২০১৬ সন থেকে অসমের বাতাস অবৈধ বিদেশির নামে উস্কানি, সাম্প্রদায়িকতা এবং বলপূর্বক উচ্ছেদ এই তিন রকমের বিষবাষ্পে আক্রান্ত। এনআরসি আপডেট করার কাজটা অর্ধসমাপ্ত রেখেই নানারকম সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক মন্তব্য করে ভাষিক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরকে কোণঠাসা করার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে শুরু হয় উচ্ছেদ। ২০২১ সনের সেপ্টেম্বর মাসে ধলপুরে প্রায় ২০০ পরিবারকে বলপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়। সেই উচ্ছেদের বিরোধিতা করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মইনুল হক। এরপর থেকে কয়েক মাস অন্তর অন্তর কোথাও না কোথাও উচ্ছেদ হয়। ১৭ জুলাই গোয়ালপাড়া জেলারই আরেকটি উচ্ছেদস্থল পাইকানে শুকুর আলী নামে ১৯ বছেরর আরেক যুবক পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এই ক্রমেই এবছর জুলাই মাসে ধুবড়ি জেলার কয়েকটি জায়গা মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে একটি স্থানের বিষদ বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করা হলো।
সন্তোষপুর উচ্ছেদ:
জুলাই মাসের ৯ তারিখে ধুবড়িতে তিনটি গ্রামে বলপূর্বক উচ্ছেদ চালানো হয়। এই তিনটি স্থান হলো চিরাকুটা ১ম খণ্ড, চিরাকুটা ২ খণ্ড এবং সন্তোষপুর। সন্তোষপুর- ধুবড়ি জেলার চাপর থানার অন্তর্গত একটি গ্রাম, প্ৰায় ৩৫০ পরিবারের বসতি ছিল। স্থানীয় লোকের মতে, তাদের মধ্যে প্রায় ২oo পরিবার বঙ্গ-মূলীয় মিঞা মুসলমান লোক বসবাস করত, তারা সবাই বর্তমান উচ্ছেদের স্বীকার। এই ভূমি বর্তমান অসম সরকারের কোম্পানি এপিডিসিএল-এর নামে বরাদ্দ। স্থানীয়রা আরো জানায়, সেখানে তিন ধরনের মাটির মালিকানা প্রচলিত ছিল। ১৯৬২ সনে সরকারের দেওয়া allotment বা আবন্টনপত্র ছিল। ২০০৫ সনে পুনরায় কিছু লোকজনকে আবন্টন দেওয়া হয়। এমনকি ২০২১-২০২২ সালে কিছু লোককে সরকারের পক্ষ থেকে পাট্টাও দেওয়া হয়। তার ভিতর ১৯৬২-তে দেওয়া allotment এখনও পাট্টা হয়নি। এসব থাকা সত্ত্বেও মাত্র ২০/৩০ ঘর লোককে ছেড়ে বাকিদের উচ্ছেদ করা হয়।
উচ্ছেদ পরবর্তী অবস্থা:
স্থানীয়দের মুখে জানা যায়, তাদের গ্রামে থাকা প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। শিক্ষকদেরকে অন্য জায়গায় বদলি করে দেওয়া হয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া হয়েছে। উচ্ছেদের সময় থেকেই গ্রামে বিদ্যুৎসংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। তাদের গ্রামে থাকা সরকারি চারলাইনের রাস্তা বন্ধ করার আদেশ দিয়েছেন জেলা-উপায়ুক্ত। সেখানকার লোকেরা যাতে জল পান করতে কিংবা অন্য কাজে ব্যবহার করতে না বা খেতে না পারে তার জন্য গ্রামে থাকা সমস্ত জলের কুয়া এবং অনান্য জলের ব্যবস্থাও বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ-প্রশাসন। এমনকি এই প্রচন্ড গরমে রাতে বাচ্চা-কাচ্চাসহ পরিবার নিয়ে আশ্রয় নেওয়ার জন্য তারা যে তিরপলের ছাদের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেটাও কেটে দেওয়া হয়, যাতে লোকেরা ওখানে থাকতে না পারে। তাদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র থালা-বাসনগুলো পর্যন্ত ফেলা হয়। তারা বর্তমানে উচ্ছেদ হওয়া স্থানের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে অস্থায়ী ভাবে পরিবারের সাথে বিপদসংকুল জীবন যাপন করছেন। তারা কোনও মানবিক সাহায্য পাচ্ছেন না। তাদের মধ্যে অসুস্থ, বৃদ্ধ, গর্ভবতী মহিলা, বাচ্চা, বুড়ো, সবাই রয়েছেন। স্থানীয়রা আরো জানান, বাইরে থেকে কোনও বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের আগমনের কথা শুনলে তাদের গ্রামের একমাত্র চলাচলের রাস্তা পুলিশ বেরিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেয়।
প্রশ্ন ও ভবিষ্যৎ:
সন্তোষপুরের এই উচ্ছেদ শুধু একটি গ্রামের বঞ্চনার গল্প নয়, এটি প্রশ্ন তোলে মানবাধিকার, সরকারি নীতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে। কেন একটি গ্রামের মানুষকে তাদের জমি, ঘর, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মৌলিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হলো? এপিডিসিএল-এর জন্য জমি বরাদ্দের নামে কি এই মানুষদের জীবন ধ্বংস করা ন্যায়সঙ্গত? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের সবাইকে। সন্তোষপুরের মানুষ এখনও আশা করছে, তাদের কণ্ঠস্বর কেউ শুনবে। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত তারা অস্থায়ী ত্রিপলের নীচে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি! এই গল্প শুধু সন্তোষপুরের নয়, এটি আমাদের সবার।
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)