দেশজুড়ে সরকারি স্কুল শিক্ষা আজ গভীর সংকটের সম্মুখীন

by দেবদাস মাজী

শিরোনামের প্রসঙ্গে যাওয়ার পূর্বে বেগম রোকেয়ার একটি গল্প শোনানো প্রয়োজন বলে মনে করছি। শিক্ষার্থীদের এই গল্পটি তিনি প্রায়‌ই শোনাতেন। গল্পটি এরকমঃ

“শয়তান তার চ্যালাদের মানুষের মনে ঢুকে মানুষদের দিয়ে অপরাধমুলক কাজ করাতে পাঠাত। ফিরে এসে চ্যালারা তাদের কাজের ফিরিস্তি দিত। একদিন এমনিভাবে চ্যালারা শয়তানের কাছে কাজের ফিরিস্তি দিচ্ছে। একজন বলল সে চারজন মানুষের মনে ঢুকে তাদের দিয়ে নরহত্যা করিয়ে নিয়েছে। আরেকজন বলল সে নাকি আটজন মানুষের মনে ঢুকে তাদের দিয়ে ডাকাতি করিয়ে নিয়েছে। এভাবে চ্যালারা তাদের কাজের ফিরিস্তি দিয়ে চলেছে আর শয়তান প্রশস্তি সূচক মাথা নেড়ে চলেছে। শেষে একজন যখন বলল যে সে একজন ছাত্রের পড়া ভুলিয়ে দিয়েছে তখন শয়তান তাকে কোলে নিয়ে চুমু খেতে লাগল। এই দেখে বাকিরা অবাক হয়ে বলল, “আমরা মানুষদের দিয়ে এত বড় বড় অপরাধ করিয়ে নিয়েছি, আপনি শুনে শুধু মাথা নাড়লেন। আর ও যখন বলল যে কেবল একটি ছেলের পড়া ভুলিয়ে দিয়েছে তখন আপনি তাকে কোলে নিয়ে চুমু খেতে লাগলেন! এটা কেমন বিচার হল!! “শয়তান তখন বলল, “দূর বোকা! এটুকু বুঝলি না! সংসারে যত অপরাধ আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় অপরাধ হল কাউকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা।”

প্রকৃত শিক্ষা থেকে এদেশের জনগণ ঐতিহাসিকভাবেই বঞ্চিত। বর্তমান শিক্ষা সংকট নিয়ে কথা বলার পূর্বে আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাস নিয়ে স্বল্প কথা বলা প্রয়োজন বলে মনে করি। ইংরেজ শাসনের পূর্বে এদেশে সকলের শিক্ষা লাভ করার অধিকার ছিল না। কেবলমাত্র উচ্চবর্ণের লোকেরাই শিক্ষা লাভ করতে পারত। দক্ষতা, নিপুণতা অকেজো করতে মহাভারতে দ্রোণাচার্য একলব্যের আঙ্গুল চেয়েছিলেন গুরুদক্ষিণা হিসেবে। এই ঘটনা প্রতীকি হলেও এই কাহিনীর মধ্যে শূদ্রদের শিক্ষা বঞ্চনাকে ইঙ্গিত করে। শূদ্রদের শুধু অস্ত্রবিদ্যা কেন, শাস্ত্র বিদ্যালাভ করারও অধিকার ছিল না। শোষণের শাসন এবং প্রভুত্ব কায়েম করার লক্ষ্যে নিজেদের রচিত শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে নিম্নবর্ণের মানুষদের তারা শতশত বছর ধরে শিক্ষার অধিকার সহ বিভিন্ন সামাজিক মৌলিক অধিকার গুলি থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিল। ফলে ব্যক্তি মালিকানা কেন্দ্রিক শোষণের বর্ণব্যবস্থা থেকেছে অটুট।

