“বাবা, বাবা, আমিও তোমার সাথে ঈদ পড়তে যাবো”, সায়েদা বলে বাবাকে। সাবের আলি পাঞ্জাবিতে আতর লাগাতে লাগাতে আয়নার দিকে তাকায়, আর কানে তুলোয় করে একটু আতর নিয়ে গুঁজে দেয়। তাতে আতরের সুগন্ধ আরও তীব্র হয়ে ওঠে, এবং আরও বেশি বেশি করে ঈদের সুগন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। আতর লাগানো শেষ হলে, কাদের ভাই এর দেওয়া সুরমা চোখে লাগায়। কাদের মিয়া আগের বছর হাজি হয়ে ফিরেছে মক্কা মদিনা বিচরণ করে। সঙ্গে এনেছে অনেক কিছু। খেজুর, তেঁতুল, জমজমের পানি, জায়নামাজ, টুপি, সুরমা, আতর, আরও কত কি! সাবের তার চাচারে ভাই বলে একটু সুরমার ভাগীদার হতে পেরেছে। নইলে প্রতিবেশীরা তো দুই এক পিস খেজুর ছাড়া আর কিই বা পায়!

চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে সাবের তার স্ত্রীকে ডাক দেয়, “সাদিয়া, রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে একটু মেয়েটাকে সাজিয়ে গুছিয়ে দাও। সময় হতে চললো যে”। সায়েদা মিটকেশে রাখা কলার থোকা থেকে একটা কলা বের করে খেতে শুরু করেছে ততক্ষণ। আর তার ছোট ভাই রাতুল, সে খেলনা বন্দুক নিয়ে অদৃশ্য চোর ডাকাত দের গুলি ছুড়তে ছুড়তে একবার এদিক ছুটছে, একবার ওদিক। মা এসে সায়েদা কে নতুন জামা পরায়, চুল সিঁথি করে দেয়, আর মাথায় একটা গোলাপি রঙের ফুলওয়ালা ভেল পরিয়ে দেয়। সায়েদা মাকে মনে করিয়ে দেয়, “মা, আমার চুড়ি গুলো তো পরা হলনা?”। মা তখন চুড়ি গুলো আলমারি থেকে বের করতে যায়। এদিকে রাতুল হিসেব করতে শুরু করেছে, “বড় বাবা দিলো বিশ টাকা, বাবা বিশ টাকা, চল্লিশ, চল্লিশ, সোহেল কাকু দিল দশ টাকা, আর মা দিলো আর দশ টাকা, হলো আমার সত্তর টাকা মোটে”। 

ওদিকে ঈদ গাহা ময়দান থেকে মাইক এর আওয়াজ কানে আসছে বেশ কিছুক্ষণ থেকে। মৌলবি সাহেব রোজা, নামাজ নানান বিষয়ে বক্তব্য রেখে চলেছেন। “রোজা রাখা মানে শুধু না খেয়ে থাকা নয়। এ হল মানুষের ধৈর্যের এক বিশাল পরীক্ষা। আজ আমরা অনেকেই আছি যারা সবগুলো রোজা রাখতে পেরেছি। অনেকেই আবার পারিনি। কেউ কেউ অসুস্থতার জন্য রোজা রাখতে পারিনি। আল্লাহর কাছে তাদের হয়ে আমরা সকলেই ক্ষমা চেয়ে নেব, এবং আমরা জানি আল্লাহ পাক আমাদের ক্ষমা করে দেবেন। কারণ তার থেকে ক্ষমাশীল আর কেই বা থাকতে পারে! কিন্তু আমরা যারা ইচ্ছা করে রোজা রাখিনি, নামাজ পড়িনি, তাদের কি আল্লাহ-তায়ালা ক্ষমা করে দেবেন? কখনোই নয়…”

