আরো একবার এসে দাঁড়ালাম নদীর কাছে। এই নদী আমার ভালোবাসার। এই নদী আমার স্মৃতির। এই নদী আমার জীবনের সঙ্গে অনেকখানি মিশে থাকার অবশ্য নদী না বলে খালও বলা যায়। এপারের থেকে ওপারের দূরত্ব খুব বেশি নয়। হয়তো ছিলো একদিন। সেদিন তার সারাটা শরীর জুড়ে ছিল যৌবনের দামালপনা। কিন্তু আজ সে ক্ষীণকায়া। দুই পাড় পরস্পরের কাছে আসতে আসতে অনেকটাই অপ্রশস্ত করে দিয়েছে তাকে। এ পাশের পাড় বরাবর গ্রাম। ওপারে ফাঁকা ফাঁকা কতগুলো বনবাবলার সারি। ওটাই নদীর সীমানা। সেই সীমানার পরে বিস্তৃত একখানি মাঠ। সারি সারি ফসলের ক্ষেত। মাঠের শেষে অনেকখানি দূরে আরো একখানি গ্রাম। সে গ্রামের মাথার উপর দিয়ে যখন সূর্য ডোবে, নদীর জলে ছড়িয়ে পড়ে দিনান্তের বাদামি আভা, সেই আভায় মন কেমনের বার্তা ছড়ায়। ঝিমিয়ে আসে এপারের গ্রামখানি। রাত্রির হামাগুড়ি শুরু হয় ঝোপে ঝাড়ে।
কতবার এমনি করে এসে দাঁড়িয়েছি এখানটায়। আজও দাঁড়ালাম। পশ্চিমের মাঠের পাশে দিগন্তে সূর্য ডুবছে। সারাটা আকাশ একটা রক্তিম আভায় মাখামাখি। দিনশেষের রোদ নিজেকে গুটিয়ে এনে ঢুকতে শুরু করেছে খোলসের ভেতর ।এক ঝাঁক বালিহাঁস মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। দূরে দূরে কৃষকের ঘরে ফেরার ব্যস্ততা ।বনবাবলার মাথায় মাথায় বসে আছে গোটাকয় পানকৌড়ি আর দুধেল ডানার বক।
সুপ্রিয়া বলতো, ” আমরাও যদি ওদের মতো উড়তে পারতাম।”
আমি জিজ্ঞেস করতাম,” কেন, কি হতো তাতে?”
সুপ্রিয়ার দৃষ্টি তখন দূরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বনবাবলার ডালে বসে থাকা বকেদের দিকে।বলতো,” ওদের মতই যেখানে ইচ্ছা যেতে পারতাম। যেভাবে ইচ্ছে থাকতে পারতাম।”
একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এই জীবনটা কি তোর ভালো লাগেনা সু?”
কোনও উত্তর দেয়নি সুপ্রিয়া। বরং আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আমাদের আকাশটা কত বড়ো তাই না সোমু দা?”
প্রথম থেকেই আমাকে’ দাদা ‘ বলে ডাকতো সুপ্রিয়া। কিন্তু কোনদিন ‘বোন’ বলে ভাবতে পারিনি তাকে। তার কাছে গেলেই এক অন্যরকমের ভালোলাগা অনুভব করতাম। সে ভালোলাগা একদিন ভালোবাসায় বদলে গিয়েছিলো। আর সেটা হতে সাহায্য করেছিল এই নদী। কতদিন কত খেলার ছলে এসে দাঁড়িয়েছি এই নদীর কাছে। ছোট ছোট ঝোপের পাশে তাকিয়ে দেখেছি দিগন্তে সূর্য ডোবা। বালিহাঁসের ডানায় ঝলকে উঠতে দেখেছি দিনশেষের রোদ। আবার দিনের আলো মুছে দিয়ে সন্ধেকেও নামতে দেখেছি বহুদিন।
একদিন সুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করেছিল, “আচ্ছা সমু দা, এরকমই কোনো নদীর পাড়ে যদি আমাদের একটা বাড়ি হয় কেমন হবে বলো তো?”
