সন্ধ্যানদীর জলে
শঙ্খ ঘোষ
প্রথমা প্রকাশন, ২০১৯
পাতাঃ ১৫২
মূল্যঃ ২৮০
পাঁচটি অধ্যায়ের (একুশে, একাত্তর ও নববর্ষ; ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান; গানের ভিতর দিয়ে; শিক্ষা আন্দোলন এবং স্মৃতি, ভ্রমন) ভেতর তেইশটি উপ-অধ্যায় সম্মিলিত মোট ১৫২ পাতা জুড়ে কবি, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক পিয়াস মজিদের বিচক্ষণ সংকলনের ফল হিসাবে আমরা পেলাম শঙ্খ ঘোষের ‘স্মৃতিকথায়, ভ্রমণপঞ্জিতে, অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণে’ বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর ‘সপ্রাণ সম্পর্ক’- এর এক সজীব প্রেমমুগ্ধ চিত্র। টুকরো টুকরো ছবিতে ধরা পড়েছে কবির গভীর ইতিহাস চেতনা ও বাঙালি সংস্কৃতির বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ। ভালোবাসা ও মায়ার বাঁধনে ধরা পড়েছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের এক বিশেষ নৈসর্গিক রুপ। ধরা পড়েছে কবির পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, রূপসা, সন্ধ্যা, ব্রম্বপপুত্র প্রভৃতি নদী ভ্রমনের এক মধুর নিবিড় বিচিত্র ছবি।সন্ধ্যা নদী। বাংলাদেশের বরিশাল জেলার অন্যতম প্রধান নদী। কবি শঙ্খ ঘোষের নাড়ি ছেঁড়া নদী। নিজ পৈতৃক বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়া ছুঁয়ে আছে এই নদী। কবি এখানে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। সেখানে কেমন ছিল তাঁর ছোটোবেলাকার পুজোর নানা রঙের দিনগুলো, পঞ্চাশ বছর পরে তাঁর সেই ছেলেবেলার ভিটেতে পা পড়ার অবর্ণনীয় অনুভূতির অভিজ্ঞতা, হারানো মাটি, হারানো জল, হারানো মানুষের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, তাঁর সুক্ষ্য অনুভূতির ঢেউ –এসবই সজীব হয়ে আমাদের সামনে বার বার ধরা দেয়।
কবির অনুভূতি, জন্মভূমি হল চির আকাঙ্ক্ষিত সেই স্থান যেখানে আমরা সমৃদ্ধ হই। যে কোন মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় তার জন্মভূমি। জন্মভূমির সাথে থাকে আমাদের নাড়ীর সম্পর্ক। শৈশবের বেড়ে ওঠা মুহূর্তগুলো জড়িয়ে থাকে আজীবন। জন্মভূমির প্রতি ভালোবাসা বা মনের গভীর সম্পর্ক বা টান নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দূরহ। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন–ঝা চকচকে রাজপ্রাসাদ বা অট্টালিকা, জন্মভূমি আমাদের আবেগ অনুভূতি ভালবাসার সাথে মিশে থাকে। ফেলে আসা মুহূর্তগুলো রয়ে যায় স্মৃতি হয়ে। মিষ্টি, মধুর, তিক্ত সব রকম স্মৃতির ভার বহন করেই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। জীবন বয়ে চলে আর চলার পথে প্রতিমুহূর্তে আমাদের মুখোমুখি হতে হয় বিচিত্র ঘটনা প্রবাহের। সময়ের সাথে সাথে মানুষের পরিবর্তন ঘটে। জীবনে ঘটে চলা বিচিত্র ঘটনা, অভিজ্ঞতা স্মৃতি হয়ে রয়ে যায়। স্মৃতি কখনো আমাদের হৃদয়ে আনন্দের আবার কখনো বেদনার রঙে ছবি আঁকে। স্মৃতির সরণি বেয়ে মানুষ যখন হেঁটে চলে তখন সবকিছুই জীবন্ত হয়ে ওঠে। চিরকাল নতুন হয়ে থাকে ভালোবাসা মাখানো সেই সব স্মৃতি যা স্থান-কাল গণ্ডি ভেদে মুছে ফেলা যায় না। তাড়া করে ফেরে, সজীব হয়ে থাকে হৃদয়ে। আর সেই ভালোবাসা থেকেই মন যেতে চায় ফেলে আসা সেই দিনগুলিতে।
