রাত দশটা। ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবনিতা চুপিসারে রেডিওতে কান পেতে সেই ভরাট আবেগময় উদাত্ত কণ্ঠস্বর শোনার অপেক্ষায়। ‘আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়…’ মোটা পাওয়ারের চশমা। মাইক্রোফোনের কাছে হুমড়ি খেয়ে সংবাদ পড়ছেন। কাচের ঘরের মধ্যে শব্দের ওজনে, ঘটনার ভিন্নতায় ওই ব্যারিটোন ভয়েস কেমন করে শরীরের ভঙ্গিমাকে বদলে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে দিন-রাতের অন্ধকারের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে সময়। তৈরি হচ্ছে খবর। শরীর ও মনে হিল্লোল তুলছে সেই খবরের দ্যোতনা। আন্দোলিত গোটা পূর্ব পাকিস্তান। এই সময়টুকুতে যুদ্ধের সংবাদে তারা মনে করতেন, মুক্তিযোদ্ধাদের মতো তারাও সম্মুখযুদ্ধে নেমেছেন রাইফেলের বদলে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠকে হাতিয়ার করে। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কণ্ঠস্বরে পৌঁছে যেতেন যুদ্ধরত মুক্তিসেনার কাছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তা প্রেরণার কাজ করত। এভাবেই শব্দকে কণ্ঠের জাদুতে মিশিয়ে তিনি হয়ে উঠলেন মুক্তিযুদ্ধের শব্দসেনা। সেই শব্দতরঙ্গ কখন যেন দেশভাগের জ্বালাকে মুছিয়ে দিয়ে পশ্চিমবাংলাকে আবার পূর্ববাংলার সঙ্গে একাকার করে দিত। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন বাঙালির এক প্রেরণা-কণ্ঠ।
বাঙালির সুদীর্ঘ বছরের ইতিহাসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এক অনন্য মহাকাব্য। এই স্বাধীনতা যুদ্ধের মাঝেই বাংলাদেশের সামগ্রিক চেতনা দাঁড়িয়ে আছে এবং থাকবে। একাত্তরের সেই মুক্তিযুদ্ধে কেবল যে যুদ্ধক্ষেত্রে, তা নয়। বাঙালি ঐক্যবদ্ধ লড়াই চালিয়েছিল প্রতিটি ক্ষেত্রে- সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে এবং অন্য আরও নানাভাবে। সেই যুদ্ধেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলো বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। অবশ্য পরবর্তী সময়ে ‘বিপ্লবী’ কথাটি বাদ দিয়ে বলা হয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ এবং এখনো এ নামেই পরিচিত। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল আকাশবাণী এবং বিবিসি রেডিও। উপেন তরফদারের প্রযোজনায়, প্রণবেশ সেনের গ্রন্থনায় রাত ১০টায় আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ পরিক্রমায় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠসৈনিক। পাকিস্তানি বাহিনী যখন নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল, তখন ওপার বাংলার মানুষ উৎকর্ণ হয়ে শুনতে চাইত আশার বাণী। খুঁজত আশার আলো। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন শব্দসংগ্রামী হয়ে উঠেছিলেন। কোটি মানুষের আগ্রহের একটি বিন্দু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর কণ্ঠস্বর ইতিহাস রচনার দলিল হয়ে উঠল।
আমার প্রিয় মহাকাব্য মহাভারতে কৌরব-পান্ডবদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধের প্রতিটি মুহূর্তের ধারাভাষ্য দিতেন সঞ্জয়। বলা হয়, এই ধারাভাষ্য এতটাই জীবন্ত ছিল যে, অন্ধ ধ্রতরাষ্ট্র যুদ্ধের ভয়বাহতায় বার বার শিউরে উঠতেন যন্ত্রণায়। একাত্তরের রণাঙ্গনে দেবদুলালের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি ছিল না ঠিকই, কিন্তু রাত ১০টায় আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ পরিক্রমায় সেই উদাত্ত কণ্ঠ ‘আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়…’ এক লহমায় মুক্তিকামী বাঙালিকে নিয়ে যেত পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মাতৃভূমিকে রক্ষার লড়াইয়ের রণাঙ্গনে।