ইংরেজ আসার পর তাদের শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজনে সকল বর্ণের জন্য শিক্ষার অধিকার দেয়। সেই শিক্ষা যদিও প্রকৃত শিক্ষা ছিল না। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল কেরানি ও আমলা তৈরি করা। যারা শিক্ষা লাভ করত তাদের লক্ষ্য ছিল শিক্ষা সমাপনান্তে একটি চাকুরি পাওয়া যাতে করে শাসন ব্যবস্থায় সেবা দিয়ে নিজের বাকি জীবন স্বচ্ছন্দে চলে যেতে পারে। একজন মানুষের সত্যিকারের মানুষ হয়ে ওঠার যে শিক্ষা , সেই শিক্ষা গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থায় পাওয়া যায় না। প্রশাসন চালানোর জন্য যতটুকু শিক্ষা প্রয়োজন সেই শিক্ষাই দেওয়া হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমসাময়িক শিক্ষা প্রসঙ্গে বলেছিলেন ,”শিক্ষাকে আমরা বহন করিয়াই চলিলাম, শিক্ষাকে আমরা বাহন করিতে পারিলাম না।”  যদিও সকলের জন্য শিক্ষালাভ করার এই অধিকার পেতে সাধারণ মানুষকে দীর্ঘদিন ধরেই লড়াই করতে হয়েছে। জ্যোতিবা ফুলে, সাবিত্রী বাঈ ফুলে, আব্দুল বারি, বেগম রোকেয়ার হাত ধরে এদেশের জনগণ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার সু্যোগ পেয়েছে। বর্তমানে কায়েমি শক্তি, সকলের শিক্ষালাভের সেই অধিকারটুকুও কেড়ে নিতে চলেছে। কারণ শিক্ষা আনে চেতনা আর চেতনা আনে পরিবর্তন।

এক এক করে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের পিছনে যে যে সম্ভাব্য কারণ গুলি রয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা যাকঃ-

১) বেকারত্ব এবং অভিভাবক, ছাত্রদের উদাসীনতা :

শিক্ষার এই বেহাল দশা সত্ত্বেও অভিভাবকদের কোনো হেলদোল নেই। অনেক অভিভাবকই এমনও রয়েছেন যারা জানেন না তাদের ছেলেমেয়েরা কোন ক্লাসে পড়ে। মূল্যবৃদ্ধি থেকে শুরু করে দৈনন্দিন বিভিন্ন সমস্যায়  জর্জরিত অভিভাবকদের ছেলেমেয়েদের সমস্যা নিয়ে ভাবার সময়, আগ্রহ কোনটাই নেই। বর্তমান ছাত্রদের‌ও শিক্ষা গ্রহণে বিশেষ একটা আগ্রহ নেই, স্কুলও নিয়মিত যায় না। এ ব্যাপারে তাদের খুব একটা দোষ দেওয়াও যায় না। কর্মসংস্থানকে মাথায় রেখেই ছেলে মেয়েরা পড়াশুনা করে।  দিন দিন চাকরি প্রাপ্তির সম্ভাবনা সংকুচিত হ‌ওয়ায় ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়ায় আগ্রহ হারাচ্ছে। শিক্ষার সঙ্গে অর্থনীতির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। সবাই লেখাপড়া করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য, কিন্তু ভালোভাবে লেখাপড়া করেও যদি কর্মসংস্থান না হয় তখন ছাত্রছাত্রীরা স্বভাবতই শিক্ষা বিমুখ হয়ে যায়। তাছাড়া বাড়ির অভিভাবকরা যদি আগে দৈনিক সাত-আট ঘণ্টা কাজ করে সংসার চালাতে পারত, এখন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির ফলে আট ঘণ্টা কাজ করে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আট ঘণ্টার জায়গায় প্রয়োজন হচ্ছে তার কয়েকগুণ বেশি সময়ের। তাই তাদের সন্তানদেরকেও কাজে যোগ দিতে হচ্ছে। কাজ করতে গেলে লেখাপড়া হবে না, আর ভাল ভাবে লেখাপড়া করতে গেলে কাজ করা হবে না। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি মূল্যবৃদ্ধির বাজারে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে…কাজ-কর্মের পর ভাবনা-চিন্তা বা পড়াশুনা করার জন্য অবশিষ্ট সময় প্রায় নেই বললেই চলে।