সকাল আটটায় জামাত। সাবের তাড়া দেয় তার বউকে। সাদিয়া মেয়েকে তৈরি করে মুরগীর মাংসে হাত দিয়েছে। হাত ধুয়ে এসে মেঝেতে সপ পেতে দেয়। সাবের দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে সপের ওপর বসে কলার থোকাটা বের করে এনে একটা একটা করে কলা ছিঁড়ে  দেয় দুই ছেলে মেয়ে কে। সাদিয়া বলে, “বাবা, আজকে আমিও তোমার সাথে ঈদ পড়বো লাইনে দাড়িয়ে”। “তুই মেয়ে মানুষ নস? তুই কিভাবে ছেলেদের সঙ্গে দাঁড়াবি লাইনে”, রাতুল বলে ওঠে। “তাতে কি হয়েছে? মেয়েদের নামাজ কি আল্লা নেয়না নাকি?” বাবা কিছু বলেনা। সাদিয়া একটা ছোট হাঁড়ী তে লাচ্ছি, আর একটা বাটিতে করে খুরমা খেজুর তাদের সামনে এনে রাখে। ঐ দিক মৌলবি সাহেব হাঁক দেয়, “যারা তিরিশটা রোজাই রাখতে পেরেছেন, আজকের এই পবিত্র দিনে তাদের মুখ আল্লাহ-তায়ালা সোনার মতন উজ্জ্বল করে দেবেন। আর যারা রাখতে পারেনি, তাদের এই ঈদ মানে শুধু লাচ্ছি, সমই, আর মাংস পোলাও খাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়…” বরের বাটিতে লাচ্ছি হাতা দিয়ে তুলে দেয় সাদিয়া। “আমাদের মায়ের বাড়ির দিকে, মেয়ে ছেলে সবাই ঈদের নামাজ পড়তে পায়। আলাদা আলাদা ব্যবস্থা থাকে সবার। একই মাঠে মাঝখান দিয়ে পর্দা টাঙিয়ে দেয়। এখানেও তো পারে?”

“যেখানে যেমন নিয়ম আর কি”, সাবের মাথা নিচু করে খেতে খেতে বলে।

“আমি দেখিস বাবার পাশেই দাঁড়াবো লাইনে।”

“তুই বললেই হবে? মানুষ গুলো তোকে লাইন থেকে বের করে দেবে। বাবা তোকে নিয়ে দাঁড়াবেই না দেখবি!”

“বাবা, বাবা, তুমি দেখ রাতুল কেমন করছে, আমি ঈদ এর নামাজের সব দুয়া মুখস্থ করে নিয়েছি। মা আমাকে সব নিয়ম শিখিয়ে দিয়েছে। কয়বার তাকবীর, কয়বার সিজদা, সব।”

ঘড়ি তে সময় তখন সকাল সাতটা। একটু আগেই ঈদগাহের ময়দান না পৌছাতে পারলে শেষের সারিতে দাড়াঁতে হয়। যত সামনের লাইন, তত বেশি নেকি। এই গল্পটা সাবের অনেকবার শুনিয়েছে তার ছেলে-মেয়েকে।

“সবাই সামনের লাইন গুলো ভর্তি করুন আপনারা। সামনের লাইন ফাঁকা রেখে পেছনের সারি তে দাঁড়ানোর এ কেমন শয়তানি হরকত… আল্লাহ আমাদের আশরাফুল মাখলুকাত বানিয়ে পাঠিয়েছেন… আমাদের এই পৃথিবীতে আসার শুধু একটাই উদ্দেশ্য হল আল্লাহর ইবাদত করা… তিনি আমাদের জন্যই পৃথিবী যাবতীয় জিনিস সৃষ্টি করেছেন…”

“কই হে সাবের, চল তাড়াতাড়ি বের হও। সাতটা বেজে পার হয়ে গেল। আমরা প্রতিবার পেছনের লাইন এই জায়গা পাচ্ছি। চল, এই বার যদি একটু আগে বেরোনো যায়।” বাড়ির বাইরে হাঁক দেয় কাদের আলী। সায়েদা আর রাতুল ছোট ছোট পা চালিয়ে বের হয়ে আসে। সাবের সাদা রঙের জোব্বাটা পরে বেরিয়ে আসে। আজকের সকালটা যেন একটু অন্যরকম। বাইরে বেরিয়েই তারা দেখে বাড়ির সামনের টিউবওয়েলে স্নান করছে পাড়ার সকলে। দুই একজন মেয়েমানুষ তাদের বাচ্চাদের জোড় করে সুগন্ধি সাবান মাখিয়ে দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার দাঁতন করতে করতে মাঠের দিকে হেঁটে চলেছে কোনদিকে না তাকিয়েই। সাবের কাদেররা সালাম বিনিময় করে।