মুক্তিযুদ্ধের খবর পড়তে পড়তেই বাংলাদেশের সঙ্গে গড়ে ওঠে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। তিনি বলতেন, ‘বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় স্বদেশ।’এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন – “আকাশবাণীর খবর পড়তে গিয়ে মাঝেমধ্যে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারিনি। মনে হতো, আমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন আমার বুকের ভেতরের সব লুকানো আবেগ আর উত্তেজনা ঢেলে দিয়েছিলাম আকাশবাণীর সংবাদ, সংবাদ-পরিক্রমা বা সংবাদ-সমীক্ষা পড়তে গিয়ে। রণাঙ্গনের খবর যখন পড়তাম, তখন মনে করতাম, আমিও সেই রণাঙ্গনের সৈনিক, যখন মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের কথা পড়তাম, তখন আমার মনের সমস্ত উল্লাস উচ্ছ্বাস নেমে আসতো আমার কণ্ঠজুড়ে। যখন করুণ হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা পড়তাম, তখন কান্নায় জড়িয়ে আসত গলা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকটায় যেনো নেশায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। উত্তেজনা আর প্রবল আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, কখন পড়বো বাঙলাদেশের খবর। এই খবর পড়ার জন্য কখনো কখনো রাতে বাড়িও ফিরিনি। রাত কাটিয়েছি আকাশবাণী ভবনে। ভোরের খবর পড়তে হবে যে!’’
দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় একদিন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- ‘‘অদেখা পূর্ববঙ্গের অচেনা বঙ্গভাষীর প্রতি নৈকট্য বোধে মন আপ্লুত হয়েছে আমার বারবার। আর কল্পনায় গড়ে তুলেছিলাম বাংলাদেশ নামের একটি মানসী মূর্তিকে।… আমি প্রাণভরে আমার যৌবন উজাড় করে দিয়েছিলাম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য। এমন ঘটনা তো সবার ভাগ্যে ঘটে না! আমি তো সেই ঘটনার ভাগ্যবান ব্যক্তি। পেয়েছি কোটি বাঙালির ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে আমি মরতে চাই।” দেবদুলাল বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও বক্তৃতায় বলেছেন, তাঁর পেশাগত জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়টা। শুধু একাত্তর নয়, সে-ই ১৯৬৮-৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি পড়েছেন বাংলাদেশের খবর।
২৫ জুন স্বনামধন্য সংবাদ পাঠক ও অননুকরণীয় বাচিকশিল্পী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৮৯ তম জন্মদিন। পঁচিশে জুন, ১৯৩৪ সালে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম পশ্চিবঙ্গের নদিয়া জেলার শান্তিপুরে। বাবার নাম নন্দদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও মা নীহারবালা। শান্তিপুর মিউনিসিপাল স্কুলে তিনি কিছুদিন পড়াশোনা করেন। তারপর ওঁরা চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হোন সরস্বতী ইন্সটিটিউশনে। স্কুলের পড়াশোনার পর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। কিন্তু সংসারের অর্থকষ্ট মেটাতে তিনি বন্ধ করেছিলেন পড়াশুনা। তাতে