২) পাশ ফেল প্রথা:

একথা ঠিক যে উন্নত দেশগুলির শিক্ষা ব্যবস্থায় পাশ ফেল প্রথা নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নকল শুধু পছন্দানুসারে কেন ? সরকার থেকে প্রাপ্ত মৌলিক অধিকার গুলি কি ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশের আদলে? ভারতবর্ষের যে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি তাতে করে পরীক্ষা প্রথা  তুলে দেওয়া কি আদৌ যুক্তিযুক্ত? পাশ ফেল প্রথা যখন ছিল, ছাত্র ছাত্রীদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া ও ভাল ফলাফলের জন্য নিয়মিত পড়াশুনা করতে হতো। বর্তমানে কোন শিক্ষার্থী সব বিষয়ে শূন্য পেলেও পরের ক্লাসে গড়গড় করে উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। পাশ ফেল প্রথা থাকলে সে কিছু না কিছু  অবশ্যই পড়তো। সবাই পাশ করে নতুন ক্লাসে উঠবে এবং সে ফেল করলে সেই ক্লাসেই থেকে যাবে, এই ভয় থেকে সে পড়াশুনা করতো, নিয়মিত স্কুলেও যেতো। অভিভাবকরাও নিয়মিত স্কুলে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতো। পাশ ফেল প্রথা নেই। অভিভাবকদের আগ্রহ নেই। শিক্ষকদের মধ্যেও পড়ানোর সেই তাগাদা নেই পাশফেল প্রথা না থাকার কারণে।

৩) শিক্ষকের অভাব :

বর্তমান সময়ে সরকারি স্কুলগুলিতে শিক্ষকের মারাত্মক অভাব দেখা দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ নেই। যারা রিটায়ার্ড হয়ে যাচ্ছেন, তাদের জায়গায় নতুন শিক্ষক নেই । যথেষ্ট শিক্ষক না থাকার কারণে যেসব অভিভাবকের সামর্থ্য আছে তারা নিজেদের সন্তানদের বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করছে। এর দেখাদেখি সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যান্য সাধারণ  অভিভাবকরা হাজারো অভাব অনটনের মধ্যেও বেসরকারি স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করতে বাধ্য হচ্ছে। ফল স্বরূপ সরকারি স্কুলে নিয়মিত হারে ছাত্র কমে যাচ্ছে। ছাত্র কমে যাওয়ার জন্য ছাত্র শিক্ষক অনুপাত হিসেবে স্কুলগুলোতে শূন্যপদ কমে যাচ্ছে। আগে ১৫০ জন ছাত্র থাকায় শিক্ষকের দরকার ছিল ৫ জন। এখন ৬০ জনে দুজন শিক্ষক লাগছে। দুজন শিক্ষককেই সমস্ত ক্লাস নেওয়া ও শিক্ষা বহির্ভূত সমস্ত কাজ করতে হচ্ছে। ফলে যেসব ছাত্র অনন্যোপায় হয়ে সরকারি স্কুলে পড়ত তারাও বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হতে বাধ্য হচ্ছে বা স্কুল ছুট হচ্ছে। এইসব কারণে সরকারি স্কুলগুলিতে ছাত্র সংখ্যা দ্রুততার সঙ্গে কমছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৮০০০ স্কুলে ছাত্র সংখ্যা এত‌টাই কমে গেছে যে স্কুলগুলি প্রায় উঠে যাওয়ার মুখে।

৪) সিলেবাস ও পাঠ্যপুস্তক:

