চাঁদের পাহাড়

দিগরডিহির ঢিবিতে সন্ধ্যার অন্ধকারে একটা আলো ঘুরছে বনবন বনবন করে৷ আলো নয়, আগুন৷ বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে আগুনের শিখাটি ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে একসময় থেমে গেল৷ এখন মাটির উপর জ্বলছে ওটা৷ আগুনের শিখায় দূর থেকে একটি মুখ দেখা যাচ্ছে৷ কালো লাবণ্যময়ী কিশোরী মুখ৷ বিন্তি শবরির মুখ৷

লখাই ওপর থেকে পাহাড়ি পথ বেয়ে নীচে নেমে আসছে আগুনটাকে লক্ষ্য করে৷ পরনে হাফ প্যান্ট আর একটা ছেঁড়া লাল রঙের জামা৷ খালি পা৷ হু হু ঠান্ডা বাতাসে কেঁপে কেঁপে উঠছে তার শরীর৷ হাতে একটা মৃত মেঠো ইঁদুর৷ ইঁদুরের লেজটা তার হাতের মুঠোয়৷ দেহটা ঝুলছে৷ দুলতে দুলতে সে এগিয়ে আসছে আগুনের দিকে৷

বিন্তির কাছে এসে লখাই ‘হুম’ করে একটা শব্দ করল মুখে৷ বিন্তি ভয় পেল না৷ লখাই বলল, ঝিনুক পুড়াছস?

বিন্তি বলল, হঁ, ঘরে চুন নাই একটুকুন৷ তামুক খাবো কেমনে? টুকু তামুক আছে ত দে৷

লখাই আগুনটার পাশে গিয়ে বসল বিন্তির গা ঘেঁসে৷ বলল, দাঁড়া, আগে ইঁদুরটা পুড়াই৷ বলে, ওটা আগুনের মাঝখানে রেখে ফুঁ দিতে লাগল৷   ভেতরে শালপাতার ঠোঙ্গায় একগুচ্ছ ঝিনুকের খোল পুড়ছে৷ উপরে ইঁদুর পুড়ছে পটপট শব্দে৷

বিন্তি বলল, আমার ঝিনুক পুড়ছে নাই, আর তুই ইঁদুর দিয়ে দিলিস৷ আগুনটা ত নিভেই গেলেক৷

লখাই আরো জোরে ফুঁ দিতে দিতে বলল, নিভভেক নাই৷ তুই আর দুটি কাঠঝুড়ি নিয়ে আয়৷ হামি তর ঝিনুক পুড়াই দিছি৷ আর ইঁদুরটা ত    তকেই খাওয়াবো বলে আনেছি৷ আমি খায়েছি দুটা ঘরে পুড়ায়৷

— হামকেই দিবি? তুই খাবিস নাই? বিন্তির জিভে জল আসতে লাগল মাংস খাবার লোভে৷ ঘরের বাইরে ডাঁই করে রাখা কাঠকুটো থেকে সে আরো কিছু জ্বালানি এনে দিল লখাইকে৷

লখাই আগুনটা বাড়িয়ে নিয়ে বলল, বইস, বইস৷ জাড়ে ত কাঁপছিস তুই৷ আগুনটা তাপে লে টুকু৷ গরম হয়ে লে৷ তারপরে আরাম করে ইঁদুরপোড়াটা খাবি৷

বিন্তি লখাইয়ের পাশে গিয়ে বসতেই লখাই তার আগুনে তপ্ত হাতদুটি বিন্তির দুই গালে বসিয়ে দিয়ে বলল, লে তোর জাড়টা খেইদে দিছি হামি৷ গরম করে দিছি৷

বিন্তি লজ্জা পেয়ে লখাইয়ের হাতদুটি নিজের গাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ছাড় ছাড় হামাকে জাড় লাগে নাই৷ তুই নিজের জাড়টা ভাঙা আগে৷

ইঁদুরটা পুড়ে যেতেই লখাই তার চামড়া হাড় ও লেজটা ছাড়িয়ে মাংসটা একটু একটু করে বিন্তির হাতে দিয়ে বলল, লে, খা৷

বিন্তি বলল, তুই আগে খা, তারপরে হামি খাব৷

লখাই বলল, হামি ত ঘরেই খায়েছি৷

এক টুকরা খা তুই আগে৷ বিটিছেলাকে আগে খাতে নাই, বুঝলি?

লখাই এক টুকরা মাংস মুখে নিতেই বিন্তি খেতে শুরু করল৷ খেতে খেতে বলল, তুই হামাকে ইটা-উটা রোজেই আনে দিস কেনে বলত?

সেটা নাই জানিস নাকি? লখাই বিন্তির হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলল, তর বাপই ত বলেছে, হামার সঙ্গে তোকে বিহা দিবেক৷

যখন দিবেক, তখন দিবেক৷ এখন ত দেয় নাই৷ বিন্তি তৎক্ষনাৎ হাতটা ছাড়িয়ে নেয়৷

লখাই বলে, দিবেকেই ন৷ পূব থেকে মাই বাপ ঘুরলেই ত হামদের বিহা হবেক৷

হবেক বললেই কি হবেক? বিহাঘরে কত খরচ হবেক জানিস? সবাইকে ভোজ খাওয়াতে হবেক৷ কত জিনিস কিনতে হবেক৷

পূব খাইটে ত অনেক টাকা আনবেক হামদের মাই-বাপ৷ ঘুরলেই সব হবেক৷ তুই এত চিন্তা করছিস কেনে?

আগুনটা ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে৷
লখাই বলে, তর ঝিনুক পুড়ে গেছে। রাখ ঠাণ্ডা হোক৷ কাল সকালে গুঁড়া করে চুন করবি৷ আজ হামার কাছেই টুকু তামুক লে৷ লখাই নিজের ছেঁড়া জামার পকেট থেকে তামাক ও চুন বার করে হাতের তালুতে অনেকক্ষণ ধরে ডলে কিছুটা বিন্তির মুখে গুঁজে দেয়৷ বাকিটা নিজের মুখে নিয়ে  বলে, হামি যাছি রে৷ তুই ঘরে সামা৷ ঘুমাবি যা৷ একলা একলা বাইরে থাকিস না৷ হুড়াল আসবেক৷

আকাশে একটা মস্ত চাঁদ উঠেছে৷ লখাই সরু রাস্তা বেয়ে উপরের টিলায় নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়৷

বিন্তি তাকিয়ে থাকে সেই দিকে৷

You may also like

Vinnokatha
Prothom Khondo
Price: Rs.260/-
www.vinnokatha.in
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে। সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে।সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
Vinnokatha
Prothom Khondo