বিষম চটে গিয়েছিলেন তাঁর বাবা। তিনি তখনই ছেলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেন। কলকাতায় ঘরছাড়া হয়ে উঠলেন হ্যারিসন রোডের একটি মেসে। ওই মেসে তখন থাকতেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। রোজগারের জন্য তখন যা পেতেন তাই করতেন। কখনো গৃহশিক্ষকতা, কখনো টাইপিস্ট, কখনো স্টোরকিপার এবং এমনকি চায়ের দোকানেও তাঁকে কাজ করতে হয়েছে। অর্থকষ্ট এতটাই ভয়াবহ ছিল। এতো অসুবিধার মধ্যেও সৃজনী মনটা কিন্তু উধাও হয়ে যায় নি। সময় পেলেই শুনতেন জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ও বাচনভঙ্গি। তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন কাজী সব্যসাচী। আবৃত্তিচর্চার সূত্রপাত তখনই। সারাদিন কাজ করতেন, রাতে ফিরে কলম-খাতা নিয়ে বসে যেতেন , কবিতাও লিখতেন। যৌবনে ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘে কাজ শুরু করেছিলেন। দেবদুলাল নিজেই লিখেছেন, “… পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে। তখন উত্তর কলকাতার জেলেটোলা স্ট্রিটে ‘অরণি’ নামে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের একটি শাখা সংগঠনের কর্মী ছিলাম আমি।” আর এভাবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি উজ্জ্বল নাম। ১৯৫৮ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হোন।
এমনই একটা সময় সঙ্গীত পরিচালক সুধীন দাশগুপ্ত এবং সুবীর হাজরার (সত্যজিৎ রায়ের সহকারী) একটি ছবিতেও প্রোডাকশনের কাজ করেছিলেন তিনি। যদিও সে ছবি মুক্তি পায়নি। সুধীন দাশগুপ্তই তাঁকে আকাশবাণীর ‘অনুষ্ঠান ঘোষক’-এর পদে চাকরির পরীক্ষা দিতে বলেন। অতঃপর ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঘোষক হিসাবে আকাশবাণীর চাকরিতে প্রবেশ করেন। তারপর একটানা চৌত্রিশ বছর আকাশবাণীতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। অচিরেই কুশলতায় হয়ে ওঠেন আকাশবাণীর সংবাদ ও ভাষ্যপাঠক। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি দিল্লীতে বাংলা বিভাগে সংবাদ পাঠক রূপে নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফিরে আসেন কলকাতার বেতার কেন্দ্রে। তারপরের ঘটনা তো ইতিহাস, আগেই বলেছি।
সংবাদ পাঠকে তিনি এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে, ঘরে ঘরে সংবাদ পরিক্রমা শোনার জন্য রেডিও খোলা হতো। খবর পড়ায় একটা আলাদা ঘরানা তৈরি করেছিলেন দেবুদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। সহকর্মীদের মধ্যে এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে, সমসাময়িক অনেকে তাঁকে নকল করতেন। কেউ কেউ গুরু মানতেন। তার গভীরতা যে কতটা ছিল একটা ঘটনা উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে। দেবুদুলালের সঙ্গেই সংবাদ পড়তেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। একবার খবর পড়তে গিয়ে তিনি বলে ফেললেন, “আকাশবাণী কলকাতা। খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।” ডিউটি অফিসার তো মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রেখেছেন। কিন্তু এই ঘটনা ইঙ্গিত দেয় কী মারাত্মক প্রভাব ছিল দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