সরকারি স্কুলের সিলেবাস, বই দিনের পর দিন যেভাবে নিম্নমানের ও অবিজ্ঞানসম্মত বানানো হচ্ছে (করে দেওয়া হচ্ছে) তাতে করে শিক্ষার মানের অবনমন হওয়াটা অতি স্বাভাবিক। জানতে ইচ্ছা করে কোন বিশেষজ্ঞ টীম এই সিলেবাস বানান? দল দাসত্বের বোঝা মাথায় চাপিয়ে চিন্তা-চেতনা, বুদ্ধিমত্তাতে কি  উনারা তালা মেরে দিয়েছেন?  ওনাদের বাড়ীর ছেলে-মেয়েরা কি ওনাদের তৈরি করা সিলেবাসে এবং বই-পত্র আদৌ পড়ে! বইগুলির কোন মাথা মুন্ডু নেই,  দু তিনটে বিষয়কে একসঙ্গে ঠাসিয়ে গাল ভরা নাম দেওয়া হচ্ছে আমার ব‌ই, আমার পরিবেশ ইত্যাদি।

৫) মিড ডে মিল:

 

 

একে তো  শিক্ষকের অভাব, তায় আবার তাদের মিড ডে মিলে তদারকিও করতে হয়। কোথায় কখন ভাতে পোকা পাওয়া গেল কিংবা ডালে টিকটিকি পড়ে গেল তার জন্য সদা সতর্ক থাকতে হয় শিক্ষক মশাইদের। অনীহা মিড ডে মিল নিয়ে  নয়, অনীহা পরিকাঠামো বিহীন মিড ডে মিল প্রকল্প নিয়ে। আচ্ছা বলুন তো প্রত্যেক মিলের জন্য যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ (প্রাথমিকে ৬ টাকা ৭৮ পয়সা, এবং উচ্চ প্রাথমিকে ১০ টাকা ১৭ পয়সা) তাতে করে কি ভাবে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার খাওয়ানো সম্ভব? বাজেট তৈরী করা কর্তৃপক্ষ‌ ও বিশেষজ্ঞদের সন্তানদের পুষ্টিকর মিল দেওয়ার জন্য  ওনাদের পরিবারে কি একই বাজেট বরাদ্দ করা হয়। মিড ডে মিল যখন ছিল না, তখন কি ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করেনি নাকি স্কুলে আসত না? পরিকল্পনা, পরিকাঠামোবিহীন মিড ডে মিল প্রকল্পে ছাত্র-ছাত্রীদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী হচ্ছে। উলটে এখনই বরং স্কুলে উপস্থিতির হার কমছে। আর মিড ডে মিল যদি চালাতেই হয়, তাহলে নিউট্রিশন বা এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করলে, বেকারত্বও নিরসন হবে এবং কর্মসংস্থানও তৈরী হবে। শৈশব থেকে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষক হওয়ার যে পড়াশোনা তাতে বাজার-হাট, রান্নাবান্না এবং পরিবেশন সংক্রান্ত কিছু রয়েছে বলে তো জানা নেই। আসল উদ্দেশ্য হল শিক্ষকদের মিড ডে মিলের মতো নানা কাজে এনগেজ করাতে শিক্ষার মান কিছুটা হলেও প্রশ্নের মুখে পড়ছে।  এবং পড়া হোক বা না হোক,  ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে আগামী দিনে শ্রমিক হতে পারে তা সুনিশ্চিত করা। শিক্ষক মশাইরা নিজ নিজ বিষয়ের বিশেষজ্ঞতা বিসর্জন দিয়ে খাদ্য বিশেষজ্ঞে পরিণত হয়েছে।

৬) শিক্ষক- শিক্ষিকাদের শিক্ষা বহির্ভূত কাজ:

শিক্ষক- শিক্ষিকাদের মিড ডে মিলের দায়িত্ব ছাড়াও আরো অনেক কাজ করতে হয় যার সঙ্গে পড়াশোনার কোনরকম সম্পর্ক নেই। সরকারি প্রকল্পের শেষ নেই। বিদ্যালয় ব্লক অফিসের শাখায় পরিণত হয়ে গেছে। স্কুলভিত্তিক প্রতিটি প্রকল্পের জন্য একজন করে নোডাল টিচার থাকে। কোন শিক্ষকের অধীনে যদি কোন প্রকল্প থাকে এবং শিক্ষক মশাই যখন সেই সরকারি প্রকল্পকে সফল  করতে ব্যস্ত তখন সেই শিক্ষকের জন্য বরাদ্দ ক্লাসগুলো কে নেবেন? তার উপর প্রতিবছর ভোট সংক্রান্ত কিছু না কিছু কাজ লেগেই থাকে। এক কথায় লেখাপড়া চুলোয় যাক, সরকারি প্রকল্প রূপায়ন জিন্দাবাদ। ভোটের সময় শিক্ষককে হতে হবে বি এল ও। শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের এইসব কাজের জন্য স্থায়ী পদে নিয়োগ করা যেত না? তাহলে তো অনেক কর্মসংস্থান‌ও হত । ভোটার তালিকা সংশোধন, সেন্সাসের কাজের জন্য বাড়ি বাড়ি যাওয়া, ব্লক অফিস জেলা অফিস ছোটাছুটি করতেই সময় শেষ।

