাদের কোন প্রকার মদদ ছিল না। আর ওই প্রাণীটি অলৌকিক তা বুঝেছিলাম মেঘেন্দ্রের কথা শুনে। পাশের বাড়ির কাকিমা যখন বটিটা ছুড়ে মারল। তখন সেটা প্রানীটিকে ভেদ করে পিছনের দেয়ালে গিয়ে লাগলো। প্রাণীটিকে আঘাত করে নয়। বুঝলি হিরু প্রকৃতির ধ্বংস ও সৃষ্টি প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কারো নেই।
হ্যাঁ আপনারা ঠিকই ধরেছেন “হায়দার চাচা” নামে দাদু বিশেষভাবে সবার কাছে পরিচিত।
আড্ডার শেষে হায়দার চাচা আরো একটি কথা বলে গেলেন, গঙ্গা নদীর তীরে এমন অনেক গ্রামই আছে। আমি শুধু এই সেহরিলকে বাঁচালাম। বাকি গ্রামগুলিকে সতর্ক করার দায়িত্ব তোমাদের।