আকাশকুসুম

বিছানায় শুয়ে উসখুস করছিলেন নাফিস সাহেব। ফজরের আজান শুনে ভাবলেন, এ ভালোই হল। রাতজুড়ে এলোপাথাড়ি চিন্তায় ঘুম আসেনি। এই বয়সকালে ঘুমও অনিয়মিত হয়ে গেছে। একা বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে নানা কথা মনে আসতে থাকে তাঁর। ছোটবেলার মানুষজনেদের কথা, যাঁদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। বেঁচে থাকতেই তাঁদের কেউ কেউ চলে গেছিলেন সীমান্ত পেরিয়ে। মোবাইল ল্যাপটপের পর্দায় আন্তর্জালিক জগতে তাঁদের কারো কারো ছেলেমেয়ে বা নাতিনাতনিদের সাথে যোগসুত্র আছে বটে। কিন্তু ওই বয়সের কজনই বা তাঁর মতো বয়স্ক মানুষকে সময় দেবে?

শুধু কি ছেলেবেলা? যৌবনের বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ সে উত্তরের নকশালবাড়িই হোক বা পূর্বের কালুরঘাট, কলকাতা কিম্বা ঢাকা, তাঁরমতো যাঁদের পরিবারের লোকজন সীমানার দুই পারেই আছেন তাঁদের সব ঘটনাই ছাপ ফেলে যায়। তবে নাফিস সাহেব ছিলেন যাকে বলে সাবধানী মানুষ। এসব বিপ্লবী রোম্যান্টিসিজমে গা ভাসান নি। পরিচিত অনেকেই ছিলেন, এমনকি তাঁর মত গ্রাম থেকে আসা সদ্য তরুণরাও বাদ ছিলেন না। তিনি যান নি তাতে।

কলেজজীবন শেষ করে উচ্চতর ডিগ্রি হাসিল করে একটা অধ্যাপনার চাকরিও বাগিয়ে নিয়েছিলেন। দুর্নীতি, অন্যায্য সুবিধা নেওয়াই হোক বা পরোপকার কোন সুনাম বা দুর্নামই তাঁকে দেওয়া চলেনা। তবে পদোন্নতির জন্য যুগধর্ম মেনে যা করতে হত নাফিস সাহেব তার মধ্যে কোন ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত রেখে যান নি।

অধ্যক্ষ হওয়ার পরে যাঁরা ভেবেছিল তাঁর নির্বিবাদী চরিত্রের সুযোগ নেবে তাঁদের বড়ই হতাশ করেছেন। তারাও চোরাগোপ্তা অনেক কিছুই করার চেষ্টা করেছিল, উপরমহলকে জড়ানোর চেষ্টাও কম হয়নি। তাতে বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। তার মধ্যেই ছেলেমেয়েদের পড়িয়েছেন, ছেলেদের চাকরি ও মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। একজন দুজন নয়, পাঁচ-পাঁচজন। যা তাঁর সময়ের ও সামাজিক পরিসরের নিরীখে ব্যতিক্রম। ছেলেমেয়েদের যখনই সন্তান হয়েছে বা অন্য প্রয়োজন পড়েছে তারা এসে তাদের মাকে নিয়ে গেলেও নাফিস সাহেব বিশেষ যান নি। গেলেও থাকেন নি। তাই নাফিস সাহেব আজ একা।

একাকীত্ব যে খারাপ লাগে তা নয়। কিন্তু একাকীত্ব একটা বোঝা, তবে অপ্রিয় সঙ্গের থেকে একাকীত্ব ভালো। মনে পড়ে, এর সবকিছুই মনে পড়ে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে, পথে যেতে যেতে সবই মনে পড়ে।

অবসরের পর নাফিস সাহেব একেবারে কর্মহীন হয়ে যান নি। পাড়ার মসজিদের কমিটিতে ঢুকেছেন। সামাজিক প্রতিপত্তির জোরে চেয়ারম্যানও হয়েছেন। কোনও কোনও জুম্মায় খুতবার আগে ভাষণও দিয়ে দেন। চাকরি জীবনে দাড়ি না রাখলেও এখন তাঁর গাল শ্মশ্রুশোভিত।

না, এতটাও মসৃণ চলছে না সব কিছু। কোন প্রতিষ্ঠান থাকলে তার কর্মকান্ড থাকবে। আর থাকবে তাকে ঘিরে লাভ লোকসান। আর এইসব সামলানো জোয়ান বয়সে যত সহজ হয়, বয়সকালে ততটা নয়। এই তো কিছু বছর আগে যখন তিনি সদ্য অবসর নিয়েছেন তখন কমিটির বেশ কিছু তালেবর সদস্যের সাথে রীতিমতো ঝগড়া করেই তিনি মসজিদকে মার্বেল বসানোর বদলে সাদামাঠাভাবেই দোতলা করালেন। তাতে প্রভাবশালী টাইলস ব্যবসায়ী সদস্যের কিছু কামিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ঝাড় খেলেও মসজিদে লোকসংখ্যা বেড়েছে, তাই দোতলা কাজে লেগে যাওয়াই এনিয়ে বেশি কথা ওঠে নি। বিরোধী সদস্যদের ব্যাপারটা হজম করে যেতে হয়।

তেমনি মসজিদে এসি বসানোর বদলে লাইব্রেরী করা, ইমাম রাখা, মিনার বানানো এসবের অনেক কিছু নিয়েই পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। আগেকার মানুষেরাও আর নেই। কেউ মারা গেছেন, কেউ আগের মত কর্মঠও নন। ফলে নাফিস সাহেবের প্রতাপও আর আগের মতো নেই। সম্মান নিয়ে সরে যাওয়াই ভালো, এরকমও ভেবে রেখেছেন। পথে আসতে আসতে এসবই ভাবছিলেন তিনি।

ওজুর সময় জলের এত সরু ধারা দেখে চমকে গেলেন তিনি। হাঁক পাড়লেন খাদেমকে।

“জল শেষ কেন? মোটর চালাও নি?”

“চালিয়েছিলাম সাহেব। অন্য দিন যেরকম চালাই।”

খোঁজ নিয়ে দেখা গেল পাইপে ছোট ফুটো, আর তা দিয়েই জল বেরিয়ে যাচ্ছে। মনটা খিঁচড়ে গেল নাফিস সাহেবের। নাহ, আর পারা যায় না। ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে গিয়েই থমকে গেলেন নাফিস সাহেব। পাইপের জল ঝিরিঝিরি ধারায় বেরিয়ে গিয়ে পাশের বাড়ির এক দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে। আর সেখানেই গজিয়েছে একটা ছোট্ট আগাছা। যাতে ফুটে আছে নীল নীল ছোট্ট ছোট্ট ফুল। মনটা একেবারেই ভালো হয়ে গেল নাফিস সাহেবের।

মসজিদের দায়িত্ব এবার ছেড়েই দেবেন। আর এই বুনো ফুলের আগাছাকে নিয়ে গিয়ে টবে পুঁতে রাখবেন। যদি বেঁচে যায় তবে এই ফুলগুলোই হয়ে থাকবে এতদিনের স্মৃতি হয়ে।

ঘুরে খাদেমের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা, এটাকে সারিয়ে নেবো। আর একটা জরুরি কমিটির মিটিং ডাকবো।“

You may also like