৭) শিক্ষক সমাজের উদাসীনতা :

সবচেয়ে দুঃখের কথা শিক্ষা ব্যবস্থার দৈন্যদশা নিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ও সচেতন অংশ শিক্ষক সমাজের উদাসীন অবস্থান। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষক সমাজের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তাদের অধিকাংশই রাজনৈতিক দলগুলোর অন্ধ সমর্থকে পরিণত হয়েছে। সমস্যার গভীরে যাওয়া এবং তলিয়ে দেখার সময় তাদের নেই। ছাত্র-অভিভাবকদের সচেতন, সংগঠিত করে প্রতিবাদী কর্মসূচিতে সামিল করানোর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। অধিকাংশই আত্মকেন্দ্রিক জীবন-যাপন, বিনোদন, ভোগ-বিলাসের মধ্যে ব্যস্ত। জনসাধারণের শিক্ষক বিরোধী হওয়ার এও এক বড় কারণ। সরকারি শিক্ষকদের অনেকেই নিজেদের সন্তানদের বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। কিন্তু তারা একথা ভেবে দেখেন না, তাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষান্তের পর চাকরি কোথায় করবে যদি সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়; কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে নচেৎ বেসরকারি সংস্থার  ১০-১২ হাজার টাকার বেগার শ্রমিকে পরিণত হবে! শিক্ষা বিরোধী আইন গুলো যে শিক্ষার বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে প্রণীত এবং তার ফলে যে তাদের কর্মসংস্থানেও কোপ পড়বে সেই দিকে তাঁদের হুঁশ নেই। শাসক শক্তি শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করতেও সফল হয়েছে। এর পরিণাম পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি ২৬০০০ শিক্ষকের চাকরি হারানোতে সম্মিলিত কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে উঠেনি। এনসিটিই ২০১০ সালের ২৩-শে আগস্টের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী দেশজুড়ে সরকারি শিক্ষকদের মধ্যে যাদের চাকুরী আর পাঁচ বছর বাকি রয়েছে তাদেরকে বাদ দিয়ে বাকি সকলকে দু’বছরের মধ্যে দেড়শ নম্বর এর টেট পরীক্ষায় বসতে হবে এবং পাশ করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে দেশজুড়ে অনেক সরকারি শিক্ষক তাদের চাকরি হারাবে এবং চাকরি হারানোর আতঙ্কের আবহে অনেকেই স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যায় ভুগবে।

৮) রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সংগঠনগুলির উদাসীনতা :

মুখে শিক্ষাকে বাঁচানোর কথা বললেও, ভোটের রাজনীতি করা এবং রাষ্ট্র  ব্যবস্থায় সামিল হওয়া কমবেশী সমস্ত দলই সময়ে সময়ে শিক্ষার বেসরকারীকরণের লক্ষ্যে শিক্ষা বিরোধী আইন প্রণয়ন করেছে এবং করে চলেছে। সংসদীয় রাজনীতির বাইরে যেসব রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে , যারা সেই অর্থে ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেনি বা হয় নি, শিক্ষা পরিকাঠামো বাঁচাতে তাদের উদ্যোগও যথেষ্ট নয়। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় শিক্ষার ধ্বংস যজ্ঞে শাসক-বিরোধী সহ সমস্ত শক্তি যেন এক সুরে তাল মিলিয়েছে, মৌন সমর্থন রয়েছে।

