অনৈতিক আনন্দ

সোনিয়া তাসনিম

কবিরের ছেলেটা দেখেছ, কেমন বাউন্ডুলে! কাজকর্ম নেই কিছু, সারাদিন কেবল ভবঘুরের মতো ঘুরে বেরাতে পটু। আর ঐ যে জমিলার মেয়েটা, বাপ রে, কী দেমাগ হয়েছে! যেই না দুই পয়সা রোজগার করে, তার অহংকারে একদম…

আহ, থামবে? সকাল সকাল শুরু হয়ে গিয়েছে তোমার! বলি, এত এনার্জি পাও কোথা থেকে বল তো? সারাবেলা কাজ করতে গিয়ে তোমার হাড় জুড়ায় না, সুযোগ পেলেই তো এই এক গল্প ফেঁদে বসো। আরে, কিছু নিজের দিকেও দেখ, তুমিও তো কারও থেকে কোনো অংশে বৈ কম যাও না।

হাতে থাকা খবরের কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলে রেখে দিয়ে রাহেলার উদ্দেশ্যে কথা বলেন জমির সাহেব। ঘড়িতে সকাল সাতটা বেজে পাঁচ। জলদি স্নান সেরে নিয়ে বেড়িয়ে পড়তে হবে। নইলে আজ কপালে নির্ঘাত দুঃখ আছে। এই নিয়ে পরপর তিনদিন হাজিরা খাতায় লাল কালির দাগ পড়বে। উফ! কি করে বুঝানো যায়, সকলকে যে ঢাকা শহরের জ্যাম বলে কথা। এটা মোটেও যে সে ঝামেলা নয়। একবার ফেঁসেছ তো, বাছা খুব করে কেঁদেছ। সবাই জানে এই আপদের গল্প। তবুও যেন কিছু না বুঝার ভান করে ফুল বাবুটি সেজে থাকে। ন্যাকা যত্তসব। আপনমনেই চেনা মুখ কতগুলোর গুষ্টি গিলে খেলেন জমির চৌধুরী। রাগে পিত্তি খানা জ্বলে যাচ্ছে। রোজ সকালে এই পাবলিক বাসে ঝুলে আপিস করবার মত এত হ্যাপা বুঝি আর কোন কিছুতে নেই। কি আর করা! সবই কপালের লিখন। মাঝে মাঝে মনে হয় সৃষ্টিকর্তার বুঝি ওর ভাগ্য লিখবার সময় দোয়াতের কালি ফুরিয়ে এসেছিল। এই যত সব দুর্ভোগ ওটার জন্যই হচ্ছে। এই রে! সাতটা পনেরো। প্রমোদ গুনেন জমির সাহেব। নাহ! এবার উঠতেই হবে।

শুনছ, স্নানের জন্য একটু গরম পানি হবে কি? কাল রাত থেকে বাতের ব্যাথাটা বড্ড ভোগাচ্ছে।

জমির সাহেব গলাটা চড়িয়ে নেন। রাহেলা কথাটার জবাব না দিয়ে গোমড়া মুখে রসুই ঘরের দিকে যায়। বুঝাই যাচ্ছে সকাল সকাল পরচর্চার গল্পে জমির সাহেবের বাধা দেওয়াটা ওনার মোটেও পছন্দ হয় নি। স্ত্রীর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলেন জমির। এই না হলো বাঙালির অভ্যাস। যখন দেখ কেবল পরনিন্দা আর পরচর্চা। পাকা জহুরীর মত চোখে চশমা এঁটে নিয়ে অপরের দোষ খুঁজে বেড়ানো। এই করেই জীবন পাত। এই জন্যই বাঙালি আজীবন সেই ‘ভেতো বাঙালিই’ রয়ে গেল। জীবনে উন্নতি আর… সে যাক গে। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। চটপট গোসল সেরে কোনমতে নাকে মুখে দুটো গুঁজে নিয়ে জমির সাহেব পথে বেরিয়ে এলেন। আর তখুনি খেয়াল হলো, পানের স্টক শেষ। দুপুরের খাবার পর এক খিলি পান মুখে না নিলে আহারের সুখটা কেমন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। পিওনটাও আজ দুদিন হয় ছুটিতে। পরে আর কিনবার ফুরসত হয় কিনা তাই ভেবে মলয়ের দোকানের দিকে পা বাড়িয়ে নেন উনি। মলয় তখন সবে ঝাঁপি খুলেছে। জমির সাহেবকে দেখেই এক গাল হাসি হেসে বলল

আদাব চাচা, কি দিমু?