কাজের প্রতি তাঁর ছিল প্রচণ্ড নিষ্ঠা। বানান নিয়ে ভয়ঙ্কর খুঁতখুঁতে ছিলেন। একটা ঘটনা। কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। প্রচুর বিদেশি ডেলিগেট এসেছেন শহরে। হঠাৎ আকাশবাণীর নিউজ রুমে দেবুদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় হন্যে হয়ে সব হাই কমিশনের ফোন নম্বর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। উনি রেকর্ডিং-এর আগে সমস্ত হাই কমিশনে ফোন করে যাচ্ছেন। আর গম্ভীর মুখে কী সব আলোচনা করছেন। একটু পরেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হল।খবর পড়ার সময় নির্ভুল বিদেশি উচ্চারণে অনায়াসে বিদেশি নামগুলো বলে গেলেন। এই ছিলেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
এর পরের ঘটনা। যখন কলকাতায় টেলিভিশন এল অনেকেই অপেক্ষা করেছিলেন কবে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আসবেন টেলিভিশনে খবর পড়তে। এলেন কিন্তু রেডিওর মতো আবেদন পাওয়া গেল না। পরে নিকটজনদের কাছে মজা করে বলেছিলেন , ‘দু’দিন খবর পড়েই বুঝলাম, ওটা আমার কাজ নয়। বুঝলে, ওতে গ্ল্যামার লাগে, আর কী যেন বলে, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ। ওসব আমার নেই।’
কবিতার সঙ্গে মগ্ন সহবাসে বাচিক শিল্পী দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠ-জাদু-মায়ায় মুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত না হয়ে পারা যায় না। আবৃত্তি শিল্পের জনপ্রিয়তার কাণ্ডারী ছিলেন তিনি। এই শিল্পের ক্ষেত্রে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। শৈশব থেকেই আবৃত্তির প্রতি দেবদুলালের ছিল গভীর অনুরাগ। পরবর্তীকালে প্রখ্যাত শিল্পী শম্ভু মিত্রকে আদর্শ হিসেবে সামনে রেখে আবৃত্তিচর্চার প্রতি মনোযোগী হয়ে ওঠেন। আকাশবাণীতে এসে তাঁর অন্যতম প্রিয় আবৃত্তিশিল্পী কাজী সব্যসাচীকে সহকর্মী হিসেবে পেয়ে আবৃত্তিচর্চার প্রতি আরও উৎসাহিত হন। আবৃত্তি পঠিত শিল্প নয়, প্রয়োগ শিল্প, এটা তিনি মনেপ্রাণে অনুধাবন করতেন। তাই আবৃত্তিচর্চা ও অনুশীলনের মধ্য দিয়েই তিনি উচ্চারণের শুদ্ধতা এবং দ্রুত-বাচনভঙ্গীর দক্ষতা অর্জন করতে পেরেছিলেন। কণ্ঠস্বরের যত্ন ও চর্চায় তিনি ছিলেন অকৃপণ। ঈশ্বরদত্ত কণ্ঠস্বরটিকে সঠিক রাখার জন্য শোনা যায় তিনি নাকি পুকুরের মাঝখানে গিয়ে কিসব আওড়াতেন। রবি ঠাকুর, মধুসূদন দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, সুকুমার রায় থেকে শুরু করে সমসাময়িক বহু কবির কবিতা তাঁর কণ্ঠের জাদুতে শ্রোতাকে মন্ত্রমুগ্ধ রাখত। রবি ঠাকুরের প্রতি তাঁর টান ছিল খুব। রবি ঠাকুরকে নিয়ে তাঁর একটি কবিতা, ‘ তোমার গান, তোমার সুর ‘ ১৩৮৮ বাংলা সনের ২৫ শে বৈশাখ ‘সৌম্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কবিতা ও গদ্য দুই-ই তিনি কণ্ঠের মাধুর্যে সুখশ্রাব্য করে তুলেছিলেন জনমনে। তাঁর ঐ ব্যারিটোন কণ্ঠস্বরে বিমোহিত ছিল দুই বাংলার মানুষ, কয়েক দশক। পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, তরুণ চক্রবর্তী, জগন্নাথ বসুর মতো প্রখ্যাত বাচিক শিল্পীরাও তাঁর কাছে ঋণী বলে উল্লেখ করেছেন।
বাচ্চাদের আবৃত্তি শিক্ষার জন্য খুব সহজ সরল ভাষায় অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে লিখেছেন, ছোটদের বিষয়ঃ আবৃত্তি। এখানে এক জায়গায় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আক্ষেপ করে লিখেছেন – “ইদানিং শিশুদের মুখে ছড়া প্রায় শোনাই যায় না। তাদের মুখ দিয়ে এমন সব ভারী ভারী দুরূহ কবিতা বলানো হয়, সেগুলোর অর্থ একবর্ণও তারা বোঝে না। আমার তাই মনে হয়, ছড়া শুনিয়ে ছড়া শিখিয়ে ছড়ার ছন্দে তার কান ভরিয়ে, ছড়ার মজায় তার মন মজিয়ে তারপর তাকে কবিতা-আবৃত্তি শেখানো উচিত।” বোঝাই যায় শিশুমনের কত গভীরের খোঁজ তিনি রাখতেন।
