পঞ্চায়েত ভোটের দামামা বেজে গেছে। একই সঙ্গে শুরু হয়ে গিয়েছে রক্তঝরার কাহিনি। কিছু কিছু জায়গায় মনোনয়নপত্র দাখিলকে কেন্দ্র করে দিনে-দুপুরে পুলিশের চোখের সামনে মুড়ি মুড়কির মতো বোমা, গুলি পড়ছে। অভিযোগ, শাসক দলের চোখ রাঙানির সামনে নতি-স্বীকার করে বিরোধী প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারছে না৷ মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামে অকালে প্রাণ হারালেন ফুলচাঁদ শেখ। ভোটের দিন যত এগোবে খুনোখুনির সংখ্যাও তত বৃদ্ধি পাবে। রাজ্যের উত্তর থেকে দক্ষিণ প্রায় সর্বত্র প্রতি দিনই হিংসার খবর আসছে৷ আগ্নেয়াস্ত্রের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র আমার বাংলা। নির্বাচনের নামে প্রহসন চলছে। রাজ্য নির্বাচন কমিশন নিধিরাম সর্দার। পুলিশ প্রসাশন ঠুঁটো জগন্নাথ। ভীত, সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ। নিজেদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে প্রাণটাই না খোয়া যায়! সংবাদপত্রের পাতায়, টেলিভিশনের পর্দায় এখন শুধু সংঘর্ষ, অভিযোগ- পাল্টা অভিযোগের খবর৷ সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও একটি উপাদান–সন্ত্রাসের আবহ৷ প্রতিদিন কানে আসছে, শাসক ও বিরোধী দলের দ্বৈরথের ভয়ংকর হিংসার ছবি। সব মিলিয়ে, অবস্থাটা এমনই দাঁড়িয়েছে যা গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো বিজ্ঞাপন নয়৷
রাজ্যে সাড়ে পাঁচ কোটির বেশি ভোটদাতা, ২২ টি জেলায় ৩,৩১৭ টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ৩৪১ টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং ২০ টি জেলা পরিষদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন। মোট পঞ্চায়েত আসনের সংখ্যা ৬৩,২৮৩। মোট নির্বাচন কেন্দ্রের সংখ্যা ৫৮,৫৯৪। মহামান্য হাইকোর্ট রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে ৭ টি জেলায় স্পর্শকাতর ও অতিস্পর্শকাতর এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু তাতে কি হিংসার বলি বন্ধ হবে? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে রাজ্য সরকার ও রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পান্ডের আইনি লড়াই সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে তিন দফায় ভোট হয়েছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে। কিন্তু বাস্তবে কোনও লাভ হয়নি। সাধারণ ভোটারদের অরক্ষিত রেখে হাজার দুয়ারীতে কেন্দ্রীয় বাহিনী ভ্রমণে বেড়িয়ে ছিলেন ভোটের দিন।
২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনে লাগামহীন সন্ত্রাস দেখেছিল রাজ্য। বিভিন্ন জায়গায় বিরোধীদের মনোনয়ন জমায় বাধা ও প্রত্যাহারে বাধ্য করার অভিযোগ উঠেছে। এমনকী ভোটর দিন দেদার ছাপ্পা ভোট দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। ৩৪ শতাংশ বুথে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শাসকদল জয়লাভ করেছিল। সবক্ষেত্রেই প্রধান অভিযুক্ত ছিল তৃণমূল। কিন্তু হিংসা ও সন্ত্রাসের পরিবেশ বাংলার নির্বাচনে নতুন কোনও বিষয় নয়। কংগ্রেস ও বাম জমানাতেও রক্তপাতহীন ভোট ছিল আকাশকুসুম কল্পনা। রক্তপাতের সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। বরং উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন, কেন্দ্রীয় বাহিনী, পুলিশ প্রশাসন বারে বারে ব্যর্থ। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ছিল কোদালের বাঁটের দাপট। এবার ভোট বাজারে কোদালের বাঁটের সঙ্গে সঙ্গত করছে কাঁচা বাঁশ, ক্রিকেট উইকেট ও জলের পাইপ। এর সঙ্গে তো আগ্নেয়াস্ত্র আছেই। অর্থবল আর বাহুবল এখন নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার মূল চাবিকাঠি।
প্রশ্ন, কেন এত হিংসা? এত রক্ত কেন? রাজনৈতিক ব্যাখ্যা একটাই, সামনের বছর যেহেতু লোকসভা নির্বাচন, তাই পঞ্চায়েত ভোটকে তার সেমিফাইনাল ধরে নিয়ে সব দলই চাইবে নিজেদের শক্তি ও প্রভাব যতটা সম্ভব বাড়িয়ে নিতে৷ আর যেহেতু, দীর্ঘ দিন ধরেই ভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে অপরাধ জগতের একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলি গণতন্ত্রের স্বার্থ মেনে মানুষের সমর্থন সংগ্রহের জন্য চেষ্টা না করে পেশীশক্তির সাহায্যে সন্ত্রাসের মাধ্যমে তা ‘আদায়ের’ সহজিয়া পথ অবলম্বন করছে৷ শাসক দলের জন্য কথাটা আরও বেশি করে সত্যি৷
কিন্তু, শুধুই রাজনৈতিক ক্ষমতাটা বিস্তারের জন্যই এত রক্তপাত মনে করলে, সমস্যার সার্বিক চিত্রটা ধরা যাবে না৷ নিছক রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের প্রেক্ষিতে এই হিংসাকে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় না৷ এই হিংসার একটা অর্থনৈতিক ভিত্তিও আছে৷ প্রতি বছর গ্রাম-বাংলায় যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পে উন্নয়নের জন্য আসছে, তার একটা বড়ো অংশ লুঠ করার অধিকার পেতেই পঞ্চায়েত ভোটের সময় যেনতেনপ্রকারেণ ক্ষমতা দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে রাজনৈতিক দলগুলি৷ উন্নয়নের টাকার একটা বড়ো অংশই নির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে চোরাপথে রাজনৈতিক দলগুলির নেতা ও কর্মীদের পকেট স্ফীত করে চলেছে৷ সব দিক থেকেই পঞ্চায়েত হল সেই মৃত সঞ্জীবনী। এই জন্যেই পঞ্চায়েত দখলের জন্য এত মরিয়া থাকে শাসক দলগুলি৷ ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গ্রামের মানুষের অধিকার, সুযোগ সুবিধা পাওয়ার বদলে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের করে খাওয়ার জায়গা এখন পঞ্চায়েতরাজ।
যেখানেই বাঙালি সেখানেই ভোটে হিংসা, রক্তপাত, সন্ত্রাস। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ভারতের এই দুই রাজ্য ও প্রতিবেশী বাংলাদেশে নির্বাচনে রক্তপ্রবাহের দৃশ্য সবচেয়ে বেশি। কয়েক বছর আগেও বিহারকে আমরা জঙ্গলরাজ বলতাম। কিন্তু হিংসার আবহে বাংলা এখন কয়েক যোজন এগিয়ে। ভারতের অন্য রাজ্যে যখন রক্তপাতহীন ভোট প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, তখন বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্য বা দেশে নির্বাচনে রক্তপাত অতি স্বাভাবিক ঘটনা। বাঙালির এ বড় লজ্জা! গোখলে বেঁচে থাকলে তাঁর বক্তব্য নিশ্চিত ফিরিয়ে নিতেন।
গ্রাম বাংলার খেটে-খাওয়া অতি সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলের প্যাঁচপোচড়া বুঝতে না পেরে সহজেই তাদের দ্বারা ভুল পথে পরিচালিত হয় এবং নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়েন। অকালে ঝরে পড়ে তাজা প্রাণ। মায়ের কোল খালি করে ক্ষমতা দখলের খেলা চলে। আজ পর্যন্ত বাংলায় একটিও পঞ্চায়েত নির্বাচন রক্তপাত ছাড়া হয়নি। পঞ্চায়েত নির্বাচনের সঙ্গে বাংলায় হিংসার সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে। এটা বামফ্রন্টের সময় থেকে দেখে আসছি। স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের পরও বাংলায় ভোটে হিংসা ছবি বদলায়নি। গণতন্ত্র মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে।
রাজনীতিতে বাবু কালচার যতদিন থাকবে ততদিন মাঠে-ময়দানে লড়াই করবে সংখ্যালঘু ও পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়। রাজনৈতিক স্বার্থে এদেরকে বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করা হয়। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মাথায় বসে আছেন ব্রাহ্মণ্যবাদীরা যাঁরা ঠান্ডা ঘরে বসে সাধারণ মানুষের মধ্যে লড়াই বাঁধিয়ে দেন। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। পরিসংখ্যান বলছে, ভোট-বলিতে এগিয়ে সংখ্যালঘুরা। মারবে তারা, মরবে তারা। জেল খাটে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে বাবু সমাজ রাজনৈতিক পালঙ্কে দোল খায়। আর কবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘুম ভাঙবে ? আর কতদিন এভাবে রক্তগঙ্গা বইবে?
জনগণই গণতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি। কিন্তু জনগণকে গিনিপিগ হিসাবে ব্যবহার করা যতদিন চলবে ততদিন চলবে এই রক্তপাত। এমতাবস্থায় সাধারণ মানুষের একজোট হয়ে নিজেদের ভালোমন্দ বুঝে নেওয়ার সময় এসেছ। রাজনীতির এই দূষিত পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন করতে এগিয়ে আসতে হবে খেটে খাওয়া মানুষকেই। কারণ এই দেশটা শুধুমাত্র গুটিকতক রাজনীতির কারবারিদের নয়, এই দেশটা আমার, আপনার, সবার।