৯) নাগরিক সমাজের উদাসীনতা :

তথাকথিত প্রগতিশীল নাগরিক সমাজ‌, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলিও  এই বিষয়ে উদাসীন। নিজেদের বাড়ীর ছেলে মেয়েদের নামি দামি বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়ে সামাজিক দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। বাড়ির সন্তানরা সরকারি স্কুলে পড়াশুনা না করায়, সেখানে কি হচ্ছে বা হচ্ছে না তার খোঁজ খবর রাখারও প্রয়োজন বোধ করেন না। খুবই প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত প্রবাদ “শিক্ষা আনে চেতনা আর চেতনা আনে বিপ্লব”। যারা আগামী দিনে দেশের ভবিষ্যৎ, সেই ছাত্রছাত্রীরা যাতে না বুঝতে পারে যে দেশ জুড়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের মূল কারণ ‘শোষণের শাসন কাঠামো’, তাই তাদের শিক্ষার অঙ্গন থেকে দূরে রাখতে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল কর্মকান্ড চলছে এবং এই কাজকে আরও সুগম করতেই  গ্রামে শহরে অপসংস্কৃতির জোয়ার ব‌ইয়ে দেওয়া হয়েছে । কিছুদিন পূর্বে শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও বাংলাদেশে সেখানকার সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে GenG-দের  লক্ষ্যবিহীন ও বিশৃঙ্খল প্রতিবাদী আন্দোলন দেখলাম। শিক্ষা সংকটের ফল স্বরূপ আগামীদিনে এদেশের হতাশ-নিরাশ ও চিন্তা-ভাবনা বিহীন যুব সমাজ কি সেই পথেই পরিচালিত হবে না?

 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা এভাবে ধ্বংস হয়ে গেলে কী হবে ?

শিক্ষাকে বেসরকারিকরণ করা অতীত কালের বর্ণাশ্রম ও দাসত্বের প্রথাকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নয় কি? ভারতের বর্ণাশ্রম কেন্দ্রিক শোষণ ব্যবস্থা সফল হওয়ার প্রধান ভিত্তি ছিল নিম্নবর্ণের মানুষদের শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। ব্রিটিশ পূর্ব ভারতে শত শত বছর ধরে তাদের শিক্ষা লাভ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার কারণে তাদের চিন্তা-চেতনা ও জীবনযাত্রার মানে কোন পরিবর্তন হয়নি। ইংরেজ আসার পরে তারা শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পায়। তারা  নিজেদের শাসন কায়েম রাখার জন্য, তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সকলের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলন করেছিলেন ঠিকই কিন্তু এর ফলে যারা শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায় , শিক্ষার স্বল্প পরিসরেও তারা নিজেদের গোলামি থেকে নিজেদের মুক্ত করার উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করে যান। বিশ্বের বিভিন্ন জ্ঞান ভাণ্ডারের সন্ধান পান যা সেই সময়কাল পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে লুক্কায়িত ছিল। সকলের শিক্ষা লাভের অধিকার সুনিশ্চিত না হলে আমরা কি আম্বেদকরকে পেতাম? পেতাম কি পেরিয়ার, জ্যোতিবা ফুলে, সাবিত্রীবাই ফুলে, বেগম রোকেয়া এবং জয়পাল সিং মুন্ডাদের মতো ব্যক্তিত্বদের? এনারা নিজেরা লেখাপড়া শিখে হাত গুটিয়ে বসে থাকেননি। শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত মানুষদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের জন্য লড়াই চালিয়েছিলেন। তারা জানতেন শিক্ষা না পেলে কোনো জাতি উঠে দাঁড়াতে পারে না। বেগম রোকেয়া উদ্যোগী না হলে আমরা কি নাজমা হেফাতুল্লাকে পেতাম? পেরিয়ার, আম্বেদকর উদ্যোগী না হলে আমরা কি রামনাথ কোবিন্দ বা দ্রৌপদী মুর্মুকে পেতাম? এই প্রসঙ্গে হাজি মহসিন, হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের কথাও উল্লেখ করতে হয়।