দেখতে দেখতে আশেপাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করে বাকিরা। একজন দুজন চারজন পাঁচজন ছোট ছোট ছেলে মেয়ে। কেউ লাল, কেউ হলুদ, কেউ নীল, নানান রঙে ঈদের সকাল যেন রামধনুর রঙে সেজে উঠেছে। তার সাথে সাথে বেরিয়ে আসছে সাদা রঙের পাঞ্জাবী পরা আধবয়সী ছেলেপুলে গুলো। বেশির ভাগেরেই চোখে সুরমা, আর কানে গুঁজে দেওয়া আতর মাখানো তুলো। আর মাথায় টুপি। আজকের সকালখানি ভারি উজ্জ্বল। আকাশে সূর্য চকচক করছে। সারি সারি লোকজন এগিয়ে চলেছে ঈদগাহ ময়দানের দিকে। রাতুল আর সায়েদা একে অপরের সাথে বোঝাপড়া করে নিচ্ছে মেলায় তারা আজ কি কি খাবে, কি কি কিনবে। সিঙ্গারা, চটপটি, আইসক্রিম, ফুচকা সবই আছে তাদের লিস্টে। আর ফেরত আসার সময় একটা সেরেঞ্জা লাগা বেলুন, আর একটা বড় বেলুন। সেরেঞ্জা লাগানো ছোট সাইজ এর বেলুন গুলো বাচ্চারা খুব পছন্দ করে। এই বেলুনগুলোর ভেতরে কয়েকটা সর্ষে দানা ঢুকিয়ে ফুলিয়ে দেওয়া হয়। এবং বাচ্চারা যখন সেরেঞ্জা টি ধরে ঝাঁকি দেয়, বেলুনটা ঝনঝন করে বেজে ওঠে। লাল হলুদ রঙের এই বেলুনগুলো একটা করে কিনে আনা রাতুলের প্রতিবারের স্বভাব। এসব করে টাকা পয়সা বাঁচলে তারা মায়ের জন্য বাকি টাকার ফুচকা আনবে বলে ঠিক করলো।

সবাই মিলে যখন হাঁটা শুরু করলো, ঘড়ি তে তখন সকাল সাতটা বেজে পঁচিশ। “তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম”, সবার মুখে গুনগুন করতে আরম্ভ করলো। একের পর এক গলি ভেঙে ভেঙে এগিয়ে চলল কাফেলা। মোড়ে মোড়ে সাজানো হয়েছে গেট। কৃত্রিম ফুল, আর চকমকি কাপড় দিয়ে মোড়ানো হয়েছে মাটিতে পোঁতা বাঁশ। তবে এবার একটা নতুন সংযোজন, প্রত্যেক পাড়ায় পাড়ায় গেট গুলোতে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে মাইক। ঈদগাহে লাগানো মাইকের শব্দ ঈদগাহের বাইরেই বেরোই না বললেই চলে। যারা বাড়িতেই নামাজ পড়ে ঈদ পালন করবে, তাদের জন্যই নাকি এই অভিনব ব্যবস্থা। সেই মাইক এর আওয়াজ এ মেতে উঠেছে পাড়ার গলি গলি। সাবের তার দুই ছেলে মেয়েকে নিজের দুই অনামিকা ধরিয়ে দিয়ে নিয়ে চলেছে। ঈদগাহ প্রাঙ্গণে পৌঁছল যখন তারা তখন সময় সাতটা বত্রিশ।

“তুই শবনম দের সাথে মেলা ঘুরে নে মা, আমি গিয়ে নামাজ টা পড়ে নি কেমন।” সায়েদা অসহায় দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকায়। রাতুল বাবার আঙ্গুল তখনো ছাড়েনি। ও নামাজ পড়বে বাবার সাথে। “তুমি ওকে নিয়ে যাচ্ছ বাবা, ও তো একটাও সূরা মুখস্থ করতে পারেনি এখনো।” সাবের আলি আর কিছু বলেনা। শুধু বলে দেয় সায়েদা কে যে ওকে নামাজ শেষে কোথায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। “ওই যে তোর সঞ্জয় কাকু আইসক্রিম এর দোকান বসিয়েছে রাস্তার মোড়ে, ওইখানেই দাড়িয়ে থাকিস কেমন। ওইখান থেকেই তারপর আমরা একসাথে বাড়ি চলে যাবো।”