দীর্ঘ পরাধীনতার পর আমাদের দেশ স্বাধীন হয়। সেই স্বাধীনতার পিছনে রইলো এক মর্মবিদারী ইতিহাস। ভারতবর্ষ দ্বিখন্ডিত হলো। কোটি কোটি মানুষের জীবনে নেমে আসে অনিশ্চয়তা আর বিপর্যয়। ছেড়ে চলে যেতে হয় সাত পুরুষের বসত ভিটে, নদী, মাঠ ঘাট, আশৈশব, হেঁটে চলা পথ আর চেনা প্রান্তর। উদ্বাস্তু জীবনের নানা যন্ত্রণা চিত্রিত হতে থাকে, স্মৃতি হয়ে রয়ে যায় আজীবন। কবির জীবনের সূচনা ও প্রথম বিকাশ হয়েছিল যেখানে, তার সজীব স্মৃতি কবি মনকে আচ্ছন্ন করে রইল গভীরভাবে। জন্মভূমির ধূলিকণা হয়ে রইল কবির কাছে পবিত্র। পরবর্তীকালে তার অমলিন ছাপ রয়ে গেল কবির সাহিত্য চর্চায়।
দেশভাগ ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল বাঙালির সত্তাকে। দেশভাগ নামক ক্ষতস্থান থেকে বয়ে গেছে প্রচুর রক্ত। সময় সেই ক্ষতে হয়তো কিছুটা প্রলেপ দিয়েছে তবুও সেই ক্ষত থেকে আজও ব্যথা নিঃসৃত হয়। ওপার এপারের প্রাচীর গলিয়ে ভালোবাসা আর বেদনার বাতাস কখনো কখনো ফিরিয়ে নিয়ে যায় অতীতে।কবি যতদিন বেঁচে থেকেছেন বাংলাদেশের সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ককে কখনোই শিথিল হতে দেননি । ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে, কোন ব্যক্তির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে আবার কখনো সশরীরে ভ্রমণের মধ্য দিয়ে যাপন করেছেন সেসব পরম যত্নের আদরের মুহূর্তগুলো। ভালোবেসে হৃদয়ের টানে বারে বারে ছুটে গেছেন সেই মাটিতে। আজীবন মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরে যায়নি বাংলাদেশের মাটি ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি।
সন্ধ্যা নদীর তীরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ফুটে উঠেছে কবির স্মৃতি বিজড়িত জন্মভূমি–স্মৃতি কথায়, ভ্রমণপঞ্জিতে অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে ভ্রমণের সুখকর অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে। বিভিন্ন সমাবেশে, অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দান বা মঞ্চ আলো করার চেয়ে কবিকে বেশি আকর্ষণ করেছে বিস্তীর্ণ প্রান্তর মায়াময় ভূমি নদী আর ভালোবাসার সম্পর্ক।
‘কালো মাটির কালো পুতুল’ রচনাটিতে ধরা পড়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ। স্বাধীনতার জন্য, ভাষাকে স্বীকৃতি দেবার জন্য, দেশপ্রেমীদের আত্মত্যাগ। কিভাবে আক্রান্ত হয়েছেন বুদ্ধিজীবীরা। মুক্তি বাসনার প্রথম আগুন যেহেতু এখান থেকেই যে জ্বলে উঠেছিল অবিশ্বাস্যভাবে। সেইসব কবিদের নিয়ে কবি চিন্তিত হয়েছেন যাদের লেখনি আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল হাজার হাজার দেশপ্রেমীদের। স্মৃতি পটে ধরা পড়ে, স্পেনের গৃহযুদ্ধের রাফায়েল আলবের্তির কথা। তাঁর মতো এঁরাও কি দেখতে পাচ্ছেন সারি সারি ‘গ্রামীণ যোদ্ধাদের স্তূপাকার মুখ, যে-মুখে অনেক জানার চিহ্ন নেই, যে-মুখে আছে কেবল বেচেঁ থাকবার জন্যই মরবার প্রতিজ্ঞা?'