আকাশবাণী কলকাতার বেতার কেন্দ্র হতে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে অবসর নেন। কলকাতার সাদার্ন এভিনিউতে তাঁর নিজ বাসভবন। সেখানেই চার তলায় থাকতেন তিনি। তাঁর স্ত্রী ছিলেন কত্থক নৃত্যশিল্পী রুবি বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে শুরু করেছিলেন ‘রসকলি’ নামে একটি আবৃত্তি ও নৃত্যচর্চা কেন্দ্র। কিন্তু ২০০৮ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্ত্রীর অকাল প্রয়াণে প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে হঠাৎ সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি শুয়ে থাকতেন তাঁর ছোট্ট বিছানাতে। কারণ তিনি দুরারোগ্য পিএসপি বা প্রোগ্রেসিভ সুপ্রা নিউক্লিয়ার পলসি রোগে আক্রান্ত ছিলেন। বেশ কিছুদিন অসুস্থ হয়ে স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল তাঁর। সেই দরাজ কণ্ঠ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যাচ্ছিল। পরিবারের লোক ছাড়া কারও সাথে তেমন সাক্ষাৎ করতেন না। মাঝে মাঝে হয়তো তাঁর অনুরাগীরা যেতেন, দু-চারটে কথা বলতেন তারপর আবার নিবিড় একাকীত্ব। নিজের বাসভবনে ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ২ রা জুন ৭৭ বৎসর বয়সে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। তাঁর কন্যা দেবারতী বন্দোপাধ্যায় এবং পুত্র দেবরাজ বন্দোপাধ্যায়।
কর্মক্ষেত্র থেকে অবসরের পর পর একক বা যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন বিভিন্ন বিষয়ের বই। অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন, আবৃত্তি, ছোটদের বিষয়ঃ আবৃত্তি, বড়োদের আবৃত্তির কবিতা। পীতম ভট্টাচার্যের সঙ্গে লিখেছেন, আবৃত্তির বাংলা ব্যাকরণ। এছাড়া এককভাবে লিখেছেন বা সম্পাদনা করেছেন, সেরা আবৃত্তির কবিতা সংগ্রহ, গল্প সংকলন- বাংলাদেশের গল্প, প্রবন্ধ- সম্প্রচারের অন্তরালে এবং একাত্তরের যুদ্ধে ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশ প্রভৃতি। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু আবৃত্তির রেকর্ড/ক্যাসেট প্রকাশিত করেন। যেমন – বঙ্গভূমির প্রতি, কেউ কথা রাখেনি, উত্তরাধিকার (এইচ এম ভি), রবীন্দ্র বিচিত্রা – (অডিও), হৃদয়জ কিছু কথা (আধুনিক কবিতা) – হৃদিরঞ্জন ক্যাসেট, রথের রশি – সাউন্ড উই, ক্ষুদিরামের মা – গীতালি (বাংলাদেশ), কবিতার আবৃত্তি – বঙ্গীয় সংগীত পরিষদ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমির উপর কলকাতায় নির্মিত ‘ জয় বাংলা ‘ ছবিতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এক বাংলাদেশী কবির ভূমিকায় অভিনয় করেন। সম্প্রতি তাঁর জীবন নিয়ে ছবি তৈরি করছেন পরিচালক পাভেল।কিন্তু করোনা এসে সব কিছু বানচাল করে দিল।