চমকে উঠেছিলাম সেদিন, “মানে?”
হঠাৎ যেন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম খুব। ভেতরে অনুভব করেছিলাম কিসের এত অস্থিরতা। দূরের গ্রামটার মাথার উপর দিয়ে তখন সূর্য ডুবছে ।চারিদিকে দিনশেষের ইশারা। পাখির দল ফিরতে শুরু করেছে বাসায় ।দিনশেষের উড়াল দেওয়া বালিহাঁসের ডানা চ্যুঁইয়ে সন্ধ্যা নামছে। নদীর জলে হাল্কা একটা হাওয়ার কাঁপন।আমাকে ভয় পেতে দেখে হেসে ফেলেছিল সুপ্রিয়া, “ভয় পেয়ে গেলে সমুদা? পুরুষ মানুষ এত ভীতু হলে চলে? চলো বাড়ি যাই।”
বাবা বলতো, “বুঝলি সমু, জীবনে ভয় পাবিনা। ভয় সব সময় মানুষকে বিপথে চালিত করে। সাফল্য পেতে চাইলে আগে সাহসী হবি।”
আমাদের আর্থিক অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না। সংসারে বাবা-মা আর আমরা তিন ভাই বোনকে নিয়ে মোট পাঁচ জনের সংসার। চাষের কাজ করে বাবার পক্ষে সে সংসার টেনে নিয়ে যাওয়া প্রায় ছিল দুঃসাধ্য। বিঘে চারেক মাত্র জমি। কত আর ফসল হয় তাতে। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। দু’বেলা-দু’মুঠো খেতে পাই কেবল। পড়াশোনার খরচ চালানো অসম্ভব বিবেচনা করে বাবা আমাকে মামার বাড়িতেই পাঠিয়ে দিয়েছিল। সবে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়েছি। কীইবা এমন বয়স। নতুন বাড়ি। নতুনগ্রাম। নতুন সব মানুষজন চারপাশে। তবে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছিলাম অল্পদিনেই। দিকে দিকে হাজারো গাছের মেলা। পাখপাখালির ভীড়। বিরাট একখানা মাঠ। উন্মুক্ত আকাশ। আর এই নদী। খেলার ছলে কতবার এসে দাঁড়িয়েছি এই নদীর পাড়ে। দুই চোখ ভরে দেখেছি তার নিরন্তর বয়ে চলা। ভরদুপুরে আকাশের ছবি ভাসতে দেখেছি তার বুকে। পানকৌড়ি, মাছরাঙাদের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল আমার। বন্ধু করে নিয়েছিলাম নদীকে। মাঠ, নদী, ফুল, পাখি, গাছপালা – এরাই ছিল আমার সারাক্ষণের খেলার সাথী। আর ছিল সুপ্রিয়া। মামা বাড়ির পাশেই বাড়ি। নিত্যানন্দ রায়ের ছোট মেয়ে। ওই বয়সেই তার চোখ জুড়িয়ে যাওয়া চেহারা। পড়াশোনাতেও মন্দ নয়। আমার থেকে এক ক্লাস নিচে পড়তো সে। কতই বা বয়স দুজনার। রান্নাবাটির দিনটাও শেষ হয়নি। কত ছুটির দুপুরে মামাদের আমবাগানে রান্নাবাটির সংসার সাজিয়েছি আমরা। অথচ সংসার সম্পর্কে কোনও ধারণাই হয়নি আমাদের। যখন ধারণা হলো ততদিনে অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছি দু’জন। গাছের তলায় রান্নাবাটির সংসার সাজানোও শেষ হয়ে গিয়েছে। বরং মনের কোনায় একটু একটু করে বড়ো হচ্ছে সত্যিকারের এক সংসার গড়ার স্বপ্ন। পরস্পরের প্রতি গড়ে উঠেছে অন্যরকমের টান। পড়াশোনার চাপ বেড়েছে। স্কুল থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরটাকে খোলা হাওয়ায় জুড়াবো বলে এসে দাঁড়াই নদীর পাড়ে। আসে সুপ্রিয়াও। দিনশেষের রোদ ততক্ষণে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছে নিজেকে। একটু একটু করে পাল্টাতে শুরু করেছে আকাশের রং। পানকৌড়ির ডানাতেও ক্লান্তির ছোঁয়া। মন কেমনের এক ছবি মাঠজুড়ে।
সুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করতো,” এই বিকেলটা তোমার ভালো লাগে সমু দা?”