রাতুল এক অদ্ভুত উল্লাসের ভঙ্গি করে এবং বাবার আঙুল ধরে মিলিয়ে যায় নামাজি মানুষ গুলোর ভিড়ে।

“ঐ দিকে চ, মেলা তো ঐ দিকেই বসেছে, তুই এখানে দাঁড়িয়ে আর কি দেখবি!” শবনম হাত ধরে টানে সায়েদার। “দেখ, আমি এত্ত করে বললাম বাবাকে আমাকে নামাজ পড়তে নিয়ে যেতে, বাবা নিয়েই গেলনা।”শবনম বলে, “আরে বোকা, তুই কোনও মেয়ে মানুষ দেখতে পাচ্ছিস নামাজের লাইন গুলোতে। মেয়েরা পড়েনা বলেই তোর বাবা নিয়ে যায়নি।” শবনম বয়সে দুই বছরের বড় সায়েদার থেকে। সাবের আলির আর এক চাচার ভাইয়ের মেয়ে সে। ওর বাবা বোম্বাই এ কাজ করতে গিয়ে আর ফিরে আসতে পারেনি। লোকে বলে ওর বাবাকে নাকি কোন এক ঠিকাদারই মেরে ফেলেছে ইনস্যুরেন্সের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার জন্য। এখন শবনম থাকে তার মা আর এক ভাইয়ের সাথে। মা আই.সি.ডি.এস. এর হেল্পার এর কাজ করে। ভাই ছোট। তিনজনে মিলে সংসার। তবে শবনম মেয়েটি ভারী মিষ্টি স্বভাবের। জাতগুষ্টির লোকেরা, মেয়ে খানির মিষ্টি স্বভাব, আর তার মায়ের নিরীহ ব্যাবহারে সন্তুষ্ট হয়ে প্রায়শয় নানান সাহায্য করে দেয়। যেরকম গতবার বর্ষায় তাদের বাড়ির টিনের ছাউনি উড়ে গেছিল ঝড়ে। তখন আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে বাড়ি ঢেকে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। বাড়ির বড় সন্তান হওয়ায় অনেক গুরুদায়িত্ব নিতে হয় শবনমকে।

সায়েদা ও শবনম, দুজনে মিলে মেলা ঘুরতে শুরু করলো। তবে এখনকার মেলাকে আর আগের মত মেলা বলা চলেনা। বছর কয়েক আগে ঈদ উপলক্ষে নানান রকমের দোকান পাশার, ছেলে মেয়েদের আনন্দ ফুর্তির জন্য বাঁশের তৈরি চরকি, লটারি খেলা, আরও কত কি যে আসতো! তাছাড়াও আসতো হাতে কৃত্রিম ট্যাটু লাগিয়ে দেওয়ার দোকান। সবাই ত্রিপল কিংবা চট পেতে বসে পড়তো মাটির উপর। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে সায়েদার চোখ গিয়ে পড়লো এরকমই একটা দোকানে। একজন ধুতি পাঞ্জাবী পরা লোক অনেক গুলো কাঠের তৈরি ছাঁচ নিয়ে বসে আছে মেলার এক কোনায়। কোন ছাঁচে তাজমহল, কোনটাতে গোলাপফুল, তো কোনটাতে আবার দূরদর্শন চ্যানেলের শক্তিমান একটা অদ্ভুত রকমের ক্যারিকেচার হয়ে দাঁড়িয়ে! সায়েদা তৎক্ষণাৎ শবনম কে বলে, “চল শবনম, হাতে গোলাপফুলের মেহেন্দি লাগিয়ে আসি।” তারা দুজন মিলে এগিয়ে যায়, কিন্তু শবনম বলে ওঠে, “মেহেন্দিটা বরং আমরা পরেই লাগায়। নইলে এই রঙ মাখা হাতে কিছু খেতে গিয়ে হাত ধুতে গেলে ডিজাইন ধুয়ে চলে যাবে তো!”