তাই একথা সত্যি যে সরকারি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও তা সর্বোচ্চ মানে এবং সামগ্রিক ভাবে সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছাতে পারেনি। ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষজন এখনো অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারেনি। ভারতবর্ষের অধিকাংশ সম্পদের মালিকানা উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্ত লোকেদের হাতে। বেসরকারিকরণ হলে তাদের কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু নিম্ন বিত্তের দলিত-সংখ্যালঘু-আদিবাসী মানুষের কাছে সম্পদের মালিকানা না থাকায় তারা পয়সা দিয়ে শিক্ষা কিনতে পারবে না। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই? যাদের টাকা রয়েছে, তারাই একমাত্র আধুনিক চিকিৎসার সুবিধা পাচ্ছে, বাকিরা বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন। ফলে যে শিক্ষা তাদের একদিন শতশত বছরের গোলামির রাস্তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখিয়েছিল, সেই শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হ‌ওয়ার কারণে তারা আবার সেই গোলামি অর্থাৎ বর্ণাশ্রমের যুগেই ফিরে যাবে। অশিক্ষিত-কুশিক্ষিত জনগণ অসুস্থ সমাজ তৈরী করে। বর্তমান সরকার এক দেশ এক ভোটের কথা বলে, এক দেশ এক ভাষার কথা বলে। একই ভাবে এক দেশের জন্য , ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে একই শিক্ষা ব্যবস্থা  হওয়া কি উচিৎ নয়?  জঙ্গলে আগুন লাগলে যেমন কোন প্রাণীই রেহাই পায় না তেমনি সঠিক শিক্ষার অভাবে সামাজিক অপরাধ বেড়ে গেলে বিত্তশালী হোক আর দরিদ্র কেউই রেহাই পাবে না।

সমস্যা ও সমস্যার মূল কারণ না জানা জনসাধারণের এক বিরাট সংখ্যক মানুষের শিক্ষকদের প্রতি ক্ষোভ তৈরী হয়েছে। শিক্ষকদের নিয়ে কুৎসা এবং শিক্ষকদের একাংশের বিশৃঙ্খল ভোগী জীবন যাপন এই ক্ষোভের পরিবেশ তৈরীতে সাহায্য করছে। কিন্তু জনসাধারণকে একথা ভুললেও চলবে না যে দেশজুড়ে বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের চাকরি চলে গেলে শুধু স্কুলগুলোই যে শিক্ষক শূন্য হয়ে পড়বে তা নয় এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। কেননা বেসরকারি বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর সামর্থ্য বেশিরভাগ অভিভাবকের নেই। তাই কায়েমি স্বার্থবাদীদের ফাঁদে পা না দিয়ে , সরকারি শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজের এই সংকটের মুহূর্তে আমাদের প্রত্যেককেই নিজেদের (ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক) মধ্যে দূরত্ব কমাতে উদ্যোগী হতে হবে। অবস্থান আমাদের নিতেই হবে…হয় চুপচাপ থেকে  সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিজেদের চোখের সামনে ধ্বংস হতে দেব, নয় সরকারি শিক্ষাকে বাঁচানোর লক্ষ্যে নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলবো। অসম  বিকাশের দেশে কায়েমি স্বার্থবাদীদের পরিকল্পনা সম্পর্কে অনেকেরই সম্যক ধারণা নেই তাই শিক্ষা ব্যবস্থার এগিয়ে থাকা অংশ হিসেবে শিক্ষক সমাজকে ঐক্য গড়ে তোলার মূল দায়িত্ব ও উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজকে গা ছাড়া মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। অতীত সময়ে সমাজের সামগ্রিক স্বার্থে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে শিক্ষক সমাজ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এবং মানুষকে পথ দেখিয়েছে। সেই আশা কি বর্তমানে করা অন্যায় হবে?

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

 

You may also like