আমি বলতাম, “হুঁ।”
ফের জিজ্ঞেস করতো, “গ্রামটা? “
আবারো বলতাম, “হুঁ।”
“নদী?”
“নদীকেও খুব ভালোবাসি।”
তারপরেই আচমকা সেই প্রশ্ন, “আর আমাকে?”
দূরের মাঠটার দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তাকাতাম সুপ্রিয়ার দিকে। দুই চোখ ভরে দেখে যেতাম কেবল। দিগন্তের শেষ সীমানায় পৌঁছে যাওয়া সূর্যের শেষ রোদটুকু ছড়িয়ে পড়তো তার মুখে। তীব্র এক ভালোলাগা উথলে উঠতো বুকের ভিতর।
সুপ্রিয়া জিজ্ঞেস করতো,” কি হল সমু দা?”
আমি বলতাম, “তোকে খুব ভালোবাসি রে সু।”
এভাবেই একটা অদৃশ্য বাঁধনে একটু একটু করে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম আমি। নদী, মাঠ, গাছপালা, ফুল, পাখি, আর সুপ্রিয়ার সঙ্গে। যখন গ্রীষ্ম কিংবা পুজোর ছুটিতে বাড়িতে যেতাম দুদিনেই কেমন হাঁপিয়ে উঠতাম। কোনও কিছুতেই ভালো লাগতো না আমার। নিজের বাড়িঘর, গাছপালা, মাঠ – সবাইকেই যেন পর মনে হতো। অদৃশ্য এক উপস্থিতি কিছুতেই একাত্ম হতে দিত না তাদের সঙ্গে।
মা বলতো,” তোর কী হয়েছে বলতো সমু? সারাক্ষণ চুপচাপ বসে থাকিস। কোথাও একটু বেরোস না। একটু বাইরে বেরো। মানুষের সাথে মেশ। খোলা হওয়া গায়ে লাগা। “
কোনও উত্তর না দিয়ে তাকাতাম মায়ের দিকে। মা ফের জিজ্ঞেস করতো, “তোর কি কিছু হয়েছে রে খোকা?”
আমি মাথা নাড়তাম। বাবা বলতো, “কি আবার হবে? কত পড়ার চাপ থাকে ওর বলো তো? নারে সমু, তোর যেমন ভালো লাগে থাক।”
নিজেকে নিজের ভিতরে আটকে রাখতাম ক’দিন। সারাদিন খাওয়া, ঘুম, আর বিকেল হলে বাড়ির সামনের মাঠে গিয়ে দাঁড়ানো। বেশ বড় মাঠ। ফসলের ক্ষেত। রাশি রাশি ফসল। অসংখ্য পাখি। কিন্তু আমার চোখ জুড়ে কেবল ভাসতো নদী। নদী পাড়ের বনবাবলার গাছ। গাছের মাথায় পানকৌড়ি, বকের মেলা। পশ্চিমের মাঠ। দিগন্তের কোল ঘেঁষে সূর্য ডোবা। আর ভাসতো সুপ্রিয়ার মুখখানি। বুকের ভেতর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইতো দলা পাকানো একটা কষ্ট। অস্থির হয়ে উঠতাম। তবু যেন শেষ হতে চাইতো না ছুটির দিনগুলো।
অবশেষে ছুটি ফুরোতো। আমি এসে দাঁড়াতাম এই নদীর পাড়ে। শান্ত, স্নিগ্ধ, ছোট্ট এই গ্রাম্য নদী। অথচ কোথায় যেন এক বিরাট বিস্তৃতি তার। পাখির ডানায় ভর করে সন্ধে নামতো। একটু একটু করে কালো হয়ে আসতো তার বুক। সারা মাঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তো ঝাপসা অস্পষ্টতা। তখনই আমার পাশে এসে দাঁড়াতো সুপ্রিয়া। বলতো,” কদিন খুব আনন্দে কাটালে বলো?”