“হ্যাঁ রে, আমি তো ভেবে দেখেনি। ঠিক আছে, চল আগে মেলাই ঘুরে নি দুজনে মিলে। আমাদের তো আর নামাজ পড়বার কথা না, তাই মেলা ঘোরা ছাড়া আমাদের আর কিই বা করবার আছে।” ওই কাঠের ছাঁচ দিয়ে হাতে ডিজাইন বানানোটাকে ওরা ভাষায় মেহেন্দি লাগানো বলে। তারপর তারা দুজনে মেলা ঘুরতে শুরু করলো। আর অপরদিকে নামাজ শুরু হবার প্রায়। মৌলবি সাহেব সবাই কে নামাজ পড়বার নিয়ত শেখাতে শুরু করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঈদুল ফিতর নামাজের নিয়ম কানুন ও শিখিয়ে দিচ্ছিলেন সবাইকে। আসলে এই পরব বছরে দুই বারই আসে। আর মানুষজন প্রায়শই ভুলে যায়। কিন্তু তখনই, ঈদগাহ পরিচালন কমিটির একজন সদস্য ইমাম সাহেবের কানে কানে গিয়ে কিছু একটা বললেন।

“ভাই বেরাদারগণ! আপনারা সবাই জানেন যে আমাদের এই যে ঈদগাহ ময়দান, এবং নিকটবর্তী দাফন-স্থান এসব কিছু আপনাদেরই সম্পদ। এতদিন হল, আপনারায় এসবের দেখভাল করে এসেছেন। তাই আমি আপনাদের সকলের কাছে এই পরিচালন সমিতির হয়ে মুক্ত হস্তে দান করার অনুরোধ করছি। আমি দেখেছি, এই গ্রামে আল্লাহর রহমতের কোন অভাব নেই। আমি এর আগে আরও পাঁচ ছয় খানা গ্রামে ইমামতি করেছি, কিন্তু আমি উঁচু গলায় বলতে পারি, এখানকার মানুষের মত দয়াশীল আর দানশীল মানুষ খুব কম জায়গায় দেখা যায়। আপনাদের মধ্যে কেউ মাষ্টার আছেন, কেউ ডাক্তার আছেন, কেউ বা আছেন বড় অফিসার, তাছাড়া আমার আদরের বাকিসকল গ্রামবাসীরা তো আছেনই। আমি সবাইকে নিজের ক্ষমতা অনুসারে দান করার অনুরোধ জানায়।”

তারপর একজন সদস্য ইমাম সাহেবের হাত থেকে মাইক নিলেন, এবং সবাইকে অনুরোধ করতে শুরু করলেন নিজের মত করে। তার কথামত ঈদগাহ কমিটির মেম্বাররা এক একজন এক একটি লাইনে দাড়িয়ে পড়লেন। সবার হাতে একখানা করে ছোট ছোট নোটবুক। অনুরোধ করা হল যাতে সবাই শান্তিপূর্ণ ভাবে নিজ নিজ জায়গায় বসেই হাত তুলে নাম সহ টাকার পরিমাণ লিখিয়ে দেন। পেছন দিক থেকে সূর্য ততক্ষণে দাবদাহ শুরু করেছে।

সাবের আলি পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছতে থাকে। তার হাতের ঘড়িতে সময় তখন সাতটা বেজে তেতাল্লিশ মিনিট। তার পাশেই বসে আছে রাতুল।

“বাবা নামাজ কখন শুরু হবে বলোনা?”

