বিহতজনের উপাখ্যানঃ একটি মূল্যায়ন

বিহতজনের উপাখ্যান
আবু সিদ্দিক
প্রকাশকঃ রবি প্রকাশ, বাঘাযতীন, কলকাতা
প্রথম প্রকাশঃ ২০২১
পৃষ্ঠাঃ ৯৬
হার্ড কভার
বিনিময়ঃ ২০০/-
ISBN: 978-81-945846-5-0

বিহতজনের উপাখ্যান দ্বিভাষিক কবি ও গল্পকার আবু সিদ্দিকের এক অনবদ্য গল্প সংকলন যা প্রান্তিক, দলিত, ও শ্রমজীবি  মানুষের জীবনের উপর মর্মস্পর্শী আলো ফেলে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে নিজের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেছে।সংকলনটি করোনাকালে প্রকাশক কৌশিক গুড়িয়ার রবি প্রকাশের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এবং ব্যথিত, অসহায়, বঞ্চিত মানুষের প্রতি উৎসর্গীকৃত।

বইটিতে আছে মাটি ছুঁয়ে চলা গরিব মানুষের জীবনযাপনের গল্প যার কুশীলবরা আমাদের পরিবেশে লড়তে থাকা বাস্তব সমাজ জীবনের প্রতিনিধিস্বরূপ। কোভিড-১৯ এর কারনে নিউ নর্মাল পরিস্থিতিতে খেটে খাওয়া মানুষের কষ্টসাধ্য দিনযাপন, অস্তিত্বের লড়াই, অভিযোজন, গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে লেখকের একাত্মতা, চরিত্রগুলোর সরলতা পাঠককে সমাজ অনুধাবনে নতুন দৃষ্টি দেয়। কাহিনী বর্ণনায়, কথ্য ভাষার প্রয়োগে লেখকের সাবলীলতা লক্ষণীয়। প্রতিটি গল্পে মাটির গন্ধ, প্রাকৃতিক পরিবেশের আনন্দের সঙ্গে সহায়সম্বলহীন মানুষের দুঃখ-সুখের  মেলবন্ধন তার লেখনিতে এক বিশিষ্টতা  দান করেছে।
বিভিন্ন গল্পে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের একত্র সহাবস্থান ভারতীয় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাই তুলে ধরে।

বর্তমান উত্তর-আধুনিক সময়ে যান্ত্রিক সভ্যতা, শিল্পায়ন, ভোগবাদ, ধনতান্ত্রিক লিপ্সা এবং অবাধ বাণিজ্য ধনী-দরিদ্রের ব্যবধানকে যখন আরো প্রকট করে তুলছে, তখন বিশ্বগ্রাসী করোনার কারনে শ্রমজীবিরা কাজ হারিয়ে ভাইরাসে আক্রান্ত হবার আগেই অনাহারে মারা যাচ্ছে। কালের দলিলে এদেরকে চিরমুদ্রিত করাই লেখকের মূল লক্ষ্য। কুরমী, কেরু, খামারু, গনেশ, পরান, মধু, শেরু, হারু, আজা্‌দ, শান্তি মুর্মু, মকবুল—এরা সবাই কর্মহীন, উদরান্ন আহরণে অপরাগ। এরা হয় ক্ষুদ্রব্যবসায়ী  না হয় দিনমজুর অথবা প্রান্তিক কৃষক অথবা পরিযায়ী শ্রমিক। করোনাকালে সকলের সামনে নেমে এসেছে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার দুর্ভেদ্য অন্ধকার।

 লকডাউনের সময়ে পরিচারিকার কাজের শর্তে টাকা চাইতে গেলে অপমানিত হয় কুরমী। গৃহকর্ত্রী  তার পায়ের কাছে একটা ২০০ টাকার নোট ছুঁড়ে দেয়, কাজ পাবার আশায় রাজমিস্ত্রী কাজের জোগাল কেরু আল্লার কাছে গৃহমালিকের জন্য দোয়া করে, মা-বৌ-মেয়ে অনাহারে ঘরবন্দী আর রোজগারের আশায় পুরুষ মানুষ পড়ে আছে ভিন রাজ্যে। লেখকের কলম অত্যন্ত সহানুভূতির সাথে এদের দিন আনা দিন খাওয়া জীবনকে তুলে ধরেছে। আর্থিক অনটনের কারনে সংসারে নিত্য কলহ লেগেই রয়েছে। স্বামী-স্ত্রী যেন পরস্পরের বিরোধী। স্ত্রীর আঁশ কাটা কথা আর যেন সহ্য হচ্ছে না মধুর। “শালি মাগির ক্যাঁচ ক্যাঁচ শুনতে শুনতে কান পচে গেল। উঠতে বসতে মুখ ঝামটা। কার ভাল লাগে?তাই সে ভেবেছে ছ’মাসের জন্য পাঞ্জাবে যাবে। মাগির মুখ বন্ধ করবে।” এর উপর রয়েছে সোমত্ত মেয়েকে পাত্রযোগ্য করতে না পারার  ব্যর্থতা। প্রতিবেশীদের তির্যক মন্তব্য মধুর জ্বালাকে আরও বহুমাত্রিক করে তোলে।

তবে আশার কথা যে সাহেব-এর মত দুধ ব্যবসায়ীরা সুবানের মা, ছিরাফত চাচা ও করিম ভাইয়ের দুগ্ধপোষ্য শিশুদের  বাঁচিয়ে রাখে স্রেফ মানবিকতায়, মানুষের পাশে থাকার চিরন্তন অনুভবে। একই কারনে জাব্বার দেবেনের মেয়ের জন্য ভালো সম্বন্ধের বার্তা নিয়ে আসে।

সত্যিকারের ছোট গল্প, কম চরিত্র, ঘটনার জতিলতা নেই। তবে কিছু চরিত্রের মধ্যে ধরা পড়ে স্ট্রিম অফ  কনশাসনেশ।আর একটু চারিত্রিক পূর্ণতা হয়ত পাঠকের কাছে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠত। তবে সব কিছু মিলে বেশ উপভোগ্য । তারাশঙ্কর ও শরৎচন্দ্রের কিছু গল্প মনে পড়ে যায়। এখন স্বীকৃতি শুধু সময়ের অপেক্ষা।

You may also like