ঘুরে তাকাতাম সুপ্রিয়ার মুখের দিকে, “তার মানে তোরও ভালো কেটেছে? “
সুপ্রিয়া বলতো, “আমি কি তাই বলছি?”
“তাহলে কি করে বুঝলি আমার খুব আনন্দ হয়েছে বাড়িতে গিয়ে?”
“কতদিন পরে নিজের বাড়িতে গেলে। বাবা,মা,ভাই,বোন, নিজের ঘরবাড়ি – “
“তোকে বড় দেখতে ইচ্ছে করতো রে সু।”
“তাহলে যাও কেন?”
“বাবা,মা,ভাই,বোন – ওরাও যে আমাকে দেখতে চায়।”
” তাই বলে এত দিন থাকতে হবে? “
” আবার তো ফিরে এসেছি।”
সুপ্রিয়ার বুকের ভিতর এতদিন ধরে জমা হওয়া দীর্ঘশ্বাস আমায় ফিরে পেয়ে বেরিয়ে এসে মিশে যেত মাঠের খোলা হাওয়ায়। দূর দিগন্তের শেষ রক্তিমাভার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকতো সুপ্রিয়া। আমি জিজ্ঞেস করতাম, ” রাগ করেছিস সু?”
সুপ্রিয়া বলতো, “করতে নেই বুঝি?”
“তাই কি বললাম? “
তারপর মান-অভিমানের পালা মিটিয়ে অনেক কথা। অনেক স্মৃতিচারণ।
এমনই এক সন্ধেবেলায় সেই প্রশ্নটা করেছিল আমায়, “আচ্ছা সমু দা, এরকমই কোনো নদীর পাড়ে যদি আমাদের একটা বাড়ি হয় কেমন হবে বলো তো?”
সত্যি বুঝি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। আর আমাকে ভয় পেতে দেখে হেসে ফেলেছিল সুপ্রিয়া, “ভয় পেয়ে গেলে সমু দা? পুরুষ মানুষ এত ভীতু হলে চলে? চলো বাড়ি যাই। ”
সুপ্রিয়ার হাতটা ধরে ফেলেছিলাম, “না রে, সু, একদম ভয় পাইনি।”
হাসি থামিয়ে সিরিয়াস হয়ে উঠেছিল সে, “আমায় ফেলে তুমি চলে যাবে না তো সমু দা?”
জিজ্ঞেস করেছিলাম, “চলে যাবো? কোথায়?”
“তোমার বাড়ি? “
“গেলে তোকেও নিয়ে যাবো।”
না, নিয়ে যেতে পারিনি আমি। এক সন্ধেবেলায় খেতে বসে আচমকাই মামা বলেছিল, “কালই তোকে চলে যেতে হবে সমু।”
চমকে উঠেছিলাম, “কোথায়?”
“তোদের বাড়িতে।”
” কেন?”
“সে আমি তোকে বলতে পারবো না। কেবল এটুকু জেনে রাখ, এবাড়িতে তোকে আমি রাখতে পারবো না আর।”
অস্ফুটে কেবল উচ্চারণ করেছিলাম, “মামা – “
মামা বলেছিল, “আমি নিরুপায় রে সমু।”
আকাশটা বুঝি আচমকাই ভেঙে পড়েছিল মাথায়। নিজেকে বাঁচানোর তীব্র প্রয়াসের মধ্যে বারবার কেবল টের পাচ্ছিলাম নিঃসীম এক শূন্যতার মাঝে হারিয়ে যাচ্ছি বারবার। চারপাশে কেবলই শূন্যতা।
সারারাত ঘুমাতে পারিনি একদম ।সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে পড়ার স্বপ্ন দেখছি। দুই চোখ জুড়ে এই গ্রামের মাঠ, নদী, গাছপালা, ফুল, পাখি, আকাশ, আর নতুন কলেজ ।সেই সাথে জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাওয়া সুপ্রিয়া। যাকে ছাড়ার কথা ভাবতেও পারিনি মুহূর্তের জন্যেও। সেই তাকে ছেড়ে, নদী, মাঠ, ফুল ,পাখি, আকাশকে ছেড়ে –
সবকিছু ছেড়ে দিয়ে পরদিন সকালেই বেরিয়ে পড়েছিলাম বাড়ির দিকে। আমার নিজের বাড়ি। শৈশবের ঠিকানা।
আমাকে কাছে পেয়েও বাবার গম্ভীর মুখ। মায়ের চোখে জল। বাবা বলেছিল, “জীবনটা সব সময় সোজা পথে চলে না রে সমু। হঠাৎ হঠাৎ বড়োসড়ো বাঁক এসে যায়। সে বাঁক যত বড়োই হোক না কেন ভয় পেয়ে থেমে যেতে নেই।”
আচমকা অত বড়ো বাঁকের মুখে পৌঁছে থমকে গেলেও থেমে যাইনি একদম। একটু একটু করে সামলে নিয়েছি নিজেকে। যদিও চোখের সামনে বারেবারেই ভেসে উঠেছে এই নদী, মাঠ, সন্ধে নামা, আঁধার ঢাকতে শুরু করা আকাশ, আর সুপ্রিয়া। কেমন আছে? কি করছে? কোনও খবর পাইনি।
তারপর কবে যেন অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। পড়াশোনা শেষ করে স্কুলের চাকরি তে ঢুকেছি। চারপাশে অসংখ্য মানুষ। হাজার ছাত্রছাত্রীর ভীড়। সময়ের পলি একটু একটু করে ঢেকে দিয়েছে আমার অতীত। ঝাঁপসা হয়ে এসেছে এই নদী, মাঠ, আকাশ, এমনকি সুপ্রিয়ার মুখখানিও। তবে একেবারে ভুলে যায়নি। যখনই একটু একার সঙ্গে সময় কাটাতে চেয়েছি একান্তে তখনই ভেসে উঠেছে সবাই। বিস্মৃতির পাতলা পর্দা সরিয়ে আবার তারা এসে দাঁড়িয়েছে চোখের সামনে। যতবারই বিয়ে করার কথা ভেবেছি ততবারই যেন সুপ্রিয়া এসে দাঁড়িয়েছে আমার মুখোমুখি। জিজ্ঞেস করেছে, “কি হল সোমু দা, আমার কথা ভুলে গেলে? কি করে ভুললে বলতো? সেদিন আমবাগানে – “
যেদিন এই গ্রাম ছেড়ে, এই নদী, মাঠ, গাছপালা ছেড়ে, সুপ্রিয়া কে ছেড়ে আমি চলে যাই তার আগেরদিন সন্ধেবেলায় নদীর কাছ থেকে ফেরার পথে মামাদের আমবাগানের ঝাঁপসা আঁধারে নিজেকে আমার কাছে সম্পূর্ণরূপে সমর্পনে উদ্যত হয়েছিল সুপ্রিয়া।আমার ঠোঁট দু’টো স্পর্শ করেছিল ওকে।আমার মন,আমার সমগ্র সত্ত্বা জুড়ে সেই মুহূর্তে কেবল ছিল তারই উপস্থিতি।
সুপ্রিয়ার কথায় সে সবই মনে পড়ে গেছে বারবার। নিজেকে নিরস্ত করেছি বিয়ে করার থেকে। ভেবেছি এই স্মৃতিটুকু নিয়েই থেকে যাব জীবনের বাকিটা সময়।
নিজেকে যতটা স্থির রাখার চেষ্টা করেছি নিজের সিদ্ধান্তে ততোই পেছন থেকে আমায় তাড়িয়ে বেড়িয়েছে মা, “বয়স তো কম হলো না সমু। এবার অন্তত বিয়েটা কর।”
বলেছি ,”কেন মা, বেশ তো আছি।”
“এটা বেশ থাকা নয় রে। বৌ সন্তান নিয়ে সুখে থাকাটাই বেশ থাকা বলে।”
“সময় কি ফুরিয়ে যাচ্ছে মা?”
“নয়তো কি? এই বৈশাখে চল্লিশে পড়লো তোর। এখনও যদি বিয়ে না করিস আর কবে – “
” ঠিক আছে, আর কটা দিন যাক। নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে নিই। তারপর – “
“কি আর গোছাবি। বৌ আসুক। সে ই গুছিয়ে নেবে সব।”
নিরন্তর পেছনে পড়ে আছে মা। আর আমি সিদ্ধান্তে থেকেছি অনড়। সুতরাং চল্লিশে পৌঁছেও আমি এক। ঠিক একাও নয়। সুপ্রিয়া আছে। আমার স্মৃতিতে। আমার সত্ত্বায়। আর থেকে গেছে এই নদী, মাঠ, আকাশ, বনবাবলার গাছ, বক, পানকৌড়ি, বালিহাঁসের সারি, ঝিঁঝিঁ ডাকা সন্ধে। বারে বারে ফিরে আসতে ইচ্ছে হয়েছে এদের কাছে। কিন্তু পারিনি। অদৃশ্য এক নিষেধের দেয়াল খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে সামনে। একটা অভিমান এসে পেছন থেকে টেনে ধরেছে বারবার। অগত্যা পিছিয়ে এসেছি।
এরইমধ্যে কাল রাতে হঠাৎ মামার ফোন, “একটাবার তোর মাকে নিয়ে আসতে পারবি সমু?”
এতদিন পরে হঠাৎ এভাবে মামার আহ্বান পেয়ে চমকে উঠেছিলাম। আচমকাই তীব্র ঝাঁকুনি অনুভব করেছিলাম সমগ্র সত্ত্বায়। তবু বলেছিলাম, “কিন্তু মামা – “
মামা বলেছিল, “আর না করিস না সমু। মায়ের শরীরটা খুবই খারাপ। বোধ হয় বাঁচবে না। তোদের দুজনকে খুব দেখতে চাইছে।”
মা বলেছিল ,”এটা অভিমান করে বসে থাকার সময় নয় সমু। মা তোকে কত ভালোবাসতো বল। তার শেষ সময় আজ – “
আর বলতে পারেনি মা। আমার হাতদুটো ধরে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেছিল। আমার ভিতরের সব অভিমান ধুয়ে গিয়েছিল সেই চোখের জলে।
অগত্যা এতগুলো বছর পরে ফের একবার মামার বাড়িতে পা রাখা। আর আরও একবার এসে দাঁড়ানো এই নদীর পাড়ে।
শেষ ফাল্গুনের পড়ন্ত বিকেল। দিগন্তে সূর্য ডুবছে। মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল বালিহাঁসের ঝাঁক। ওপারের বনবাবলার মাথায় শেষ উড়ালের অপেক্ষায় বক,পানকৌড়ি, মাছরাঙা রা। বড়ো মাঠটার বুক জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে দিনশেষের বিষন্নতা। বিষন্নতা আমার ভেতরেও। কতদিন, কতবার এমনি সময় এমনি করে এসে দাঁড়িয়েছি এখানে। তবে একা নয়।সঙ্গে সুপ্রিয়া ছিল।কিন্তু আজ –
বিকেলের শেষ আলো মুছে গিয়ে কখন সন্ধে নামতে শুরু করেছে খেয়াল নেই। ঝোপঝাড়ের গায়ে গায়ে জড়িয়ে আসছে ঝাঁপসা আঁধার। ঝিঁঝিঁরাও বেরিয়ে পড়েছে বাসা ছেড়ে। নদীপাড়টা নির্জন হয়ে এসেছে অনেকখানি। আচমকা পিছনে পায়ের শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকালাম। আর অস্ফুটে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, ” সু – “
“হ্যাঁ আমি। কতগুলো বছর তোমার অপেক্ষায় থেকেছি। জানতাম তুমি আসবে। আর এলেও।”
“ভালো আছিস সু? এ কী চেহারা হয়েছে তোর?”
” এভাবে কি ভালো থাকা যায় সমু দা? তাই তো – “
” আজও আমায় ক্ষমা করতে পারিস নি, না রে সু?”
“ক্ষমা? ক্ষমা কীসের সমু দা? তুমি তো কোন দোষ করো নি।”
” সু – “
” হ্যাঁ সমু দা। তুমি না জানলেও আমি জানি কেন সেদিন তোমায় চলে যেতে হয়েছিল।”
” কেন রে?”
” তোমার মনে আছে সমু দা, সেদিন সন্ধ্যায় মামাদের আমবাগানে আমার ঠোঁটে তোমার ঠোঁট।আমার শরীরে তোমার শরীর।চারিদিকে সন্ধ্যার আড়াল।নির্জনতা – “
” হ্যাঁ,কেউ কোথাও নেই।কেবল তুই আর আমি।”
” না সমু দা,আরও একজন ছিল।”
” আরও একজন? কে সে?”
” আমার বাবা।কী একটা কারনে সেদিন বাগানে ঢুকেছিল।আর চোখের সামনে ওভাবে দেখে ফেলেছিল আমাদের।বাবা ই তো গিয়ে তোমার মামা কে বলল।সে রাতে আমায় খুব মেরেছিল গো সমু দা।তারপর তো এক সপ্তার মধ্যে বিয়েটা দিয়ে দিল।”
” তোর বিয়ে হয়ে গেছে সু?”
” হয়েছিল।”
” মানে?”
” মাত্র এক মাসের সংসার আমার।ও বাড়ি থেকে তোমার কথাটা কী করে যেন জেনে গিয়েছিল।আরও একবার মার খেয়েছিলাম আমি।মেরে ধরে তাড়িয়ে দিয়েছিল আমাকে।আর জোর করেনি বাবা।সেই থেকে একাই আছি।প্রতিদিন এসে দাঁড়াই এখানে।বিকেলের আলো ফুরিয়ে সন্ধে নামে।ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝিঁ রা বেরোয়।দিন শেষের উড়াল দিয়ে ঘরে ফিরে যায় বালিহাঁসের ঝাঁক।আমি বসে থাকি তোমার আশায়।কেবলই মনে হয় তুমি আসবে।তারপর আমাকে নিয়ে – “
বলতে বলতে থেমে গেল সুপ্রিয়া।দিন শেষের সমস্ত আলো মুছে গিয়ে সন্ধে নামছে।একটা অস্পষ্টতায় ঢাকতে শুরু করেছে চারিদিক।বনবাবলার মাথার ওপর থেকে কখন উড়ে গেছে বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙারা।দিগন্তের রক্তিমাভা ঢেকে যাচ্ছে ঝাঁপসা অস্পষ্টতায়।আমি তাকিয়ে আছি সুপ্রিয়ার দিকে।বারে বারে ফিরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে সেইসব দিনগুলোয়।সেই বিকেল।সেই নদীপাড়।সেই সন্ধে নামা।সেই বনবাবলার মাথার উপরে বসে থাকা বক, পানকৌড়ি, আর মাছরাঙা।সেই ঝিঁঝিঁর ডাক।সেই –
” আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যাবে সমু দা?”
বহুদিন পর বুকের ভেতরটায় ফের একবার তীব্র ভালোলাগা। ফের একটা উচ্ছ্বাসের ঢেউ।যে ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছি আমি।।
( গল্পটি বরাহনগর দর্পণ শারদ সংখ্যা ‘বাংলার মুখ’ এ প্রথম প্রকাশিত)