“এই শুরু হয়ে যাবে বাবা খুব তাড়াতাড়ি।”

“ভালো লাগছেনা, কখন বাড়ি যাব।”

“ওরকম বলতে নেই বাবা। ঐ যে আসমানে আজ ফেরেশতারা উড়ে বেড়াচ্ছে। ওরা সব দেখছে আর ছবি তুলছে। সেই ছবি ওরা আল্লাহকে গিয়ে দেখাবে, আর বলবে দেখুন আপনার বান্দারা কত আনন্দের সাথে ঈদ এর নামাজে সামিল হয়েছে সবাই মিলে।”

রাতুল আকাশের দিকে তাকায়। রোদ ঝলমলে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে তার চোখ ধাঁধিয়ে ওঠে। ও মনে মনে ভাবে দিদির সাথে গেলেই ভালো হত। এতক্ষণ কত আনন্দে মেলায় ঘুরে বেড়াতো সে। দিদিরই মজা। নামাজ পড়বার কোন ঝামেলা নেই। কিন্তু ও ফেরেশতাদের খুঁজে পায়না আকাশে। শুধু দেখে একজোড়া শালিক এক গাছ থেকে অন্য গাছে উড়ে যাচ্ছে আর আসছে। রাতুলের মনে হয় এই শালিক গুলোও কি ঈদের নামাজ পড়তে যায় কোথাও? ওদের ও কি কোন আলাদা ঈদগাহের মাঠ আছে নাকি? সেখানে কি শুধু শালিক পাখিরাই যায় ঈদ পড়তে? পায়রা গুলো যায়না? পায়রা গুলো কোথায় যায় তাহলে? রাতুল দেখেছে তার বাবার মোবাইলে, কিভাবে একটা পায়রা আল্লাহর ঘরের দিকে মুখ করে সিজদা করছিল বারবার, তার কানে ভেসে ওঠে আল্লাহ হো আকবর ধ্বনি। এসব ভাবতে ভাবতেই তার মনে হয়, পায়রা, শালিক এরা সবাই যদি ঈদের নামাজ পড়ে তাহলে সঞ্জয় কাকু কেন দোকান খুলেই বসে রইলো? নামাজ পড়তে কেন এলোনা? নামাজ নাই পড়লো, নতুন জামা কাপড় তো পরতেই পারতো!

“মোস্তাক হোসেন বিশ হাজার টাকা – বলি মারহাবা!” – বলে চেঁচিয়ে উঠলেন ইমাম সাহেব। গোটা ঈদগাহ ময়দান হঠাৎ যেন গমগম করে বেজে উঠলো। “ভাই সকলএগিয়ে আসুন। আর চারজন ভাই কি এগিয়ে আসতে পারবেন না বিশ হাজার টাকা নিয়ে?” একশো, দুশো, চারশো, পাঁচশো, হাজার টাকাও অনেক উঠলো। তবে তাদের সকলের নাম নোট বুকে, কিংবা ইমাম সাহেবের মুখে উঠলো না। অনেকেই হয়তো চায় ও নি যে তাদের নাম উঠুক এই মহফিল এ সকলের সামনে। ইসলামে বলা হয়, এমন ভাবে দান খয়রাত কর, যাতে তোমার বাম হাত জানতে না পারে তোমার ডান হাত কি দান করলো। তারপর আর এক নামে গর্জে উঠলো ঈদের ময়দান। “আমির ভাই পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ” মাশাল্লাহ। তারপর আর এক নাম, রহমান ভাই বিশ, জিলানি ভাই পাঁচ, আনসুর মাষ্টার পনেরো, কাদের ভাই ত্রিশ… এভাবে চলতেই থাকলো যতক্ষণ না সাবের আলীর ঘড়িতে সাতটা তিপ্পান্ন বাজে। সাবের আলী সামনের দিকে তাকায়, দেখে একজন মেম্বার তার সামনে মাথার টুপি খুলে দাঁড়িয়ে। টুপিতে হাবুডুবু খাচ্ছে অনেক গুলো দশটাকা, কুড়িটাকা, পঞ্চাশটাকা, একশো-টাকার নোট। সাবের তার পাঞ্জাবীর ডান পকেট থেকে একটা পাঁচশো টাকার নোট বার করে টুপিতে রাখে। টুপি সামনের দিক থেকে এগিয়ে যেতেই দেখে এবার ইমামের মাইক চলে গেছে সাত্তার মিয়ার হাতে। এই সাত্তার মিয়ার অধীনেই বোম্বাই এ কাজ করতে গিয়েছিল তার চাচাইতো ভাই কবির। সাত্তার মিয়া হাতে মাইক নিয়ে বলতে শুরু করলেন:

“আসসালামো আলাইকুম।” নামাজিদের সবার “অয়ালায়কুম আসসালাম অরহমতুল্লাহে বারকাতুহু” তে গুঞ্জে উঠলো ঈদগাহের মাঠ। “আপনারা অনেকেই জানেন যে, খুব শীঘ্রই আমি হজ্বের উদ্দেশ্যে আরব এ রওয়ানা দিব ইনশা আল্লাহ। তাই আমি আপনাদের নিকট আবেদন রাখছি, আমার চলা ফেরার মধ্যে যদি কেউ কোনদিন আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে বড়মনে মাফ করে দেবেন। ও আমার জন্য সকলে দুয়া করবেন, যাতে আমি ভালো ভাবে ফিরে আসতে পারি। আমিও আপনাদের সকলের জন্য দুয়া করবো”। পেছন থেকে কে যেন ফিসফিস করে বলে উঠলো – আর ফেরত এসে মানুষ মেরে পয়সা কামাবো। সাত্তার মিয়ার পর আরও দুইজন লোক হজ্বে যাবেন বলে সকলের কাছে ক্ষমা দুয়া চেয়ে মাইক ধরলেন।

ততক্ষণে পেছ্নের লাইন গুলো তে একটু একটু করে হই হুল্লোড় শুরু হয়েছে। নামাজে দেরি হচ্ছে কেন, তা নিয়ে কিছু লোক ঝামেলা শুরু করেছেন। “আটটার সময় টাইম দেওয়া ছিল জামাতের, আর এখন আটটা পার হয়ে গেল তবু ও নামাজ শুরু হচ্ছে না। ফাজলামির একটা লিমিট থাকা দরকার”। ধীরে ধীরে সব লাইনের লোক অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করলে ইমাম সাহেব তড়িঘড়ি মাইকের মালিকানা নিজের হাতে নিলেন, এবং নামাজের তর তরিকা বোঝাতে শুরু করলেন।

“আপনারা অনেকেই জানেন না যে কিভাবে আরবি ভাষায় ঈদের নামাজের নিয়ত করতে হয়। তাই যারা জানেন না, তারা আমার সাথে সাথে বাংলায় নিয়ত করে নেবেন। আর যারা আরবি ভাষায় নিয়ত করতে জানেন, তারা আরবি ভাষাতেই করবেন। আরও একটা কথা মাথায় রাখুন, এই নামাজে তিনটি তাকবীর বেশি বলতে হবে। প্রথম দুই তাকবীর এ হাত ছেড়ে দেবেন, আর তৃতীয় তাকবীর এ হাত বেঁধে নিতে হবে” – এই বলে তিনি কেবলা-মুখি হয়ে দাঁড়ালেন। মুসল্লিরা সবাই ঘাড়ে ঘাড় মিলিয়ে লাইন সোজা করে নিতে লাগলেন। নিয়ত শুরু হল – “নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া লিল্লাহি তায়ালা রাকয়াতা সালাতি ঈদিল ফিতর, মায়া ছিত্তাতি তাকবীরাতি ওয়াজিবুল্লাহি তায়ালা ইকতাদাইতু বিহাযাল ইমাম, মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারীফাতি আল্লাহু আকবার।” বাংলায় যারা বললো – “ইমামের পেছনে কেবলা-মুখী হয়ে ঈদুল ফিতরের দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ ছয় তাকবীরের সঙ্গে আদায় করবার নিয়ত করছি”। এই বলেই সবাই নামাজের সারিতে দাঁড়িয়ে পরলো।