(পৃষ্ঠা ১৯)। কবি খুঁজে পান আশরাফ সিদ্দিকীর চোখে এক নতুন দেশ। কলাহীন, শিল্পহীন সাহিত্য সংগীতহীন যে জাতি, তাদের জীবন মৃত্যুর মতো- বিধাতার কাছে তারা এক মূর্ত অভিশাপ। আজ এই শরতের সোনাঝরা আলোকের মাঝখানে বসে ফুটন্ত পদ্মের মতো নীল আকাশের নিচে যে দিকে তাকায় মনে হয় গান আর কলা আর শিল্প আর সুরের এ বাংলাদেশ।
‘আমাদের কাছে একুশে’ এই অংশে-একুশে বলতে যে একুশে ফেব্রুয়ারি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমাদের প্রাণের ভাষা, মায়ের ভাষা, যে ভাষায় আছে আমাদের আবেগ, ভালোবাসা। গর্বিত আমরা। তাই ‘একুশে’বললেই যথেষ্ট, শব্দটি এমন এক প্রতীক মর্যাদার অধিকারী। একুশে বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে অজস্র বাঙালির ভাষার জন্য আত্মদান। ‘আমাদের কাছে একুশে’ কবির হৃদয় বীণায় বেজে ওঠে এক করুন সুর। আমাদেরটা আসলে কাদের? কলকাতাবাসীর কাছে? পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে? নাকি ‘আমাদের’দিয়ে বোঝাচ্ছে সমস্ত বাঙালি জাতির কথা, পূর্ব -পশ্চিম নির্বিশেষে?
কবির স্বীকারোক্তি, কলকাতায় এই উদযাপনের ইতিহাস কতদিনের? বড়জোর দুই দশক। গোটা বাংলাদেশ এই ইতিহাস শুরু হয়েছে ৬০ বছরেরও আগে। শুরু হয়েছে ওদের একটা আত্মপরিচয়ের সন্ধান থেকে, আত্ম প্রতিষ্ঠার তাগিদ থেকে। একটা আবেগ, একটা সত্যের ওপর ভর করে গড়ে উঠেছিল-দিন দিন তার ব্যাপ্তি ঘটেছে। এপার বাংলায় আমরা সে টান অনুভব করিনি। মূলত বাংলাদেশের দাবিতে আর চেষ্টায় যখন এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষিত হল। তার অল্প কিছু আগে থেকে এদেশে একটু একটু করে দিনটির উদযাপন শুরু হয়েছে নিছক একটা অনুষ্ঠান হিসেবে। ভাষার জন্য আবেগ ততটা নেই, যতটা আছে আনুষ্ঠানিকতার অভ্যাস। বাংলাদেশে কুড়ি তারিখ থেকে শহীদ স্মরণের দিকে এগোবার পথ গুলো আলপনায় আলপনায় ভরিয়ে দিতে থাকে ঢাকার মানুষজন, তারপর গোটা রাত জুড়ে ফুলের স্তবক হাতে মিছিলের পর মিছিলে উপচে পড়ে সেই পথ। প্রায় ৬০ বছর জুড়ে আজও সেই উন্মাদনা একই রকম রয়ে গেছে, তার কারণ ওদের আত্মপরিচয়গত সংকট এখনো কাটেনি, প্রস্তুতি পর্ব চলছেই, চলছে ভাষা নিয়ে আমূল আবেগ। তাই একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে ওপার বাংলা রক্তের টানে বাঁধা।
১৯৫৭ সালে বুদ্ধদেব বসু ঘোষণা করে বলেছিলেন যে সরকারি প্রতিবেদনের ওই কথাগুলো ‘সারত ভুল, মূলত মিথ্যা’। এই মিথ্যার ফলে কি ঘটতে পারে, ইতিহাস তা আমাদের নিশ্চয়ই দেখিয়ে দিচ্ছে। অন্নদাশঙ্কর যে বলেছিলেন রাষ্ট্রভাষা দৌড় রাষ্ট্র পর্যন্ত তা যে যথার্থ নয়, তা যে জন ভাষাকেও আক্রমণ করে, পরবর্তী দিনগুলি তা প্রমাণ করেছে। ক্ষমতা যাদের হাতে থাকে তাদের ভাষার প্রভাব ও কিভাবে অন্যসব ভাষার স্বাভাবিকতাকে গ্রাস করে নিতে চায়, তার নজির আমরা একটু নজর করলেই নিত্য দেখতে পাবো, দেখতে যদি চাই।
অমর একুশে গ্রন্থ মেলার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে কবি কে আহবান করা হয়েছিল। কবি বলেছিলেন কলকাতা শহর থেকে বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকায় এসেছি আপনাদের অতিথি হিসেবে। আজ আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। কৃতজ্ঞতা জানাই সেই একুশের স্মৃতিকে, যার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষার এতদূর বিশ্বজনীন মর্যাদা। গর্ব নিয়ে উচ্চারণ করেছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় এর একটি কথা-‘ওপারে যে বাংলাদেশ/ এপারেও সেই বাংলা।
‘ঢাকা থেকে নববর্ষের চিঠি এসে পৌঁছেছে কবির কাছে। সেই চিঠি কবির মনে প্রাণে এনে দিয়েছে এক অন্যরকম সুখানুভূতি। দেশজুড়ে অনিশ্চয়তা, দুর্যোগের, উৎকণ্ঠার কোন অন্ত নেই অথচ তার মাঝেও কি আনন্দময় ঢল নেমেছিল পথে পথে বর্ষবরণের। উৎসবকে কেন্দ্র করে বাঙালি মনের যে উন্মাদনা, তার ঢেউ এসে পৌঁছেছে, শিহরণ তুলেছে কবি মনে। ঢাকায় পহেলা বৈশাখ উদযাপনের এক নতুন দৃশ্য ধরা পড়েছে। বিপনি বিতানগুলোতে, হাসপাতালে, বড় বড় ব্যানার, সাইন বোর্ডে শুভেচ্ছা ডালি তার সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান আর কবিতা। উৎসবের এ এক স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দময় প্রকাশ। কোন এক পয়লা বৈশাখের সকালে ‘ছায়ানট’যে দীপশলাকা জ্বেলেছিল তার আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে, সমাজের সব স্তরে।
তবুও ভালো লাগে হাসতেই, বাঁচতেই–মনে পড়ে ওর হাসি-ভরা মুখ। বন্ধু আনোয়ার পাশা। আজ আর নেই, তবুও বেঁচে থাকবে কোমল মাটি ও তৃণমূলে আনোয়ারের মতো হাজার হাজার শহীদ। ‘নদী নিঃশেষিত হলে’ আনোয়ারের লেখা কবিতার বই। কবিতাগুলো যেন আজ অন্য অর্থ বহন করছে। মৃত্যু বুঝি এমনই। মৃত্যুর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে কারোর জীবনকে যখন দেখা যায় তখন তার কাজকর্ম, তার উচ্চারণ–অন্য তাৎপর্য ফুটে উঠে। বুক ভরা শ্বাস নিয়ে বলেছিল: ‘এই মাটিতে এখনো আছে বেঁচে থাকার মানে’।
স্মৃতির সরণিতে ভেসে ওঠে নাম না জানা ভবঘুরে, এক গরিব স্কুল মাস্টার মুজিবর রহমান বিশ্বাস। আপন চরিত্রের বিশেষণ হিসেবে ‘ভবঘুরে’ শব্দটি নিজের প্রসঙ্গে ব্যবহার করতেন। নিজের পয়সায় ছোট বড় বই ছাপাতেন। ‘আমার মনোবৃত্তি, আমার চিন্তা, আমার চেতনা সকলই মানব সমাজের মধ্যে প্রসারিত করে দেব’। তাই সে সব বই এখানে-ওখানে বিলিয়ে দিতেন পরম খুশিতে। অল্প দুয়েকজনও যদি বুঝতে পারে তাকে, তবে তার মনে হয় ‘এই হতভাগ্য ব্যর্থ জীবনে তোমাদের আন্তরিকতা যেন মনে হয় সীমাহীন অন্ধকারের মধ্যে এক টুকরো আলোর পরশ’। সকল সন্তানদের জন্য এগিয়ে দিতে চায় তার চির লালিত কথাগুলি, ‘তোমার বয়:কালে এ আঁধার ঘোর যদি অনেকখানি ঘুচে যায়, নূতন ঊষার স্বর্ণদার যদি খুলে যায়, সেদিন তুমি ধীর ভাবে বিচার করে আমায় ক্ষমা কর বাবা’। মুক্ত সুস্থ পবিত্র সমাজ জীবনের বুনিয়াদ যে গড়ে উঠবে সে সম্বন্ধে ছিলেন আশাবাদী। ‘ইতিহাস বিস্মৃত সমাজ নিষ্পিষ্ট হতভাগ্য অভিশপ্ত প্রতিভা গুলির খোঁজ নিয়ে’ বেড়াতে হবে। এই জনতা এই মানুষ এই পথিক সূর্যের রক্তিম কিরণ মাথায় করে এমনি এগিয়ে চলি, সামনে এখনো অনেক পথ। একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে, আদর্শ শিক্ষক হিসেবে নিজের আদর্শকে অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাওয়া। তুমি আমার সন্তান, পিতা হিসেবে তোমাদের কাছে এটা আমার একান্ত স্বাভাবিক কামনা। আগামীতে তোমাদের জন্য এক গৌরমময় ভবিষ্যৎ সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, সেই সুন্দর ভবিষ্যতের রঙিন আভাসটা কিছু কিছু আমারও গায়ে এসে লাগছে। আমি ও একদিন এই সৃষ্টি যজ্ঞের সাথী ছিলুম—তার প্রাক্তন স্কুলের বর্তমান ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলতে চেয়েছিলেন। সৃষ্টি যজ্ঞের এমন কত সাথী কে ভুলে থাকি আমরা। কে আর জানতে চাই তাদের!
স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন নয়। পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ স্পর্শ তারাই পায় যারা দুচোখ ভরে স্বপ্ন দেখতে জানে। চলার পথে দৈনন্দিন জীবনে বেশিরভাগ নেতিবাচকতায় ভরা থাকে। এর মাঝেও সুস্থ সুন্দর স্বপ্নের কথাও খুব সামান্য হলেও থাকে যা মুছে দিতে পারে সকল বিফলতা। জেগে উঠতে পারে মন, বিশ্বাস হতে পারে স্বপ্ন শুধু স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন দেখা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সর্বাঙ্গীন বিকাশের। সিলেবাসের চাপে কুজো হয়ে যাওয়া, প্রতিযোগিতার দৌড়ে দম বন্ধ হয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েরা। সমাধানের পথ খুঁজতে গিয়ে আলোর সন্ধান পেয়েছিলেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। গড়ে তুলেছিলেন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র–যার আলোর ছটা ক্রমে ক্রমে সমগ্র বাংলাদেশকে আলোকিত করেছিল। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীরা বই পড়া, ছবি দেখা, গান শোনা, বই নিয়ে পরস্পর আলোচনা, তর্ক ভাব বিনিময়–সমৃদ্ধ আয়োজনের মধ্য দিয়ে নানা দিকে বেড়ে উঠতে থাকে তাদের মন। সমস্ত পৃথিবীর বিকাশের সাথে কতটুকু যোগ তৈরি হয় এদের? বাইরের খোলা হওয়ার সঙ্গে পরিচয়ের অভাবে আবদ্ধ হয়ে থাকে তাদের মন। এই আবদ্ধতা ভাঙতে হবে। বিশৃঙ্খলা উদ্ভ্রান্ততা অধঃপতন থেকে সরিয়ে এনে মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। ঘটাতে হবে সর্বাঙ্গীন বিকাশ। আর তার জন্য দরকার অনুকূল পরিবেশ। বিরাট সমৃদ্ধ ও আলোকিত জাতি সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন প্রকৃত মানুষ তৈরি করা। এমনই দেশভিত্তিক আন্দোলনের উৎসস্থল বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র।