দুটো পান। জর্দা বেশি, সুপুরি কম।

জমির সাহেব দু আঙুলে ইশারা করলে বললে মলয় নির্দেশ মত নিপুণ হাতে পান সাজাতে থাকে। তন্ময় হয়ে সেই শিল্পকর্ম দেখতে থাকে জমির চৌধুরী। এ যেন সাধারণের মাঝে অসাধারণ কর্ম! সবুজ পানের মাঝে রঙিন মশলার পুর জমে উঠছে, কি সুন্দর! মলয়টা পারেও সত্যি। আসলে যার যেটা কাজ। রমিজের চিন্তার মাঝেই কোণাকৃতির পান খবরের কাগজের বাহুডোরে বন্দী হয়ে গিয়েছে। জমির সাহেবের অস্থির চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছিল দোকানের পসরার মাঝে। কতশত জিনিষে ঠাসা এই পাখির নীড়ের সম খুপড়িটা।

খবর কিছু জানেন নি চাচা, কাশেম চাচার মাইয়াটা…

মলয় পানের দামটা পকেটে পুড়ে নিতে ব্যস্ত থাকলেও থমকে যান জমির সাহেব। কৌতুহলী স্বর তুলে নেন গলায়

কি হয়েছে, কাশেমের মেয়ের?

আর শরমের কথা কি কমু? এক পোলার লগে ভাগছে

দশ টাকায় দু’ টাকা ফেরত দিতে দিতে বলা মলয়ের কথা যেন রমিজের জন্য মুহূর্তেই জ্বালানির খোরাক হিসেবে কাজ করে। চোখ দুটো আত্মতৃপ্তিতে জ্বলজ্বল করে ওঠে ওর। এই কাশেমের সাথে ওর হিসেব চুকানোর খেলা বহু পুরোন গল্প। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঐ অমায়িক মানুষটার ব্যক্তিত্বের কাছে ও যেন অঘোষিত যুদ্ধে পদে পদে হেরেছে। অজান্তে মনের মাঝে ঈর্ষা খানা তুষের আগুনের মত দিন রাত জ্বলত। ওফ! আর এখন! আর ভাবা যাচ্ছে না। আনন্দের আতিশায্যে একখানা পান জলদি মুখে পুরে নেন জমির। তৃপ্তিটা বুঝি আজ ষোল আনা মিলছে। চোখ বুঁজে নিজের ভাবে চুর হয়ে ছিলেন রীতিমত।

কি খবর, জমির সাহেব? অসময়ে মজে গিয়েছেন বেশ!

চেনা স্বর। আতিক আলমের গলা। চোখ খুলে নেন জমির সাহেব। সামনেই আগুন্তুক হাসি মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সুযোগটা সদ্বব্যহার করতে বিন্দু মাত্র দেরী করেন না জমির। কায়দা করে আঙুলে থাকা চুন জিবে ছুঁইয়ে নিয়ে বলতে থাকেন

আর আমাদের কথা ছাড়ুন। মশাই, খবর শুনেছেন? সমাজে তো মানসম্মান বলতে কিছু থাকল না আর।

কোন ব্যাপার নিয়ে কথা বলছেন, বলুন তো?

আতিক আলমের প্রশ্নটা যেন বারুদ স্ফুলিঙ্গের মত কাজ করল। পথে থক করে এক দলা পানের পিক পথে ফেলে নেন জমির।

আরে বুঝলেন না! কাশেমের মেয়েটার কথা বলছি। দেখলে তো মনে হয়, ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। তলে তলে…

জমির সাহেব এক নিঃশ্বাসে ওনার কথা বলে যাচ্ছেন। ওনার চোখে মুখে খেলছে একরাশ অজানা আনন্দ ঢেউ! এক অদ্ভুত অনৈতিক আনন্দের দ্যুতি।

You may also like

Vinnokatha
Prothom Khondo
Price: Rs.260/-
www.vinnokatha.in
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে। সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
মেহনতি মানুষের মুক্তি নিশ্চয়ই একদিন আসবে।সব ধরণের শোষণ শেষ হবে একদিন--এ স্বপ্ন আমরা দেখি। শুধু দেখি না, একে বাস্তবে কার্যকর করতে 'ভিন্নকথা' তার সাধ্যমত প্রয়াস চালিয়ে যাবে। মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, মানুষের চেতনার লক্ষ্যে, মুক্তির লক্ষ্যে।
Vinnokatha
Prothom Khondo