স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করার সেই মাহেন্দ্রক্ষণের কথা দেবদুলাল কখনোই ভুলতে পারেননি। দিনটি ছিলো ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে এসেছেন স্বাধীন স্বদেশভূমি বাংলাদেশে। ওই সময় আগত বিদেশী সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। তাঁদের মাঝে দেবদুলাল বন্দোপাদ্যায়ও ছিলেন। রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে এসেছিলেন তাঁরা। উঠেছিলেন হোটেল পূর্বাণীতে। সেদিনই বেতার সাংবাদিক হিসেবে তিনি প্রথম পা রাখেন ঢাকায়। বঙ্গবন্ধু যখন বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন হঠাৎ বলে উঠলেন, কোথায় আমাদের সেই দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়? তিনি তখন উঠে এগিয়ে যান। এরপর তিনিই বলে গেছেন আবেগমথিত শব্দচয়নে- ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে আলিঙ্গন করেন’। বঙ্গবন্ধু তাঁকে জড়িয়ে ধরেন ও সংবর্ধনা জানান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে “পদ্মশ্রী” সম্মানে ভূষিত করে। সংবাদপাঠক হিসেবে ভারতে প্রথম তিনিই প্রথম এই পুরস্কারে সম্মানিত হোন।
সম্মান ও পুরস্কারের কাঙাল তিনি ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে তাঁর স্মৃতিকথা থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি। কলকাতার একাত্তরের সময়ের এক স্মৃতিকথায় তিনি বলেন, ‘’মুক্তিযুদ্ধ তখন শেষের দিকে। কলকাতায় ‘ব্ল্যাক আউট’। সন্ধ্যা হলে পাকিস্তানি বোমারু বিমানের ভয়ে রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলো কালো কাগজ দিয়ে ঢাকা থাকত। একদিন রাতে আকাশবাণী থেকে বের হচ্ছি, রাত তখন ১২টা। ইডেন গার্ডেনের পাশ দিয়ে হেঁটে পার্কস্ট্রিট গিয়ে বাস ধরব। স্টুডিওর বাইরে এসে হাঁটা শুরু করেছি। খেয়াল করলাম ফাঁকা রাস্তায় আমার পেছনে কে যেন আসছে। পেছনে ঘুরতেই দেখলাম একজন রোগা ছেলে। গায়ে ছেঁড়া জামা। পরনে লুঙ্গি। মুখে একগাল দাড়ি। অবিন্যস্ত বড় চুল। তবে চোখ দুটো কেমন জ্বলজ্বল করছে। আমি দাঁড়াতে সেও দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছু বলল না। আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। সেও আমার পিছু নিলো। ভাবলাম, কে? আইএসআইর লোক নয় তো! সাহস করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললাম, কে তুমি? আমার পিছন পিছন আসছো কেন? ছেলেটা আমার কথা শুনে ততক্ষণে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ছুটে এসে আমার পা জড়িয়ে ধরে বললো, ‘ভয় পাইয়েন না। আমি সালমান। মুক্তিযোদ্ধা। আপনাকে দেখতে এসেছি। কাল আমি যুদ্ধে যাব। আপনি আমারে দোয়া করেন, যেন খানসেনাদের দেশ থিকা তাড়াইতে পারি। ’ উঠে দাঁড়াল সালমান। তারপর এক দৌড়ে অন্ধকারে কোথায় যেন হারিয়ে গেল।জানি না সালমান এখন কোথায়? আদৌ বেঁচে আছে কিনা।
আমার জীবনের সেরা সম্মান, না পদ্মশ্রী নয়, সালমানের শুভেচ্ছা। আজও ওর কথা আমার কানে বাজে, আমি সালমান। মুক্তিযোদ্ধা…।”
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় নামটি অক্ষয় হয়ে আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী চলেছে। আমাদের আক্ষেপ এই মহান মানুষটি বাংলাদেশ থেকে কোনো সম্মাননা পাননি। বিস্মৃতপ্রায় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঠিক মূল্যায়ন নতুন প্রজন্মকেই করতে হবে। কারণ বর্তমান সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন প্রজন্মের কাজ চারপাশে নানা প্রশংসা এবং ঋদ্ধতায় পরিপূর্ণ হচ্ছে। তাই এ দায়িত্বটিও নিশ্চয় তাঁরাই নেবেন।
ঋণস্বীকার
কৃষ্ণপদ দাস, রক্তিম দাশ, কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়
তথ্যসূত্র
বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, আন্তর্জাল, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান