বিখ্যাত লেখক, হোর্হে লুই বোর্হেস লিখেছিলেন, “মানুষ ব্যতীত সব প্রাণীই অমর, কারণ তাহারা জানেই না যে তাহাদের মৃত্যু হইবে। কোন প্রাণী সত্যই কী জানে বা জানে না, তাহা জল্পনার বিষয়। জীবন যে অনিত্য, এই ভয়ানক সত্যটি কখনও তাহাকে ছাড়িয়া যায় না।” তেমনি লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ এই সন্দীপ দত্ত নামটিও আজীবন আমাদের বইপোকাদের অবশ্যই স্মরণে থেকে যাবে। হঠাৎই তাঁর চলে যাওয়ায় হতাশা দীর্ঘশ্বাস আঁচড়ে পড়েছিল বইপাড়াসহ শহরের আনাচে কানাচে, সাহিত্য চেতনার ঘরে ঘরে। তিনিই একমাত্র পথ দেখিয়ে গেছেন একক প্রচেষ্টায় একটি সংগ্রহশালা কিভাবে গবেষণার মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে। একমাত্র লিটিল ম্যাগাজিনই ছিল তাঁর বৈভব সম্পদ।
বুদ্ধদেব বসু তো কবেই বলেছিলেন— “লিটল ম্যাগাজিন মন জোগাতে আসেনি, মনকে জাগাতে এসেছে।” আমরা সাহিত্য-সংস্কৃতির সকলেই তো এই তত্ত্বেই বিশ্বাসী। সন্দীপ দত্ত, তিনিও এই নীতি ও আদর্শের উজ্জ্বল আকরে সারাটা জীবন ম্যাগাজিনকে আদর্শ ও সংগ্রহশালার বিস্তৃত রূপ দান করেছেন। হয়তো তিনি উপলব্ধি করেছিলেন প্রজন্মের পর প্রজন্ম শুধু বইকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকা যায়। বইয়ের রসদ আহবমান পৃথিবীর মতোই এগিয়ে চলাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তথা মনে এক তৃপ্তির আভা লেগে থাকে। একক উদ্যোগে একটি প্রতিষ্ঠান কিভাবে গড়ে তোলা যায় তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন সকলকে। তাঁর ব্যক্তিত্বই তাকে প্রতিষ্ঠানের কারিগর করে তুলেছেন। লিটিল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ হয়ে উঠেছেন সুতীব্র ঘোষক, একাই একটি আন্দোলনের কাণ্ডারী।
লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্তও আমাদের আপনজন যাঁর কাছে লিটল ম্যাগাজিন ছিল এক অনন্ত যাত্রা…! তিনি গত ১৫ মার্চ ২০২৩ কলকাতার এস এস কে এম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাত্র ৭২ বছর বয়সে আমাদের সবাইকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দেন। তিনি ১৯৫১ সালে জন্মগ্রহণ করেন ১৮ এম, ট্যামার লেন, কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০৯ -এ। উত্তর কলকাতার বনেদী পরিবারের ছেলে ছিলেন তিনি।
ছাত্রজীবন থেকেই বইয়ের প্রতি তাঁর একটু আলাদা ব্যতিক্রমী ঝোঁক দেখা গিয়েছিল। ২১ বছর বয়সে, ১৯৭০ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজে বাংলা নিয়ে স্নাতক স্তরে ভর্তি হন। কলেজে পড়তে পড়তেই ‘পত্রপুট’, ‘হার্দ্য’ নামের লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে প্রকাশ করেন ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। লিটল ম্যাগাজিন সর্বস্বতা ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান। তিনি ছিলেন সিটি কলেজিয়েট স্কুলের বাংলার শিক্ষক।
একসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে গবেষণা করতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই আয়োজন করেছিলেন লিটল ম্যাগাজিন প্রদর্শনী এবং আলোচনাসভার। সেই আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শঙ্খ ঘোষ, পবিত্র সরকার, উজ্জ্বলকুমার মজুমদার ও দেবকুমার বসুর মতো বিশিষ্টজনেরা।তিনি শুধু কথার মানুষ নয়, কাজেও করে দেখাতেন। নিজের জামায় বুকের উপরে যেমন লেখা থাকত— “লিটল ম্যাগাজিন কিনে পড়ুন।” তিনি নিজেও বহু নতুন নতুন পত্রিকা স্টলে স্টলে ঘুরে কিনে সংগ্রহ করতেন। শুনেছি তিনি সিগারেট না খেয়ে সেই পয়সা জমিয়ে বই নিজেও যেমন কিনতেন, অন্যকেও কিনতে বলতেন।
তিনি বলতেন, “প্রতিটা দিনই হয়ে উঠুক লিটল ম্যাগাজিন দিবস”। তাই লিটল ম্যাগাজিন সংক্রান্ত কোনো অনুষ্ঠান হলেই শরীর খারাপ থাকলেও তিনি সশরীরে পৌঁছে যেতেন দূর দূরান্তে বই, পত্রিকা প্রকাশ অনুষ্ঠানে। কলকাতা বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন প্রাঙ্গণে তাঁর ভূমিকা কারও নজর এড়ায়নি কোনো বছর। হাঁটু তথা পায়ে ব্যথা নিয়েও তিনি নতুন উদ্যমে লিটল ম্যাগাজিনকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলতেন।
সালটি ১৯৭২, তিনি কলকাতা ন্যাশনাল লাইব্রেরির মেঝেতে রাশি রাশি লিটল ম্যাগাজিন অনাদরে পড়ে থাকতে দেখে খুবই মনোকষ্ট পেয়েছিলেন। এই ছোট ছোট পত্রিকা করুণ দশা তথা শেষ পরিণতি ফেলে দেওয়ার কথা জানতে পেরে তাঁর মন প্রচণ্ড ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। বিস্তর ধুলোয় লুটোপাটি খাওয়া লিটল ম্যাগাজিনের চরম দুর্দশার ক্ষোভ তার মনে জন্ম নিয়েছিল লিটল ম্যাগাজিন রক্ষণাবেক্ষণ ও সংগ্রহের জেদ। এই জেদের শেষ পরিণতি হয়েছিল তাঁর ট্যামার লেনের পৈতৃক নিবাসে একতলার ছোট ছোট দুটো ঘরে। ৭৫০টি বই নিয়ে ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠা করেন লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র, যা পরবর্তীতে লিটল ম্যাগাজিনের বিশাল সংগ্রহশালা হয়ে উঠেছিল সমস্ত পাঠকদের কাছে। এই লাইব্রেরি ১৯৭৯ সালের ৮ মে খুলে দেওয়া হয় সমস্ত পড়ুয়াদের জন্যে। ধীরে ধীরে ১৯৯৬ সালে কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র, এই নামকরণে চিহ্নিত হয়। বহু দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ পত্র-পত্রিকা সংরক্ষণ ও তরুণ লেখকদের বই সংগ্রহের উদ্দেশ্য ছিল তাঁর গ্রন্থাগারের মূল উদ্দেশ্য।
আমার সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সেরকম কোনো যোগাযোগ বা সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তবে পিছন ফিরে তাকালে একটি দুটি ঘটনার কথা মনে পড়ে বৈকি। সালটা ১৯৯৭! তখন কলকাতা ময়দানে বইমেলা হতো। বরাবরের মতো তখন প্রতিবছর জেঠুর (কিরণ শঙ্কর মৈত্র) কাছ থেকে বইমেলায় ঢোকার গেস্ট পাশ পেতাম। আগে লাইন দিয়ে টিকিট কেটে বইমেলায় প্রবেশ করতে হতো। এখনকার মতো বইমেলা উন্মুক্ত দ্বার ছিল না। সেবার (১৯৯৭) বইমেলায় আগুন লেগে বহু বইপত্র পুড়ে গিয়েছিল। জেঠু তখন কলকাতায় পোস্টিং-এ ছিলেন (অল ইন্ডিয়া রেডিও ও দূরদর্শনের ডাইরেক্টর হিসাবে)। তাঁর সঙ্গেই তাঁর অফিসের গাড়িতে একবার সন্দীপ দত্তের ট্যামার লেনের বাড়িতে কোনো এক সূত্র ধরে গিয়েছিলাম। আবছায়া স্মৃতি থেকে ভেসে আসে একতলার পাশাপাশি দুটি ঘরময় শুধু বই আর বই। সেটিই প্রথম ও সেটিই শেষ যাওয়া তাঁর লাইব্রেরিতে। এরপর আর কোনো দিন যাওয়া হয়ে ওঠেনি। হ্যাঁ, তবে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিতে। (লিটল ম্যাগাজিন মেলা) কবিতা পড়তে গিয়ে দু’দুবার দেখা ও কথা হয়েছিল। প্রথমবার আমি নিজে থেকেই এগিয়ে গিয়ে কথা বলেছিলাম। উনি প্রথম দেখাতে চিনতে পারেননি। না পারাটাই স্বাভাবিক। তখন তো আমি সবে উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডিটুকু পেরিয়েছি। জেঠুর কথা বলাতে উনি কাছে টেনে নেন। পত্রিকা সম্বন্ধে দুয়েক কথা বললেন। বলেছিলেন, তাঁর লাইব্রেরিতে যেতে।
কিন্তু তা আর হল কৈ! তবে তাঁর সঙ্গে শুরুতে পরিচয় হবার পর এটুকু বুঝেছিলাম— তিনি ছিলেন লিটল ম্যাগাজিনের একজন পুরোধা, সংগ্রাহক, প্রাণপুরুষ এবং অভিভাবক। তাই তো বলাই যায় যে, ট্যামার লেন মানেই কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি এবং গবেষণা কেন্দ্র। যা চার দশকের বেশি সময় ধরে বাংলা ও বাঙালির লিটল ম্যাগাজিন চর্চা ও তত্ত্বতালাশের কেন্দ্র হয়ে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
শুধুমাত্র নিজস্ব ব্যক্তিগত সংগ্রহ গড়ে তোলা নয়, সেই সংগ্রহকে অনেকের কাজে ব্যবহার করতে দেওয়ার মত উদারতা, পরার্থপরতা, ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তাঁর ছিল। আর সে কারণে তাঁর লক্ষাধিক পত্রিকার সংগ্রহ নিয়ে তিনি যে লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন, তা গবেষক থেকে শুরু করে সকল পাঠকেরই নানা কাজে এসেছে। অনেকে এর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন আবার অনেকে উল্লেখ পর্যন্ত করেননি। কিন্তু এর জন্য তাঁকে কোনো খেদ প্রকাশ করতে শোনা যায়নি। এটা ছিল সন্দীপ দত্তের চরিত্রের আভিজাত্যবোধ, যাকে নিরন্তর চর্চার মধ্যে দিয়ে আয়ত্ব করতে হয়েছে। সেই বোধকে তিনি আমৃত্যু লালনও করে গেছেন।
লিটল ম্যাগাজিন ও লাইব্রেরি নিয়ে নিত্যনতুন ভাবনার তার অন্ত ছিল না। এর পাশাপাশি তিনি একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনাও করেছেন। আর লিখেছেনও কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ। সন্দীপ দত্ত সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য দুটি গ্রন্থ হল— সুভাষ মুখোপাধ্যায় : জীবন ও সাহিত্য, বাংলা কবিতার কালপঞ্জী (১৯২৭-১৯৮৯)।
ট্যামার লেনের সেই অখ্যাত মানুষটি বইয়ের নামাবলি চাদরে আজও শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে চলেছেন তত্ত্বতালাশের আখড়ায় বৃক্ষজীবন বোধে। ইতিহাসের পরত খুলছে ধীরে ধীরে অজস্র হরিদ্রাফুল তোমার শরীর ছুঁয়ে লিটল ম্যাগাজিনের টেবিলে টেবিলে মহাজাগতিক গন্ধে মথিত ঘাস, বিবর্ণ বইয়ের পাতা স্বপ্ন ভাঙে গনগনে আগুনে অশক্ত শরীর সারাদিনমান ক্ষুদ্র পত্রিকা সংরক্ষণ ভবিষ্যৎ জীবনদিশায় সম্পর্কের পরশ খোঁজে। আলো-আঁধারের বাঙ্ময় বইয়ের জগৎ ঋতুবদলে আহা তার স্বাদ বোধের প্রতীক দেহমূলে অনুভূতিমালায় উজাড় প্রকৃতি লিটল ম্যাগাজিন ললাটলিপি খোলাচিঠি…..
আজ স্তব্ধ তোমার কলস্বর। ‘পত্রপুট’ এখনও আলোড়ন ছড়ায় উদ্বেল ঢেউয়ে তথৈবচ সন্দীপ দত্ত নামটি। অন্তস্থল ছুঁয়ে চলে সকলের নিঃশব্দ তরঙ্গে। ট্যামার লেন মানেই কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র। ট্যামার লেন মানেই সন্দীপ দত্ত। আর ট্যামার লেন মানেই বই-পত্রিকার বাড়ন্ত শরীর।
কালের আবর্তে তিনি প্রস্তরফলক হয়ে চিহ্নিত থাকবেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে। লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণের মহাফেজখানা ও লড়াই আজ ইতিহাস হয়ে রইল।
এই বিরল নিরহঙ্কারী প্রকৃত সংগ্রাহক-গবেষককে অন্তর থেকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাই। একথা সকলেরই জানা যে, লেখকেরা সত্যদ্রষ্টা হন! তাই সন্দীপ দত্তের ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাক নতুন ভাবনায় আগামীর প্রত্যাশায়…!