শবনম আর সায়েদা তখন একটা ফুচকার দোকানে দাঁড়িয়ে। সায়েদা তার মায়ের জন্য ফুচকা কিনবে। ততক্ষণে তাদের দুজনের দশ বার মেলা ঘোরা হয়ে গেছে। “তুই চল আমাদের বাড়ি।” শবনম বলে সায়েদাকে। সায়েদা মানা করে দেয়। তার বাবা তাকে সঞ্জয় কাকুর আইসক্রিম-এর দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছে। “তাহলে আমি এগলাম, মায়ের কাজে হাত দিতে হবে” বলেই শবনম সেখান থেকে চলে যায়। সায়েদা অপেক্ষা করতে থাকে তার বাবার। সে মাইক এ শুনতে পায়, ইমাম সাহেব চিৎকার করে দুয়া করতে শুরু করেছেন। নামাজিরা সব হাত তুলে রবের নিকট প্রার্থনা করতে শুরু করেছেন। সায়েদার ইচ্ছে হয় গিয়ে একটু পেছন থেকেই উঁকি মেরে দেখার। সে এগিয়ে যায়। ঈদগাহের ময়দান চারিদিক দিয়ে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। আর মেইন গেট এ একটা টিনের বাড়ির মত ছাউনি। নিচে বড় বড় আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা “বিসমিল্লাহির রহমানের রহিম।” সায়েদা গেটের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। ভেতরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। সাদা সাদা অনেক গুলো টুপির মাঝখানে সে খোঁজার চেষ্টা করে তার বাবা ও ছোট ভাই কে।

হঠাৎ একটা সোঁ সোঁ শব্দ শুনতে পেয়ে ভয় পেয়ে যায় সায়েদা। দেখে মাঠের ওপর একটা হেলিকপ্টার এর মত, কিন্তু ছোট দেখতে, অনেক গুলো পাখাওয়ালা একটা বস্তু উড়ছে। সাত্তার আলীর ছেলে ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করছে সবকিছুর। তারপরই হটাৎ সবাই উঠে দাঁড়াতে শুরু করলে সায়েদা ছুটে যায় আইসক্রিম দোকানের কাছে। একটা আইসক্রিম কিনে খেতে শুরু করে সায়েদা। দেখতে পায়, শয়ে শয়ে লোক ভীড় করে বেরিয়ে আসছে মাঠ থেকে। তারা সবাই একে অপর কে জড়িয়ে ধরছে। সবাই সবাইকে “ঈদ মোবারক” বলছে। সায়েদা খুঁজতে থাকে তার বাবা আর ভাই কে। তার হাতের আইসক্রিম টা প্রায় শেষ হয়ে আসে, আর আইসক্রিমের ভেতরের কুচি কুচি নারকেলের শাঁসগুলো চিবোতে শুরু করে সে। এদিকে ওদিকে তাকায়। দেখতে পায় সাত্তার আলীর ছেলে একটা বড় ব্যাগের ভেতর তার ড্রোন ক্যামেরাটিকে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। তার ছবি তুলে নেয়নি তো ড্রোনটা? যখন সে উঁকি মেরে মেরে দেখে নিচ্ছিল ঈদগাহের ভেতরে! এসব নানান বিষয় তার মাথায় ঘুরপাক খেতে শুরু করে।

সায়েদা মনে মনে ঠিক করে ও আর এই মেলায় আসবেনা। বরং ও মায়ের সাথেই বাড়িতে বসেই নামাজ পড়ে নেবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাবের মিয়া রাতুলের হাত ধরে এগিয়ে আসে। তার হাতে হলুদ ও লাল রঙের একটা বেলুন সেরেঞ্জায় আটকানো। সায়েদা তার কাছ থেকে বেলুনটা চেয়ে নেয় এবং তার হাত ধরে বাড়ির উদ্দেশ্য হাটতে শুরু করে। সাবের সঞ্জয় কে বলে দেয়, দোকান শেষে বাড়ির দিকে আসতে, ওর ভাবি ওর জন্য লাচ্ছি সমই রাখবে। সঞ্জয় একগাল হাসি দিয়ে বলে, ঠিক আছে দাদা। একদিকে বাবা, একদিকে দিদি, আর মাঝখানে দুজনের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে রাতুল। বাড়ি পৌঁছে দেখে সায়েদা তখনও জায়নামাজ এ বসে। তার ঈদ এর নামাজ শেষ হয়েছে সবে মাত্র। সাবের আলী তার স্ত্রীর কানের কাছে গিয়ে মুচকি হেসে বলে “ঈদ মোবারক”। রাতুল দিদির কানে কানে বলে দেয় – “তোরই মজা দিদি। তুই ড্যাং ড্যাং করে মেলা ঘুরলি, আর আমি নামাজ পড়লাম”।

You may also like